ময়মনসিংহে নির্বাচনের লড়াইয়ে ৬৭ জন প্রার্থীর মধ্যে নারী প্রার্থী মাত্র ৫ জন
বাবলী আকন্দ ঃ রাজনীতির মাঠ (ফিল্ড) সৃষ্টি বা মাঠে সরব না থাকাতে নারীরা পিছিয়ে যাচ্ছেন। পাচ্ছেন না দলীয় মনোনয়নসহ অন্যান্য রাজনৈতিক সুবিধা। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলোতে শুধুমাত্র আলংকারিক হিসেবে নারীদেরকে রাখা হচ্ছে। খোদ জাতীয় পার্টির মহাসচিব মজিবুল হক চুন্নু দলটির প্রধান পৃষ্ঠপোষক সাবেক বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ এমপিকে নিয়ে এ ধরনের মন্তব্য করেছেন।
নির্বাচনের মাঠে ময়মনসিংহের ১১টি আসন খুবই গুরুত্বপূর্ণ আসন। গুরুত্বপূর্ণ সংসদীয় ১১ আসনের মধ্যে ৬ টি আসনেই মনোনয়ন চাওয়ার মতো নেই নারী প্রার্থী, অনেক আসনেও নেই কমিটি। অন্য ৫ টি আসন থেকে যারা মনোনয়ন প্রত্যাশী ছিলেন তাদের মধ্যে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ থেকে দলীয় মনোনয়ন চেয়েও মনোনয়ন পাননি ১ জন, মনোনয়ন বাতিল হয়েছে ১ জন নারী প্রার্থীর। মনোনয়ন পেয়েছেন ১ জন। আওয়ামী লীগ হলেও স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে লড়ছেন ২ জন। এছাড়া গণ মুক্তিজোট দলের একজন নারী স্বতন্ত্র হিসেবে লড়ছেন। ময়মনসিংহ ১১ টি আসন থেকে দ্বাদশ নির্বাচনে মোট ৬৭ জনের মধ্যে মাত্র ৫ জন নারী ভোটের মাঠে রয়েছেন। এদের মধ্যে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের ৪ জন ও গনমুক্তিজোট থেকে ১ জন নারী।
নারী প্রার্থী কারা:
ক্ষমতাসীন দলের নারী মনোনয়ন প্রার্থী হিসেবে ছিলেন ময়মনসিংহ-১ (হালুয়াঘাট-ধোবাউড়া) আসনে রুবি — আওয়ামী লীগ থেকে প্রচারণা চালালেও তফসিল ঘোষণা পরে তাঁকে আর নির্বাচনী মাঠে পাওয়া যায় নি। এদিকে গণ মুক্তিজোটের এমপি প্রার্থী রোকেয়া বেগম মনোনয়নপ্রাপ্ত হয়ে তিনি জোরেসোরে প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন।
ময়মনসিংহ-২ (ফুলপুর-তারাকান্দা) আসনে কোন নারী মনোনয়ন চান নি কিংবা মনোনয়নপ্রাপ্ত হয়ে লড়ছেন না।
ময়মনসিংহ-৩ (গৌরীপুর) আসনে অ্যাডভোকেট নিলুফার আনজুম পপি আওয়ামী লীগের নৌকা নিয়ে লড়ছেন। তাঁর বিপরীতে নৌকা না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে লড়ছেন ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা নাজনীন আলম।
ময়মনসিংহ-৪ (সদর) ও ময়মনসিংহ-৫ (মুক্তাগাছা)
আসনেও নেই নারী প্রার্থী।
ময়মনসিংহ-৬ (ফুলবাড়িয়া) আসনে আওয়ামী লীগের থেকে মনোনয়ন চেয়েছিলেন ফারজানা বেগম বিউটি ও সেলিমা বেগম সালমা। ফারজানা বেগম বিউটি কোন কারণে পিছিয়ে এসেছেন। কিন্তু বর্তমানে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ঈগল মার্কা নিয়ে লড়ছেন সেলিমা বেগম সালমা।
ময়মনসিংহ-৭ (ত্রিশাল আসনে)ও নেই নারী প্রার্থী।
ময়মনসিংহ-৮ (ঈশ্বরগঞ্জ) আসনে কানিজ ফাতেমা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে লড়ছেন।
ময়মনসিংহ-৯ (নান্দাইল) ও ময়মনসিংহ-১০ (গফরগাঁও)
আসনে নেই নারী প্রার্থী।
ময়মনসিংহ-১১ (ভালুকা) আসনে মনোনয়ন প্রত্যাশী ছিলেন সংরক্ষিত মহিলা আসনের সাবেক এমপি মনিরা বেগম মনি। দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবেও সামনে আসেন নি।
নারীরা কেন সরব থাকতে পারেন না মাঠে?
পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীদেরকে এখনো ভোগের পণ্য ও সৌন্দর্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখা হয়। যে সকল রাজনৈতিক দলগুলো পরিবর্তনের কথা বলে তাদের মধ্যেও এরকমটাই চর্চা হয়ে থাকে। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) অনুযায়ী যেখানে রাজনৈতিক দলগুলোতে ৩৩% নারী রাখার কথা বলা হয়েছে। সেখানে রাজনৈতিক দলগুলো পূর্ণাঙ্গ করতে না পারলেও যেটুকু রাখা হয়েছে তা আলংকারিক পদ হিসেবেই রাখা হয়েছে। অথচ নারীদের যোগ্যতা থাকা সত্বেও তাদেরকে এগিয়ে নিতে কিংবা সুযোগ দিতে চায় না রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের কতিপয় নেতা। সুযোগ দিতে চাইলেও সেখানে গিভ এন্ড টেক এর বিষয়টিও সামনে এসে দাঁড়ায়। গিভ এন্ড টেক এর বিষয়টি বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নারীদের প্রতি যৌনাকাঙখার দিকে ইঙ্গিত করা হয়। আবার ক্ষমতা নিজ নিয়ন্ত্রণে রাখতেও নেতারা তাদের স্ত্রীকেও নারী কমিটির প্রধান অথবা আলংকারিক পদ (মহিলা বিষয়ক সম্পাদক) হিসেবে রাখেন। ফলে যোগ্যতা সম্পন্ন নারী থাকলেও রাজনীতির মাঠ সরব রাখতে নিতে হয় পরিবারের প্রধান কর্তার স্বামীর অনুমতি। কোন কোন ক্ষেত্রে কোন ধরনের কর্মসূচীতে স্ত্রী যাবেন সেটিও নির্ধারণ করে দেয়া হয়। ফলে ভোটাধিকারের প্রয়োগের পাশাপাশি দলগুলোর সাধারণ আসনে নির্বাচন করার সিদ্ধান্তও উচ্চ শিক্ষিত নারীরা নিতে পারে না।
এদিকে রাজনৈতিক মাঠে নারীরা নামলেই বাধ্য হয়ে তাদের কিছু বাহ্যিক আচরণের পরিবর্তন করতে হয়। যেমন শাড়ি পড়া,মাথায় কাপড় দেয়া,ফুল হাতা ব্লাউজ পড়াসহ আরো বেশ কিছু আচরণ। যা দৃশ্যত চোখে পড়ে। এধরণের আচরণকে আদর্শিক মনে করে পরিবার, সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবেই গ্রহণযোগ্য করে তোলা হয়। এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি থাকলেও গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়ার মতো ভূমিকায় নেই নারী। পুরুষ সহযোদ্ধাদের ভীড়ে স্বকীয়তাও হারিয়ে ফেলে নারী।
ময়মনসিংহ-১১ (ভালুকা) আসনের সাবেক সংরক্ষিত আসনের মহিলা এমপি মনিরা সুলতানা মনি এ বিষয়ে বলেন, নারীরা মাঠে থাকতে পারে না এটা ঠিক নয়। নারীদেরকে সুযোগ দেয়া হয় না বা দিতে চায় না। আমি ভালুকার মতো একটা আসনে গণজাগরণ সৃষ্টি করেছিলাম। যা আমাদের সাধারণ আসনের এমপিও পারেন নি। উঠান বৈঠক থেকে শুরু করে মিছিল মিটিংয়ে সবজায়গায় আমার সক্রিয় উপস্থিতি ছিল কিছু কারণে এবার নৌকা পাওয়া হয় নি। যাই হোক, এখানে কিছু বিষয় আছে যেটি কৌশলে করা হচ্ছে এবং তা এখন দৃশ্যমান আকারে প্রকট হচ্ছে। রাজনৈতিক দলগুলোতে কোন নারীর যোগ্যতা থাকা স্বত্তেও নেতাদের ওয়াইফদেরকে প্রতিষ্ঠিত করা হচ্ছে। আগামীতে সংরক্ষিত আসনের জন্য তা রিজার্ভ করে রাখা হচ্ছে। আমি যে সংগ্রাম করে এসেছি,সংরক্ষিত আসনে এমপি নির্বাচন করার সময়ও আমার বিরুদ্ধে লেগেছিল। কিন্তু মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তিনি আমাকে সেখানে অধিষ্ঠিত করেছিলেন। সংগ্রাম এখনো করছি। সাধারণ আসন থেকে না হলেও সংরক্ষিত আসন চাইবো।
এ বিষয়ে সংসদীয় ময়মনসিংহ-১ (হালুয়াঘাট, ধোবাউড়া) আসন থেকে গণ মুক্তিজোটের এমপি প্রার্থী রোকেয়া বেগম জানান, মনে সাহস ও ইচ্ছা থাকলে সকল বাধা অতিক্রম করা যায়। একজন নারী হিসেবে আমার প্রতিবন্ধকতা থেকে গরীব হওয়াটাই বড় প্রতিবন্ধকতা। গরীব গরীবের কষ্ট বুঝে। আমি নির্বাচনে জয়যুক্ত হলে আমার এলাকার রাস্তাঘাট উন্নয়নের পাশাপাশি গরীব মানুষের পাশে দাঁড়াতে চাই। নারীরা পারে এটাও প্রমাণ করতে চাই।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ময়মনসিংহ জেলা শাখার সভাপতি এহতেশামুল আলম জানান, যোগ্যতা সম্পন্ন নারী মনোনয়ন চাইলে অবশ্যই তিনি পাবেন। নারীদের সংখ্যা বাড়ছে। নেতৃত্ব পর্যায়ে গৌরীপুরের পপিকে মনোনয়ন দেয়া হয়েছে, এটাই বা কম কিসে। তিনি উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন। আমাদের কর্মী সভাগুলোতে এখন হাজারের বেশিও নারীর উপস্থিতি থাকে। আমাদের জেলার যুব মহিলা লীগ,মহিলা আওয়ামী লীগের নারী নেতৃত্ব এখন অনেক শক্তিশালী অবস্থানে আছে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ কমিউনিষ্ট পার্টির ময়মনসিংহ জেলা শাখার সভাপতি এড এমদাদুল হক মিল্লাত বলেন, প্রথমত আরপিওতে উল্লেখ করা হলেও বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের দৃষ্টিভঙ্গিতে নারীকে অগ্রসর করার কোন ইচ্ছে নেই। দ্বিতীয়ত সামাজিকভাবে নারীর অনিরাপত্তা লিডারশিপকে বাধাগ্রস্থ করে, তৃতীয়ত রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন এবং সংবিধান প্রদত্ত দেশ চলবে সাম্যের ভিত্তিতে। সাংবিধানিকভাবে বলা আছে দেশ হবে সমাজতান্ত্রিক। সেগুলো তারা অনুসরণ করে না। নারী নেতৃত্ব (প্রধানমন্ত্রী, বিরোধদলীয় নেত্রী, স্পিকার) আসলে এরা গোটা নারী সমাজকে প্রতিনিধিত্ব করছে না। এছাড়া রাজনৈতিক মাঠে আসলে নারীকে অশ্লীলভাবে উপস্থাপন করা হয় যা নারীকে রাজনীতিতে আসতে বাধাগ্রস্ত করে।
উল্লেখ্য, ময়মনসিংহ জেলার ১১ সংসদীয় আসনে মোট ভোটার সংখ্যা ৪৪ লক্ষ ৪৩ হাজার ৯১ জন। যার মধ্যে পুরুষ ভোটার সংখ্যা ২২ লক্ষ ৪০ হাজার ৫৮৬ জন, মহিলা ভোটার সংখ্যা ২২ লক্ষ ২ হাজার ৪৭০ জন, হিজড়া ভোটার ৩৫ জন এবং জেলায় মোট ভোটকেন্দ্রের সংখ্যা ১৩৬০টি। বর্তমানে জেলায় মোট প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর সংখ্যা ৬৭ জন। এদের মধ্যে মাত্র ৫ জন নারী প্রার্থী।