প্রেরণায় নারীর অবদান
প্রত্যেক সফল পুরুষের গল্প খুঁজে খুঁজে জানুন। তাদের প্রত্যেকের সফলতার যে কোন ভাঁজে কোন এক বা একাধিক নারীর অবদান স্বীকৃতি পাবেই-হোক সে মা-কন্যা, স্ত্রী কিংবা বোন। মানুষ, মানবতা ও সাম্যের কবি বাস্তবতা বিবর্জিত যুক্তিহীন ছন্দে বলেননি, ‘কোন কালে একা হয়নি ক’ জয়ী পুরুষের তরবারী/প্রেরণা দিয়াছে, শক্তি দিয়াছে বিজয়-লক্ষ্মী নারী।’ তিনি যা বলেছেন তা দিনের আলোর মত স্পষ্ট সত্য। কবিগুরুও পুরুষের জীবনে অস্বীকার করেননি নারীর অবদান। অকুষ্ঠ চিত্তে তিনিও ঘোষণা দিলেন, ‘নারীর বচনে শুধু হৃদয়েতে হলাহল/ অধরে পিয়ার সুধা, চিত্তে দাবানল।’
নারী কোন কালেই পুরুষের প্রতিযোগি ছিলো না কিংবা পুরুষও নারীর নয়। সবকালে সবাই সবার সহযাত্রী। বরং দু’সত্ত্বার মিলনের একতায় মানুষ হতে পেরেছে পূর্ণতম সত্ত্বা।
ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ যথার্থই বলে গেছেন, ‘মানব দেহে যেমন দুই চোখ, দুই হাত, দুই পা, সমাজ দেহে তেমন নর-নারী। যে দেহে এক চোখ কানা, এক হাত নুলা, এক পা খোঁড়া সে দেহ বিকলাঙ্গ নারী জাতির সুষ্ঠু উন্নতি ব্যতীত সমাজকে সমুন্নত বলা চলে না।’
পৃথিবীবাসীর সফলতার গল্পগুলোর অবয়ব পরিপুষ্ট করতে হলে নারী এবং পুরুষকে ঘরে-বাইরে, শিক্ষায়-কর্মে সম-অবদানে বিস্তৃত হতে এবং দিতে হবে। একজন হেলেনের কারনে ট্রয় ধ্বংস হয়েছিলো-এই অপবাদে যদি নারীকে পিছিয়ে রাখা হয়ে তবে পিছিয়ে যাবে আমাদের বোন-কন্যারা । যদিও বলা হয় সম্পদ এবং নারী ঝামেলার ঝুড়ি তবুও এর জন্য দায়ের ইঙ্গিত কিন্তু পুরুষের দিকেই উঠবে। কেননা পুরুষ যদি নারীকে কেবল ভোগের সামগ্রী হিসেবে বিবেচনা না করতো তবে নারী নির্যাতনের সম্যক রূপ, পারিবারিক অশান্তির দাবানল অন্তত মানুষের পৃথিবীতে প্রজ্জ্বলতি হওয়ার সুযোগ পেত না।
শক্তির তোড়ে, কণ্ঠের জোরে আজ অপবাদের সব নারীদের ওপরে অনায়াসে চাপিয়ে দিয়ে পুরুষ মুক্তি নিতে পারে বটে কিন্তু প্রবোধকুমার সান্যালের কাছে ধরা পরা সত্য অস্বীকার করার সাধ্য কি পুরুষকূল রাখে? তিনি বলেছেন, ‘সুন্দরী নারীর মোহ মানুষকে এক আশ্চর্য পথে নিয়ে যায়। আসক্তির সঞ্চয় হয় যে পাত্রে, সেই পাত্র থেকেই এককালে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠতে থাকে নীতি ও নীচতা, ধর্ম, বুদ্ধি ও ঈর্ষা, উদারতা ও প্রলোভন, ঔদাসীন্য ও দীনতা । নারীর সংস্পর্শে এলে পুরুষের অপূর্ব চেহারা ধীরে ধীরে প্রকাশ পায়।’ আব্রাহাম লিঙ্কন বলতে ভোলেননি, ‘কোন পুরুষের সহায়তা ছাড়া কোন নারী বিপথে যায়না।’
যে সমাজ এককানা দৈত্যের মতো পুরুষশাসিত সে সমাজে শুধু পরের মেয়েরা নিগৃহীত হয়না বরং আমাদের মা-বোন এবং কন্যারাও কোথাও না কোথাও নিগৃহীত হয় । এটাই তো হওয়ার কথা; নয়কি? স্রষ্টার মহান দুতদের থেকে শুরু করে সমাজবদ্ধ যে কোন সফল মানুষের কৃতজ্ঞতা আছে কোন না কোন নারীর প্রতি। নারীর প্রেরণা ছাড়া পুরুষের সাফল্যের স্বপ্ন সুদূর পরাহত। স্রষ্টাও তাই পুরুষের প্রয়োজনে নারীকে নয় বরং সৃষ্টির পূর্ণতার প্রয়োজনে নারীকে সৃষ্টি করতে একটুও ভুল করেননি ।
আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় দিনে দিনে নারী-পুরুষের মধ্যে দ্বন্দ্ব কেবল প্রকট হচ্ছে অথচ এসব অনাকাঙ্ক্ষিত। নারী পুরুষের কিংবা পুরুষ নারীর প্রতিযোগি হবে কেন? বরং হবে-তো একজন আরেকজনের পূর্ণতার নির্দেশক। স্বপ্ন-যাত্রার বিশ্বস্ত সঙ্গী। শিক্ষার উৎকর্ষতার যুগে আজও ঘরে ঘরে নারী নির্যাতিত হচ্ছে অথচ এসব বর্বরতার দীনতম প্রকাশ। কোন এক স্বার্থে পুরুষকূলের একাংশ নারীকে কেবল দমিয়ে রাখতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ কিন্তু নারীর প্রচেষ্টায় নারীর যে উত্থান তা কি শক্তি দিয়ে মোকাবেলার সাধ্য এর পরের যুগের থাকবে? অথচ জাতীয় কবির, ‘নর যদি রাখে নারীরে বন্দী, তবে এর পর যুগে/আপনারি রচা ঐ কারাগারে পুরুষ মরিবে ভুগে/যুগের ধর্ম এই-পীড়ন করিলে সে-পীড়ন এসে পীড়া দেবে তোমাকেই’ বাণী বোধহয় সত্য হতে যাচ্ছে।
যদিও প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রের সম্পূর্ণটাই ‘ইউটোপীয়’(কাল্পনিক স্বর্গরাজ্য) ভাবধারার ছিলো তবে সেখানে তিনি নারীদের প্রতি শ্রদ্ধা-সম্মানের বিষয়ে যে উদার ধারণা দিয়েছিলেন তা যদি এই সমাজে বাস্তবায়ন করা না যায় তবে ভবিষ্যতের কোন এক কালে নারীর দ্বারা পুরুষকে পর্যুদস্ত হতেই হবে; যেমনটা দূর অতীত থেকে পুরুষের দ্বারা নারীর প্রতি চলমান সময় পর্যন্ত চলছে। ধর্ম নারীকে সম্মানের আসনে আসীন করলো অথচ কিছু মানুষ ধার্মিকের তকমা লাগিয়ে নারীর প্রতি অবিচার চালিয়ে যাচ্ছে। সময় তার সুযোগ বুঝে প্রতিশোধ নেবেই। সময়ের ধর্মই যে অতীতের পুরনারাবৃত্তি উল্টোপথে ঘটানো !
একপাক্ষিক ভাবে শুধু পুরুষদের বিরুদ্ধে বলে গেলেও সমস্যার সমাধান আসবে না।কেননা জ্ঞানীজনরা নারীদেরকেও তাদের দায়িত্বগুলো যথাযথভাবে পালন করতে বলেছেন। বিখ্যাত মনীষী ও দার্শনিক হউরিপিদিস বলেছেন, ‘দুষ্ট মেয়েমানুষের মতো অশুভ আর নেই এবং সৎ মেয়ে মানুষের মতোন ঈশ্বর আর কিছু সৃষ্টি করতে পারেননি।’’ নারীত্বের ক্ষমতার গভীরতা অতল । পন্ডিতজন কার্ভেন্টিস বলেছেন, ‘যে নারী শ্রদ্ধা আদায় করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ সে একপাল উশৃঙ্খল সৈন্যের কাছে থেকেও তা আদায় করতে পারে ।’
শেষ বেলায় দ্রোহ ও সাম্যের কবি প্রিয় নজরুলের সাথে কন্ঠ মিলিয়ে বলে যাই, ‘বিশ্বের যা-কিছু মহান্ সৃষ্টি চির-কল্যানকর/অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর…নরককুন্ড বলিয়া কে তোমা করে নারী হেয়-জ্ঞান ? তারে বল, আদি-পাপ নারী নহে, সে যে নর-শয়তান/ক্লীব সে, তাই সে নর ও নারীতে সমান মিশিয়া রহে/ক্লীব সে, তাই সে নর ও নারীতে সমান মিশিয়া রহে ।’
কাজেই পুরুষ যদি অকৃতজ্ঞ না হয় এবং নিজেকে সফল মানুষদের সারিবদ্ধ করতে চায় তবে তার জীবনে বিভিন্ন পরতে পরতে নারীর অবদান সে কোনভাবেই অস্বীকার কিংবা উপেক্ষা করতে পারে না।
(রাজু আহমেদ : কলাম লেখক)