কবিতার চলমান সংকট ও একজন নি:সঙ্গ সত্যব্রতী কবি
সুদীপ্ত শাহিন: কবি ও কবিতার কি ধরা-বাঁধা নিয়ম আছে ? বোদ্ধারা বলেন- যা সুর, তাল-লয়, ছন্দ-মাত্রা নিয়ে চলে তাই কাব্য। তবে প্রকৃতির কোন সৃষ্টিটা তাল-লয় নিয়ে চলে না? সেজন্য প্রকৃতিই তো সকল কাব্যের আধার । অকৃপণ প্রকৃতি থেকে প্লট নিতে কারো বাধা নেই। অথবা প্রকৃতির অপার সৃষ্টি নিয়ে রচিত হয়েছে যে সমাজ সেটা নিয়েও মানুষের ভাবনার শেষ নেই। তাই জগতে আছে অজস্র কবি ও কবিতা। তবুও মানুষ এসব কবি ও কবিতার বাইরে একজন কবির অপেক্ষা করে, অপেক্ষা করে একটি কবিতার। কোথায় থেকে আসে সেই কবিতা ? তা নিয়ে কবিদেরও যেনো ভাবনার শেষ নেই। যেমন কবি শামসুর রাহমান বৃক্ষের নিকটে গিয়ে একটি কবিতার আরাধনা করেছিলেন- ‘দয়াবান বৃক্ষ তুমি একটি কবিতা দিতে পারো ? বৃক্ষ বলে আমার বাকল ফুঁড়ে আমার মজ্জায় যদি মিশে যেতে পারো, তবে হয়তো বা পেয়ে যাবে একটি কবিতা।’ এভাবে কবি সুভাস মুখোপাধ্যায়ও একটি কবিতা লেখার ঘোষণা দিয়েছিলেন- ‘একটি কবিতা লেখা হবে। তার জন্যে দেয়ালে দেয়ালে এঁটে দেয় কারা, অনাগত এক দিনের ফতোয়া। মৃত্যুভয়কে ফাঁসিতে লটকে দিয়ে মিছিলে এগোয়।’ অর্থাৎ মনে যা চাইলো তা লিখলেই সেই কবিতা জন সমাদৃত হয় না। কারণ কবিতার জন্যও চাষাবাদ করতে হয়। একজন চাষী যেমন বিনা চাষে ফসল তুলতে পারে না, একজন কবিও সমাজ ও প্রকৃতিতে না মিশে কবিতা গড়ে তুলতে পারে না। আজ সেই কবি চাষীদের প্রচন্ড অভাব। তাই কবিতারও চলছে দৃর্দিন। সময় যখন অবরুদ্ধ কবিরা তখন এই রুদ্ধতা ভেদ করে একেকটি কবিতার জন্ম দেয় সূর্য্যতেজে। মানুষ তখন সূর্যদীপ্ত হয়ে পথ খোঁজে নেয় নতুন পথের । পৃথিবীর আজ অবরুদ্ধ সময়ে অনুপস্থিত সেই কবি ও কবিতা।
কবি শঙ্খঘোষ ছিলেন একজন সময়ের সত্যব্রতী, কবিতার চাষী। শঙ্খঘোষ দেখিয়ে গেছেন কখন বারুদের মত জ্বলে উঠতে হয়। এটম বোমার মত বিস্ফোরণ ঘটাতে হয় একেকটি কবিতা দিয়ে । যদিও বিশ্লেষকদের মতে তিনি ধরা-বাঁধার কবি ছিলেন না। ছিলো না তাঁর কোন নির্দিষ্ট পথ ও মত । কোনো ব্যানারে তিনি হাঁটেন নি রাজপথের মিছিলে। বরং মিথ্যুক প্রবঞ্চক নেতা-নেত্রীদের শর্তে তিনি রাজপথের মিছিলে যাবেন না- বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন। তাই বলে কি তিনি কোন পথ ও মতের বাইরে ছিলেন? শ্রেণী বিভক্তির সমাজে কোন কবি-সাহিত্যিকও কি নিরপেক্ষ থাকতে পারেন? না, কবি শঙ্খ ঘোষও নিরপেক্ষ থাকেন নি। রাজপথে তিনি হেঁটেছেন, তবে নিজের শর্তেই । কি ছিলো কবি শঙ্খঘোষের নিজস্ব শর্ত বা সত্তা? তাঁর চিন্তা কি সমাজ-দর্শন থেকে বিচ্ছিন্ন কিছু ? তিনি বলেছেন- কি নিয়ে লেখা হবে কবিতা ? বাইরের জগত নাকি ব্যক্তিগত জীবনকে নিয়ে? তাঁর ভাষায় বাইরের জগত আর ব্যক্তিগত জীবন -এই দুয়ের নিরন্তর যাতায়াতের মধ্যেই তো মানুষ বেঁচে আছে। আর এই নিয়েই রচিত হয় তৃতীয় সত্ত্বা। কবি সেই সত্ত্বা লালন করেছেন। তাই দেখা যায়, কবির কবিতা তাঁর ব্যক্তিগত জীবনে সীমাবদ্ধ নয়, বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে তার আছে এক ঘনিষ্ট বন্ধন। তাঁর ব্যক্তিগত বোধের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে রয়েছে দেশকালের অ:নিশেষ জীবন যন্ত্রণা। আসলে তাঁর কবিতা ছিলো ব্যক্তিগত জীবনের সাথে বাইরের জীবনের এক নিরন্তর সংঘর্ষ জাত ফসল। কবি একে তাঁর বিভিন্ন প্রবন্ধে তৃতীয় সত্ত্বা বলে অভিহিত করেছেন। যার দার্শনিক নাম দ্বান্দ্বিকতা অর্থাৎ থিসিস, এন্টি থিসিসের ফলে জন্ম নেয়া সিনথেসিস। দ্বান্দ্বিকতার এই নিয়মে অন্তর্জগত আর বহির্জগতের নিরন্তর সংঘর্ষ বলে তার কবিতায় উঠে আসে সমাজ,সময়ের সত্যনিষ্ঠ ছবি। আর সেই ছবিকে ভালোবাসার পাশাপাশি জীবনকে ভালোবাসার তীব্র আবেগ ও প্রেরণা।
ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের এক উত্তাল সময়ে কবি শঙ্খ ঘোষ তদানীন্তন ভারতবর্ষের অধুনা বাংলাদেশের চাঁদপুর জেলায় নিজ মাতুলালয়ে ৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৩২ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর আসল নাম চিত্তপ্রিয় ঘোষ। বংশানুক্রমিকভাবে পৈত্রিক বাড়ি বাংলাদেশের বরিশাল জেলার বানারিপাড়া গ্রামে। শঙ্খ ঘোষ বড় হয়েছেন পাবনায়। তাঁর পিতা মনীন্দ্রকুমার ঘোষ এবং মাতা অমলা ঘোষ। পিতার কর্মস্থল হওয়ায় তিনি বেশ কয়েক বছর পাবনায় অবস্থান করেন এবং সেখানকার চন্দ্রপ্রভা বিদ্যাপীঠ থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন। ১৯৫১ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে বাংলায় কলা বিভাগে স্নাতক এবং পরবর্তীতে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৫১ সালেই তিনি লিখেন তাঁর বিখ্যাত কবিতা ‘যমুনা বতী’ । দেশমাতৃকার মুক্তি আর ডাল-ভাতের নিশ্চয়তার স্বপ্ন নিয়ে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে লড়াই করে অকাতরে প্রাণ বিলিয়ে দিয়েছিলো ভারতবর্ষের যে অসংখ্য মানুষ, ব্রিটিশ চলে যাওয়ার পর সেই দেশটা কেমন হলো? সত্যি কি ব্রিটিশ মুক্ত হয়েছিলো, নাকি আড়ালে থেকে সেই ব্রিটিশই তার সৃষ্ট তাবেদার দিয়ে পরিচালিত করছিলো ভারতবর্ষের রাষ্ট্র, রাজনীতি, অর্থনীত ও সাহিত্য দর্শনকে ? এ প্রশ্ন থেকে যায় কবি শঙ্খ ঘোষের মনে । খুব অল্প সময়েই কবি তার প্রশ্নের জ্বলন্ত উত্তর পেয়ে যান। শুধু বেঁচে থাকার খাবারের জন্য মানুষকে দেশব্যাপী ভুখা মিছিল করতে হয়েছিলো। ১৯৫১ সালে কুচবিহারের রাস্তায় এইরকম এক ভুখা মিছিলে ব্রিটিশ তাঁবেদার রাষ্ট্রের পুলিশ গুলি করে এক কিশোরীকে হত্যা করে। কবি আর বসে থাকতে পারলেন না। তিনি গর্জে উঠলেন। যমুনাবতী কবিতায় তিনি লিখলেন- ‘নিভন্ত এই চুল্লিতে মা, একটু আগুন দে, আরেকটু কাল বেঁচেই থাকি,বাঁচার আনন্দে ! নোটন নোটন পায়রাগুলি খাঁচাতে বন্দী- দুয়েক মুঠো ভাত পেলে তা ওড়াতে মন দিই ! হায় তোকে ভাত দেবো কী করে যে ভাত দেবো হায়!’ সেদিনকার এই তরুণ কবিই আবার পরিণত বয়সে যমুনাবতীর চল্লিশ বছর পর লিখলেন আরেক অমোঘ কবিতা- ‘ন্যায় অন্যায় জানিনে’ । এই কবিতায় লিখলেন – ‘তিন রাউন্ড গুলি খেয়ে তেইশ জন মরে যায়, লোকে এত বজ্জাত হয়েছে !. . . পুলিশ কখনও কোনও অন্যায় করে না তারা যতক্ষণ আমার পুলিশ।’ শ্রেণী বিভক্ত ও পুরুষতান্ত্রিক সমাজের এক আবশ্যকীয় অনুসঙ্গ নারী নির্যাতন। নারী ধর্ষিতা হয় ব্রিজের আড়ালে, প্রকাশ্য রাজপথে, ভাড়ার গাড়িতে। কবি এসব অসহ্য ছবি চিত্রায়িত করলেন তাঁর কবিতায়- ‘ভয়াবহ শব্দধূমে ভরে গেছে পৌষের বাতাস, আর সেই অবসরে কোনও কোনও পিশাচ স্বাধীন রাজপথ থেকে নারী তুলে নিয়ে চলে যায় ট্রাকে।’ তেমনি ‘কালযমুনা’ কবিতায় তিনি সেই অসহায় মেয়েটির কথা বলেছেন- যে কেবল একটা ভোগ্য বস্তু, বিক্রয়যোগ্য। যার শরীরের বিনিময়ে কেনা হবে পরিবারের সুখ -‘বেচিস না মা বেচিস না আমায়- ওরাও ছিঁড়ে খাবে, না হয় তুই আমাকে খা।”
কবি শঙ্খঘোষ কোন রাজনৈতিক দলের বা মতের ব্যানারধারী ছিলেন না ঠিক। কিন্তু রাজনীতিক ভাবনা থেকে দূরেও ছিলেন না। মূলত স্বৈরতন্ত্রের আড়ালে শাসকগোষ্ঠী যে গণতন্ত্রের ধ্বজাধারী বলে দাবি করে সেই গণতন্ত্রের আসল রুপ তিনি তুলে ধরেছেন তাঁর কবিতায়- ‘মত কাকে বলে, শোনো । মত তা-ই যা আমার মত, সেও যদি সায় দেয় সেই মতে তবে সে মহৎ।’ গুজরাট দাঙ্গার পর লিখলেন- ‘নারায়ণ নয়, আমি পেয়ে গেছি নারায়ণী সেনা। যতদূর যেতে বলি যায় এরা, কখনো আসেনা কোন কূটতর্ক নিয়ে, ভাবলেশহীন ধ্বংস হাতে ছুটে যায়। যদি বলি দিন বলে দেয় দিন; যদি বলি রাত, বলে রাত।’ ভারতের প্রতিক্রিয়াশীল সাম্প্রদায়িক নেতাদের সব ছলচাতুরী এক মুহূর্তে কবি প্রকাশ করে দিলেন। নারায়ণী সেনা কারা? এটা রূপক। এরা এক বিশেষ রাজনৈতিক দলের অন্ধ কর্মী। যাদের না আছে বিবেক, না মনুষ্যত্ব। ধ্বংসের জন্য, এমনকি এদের কোনো অজুহাতও লাগে না। এখানে নারায়ণী সেনা শব্দের এক অপূর্ব প্রয়োগ! নারায়ণের নিজস্ব সেনাই নারায়ণী সেনা আর নারায়ণ শব্দটা নির্দেশ করে ধর্মের ধ্বজাধারী এক কূট শক্তিকে, যে নিজে বসে থাকে রাজাসনে আর তার তল্পিবাহকরা মেতে ওঠে ধ্বংসলীলায়। এমনি ভাবে নন্দীগ্রাম গণহত্যার পরেই লিখলেন এমন এক কবিতা, যা আগুন জ্বেলে দিল মননে। কবিতার নাম ‘সবিনয় নিবেদন’ । স্বৈরতান্ত্রিক পুলিশি রাষ্ট্রের চরিত্র উন্মোচন করে কবিতায় লিখেন- ‘গুলির জন্য সমস্ত রাত, সমস্ত দিন খোলা; বজ্র কঠিন রাজ্যে এটাই শান্তি শৃঙ্খলা। যে মরে মরুক, অথবা জীবন কেটে যাক শোক করে। আমি আজ জয়ী, সবার জীবন, দিয়েছি নরক করে।’ দেশে দেশে স্বৈরতন্ত্রের মুখোশ উন্মোচন করে তিনি লিখলেন ‘মার্চিং সং’ নামক কবিতাটি। “নেই কোনো সন্ত্রাস, ত্রাস যদি কেউ বলিস তাদের ঘটবে সর্বনাশ – ঘাস বিচালি ঘাস,ঘাস বিচালি ঘাস !’ চারদিকে অরাজকতা, সন্ত্রাস, অত্যাচার চলছে আর রাজনীতিকরা বসে আছেন ঠান্ডা ঘরে। তাঁদের গায়ে নেই ঘামের এতটুকু দাগ। সব ঠিক আছে, রামরাজ্য প্রতিষ্ঠা হয়েছে। যারা প্রতিবাদ করবেন তাঁদের জন্য উপহার – ‘সর্বনাশ’ ! গৃহপালিত চতুষ্পদের মত চুপ থাকো, ভালো থাকো : এটাই কথিত গণতন্ত্রের দান। এইরকমভাবেই তিনি তাঁর বিখ্যাত “বাবরের প্রার্থনা” নামক কাব্যগ্রন্থের “বিকল্প” কবিতায় লিখেছেন-‘নিশান বদল হলো হঠাৎ সকালে- ধ্বনি শুধু থেকে গেল, থেকে গেল বাণী, আমি যা ছিলাম তাই থেকে গেছি, আজও একই মত থেকে যায় গ্রাম রাজধানী।” সত্যিই এখনো কিছুই পাল্টায় নি। আলো আছে যার, তারই আছে। যে তিমিরে ছিলো, সে আরও অন্ধকারেই ডুবে গেছে। অথচ রাজা আসে, রাজা যায় ; জনগণ কেবল জাবর কেটেই দিনগত পাপ ক্ষয় করে। প্রতিবাদের অসংখ্য কবিতা ও অসংখ্য লাইন দিয়ে কবি প্রচলিত সমাজের এই স্বরুপ তুলে ধরেছেন। পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বব্যবস্থার কলা-কৌশল মূহুর্তে মূহুর্তে পাল্টালেও অত্যাচার, শোষণ যেনো আপেক্ষিকভাবে ধ্রুবক মনে হচ্ছে। রাষ্ট্রের শাসকগোষ্ঠীর শ্রেণী চরিত্র একই থাকছে শুধু জামার বদল হচ্ছে। এতে কবি শঙ্খঘোষ কখনো কখনো অস্থিরতায় ও দোলাচলে ভুগেছেন । কিন্তু নিরলস সাহিত্য রচনায় তিনি তার আমূল পরিবর্তন চেয়েছেন। শ্রেণী বিভক্ত সমাজে শ্রেণী সংগ্রাম যেহেতু চলমান, সেহেতু কবির দঢ় বিশ^াস সমাজের গুণগত পরিবর্তন হবেই। এই পরিবর্তনের জন্যে শোষিতের লড়াইয়ের বিকল্প নাই। এই লড়াইয়ে একজন কবি ও সাহিত্যিকের অংশগ্রহণও গুরুত্বপূর্ণ। তাই শান্ত ও আদ্যন্ত ভদ্রলোক কবি শঙ্খঘোষের কলমে ভরা ছিলো প্রতিবাদের বারুদ। যিনি তাঁর লেখনীকে ব্যবহার করেছেন ন্যয়ের পক্ষে এক অনিবার্যতায় । সেই এক এবং অনন্য কবি শঙ্খ ঘোষ। আমরা যাকে পাই প্রেমে ও অপ্রেমে। বিক্ষুব্ধ শাণিত তলোয়ারে। হালের আমলে পথে ঘাটে অনেক কবি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকলেও আজ বড্ড প্রয়োজন সময়ের প্রতিটি ঘটনায় জ্বলে উঠার মতো কবি শঙ্খঘোষের ন্যায় সময়ের সত্যব্রতীর।
Hi! I’ve been reading your web site for a while now and finally got the bravery to go ahead and give you a shout out from Kingwood Texas! Just wanted to say keep up the great job!
Everything is very open and very clear explanation of issues. was truly information. Your website is very useful. Thanks for sharing.