কমরেড আবদুল হক’র ২৮তম মৃত্যুবার্ষিকী আগামিকাল এনডিএফ ময়মনসিংহ কর্তৃক মুসলিম ইনস্টিটিউটে স্মরণসভা আয়োজন
আগামিকাল ২২ ডিসেম্বর কমরেড আবদুল হকের ২৮তম মৃত্যুবার্ষিকী। এ উপলক্ষে জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট ময়মনসিংহ জেলার উদ্যোগে মুসলিম ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে বিকাল ৪ টায় স্মরণসভার আয়োজন করা হয়েছে। স্মরণসভায় সংগঠনের সকল নেতা-কর্মিসহ প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নেতা-কর্মিদের উপস্থিত থাকার জন্য এনডিএফ জেলা সভাপতি মাহতাব হোসেন আরজু ও সাধারণ সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন এক বিবৃতিতে আহবান জানান। বিবৃতিতে নেতৃদ্বয় উল্লেখ করেন, দেশে আসন্ন জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে একদিকে যেমন ক্ষমতাসীন ও ক্ষমতা প্রত্যাশী প্রতিক্রিয়াশীল রাজনৈতিক দলগুলো দ্বন্দ্ব সংঘাতে লিপ্ত রয়েছে, তেমনি তাদের মদতদাতা ও প্রভু মার্কিনের নেতৃত্বে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদ ও তার প্রতিপক্ষ সাম্রাজ্যবাদী শক্তি চীন-রাশিয়ার মধ্যকার আন্ত:সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধে বাংলাদেশকে সম্পৃক্ত করার তৎপরতা চালাচ্ছে। স্বৈরতন্ত্রের পালাবদলের প্রহসনের নির্বাচনে এদেশের জনগণের মুক্তি নাই। এর বদলে প্রয়োজন হচ্ছে শ্রমিক-কৃষক-জনগণের রাষ্ট্র, সরকার ও সংবিধান প্রতিষ্ঠা করা। জনগণের মুক্তির এই সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যটি নির্ধারণ করা ও সে লক্ষ্যে অগ্রসর হওয়ার জন্যে সুনির্দিষ্ট রণনীতি ও রণকৌশল নির্ধারণে যিনি অণুস্মরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তিনি কমরেড আবদুল হক। দেশ-জাতি ও জনগণের কাছে শোষণমুক্তির দিক নির্দেশনা এবং সাম্রাজ্যবাদ-সামন্তবাদ ও মুৎসুদ্দী পুঁজিবিরোধী আপোসহীন নেতৃত্বের এক অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের প্রবাদপুরুষ হিসেবে কমরেড আবদুল হকের মৃত্যুবার্ষিকীর বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে। আজকের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে কমরেড আবদুল হকের রাজনৈতিক দর্শন ও জীবন সংগ্রাম শ্রমিক-কৃষক-জনগণকে পথ দেখাবে।
নেতৃদ্বয় বিবৃতিতে আরো উল্লেখ করেন, ১৯২০ সালের ২৩ ডিসেম্বর যশোর জেলার সদর থানার খড়কী গ্রামের প্রতাপশালী সামন্ত জোতদার পরিবার ও পীরবংশে জন্মগ্রহণ করেন কমরেড আবদুল হক। ১৯৩৬ সালে যশোর জিলা স্কুল থেকে কৃতিত্বের সাথে তিনি এন্ট্রাস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৩৮ সালে তিনি কলকাতা প্রেসিডেন্সী কলেজে ভর্তি হন। অত্যন্ত মেধাবী এই ছাত্র ১৯৪১ সালে অর্থনীতিতে (সম্মান) পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করেন এবং স্বর্ণপদকে ভূষিত হন। পার্টির সার্বক্ষণিক কাজের জন্য তিনি শিক্ষাজীবন শেষ করতে পারেননি। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় হতে এম. এ চুড়ান্ত পর্বের পরীক্ষার আগেই তিনি পার্টির দায়িত্ব নিয়ে কৃষক আন্দোলন গড়ে তোলার লক্ষ্যে বনগাঁ কৃষক সম্মেলনে মূল সংগঠকের ভূমিকা পালন করেন। পারিবারিক ও সামাজিক প্রতিকূলতা অতিক্রম করে আবদুল হক ছাত্রজীবন থেকেই অবিভক্ত ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সংস্পর্শে আসেন এবং শ্রমিক শ্রেণীর আদর্শ মার্কসবাদ-লেনিনবাদ গ্রহণ করে বিপ্লবী কর্মকান্ডে আত্মনিয়োগ করেন। ১৯৪১ সালে তিনি ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির প্রার্থী সভ্যপদ লাভ করেন এবং জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত একজন কমিউনিস্ট হিসেবে শ্রমিক শ্রেণীর মহান আদর্শ ও রাজনীতিকে অগ্রসর করার ক্ষেত্রে আপোষহীন ও বলিষ্ঠ নেতৃত্ব দেন। শিক্ষাজীবনে ছাত্র রাজনীতির দায়িত্বশীল নেতৃত্বের ভূমিকা নিয়ে ১৯৪৪ থেকে ৪৭ সাল পর্যন্ত তিনি সর্বভারতীয় ছাত্র ফেডারেশনের বঙ্গীয় প্রাদেশিক কমিটির সভাপতি ছিলেন। পার্টির সিদ্ধান্তে কৃষক আন্দোলন গড়ে তোলার দায়িত্ব পেয়ে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির বঙ্গীয় প্রাদেশিক কমিটির নেতৃত্বে পরিচালিত যশোর জেলা কমিটির সভ্য হিসেবে সংগঠন সংগ্রাম গড়ে তুলতে ভূমিকা পালন করেন। ১৯৪১ সালে বনগাঁতে যশোর জেলা তৃতীয় কৃষক সম্মেলনে হাজী দানেশের সভাপতিত্বে তিনি মূল সংগঠকের দায়িত্ব পালন করেন।
এই সম্মেলনে “লাঙ্গল যার জমি তার” এবং ঐতিহাসিক তেভাগা আন্দোলনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ছাত্রজীবনে ১৯৩৯ সালে ইংরেজ শাসকদের অপকীর্তির নমুনা হলওয়েল মনুমেন্ট ভাঙ্গার স্মরণীয় ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বসহ ১৯৪৩ সালের মহামন্বন্তরে কৃষকদের পাশে দাঁড়ানো, ১৯৪৪ সালে হাটতোলা বিরোধী আন্দোলন, ১৯৪৬ সালে তে-ভাগা আন্দোলন ইত্যাদিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এর প্রেক্ষাপটে তিনি কমিউনিস্ট পার্টির যশোর জেলা কমিটির সম্পাদকের দায়িত্ব পান। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পরের বছর ১৯৪৮ সালের ৬ মার্চ কলকাতার ওয়েলিংটন স্কয়ারে অনুষ্ঠিত ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেসের সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি গঠিত হয়। তিনি নেতৃত্ব দিয়ে এ পার্টিকে অগ্রসর করার সূচনালগ্নে গ্রেফতার হন। এ সময় ১৯৫০ সালে রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে খাপড়া ওয়ার্ডের গুলিতে তিনি মারাত্মকভাবে আহত হন। কারাগারে অন্তরীণ থাকা অবস্থায় ঔপনিবেশিক কারাকানুনের বিরুদ্ধে আন্দোলন গঠন করেন যা ১৯৫০ সালের রাজশাহী জেলের ‘খাপড়া ওয়ার্ড আন্দোলন’ নামে ইতিহাসখ্যাত হয়েছে। দীর্ঘ সময় কারা ভোগ করার পর ১৯৫৬ সালে পাকিস্তান সরকার রাজবন্দীদের মুক্তি দিলে কমিউনিস্ট নেতৃবৃন্দ ও কর্মীরা মুক্তি পায়। ১৯৫৭-৫৮ সালে ছাত্র-কৃষক-শ্রমিকদের গণসংগঠন গড়ে তোলার পদক্ষেপ নেয়া হলে তিনি ১৯৫৮ সালে তিনি পূর্ব পাকিস্তান কৃষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ষাটের দশকে কমরেড আবদুল হক বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলনে সোভিয়েত রাশিয়ার ক্রুশ্চেভের সংশোধনবাদীর নীতির বিরোধিতা করেন। সোভিয়েত রাশিয়ার মহান নেতা জোসেফ স্তালিনের মৃত্যুর পর ক্রুশ্চেভ সংশোধণবাদীরা সোভিয়েতের ক্ষমতা দখল করে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েতকে সামাজিক সাম্রাজ্যবাদী দেশে পরিণত করে। এর ফলে বিশ্বকে সাম্রাজ্যবাদীরা ভাগবাটোয়ারা করে নিতে একদিকে থাকে পরাশক্তি মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ এবং প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড়ায় সোভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ। এ পরাশক্তিদ্বয় বাজার প্রভাব বলয়কে কেন্দ্র করে পৃথিবীকে ভাগবাটোয়ারা করে নিতে পৃথিবীর দেশে দেশে রক্তের বন্যা তৈরি করে। তৎকালীন সময় সাম্রাজ্যবাদের এই স্বরুপ তুলে ধরতে কমরেড আবদুল হক ১৯৬৫ সালে লেখেন ঐতিহাসিক গ্রন্থ “যত রক্ত তত ডলার”। এ প্রেক্ষাপটে শ্রমিক-কৃষক-জনগণের রাষ্ট্র, সরকার ও সংবিধান প্রতিষ্ঠা না হয়ে ৭১’সালে নয়া-ঔপনিবেশিক আধা-সামন্তবাদী বাংলাদেশের জন্ম হওয়ায় তিনি অসমাপ্ত জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করার দিকে অগ্রসর হওয়ার আহবান জানান। কমিউনিস্ট আন্দোলন পরিচালনা করতে যেয়ে কমরেড আবদুল হক সকল ধরণের সংশোধনবাদ ও সুবিধাবাদের বিরুদ্ধে ধারাবাহিক আপসহীন সংগ্রাম পরিচালনা করেছেন। চীনা পার্টি কর্তৃক উপস্থাপিত তিন বিশ্বতত্ত্ব যা প্রতিবিপ্লবী, শ্রেণী সমন্বয়বাদী ও বেঠিক প্রমাণিত হয়েছে- এই তিন বিশ্বতত্ত্বের বিরুদ্ধে কমরেড আবদুল হক পরিচালনা করেন দৃঢ় মতাদর্শগত সংগ্রাম। তিনি বরাবরই সংশোধনবাদের বিরুদ্ধে মার্কসাবাদ-লেনিনবাদকে সমুন্নত রেখেছেন।
বাংলাদেশকে সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত করার বিপদ ক্রমেই বাড়ছে। প্রচলিত প্রহসনের এ নির্বাচনী প্রক্রিয়া দেশের জনগণকে এ বিপদ থেকে মুক্ত করতে পারবে না। সাম্রাজ্যবাদের আশীর্বাদ নিয়ে এ নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় আওয়ামী জোট বা বিএনপি জোট বা প্রতিক্রিয়াশীল যে কোন রাজনৈতিক দল যে কেউ ক্ষমতায় আসুক, এরা সকলেই জনগণের উপর শোষণ-নির্যাতন ও স্বৈরতন্ত্র বৃদ্ধি করাসহ বিশ্বযুদ্ধের ক্ষেত্র হিসেবে দেশকে ব্যবহার করবে। তাই সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসী যুদ্ধ এবং তাতে বাংলাদেশকে সম্পৃক্ত করার বিরুদ্ধে সকলকে সোচ্চার হতে হবে। স্বৈরতান্ত্রিক পালাবদলের প্রহসনের এই নির্বাচনী প্রক্রিয়ার বদলে শ্রমিক-কৃষক-জনগণের রাষ্ট্র, সরকার ও সংবিধান প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে অগ্রসর হতে হবে। এ ক্ষেত্রে কমরেড আবদুল হকের বিপ্লবী জীবন থেকে শিক্ষা নিয়ে অকুতোভয় সাহসী হয়ে সত্যের পথে ইস্পাত দৃঢ় ভূমিকা নিয়ে অগ্রসর হতে হবে। সবাইকে আবারও সংগ্রামী অভিনন্দন জানাচ্ছি।