ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারের ক্ষেত্রে সতর্ক হতে হবে
নিজস্ব প্রতিবেদক: শিল্প বিপ্লবের তৃতীয় পর্যায়ে ইন্টারনেট একটি যুগান্তকারী আবিস্কার। এর মাধ্যমে দ্রুত আমূল পরিবর্তন ঘটছে বিশ্বের সামগ্রিক উৎপাদন কাঠামোর। বিশেষত যোগাযোগ ব্যবস্থায় সৃষ্টি হচ্ছে নতুন নতুন মাধ্যম। পারস্পরিক যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ফেসবুক, মেসেঞ্জার, হোয়াটস আপ, টুইটার ইত্যাদি। আমাদের দেশে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম হিসেবে মূলত বেশি ব্যবহার হয় ফেসবুক। এর মাধ্যমে পারস্পরিক যোগাযোগ ও সম্পর্ক কাছাকাছি আসায় পুরনো অনেককে নতুনভাবে চেনার সহজ হয়। ফলে পারস্পরিক যোাগাযোগের গন্ডি নিজের পাড়া-মহল্লা ও অঞ্চল ছাড়িয়ে দেশ-বিদেশে বিস্তৃতি ঘটে। তবে এর আড়ালে ফেসবুকের ক্ষতিকর দিকগুলিও মানুষকে আজ আশংকাজনকভাবে ভাবাচ্ছে। গভীরভাবে এর ক্ষতিকর দিকগুলি ভাবলে অনেকে হয়তো এই মাধ্যম ব্যবহার থেকে বিরতই থাকতে পারেন।
বলতে গেলে সোশ্যাল মিডিয়া বিশেষ করে ফেসবুক হলো একটা মারাত্মক নেশা। অনেকটা ইয়াবা, ফেনসিডিলের মতই নিরব ঘাতক হিসেবে এই নেশা হানা দিচ্ছে। কিন্তু ফেসবুক নামক এই অনলাইন প্রোডাক্টের মাদকতা নিয়ে তেমন সচেতন নয় ব্যবহারকারীরা। এর ব্যবহারের মাধ্যমে কখন যে মনের অজান্তে নোমোফোবিয়ায় আক্রান্ত হয়ে পড়ে ব্যবহারকারীরা সেটার খেয়ালও কেউ করে না।
ফেসবুক শুধু নোমোফোবিয়া তে না, ইনসোমনিয়া, ডিপ্রেশন, টেনশনসহ নানা রকম রোগে আক্রান্ত করে। হতাশা, হিংসা-বিদ্বেষের দিকে ধাবিত করে। ব্যবহারকারীরা সাধারণত লাইক, কমেন্ট,রিয়াক্ট ও শেয়ার ইত্যাদির মাধ্যমে নিজেদের অভিব্যক্তি প্রকাশ করে। ‘লাইক’ অপশন এত ক্ষতিকর যে, যিনি স্বয়ং এই লাইক অপশনের জনক, সে রোজেনস্টাইন নিজেই তার ডিভাইস থেকে “লাইক” অপশনটি রিমুভ করে দিয়েছেন বলে অনেকে বলে থাকেন।
সাধারণত আমরা যখন ফেসবুকে কোন লাইক পাই তখন আমাদের মস্তিষ্কে ডোপামিন নামক হরমোন রিলিজ হয়। ডোপামিন হলো সেই হরমোন যেটা কেউ নেশাদ্রব্য/ড্রাগস নিলে মাথায় রিলিজ হয়। আর এতে আমাদের ভালো লাগে। আসক্ত হয়ে পড়ি। আর এই আসক্ত হওয়ার জন্য ফেসবুক নোটিফিকেশন নামক অপশন চালু করেছে। এসব কাকতালীয় না। ফেসবুক যেহেতু মানুষের সাইকোলোজি নিয়ে বিজনেস করে, সেই কারনে ফেসবুকের সূচনার প্রথম দিকে ফেসবুকের একজন কো-ফাউন্ডার ফেসবুক থেকে বিদায় নিয়েছিল। আমরা অনেক মানুষ কিছুটা ইম্যাচিউর। অপরের ভালো কিছু দেখলে নিজের যা আছে সেটাতে সন্তুষ্ট থাকতে পারি না। তার সুবাদে, যখন আপনার কোন বন্ধু তার কোন সফলতা ফেসবুকে ঢাকঢোল পিটিয়ে প্রচার প্রসার করে তখন আপনার খারাপ লাগে। কারন আপনার ইনকাম কম কিংবা চাকুরী নাই। আবার আপনার বন্ধু তার পারিবারিক ভ্রমন নিয়ে পিক দিলো, ভালো কোন হোটেলে উঠে তার কোন পিক দিলো, অনেক নামীদামী খাবারের পিক দিলো। আর যারা গরিব, সেসব বন্ধুরা এসব দেখলে হতাশা বৈ আর কিছু আসবে? কারন হয়তো আপনার ফ্যামিলিয়াল লাইফে গন্ডগোল চলছে, আপনার সন্তান সন্ততি খুব কষ্টে আছে। কিন্তু আপনারই ফ্রেন্ড দিব্যি সুখে দিন কাটাচ্ছে। আর এটা কষ্ট ছাড়া কিছুই দিবে না আপনাকে যদিও আপনি একটা লাইক আর নাইস কমেন্টস করেন। এ সমস্ত কারণে ফেসবুক হলো একটা হতাশার জায়গা। এটা ব্যবহারকারীদের হতাশার জালে আটকে রাখে, নির্ঘুম রাত কাটাতে বাধ্য করে। ব্যবহারকারী নিজের কষ্ট নিজেই ভুগে থাকেন। এরকম অনেক অনেক লোক আছেন যারা এসব ট্রমা ফেইস করতেছে। ফেসবুক শুধু হতাশ-ই করে না, ব্রেইনের ক্ষতি করে। লাইক কমেন্টসের নেশায় যখন ব্রেইনে ডোপামিনের বন্যা বয়ে যায়, তখন ব্যবহারকারীর লং টার্ম মেমরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। স্মরন শক্তি কমে যায়। স্ক্রীনের নীল আলোয় চোখ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। রাতে মেলাটোনিন হরমোন এই লাইটের কারনে পিনিয়াল গ্ল্যান্ড থেকে উৎপন্ন হয় না। তাই ভুগেন ইনসোমনিয়ায়। রাতের বেলায় যখন ঘুম আসবেনা তখন ব্যবহারকারীর ব্রেইনে সারাদিন যেসব টক্সিন প্রবেশ করেছে, সেগুলো বের হবে না মস্তিষ্কে থেকে। আর ফলে ব্যবহারকারী হবেন রোগাক্রান্ত।
আসল কথা হলো ফেসবুক কোন প্রোডাক্ট না, বরং আমরাই ফেসবুকের প্রোডাক্ট। আমাদের মেধা, স্বাস্থ্য, মানসিকতা, চিন্তাচেতনা ইত্যাদি সবকিছুই ফেসবুকের মতো সোশ্যাল মিডিয়ার দাসে পরিণত হয়ে যায়। আরামদায়ক প্রতিটা লাইকে, প্রতিটা কমেন্টসে, প্রতিটা ক্লিকে ওদের ইনকাম হচ্ছে। আর আমাদের যে কত ক্ষতি হচ্ছে তা ভেবেও দেখি না। পিতামাতা অসুস্থ হলে ফেসবুকে Please keep my parents in your prayers টাইপের মেসেজ দিয়েই দায়িত্ব খালাস। বাস্তবে নিজে কোন টেক কেয়ার করি না। ভালোবাসা চলে গেছে, ফেইক সহানুভূতি এসেছে। এসব সামাজিক মাধ্যম অপরিকল্পিভাবে ব্যবহারের কারণে অনেক সময় সামাজিক, ব্যক্তিগত ও পারিবারিক সম্পর্কও ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। তাই ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারের ক্ষেত্রে ব্যবহারকারীদের আরো সচেতন ও পরিকল্পিতভাবে ব্যবহার করতে হবে।