আত্মহত্যা : এক ‘চিকিৎসাযোগ্য’ নীরব মহামারি
সংবাদভাষ্য
আত্মহত্যা : এক ‘চিকিৎসাযোগ্য’ নীরব মহামারি
জীবন আছে যার, মৃত্যু তার জন্য এক অবশ্যম্ভাবী ঘটনা৷ তবু, ‘জন্মিলে মরিতে হইবে’ এই অমোঘ সত্যিটা জেনেও মৃত্যুকে যতটা সম্ভব দূরে সরিয়ে রাখার জন্য মানুষের চেষ্টার অন্ত নেই৷
মানুষের সভ্যতার অগ্রগতির অন্যতম চালিকাশক্তি এই প্রচেষ্টা৷ বেঁচে থাকতে চায় বলেই মানুষ খাদ্যের ওপর নিজের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চায়, মহামারিকেও ঠেকিয়ে দিয়ে দীর্ঘায়িত করতে চায় নিজের জীবন৷
কিন্তু তারপরও দেখা যাচ্ছে, কোনো কোনো মানুষ এর উল্টোটাও করছে! ফেসবুক লাইভে প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়ে অবসর জীবন কাটাতে থাকা এক প্রবীণের নিজের মাথায় গুলি করে আত্মহত্যা সেই পুরনো প্রশ্নটিকে সামনে নিয়ে এসেছে আবার- মানুষ কেন নিজের জীবনকেও শেষ করে দিতে চায়? এটা কি ঠেকানোর কোনো উপায় নেই?
মোহসীন সাহেবের আত্মহত্যার ধরনটা অভিনব, তবে এটা কিন্তু পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়৷ আত্মহত্যার ঘটনা সারা বিশ্বেই ঘটছে প্রতিদিন, ঘটছে বাংলাদেশেও৷ একটি পরিসংখ্যানে দেখলাম, কোভিড-১৯ অতিমারি চলাকালীন ১০ মাসে বাংলাদেশে প্রায় ১১ হাজার আত্মহত্যার ঘটনা রেকর্ড করা হয়েছে, যেখানে ওই একই সময়ে করোনা ভাইরাসজনিত অসুস্থতায় মারা গেছেন এর অর্ধেকেরও কম মানুষ! অর্থাৎ, আত্মহত্যার এক নীরব মহামারিই যেন চলছে আমাদের অজ্ঞাতসারে৷ তবু কোভিড অতিমারি নিয়ে যে আলোচনা, সেটা ঠেকাতে যত প্রচেষ্টা, তার ছিটেফোঁটাও নেই এই ব্যাপারে!
এর একটা কারণ, আত্মহত্যা বিষয়টি আমাদের সমাজে এক ধরনের ট্যাবু হয়ে আছে৷ এ নিয়ে কেউ কথাই বলতে চায় না৷ ঠিক এই কারণেই ওই পরিসংখ্যানটাও আইসবার্গের চূড়ার মতো একটা দৃশ্যমান ক্ষুদ্র অংশমাত্র হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে; কেননা ওই ট্যাবুর কারণেই আসলে আত্মহত্যার অনেক ঘটনা লুকিয়ে ফেলা হয় স্বাভাবিক মৃত্যু অথবা দুর্ঘটনা হিসেবে দেখিয়ে৷ তবে সেটা বাদ দিয়ে শুধু ওই পরিসংখ্যানটাকে হিসেবে নিলেও বাংলাদেশে আত্মহত্যার প্রবণতা আশঙ্কাজনকভাবে বেশি৷ উনিশ শতকের খ্যাতিমান সমাজবিজ্ঞানী এমিল ড্যুরখেইম আত্মহত্যা বিষয়ক তার যুগান্তকারী গবেষণায় দেখিয়েছিলেন, প্রতি ১০ হাজারে ১ থেকে ৩ জন লোক আত্মহত্যা করে থাকেন৷ কিন্তু ওই পরিসংখ্যানের সঙ্গে বাংলাদেশের জনমিতিক মৃত্যুহারের (১৮ কোটি মানুষের শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ, অর্থাৎ বছরে গড়ে ৯ লাখ মানুষের মৃত্যু) তুলনা করলে দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশে আত্মহত্যার হার প্রায় ড্যুরখেইমের তত্ত্ব¡ অনুসারে স্বাভাবিক হারের প্রায় চারগুণ!
ড্যুরখেইমের সেই তত্ত্ব¡ আত্মহত্যাকে একটি সামাজিক ঘটনা হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে৷ অর্থাৎ, যে কোনো একটা সমাজের কিছু মানুষ আত্মহত্যা করবেই, এবং এটি শুধুমাত্র কোনো ব্যক্তিবিশেষের প্রবণতা নয়, এর কারণ নিহিত থাকে সমাজের মধ্যেই৷ আত্মহত্যার চারটি ধরন চিহ্নিত করেছিলেন তিনি- আত্মকেন্দ্রিক, পরার্থমূলক, নৈরাজ্যমূলক এবং নিয়তিবাদী৷ এর মধ্যে আত্মকেন্দ্রিক আত্মহত্যার ঘটনাই সবচেয়ে বেশি ঘটে, যে ঘটনার সূত্র ধরে এখন আত্মহত্যা নিয়ে এত আলোচনা হচ্ছে সেটিও এই রকমই৷ এ ক্ষেত্রে পারিপার্শ্বিক সমাজের সঙ্গে ব্যক্তির বন্ধন দুর্বল হয়ে পড়ে, বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন বা কখনো কখনো প্রেমাস্পদের সঙ্গে অলঙ্ঘনীয় দূরত্ব তৈরি হয়েছে, এমন ধারণা গড়ে উঠলে মানুষ আর বেঁচে থাকার কোনো অর্থ খুঁজে পায় না৷
পরার্থমূলক আত্মহত্যাকারীরা আসলে এক ধরনের বিপ্লবী, তারা সমাজকে নিজেদের কাঙ্ক্ষিতরূপে বদলে নেয়ার উদ্দেশ্যে আত্মবলিদান করেন৷ হোলি আর্টিজান, কিংবা নাইন-ইলেভেনের বিমান হামলাকারীরা এই দলে পড়েন৷
এছাড়া অনেক সময় সামাজিক নৈরাজ্য বা বিপর্যয়ে বিতৃষ্ণ হয়ে কিংবা প্রতিবাদ হিসেবেও মানুষ আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়, যেমন যৌতুকের কারণে বিয়ে না হওয়ায় আত্মহত্যা করেন কেউ কেউ৷
আর অদৃষ্টবাদী আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে, যখন কোনো প্রবল চাপের মুখে পড়ে জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণ হয়ে পড়েন কোনো মানুষ৷ উনিশ শতকের প্রেক্ষাপটে ড্যুরখেইম উদাহরণ হিসেবে দেখিয়েছিলেন, কোনো দাসকে তাঁর মালিক নিয়ম-কানুনে বেশি আবদ্ধ রাখলে বা অত্যাচার করলে সে যদি আত্মহত্যা করে, তবে সেটা নিয়তিবাদী৷ বাংলাদেশে, বিশেষ করে তরুণ সমাজের মধ্যে এই ধরনের আত্মহত্যার প্রবণতা প্রবল৷ লেখাপড়ার প্রবল চাপ, এবং তারপর অনিশ্চিত ভবিষ্যতের চাপ নিতে না পেরে অনেকেই আত্মহননের পথ বেছে নেন৷ বছর কয়েক আগে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তাইফুর প্রতীকের মৃত্যুর ঘটনাটিকে এর উদাহরণ হিসেবে দেখা যেতে পারে৷
বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশের সমাজে আত্মকেন্দ্রিক এবং নিয়তিবাদী আত্মহননের ঘটনা বৃদ্ধি কিন্তু অস্বাভাবিক কিছু নয়৷ একটা সামন্তবাদী সমাজ যখন হঠাৎ করে ফাস্ট-ফরোয়ার্ড হয়ে ধনতান্ত্রিক সমাজে ঢুকে পড়ছে, তখন তার কিছু প্রতিক্রিয়া তো হবেই! আমাদের গ্রামকেন্দ্রিক জীবন ব্যবস্থা হঠাৎ করে নগরকেন্দ্রিক হয়ে উঠছে, রিকশাচালক বা গার্মেন্টসকর্মীদের মতো অনেক মানুষ বাধ্য হয়ে নগরে অভিবাসন করছে; কেবল ঘরণীর দায়িত্ব ছেড়ে নারীরা সক্রিয় হচ্ছে বহির্মুখী কর্মক্ষেত্রে৷ যৌথ পরিবার ভেঙে গড়ে উঠছে একক পরিবার, কিন্তু সেই ছোট ছোট পরিবারও আবার সংকটের মুখে পড়ছে তাদের সন্তান, তাদের বৃদ্ধ পিতা-মাতার দেখাশোনা করতে গিয়ে৷ সাফল্য আর অর্থের পেছনে ছুটতে গিয়ে ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে পারিবারিক-সামাজিক বন্ধনগুলো৷ বাচ্চারা পাচ্ছে না স্বাভাবিক সাংস্কৃতিক পরিবেশ, খেলাঘর বা কচি-কাঁচার আসরের মতো সংগঠনগুলো হারিয়ে যাচ্ছে, হারিয়ে যাচ্ছে বন্ধুদের নিয়ে আড্ডার সংস্কৃতি৷ বাচ্চারা ছুটছে জিপিএ-ফাইভের পেছনে, আরেকটু বড়দের কাছে সোনার হরিণ হয়ে উঠছে বিসিএস৷
উন্নয়নমুখী বিকাশের পথে ছুটতে থাকা একটা সমাজের জন্য এ সব ঘটনাও অবশ্যম্ভাবী৷ এর প্রতিক্রিয়ায় কী কী ঘটতে পারে, সমাজবিজ্ঞানীরা তার আভাস তো দিয়েই রেখেছেন৷ তাই সেগুলো ঠেকানোর ব্যবস্থা গ্রহণ করাটাই সমাধান৷ যৌথ পরিবার আর ফিরিয়ে আনার সুযোগ নেই, বাস্তবতাকে মেনে একক পরিবারেই সমাধান খুঁজতে হবে৷ সমাজের, রাষ্ট্রের দায়টা এখানেই- একক পরিবারের শিশু সন্তানের দেখাশোনার জন্য নারীর কর্মস্থলের যথাসম্ভব নিকটবর্তীস্থানে গড়ে তুলতে হবে শিশু দিবাযত্নকেন্দ্র, প্রবীণদের জন্য তাদের সমবয়সিদের সঙ্গে থাকার জন্য মানসম্পন্ন প্রবীণ-নিবাস৷ কিন্তু কেমন করে যেন এই দুটি বিষয়, বিশেষ করে প্রবীণ-নিবাসকে ঘিরে আমাদের সমাজে, আমাদের মিডিয়ায় এক ধরনের প্রবল নেতিবাচক আবহ তৈরি করা হয়েছে৷ ফলে সন্তানরাও বাবা-মা-কে সেখানে রাখতে স্বচ্ছন্দ্য বোধ করেন না, প্রবীণরাও সেটা পছন্দ করেন না৷ এই নেতিবাচকতা দূর করতে রাষ্ট্রকেই উদ্যোগ নিতে হবে; এক সময় তো জন্ম নিয়ন্ত্রণকে ঘিরেও এই ধরনের নেতিবাচকতা ছিল এদেশে, রাষ্ট্রীয় প্রচারণার মধ্য দিয়ে এখন যেটা অনেকটাই গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছে৷
প্রবীণদের পাশাপাশি তরুণদের আত্মহনন প্রবণতার দিকেও নজর দেয়া জরুরি৷ সেজন্য সবচেয়ে জরুরি শিক্ষা ব্যবস্থাসংক্রান্ত ধারণার পরিবর্তন৷ জিপিএ-ফাইভের পেছনে ছোটার চেয়েও যে সমাজের প্রতি দায়িত্ববান মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠাটা জরুরি, সেটা বুঝতে এবং বোঝাতে হবে তাদের৷ উন্নত অনেক দেশে এ জন্য বছরের একটা নির্দিষ্ট সময় শিক্ষার্থীদের ছুটি থাকে, যে সময়ে সামাজিক-সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে স্বেচ্ছাসেবামূলক কাজ করতে তাদের উৎসাহিত করা হয়, অ্যাকাডেমিক ক্ষেত্রেও যার একটা স্বীকৃতি ও সুবিধা পাওয়া যায়৷ তাছাড়া, শিক্ষাকে কর্মমুখী করাটাও খুব জরুরি, যেন অ্যাকাডেমিক পড়াশোনা শেষে চাকরি না পাওয়ার হতাশাটা গড়ে না ওঠে৷
সন্দেহ নেই, এসব দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা৷ কিন্তু শুরুটা তো করতে হবে৷
আরো একটা উদ্যোগ শুরু করতে হবে এক্ষুণি৷ সেটি হলো, মানসিক স্বাস্থ্যসেবা সুবিধার সম্প্রসারণ৷ আত্মহত্যার সকল ঘটনা সম্পর্কেই আগে থেকে আঁচ পাওয়া হয়ত সম্ভব নয়, কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই সেটা আগে থেকে বোঝা যায়৷ সম্ভাব্য ‘ভিকটিম’ যদি কোনো কারণে জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণ হয়ে পড়েন, তাহলে তিনি এমন কিছু আচরণ করেন, যা থেকে ব্যাপারটি সম্পর্কে আভাস পাওয়া যায়৷ এমন ক্ষেত্রে অনেক সময়ই তিনি নিজেকে গুটিয়ে নেন খোলসের ভেতরে, অন্যদের সঙ্গে কথাবার্তা বন্ধ করে দেন, কখনো বা নিজের অত্যন্ত শখের জিনিস অবলীলায় নষ্ট করে ফেলেন বা অন্যদের দিয়ে দেন৷ এ রকম পরিস্থিতিতে মনোবিদের শরণাপন্ন হলে তাকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা সম্ভব৷ কিন্তু আমাদের দেশে মানসিক চিকিৎসা নিয়েও এক ধরনের ট্যাবু আছে৷ ঔপনিবেশিক আমলে মনোচিকিৎসার কেন্দ্রগুলো প্রথম গড়ে ওঠে, তখন সেগুলোকে জেলখানার আদলে গড়া হতো, যার নাম ছিল পাগলা-গারদ৷ সেই থেকে মানসিক চিকিৎসার অর্থ হয়ে উঠেছে পাগলের চিকিৎসা৷ এই ট্যাবু তো আছেই, আসলে মানসিক চিকিৎসার সুবিধাও এ দেশে খুব একটা নেই৷ মনোচিকিৎসক বা সাইকিয়াট্রিস্ট এবং মনোবিদ বা সাইকোলজিস্ট, বিশেষ করে ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট, অর্থাৎ যারা কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে মানসিক স্বাস্থসেবা দেন, তাদের সাহায্য নেবার সুযোগ জেলা-উপজেলা পর্যায়ে তো নেই-ই, রাজধানীর বাইরের বড় শহরগুলোতেও আসলে খুবই সীমিত৷ চলতি বছর আমাদের স্বাস্থ্য বাজেটের শতকরা মাত্র শূন্য দশমিক পাঁচ ভাগ, মানে টাকার অঙ্কে মাত্র ১৬২ কোটি টাকা এই ক্ষেত্রে, যেখানে কোভিড অতিমারির সময়ে শুধু আত্মহত্যা প্রতিরোধেই ব্রিটিশ সরকার বরাদ্দ দিয়েছে ১ বিলিয়ন পাউন্ড, মানে প্রায় এগারো হাজার কোটি টাকা!
অন্তত এই কাজটা সরকার চাইলেই শুরু করতে পারে এক্ষুনি, মানসিক স্বাস্থ সুবিধা সম্প্রসারণের উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারে৷ আর সমাজের সকলেই যদি নিজের মতো করে সচেতন হয়ে ওঠে, আভাস পেলেই মনোবিদের শরণাপন্ন হওয়ার অভ্যাস গড়ে ওঠে, তাহলেই আত্মহননের প্রবণতা অনেকখানি কমিয়ে আনা সম্ভব হবে৷