উপ-সম্পাদকীয়

লন্ডন প্রবাসী বিবিসি বাংলার সাংবাদিক কাদের মাহমুদকে যেমন দেখেছি- আমিনুল হক সাদী

নীরব নীভূত সমাজে আলো ছড়িয়ে আলোকিত ক’রে গণমানুষের কল্যাণে যিনি এক নতুন উদ্যোগ নিয়েছিলেন, লেখনীর মাধ্যমে যিনি ফুটিয়েছেন সমাজের মানুষের দুঃখ ও সুখের অভিজ্ঞতা, যাঁর লেখার সুনাম দেশে ও প্রবাসে ছড়িয়েছে তিনি আর কেউ নন আমাদের কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলার মহিনন্দ ইউনিয়নের উত্তরপাড়া নরসুন্দা নদীর পাড়ের বিশিষ্ট শিক্ষক মোশাররফ আলী মাস্টারের নাতি ও বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ আবদুল বারীর বড় ছেলে লেখক কাদের মাহমুদ। সুদীর্ঘকাল সুদূর লন্ডনের প্রবাসী হয়েও, নিজ পিত্রালয়কে ভুলতে পারেননি। মরহুম পিতার কথা স্মরণে ছুটে আসতেন পৈত্রিক ভিটা সেই অজপাড়াগাঁয়ে, সদর উপজেলার মহিনন্দ ইউনিয়নের নরসুন্দা নদীর পাড়ে। আর সেই গ্রামটিকে আলোকময় হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে: অনেক সাংবাদিক, লেখক, সাহিত্যিক ও সুশীল সমাজের গন্যমান্য ব্যক্তিবর্গের উপস্থিতিতে, ২০০৯ সনের ২১শে ফেব্রুয়ারী উদ্বোধন করেন একটি কেন্দ্র যেখানে একই সাথে রয়েছে তাঁর দাদার নামে ‘মোশাররফ আলী কেন্দ্র’ ও তাঁর জীবনসঙ্গীনীর নামে ‘ফরিদা মাহমুদ ঝর্ণা পাঠাগার’। যা নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস হতো না। এমন একটি অচেনা মফস্বল এলাকায় সাহিত্যভান্ডারে ছেয়ে যাবে ভাবা যায় না। সেই চিরচেনা গ্রামের আলোরদিশা মানুষটিকে গ্রামবাসী হারিয়ে ফেলেছে গত ৭ সেপ্টেম্বর। বিবিসি বাংলার সাবেক সাংবাদিক, যুক্তরাজ্য প্রবাসি কলামিষ্ট ও লেখক কাদের মাহমুদ দীর্ঘদিন বার্ধক্যজনিত রোগে ভোগার পর শুক্রবার স্থানীয় সময় বিকেল সাড়ে চারটায় লন্ডনের নিকটবর্তী শহর সারে নিজ বাসভবনে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিলো ৮১ বছর, তিনি দুই কন্যা ও এক পুত্র সন্তান রেখে গেছেন। তাঁর মৃত্যুতে এলাকায় শোকের ছায়া নেমে এসেছে।

একাধারে ঔপন্যাসিক, গল্পকার, কবি, কলাম-লেখক ও সাংবাদিক কাদের মাহমুদ, ১৯৪৩ সনের ১ মার্চ নেত্রকোণা কুমরী গ্রামে মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন। কাদের মাহমুদ ১৯৪৭ সন থেকে ঢাকা শহরে ছিলেন। তিনি তার প্রধান শিক্ষক ও প্রতিষ্ঠাতা পিতার ইসলামিয়া উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষা, এবং জগন্নাথ কলেজে পড়ে, বাংলা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শিক্ষা সমাপন করেন। ইতিমধ্যে ছয় দশকের গোড়ায় দৈনিক সংবাদে ক্ষণকাল শিক্ষানবিস থাকার পর দৈনিক জেহাদ, সাপ্তাহিক মুসলিম জাহান, সাপ্তাহিক সোনার বাংলা, সাপ্তাহিক পূর্বদেশ, সাপ্তাহিক চিত্রালী এবং দৈনিক আজাদ পত্রিকায় সাংবাদিকতা করেন। ১৯৭০ সনে বেতার সাংবাদিকতায় যোগ দেন তারপর, ১৯৭৩ সনের ডিসেম্বরে চলে যান বিলেতে এবং আড়াই বছরের মতো লন্ডনে বিবিসি’র বাংলা বিভাগে সহকারী অনুষ্ঠান সংগঠক হিসেবে কাজ করেন। এরপর, বিলেতের সবচেয়ে দীর্ঘায়ু বাংলা পত্রিকা লন্ডনের সাপ্তাহিক জনমতে’র সম্পাদনার কাজে নিযুক্ত থাকেন ১১ বছর ধরে। তখন তাঁর প্রত্যক্ষ সাংবাদিকতা পেশার বিরতি ঘটে। ১৯৮৭ সনে তিনি বৃটিশ বহিরাগমন আইন পেশা চর্চা শুরু করেন। ২০০৭ সনে তিনি চাকুরী জীবন থেকে অবসর নেন।

ছোটবেলা থেকে তিনি সমাজসেবায় ব্রতী ছিলেন। তিনি বাংলা ভাষা আন্দোলন উদ্বেলিত কিশোর ছিলেন; স্বাধীকার চেতনায় আকুল হ’য়ে স্কুল জীবনেই ছাত্র রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন; প্রত্যক্ষ করেন মুসলিম লীগের ভরাডুবি, বোধ করেন সামরিক শাসনের জগদ্দল পেষণ, পরে সক্রিয় ভাবে অংশ নেন শিক্ষা আন্দোলনে। সাংবাদিক হিসেবে তিনি প্রত্যক্ষ করেন আইয়ুব-মোনায়েম খানের আমল, স্বায়ত্ত্ব শাসনের উত্থান, এবং শেষে অসহযোগ আন্দোলন, শোনেন রমনা রেসকোর্সে বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ; তারপর দেখেন রক্তাক্ত পঁচিশে মার্চ। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন রক্তক্ষয়ী বাংলাদেশে অবরুদ্ধ জাতির সঙ্গে। ২০২৪ সালের গণঅভ্যুথান উপলব্দি করেন সুদূঢ় প্রবাসে।

ছয় দশকের গোড়ায় কাদের মাহমুদ সৃজনশীল রচনায় হাত দিয়েছিলেন। লেখক সংঘের মাসিক পরিক্রমা, দৈনিক আজাদ, সাপ্তাহিক চিত্রালী, দৈনিক বাংলা, সাপ্তাহিক পূর্বদেশ, দৈনিক অবজারভার, সাপ্তাহিক হলিডে’র সাহিত্য বিভাগে তার ছোট ও বড় গল্প ছাপা হয়। দেশ স্বাধীন হবার পর, তার প্রথম প্রায়োপন্যাস ‘কচ্ছপ’ ধারাবাহিকভাবে দৈনিক বাংলায় এবং দ্বিতীয় প্রয়োপন্যাস ‘উড়নচন্ডী শহরে ফনুস’ সাপ্তাহিক বিচিত্রায় ছাপা হয়। এরপর বিলেতে, তিনি কবিতা রচনায় দীর্ঘকাল ঝুঁকে পড়েন। যুক্তরাজ্য বাংলা সাহিত্য পরিষদের সভাপতি থাকাকালে সংগঠনের প্রকাশিত একমাত্র কাব্যসংকলন ‘বিলেতের কবিতা’ গ্রন্থনা করেন। তিনি দীর্ঘকাল ধ’র সাপ্তাহিক জনমতে ‘জনৈকের জার্নাল’ নামে একটি কলাম লেখেন। সমাজ কেন্দ্রিক বিষয়ে প্রবন্ধ রচনা ও পাঠ করেন। পরে তিনি আবারও কথাসাহিত্যে ফিরে আসেন। স্বনামধন্য সাহিত্যিক ও কলাম লেখক আবদুল গাফফার চৌধুরী ও বরেণ্য কবি শামসুর রাহমানের সাথে কাদের মাহমুদের নিবীড় সম্পর্ক ছিলো। ঘরোয়া আসরে কবি শামসুর রাহমান, কাদের মাহমুদ, সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ও কবি সৈয়দ শাহীন আহমদসহ অনেকের সাথে কবিতার আসর চলতো দীর্ঘ সময়ে।

১৯৯৯ সন থেকে কাদের মাহমুদের গ্রন্থাদি প্রকাশিত হতে শুরু করে। ‘কচ্ছপ’ ও ‘উড়নচন্ডী শহরে ফানুস’ ছাড়াও, তাঁর পূর্ণাঙ্গ উপন্যাস ‘অহিনকুল’, ‘ঘরের নাম বাসনা’ ও ‘পরকপক্ষীর বিভুঁইবাস’ প্রকাশ পেয়েছে। প্রকাশিত হয়েছে তাঁর ছোটগল্পের সংকলন ‘কমল রাক্ষসের উপাখ্যান’ ও ‘স্বল্পগল্প’। কবিতা গ্রন্থ বের হয়েছে ‘এক ধরণের শে¬াক’, ‘বাসর আলাপের নান্দী পাঠ’, ‘কালের মোড়’ ও ‘ভূতলে নৌযাত্রা’। বের হয়েছে ভ্রমণ কাহিনী ‘নিজ দেশ ভিন দেশ’; ছোটদের জন্য ছড়ার বই ‘ডিং ডং’ ও (১০০টি ইংরেজী ছড়ার বাংলা রূপান্তর, কার্টুন সহ দ্বিভাষিক বই) ‘ব্যা ব্যা কালো মেষ’ এবং প্রামাণ্য গ্রন্থ ‘গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলনের পথিকৃৎ-ড্রামা সার্কল’।
কাদের মাহমুদের স্ত্রী ফরিদা মাহমুদ, এককালে গল্প লিখতেন, ২০০৭ সনের মার্চে প্রয়াত হন। তাঁদের প্রথমে দুই কন্যা। বড়মেয়ে- ফারাহ স্ট্রেভান্স টোড়ী, লন্ডনের অদুরে ওকিং শহরে একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগের উর্ধতন শিক্ষিকা ও ছোট মেয়ে, নিশাত মাহমুদ, লন্ডনের কলিয়ার্স উডে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে উর্ধতন শিক্ষিকা এবং ছেলে যোশান মাহমুদ, বৃটিশ মিউজিয়ামে কম্পিউটার প্রোগ্রামার হিসেবে কর্মরত। কাদের মাহমুদের ছোটভাই জাফর সাদেক এস.এ. পরিবহণের পার্সেল ইনচার্জ হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন; তাঁর এক মেয়ে সালেহা সাদেক সোহেলী, শিক্ষিকা এবং এক ছেলে তাহের সাদেক, ছাত্র। বোনদের মধ্যে হাসিনা বেগম পারুল, জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুলে শিক্ষকতা করছেন। তার দু’ছেলে আহমেদ যুবায়ের এনাম ও আহমেদ যুনায়েদ ইউনুস এবং এক মেয়ে জুলাইকা নূর নীলা। কাদের মাহমুদের আরেক বোন ফেরদৌসি বেগম এবং তার এক ছেলে রেজওয়ান হোসেন রাজু ও এক মেয়ে তাপসী রাবেয়া হোসেন। কাদের মাহমুদকে ২০১১ সালে বাংলা একাডেমি প্রথম প্রবাসী লেখক ( সৈয়দ ওয়ালিউল্লহ সাহিত্য) পুরস্কার, সংহতি সাহিত্য পরিষদের আজীবন সম্মাননা পদক এবং সাপ্তাহিক জনমত বিশেষ পদকে ভুষিত করে।

কাদের মাহমুদ কিশোরগঞ্জে তথা পৈত্রিক বাড়ি মহিনন্দে অনেক সময় না কাটালেও তাঁর একটা অন্য রকম টান ছিলো। আমি যখন ২০০৬ সাল থেকে মহিনন্দ ইতিহাস ঐতিহ্য সংরক্ষণ পরিষদ এর প্রতিষ্ঠা করে এলাকার বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ শুরু করি তখন জানতে পারি আমাদের মহিনন্দের এই কীর্তিমান লেখকের কথা। ছুটে যাই উনার চাচাতো ভাই শহীদুল্লাহর কাছে। তিনি আমাকে উনার মোবাইল ও মেইল নাম্বার দিলে তাতে চিঠি আদান প্রদান শুরু করি মেইলে। অনেক বিষয়ে জানতে চেষ্টা করি। তার চাকুরী পেশা থেকে শুরু করে সাংবাদিকতা সাহিত্য সংস্কৃতিতে যোগদান ও অবদানের কথা। তিনি ৩৬টি বই লিখলেও সেসময়ে আমার কাছে প্রশ্ন জাগে মহিনন্দের বিষয়ে কি লিখেছেন। এমন কথা বলায় তিনিও আশ্চর্য হয়ে যান। এর কিছু দিন পর মেইল করেন। সাদী আমার ‘ভূতলে নৌ যাত্রা’ কাব্যগ্রন্থে কিশোরগঞ্জ নিয়ে রোমন্থনমূলক একটি কবিতা গ্রন্থিত হয়েছে; ‘কার ছায়ায়’ শিরোনামে। তুমার আগ্রহের প্রতি সম্মান জানিয়ে আমার লিখা। এতে করে আমাকে এবারে মহিনন্দবাসী ভাবতে পারো। কবিতাটি ছিলোÑ
“কিন্তু আমি কি কখনো ফিরে গেছি কিশোরগঞ্জে! কেমন এই টাউন! সেখানে কি একটি নড়বড়ে সেতু আছে, গুরুদয়ালের নামে একটি কলেজ, পুস্তক বিকির কিছু দোকান, ধুলো, মাছি, লাল একটি রেল স্টেশন, সাইকেলে যাওয়া যেতো নীলগঞ্জে, অথবা কোন মহিনন্দ গ্রামে, কোন তটনীর ধারে, হয়তোবা শুকিয়ে গেছে তার জল ছিল বড় ঘোলোটে একদা, সাইকেলে কদম ঠেলে যেতে যেতে পিতৃপুরুষের আখ ক্ষেতে হাঁটা, কোন মাসে গুড় তৈরী করা গন্ধের বায়ু; কিংবা উল্টো পথে হাওড়ের দেশে, নিরুদ্দেশ- ঢিবি ঢিবি বাড়ি; শুকা প্রান্তর- সেখানে কৃষ্ণা ভাগিনী গিয়ে ভয়ানক তাপ নিয়ে ফিরেছিলো মৃত্যু ও বড় শহরে; তবে সুরম্য কোঠা কি ছিল সেই টাউনে। তবে! যাওয়া তো হয় না জানি জীবনের সব পথই, যদিও এক মুখো।”

কবিতাটি লিখে মেইল করে পাঠিয়ে বললেন, তুমি সেই কবিতাটি তুমার সম্পাদিত মহিনন্দের ইতিকথা বইয়ে ছাপিয়ে দিতে পারো। এ কবিতাকে ইস্যু করেই আমি পরবর্তীতে মহিনন্দের ইতিকথা বইয়ে কাদের মাহমুদ সাহেবের জীবনীটা প্রকাশ করি। বইটি প্রকাশ পেলে হাতে পেয়ে সেসময়ে অনেক খুশি হয়ে বলেছিলেন এই মফস্বল থেকে দারুন একটা ভালো সংকলন করেছো। ধন্যবাদ তুমাকে। এরই মাঝে আমার প্রতিষ্ঠিত সংগঠনের সম্মানিত উপদেষ্টা বাংলা একাডেমীর সদস্য কবি শাহাবুদ্দিন সাহেবও ইন্তেকাল করেন। তাই উনাকে আমি উপদেষ্টা করলে তিনি কোনো আপত্তি করেননি। বলেন থাকি লন্ডনে কি পরামর্শ দেবো। যাক তুমি বলেছো তাই আছি। এর কিছুদিন পরে এক মেইল বার্তায় ইচ্ছে প্রকাশ করলেন নিজ গ্রামে মা বাবা ও স্ত্রীর নামে একটি গবেষণামুলক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলবেন। সে প্রতিষ্ঠানে থাকবে গবেষণাগার, পাঠাগারসহ কল্যাণমুখী প্রশংসনীয় উদ্যোগ। স্ত্রীর বিয়োগে ভেঙ্গে গেলেও স্ত্রীর রেখে যাওয়া টাকা দিয়ে এলাকার উন্নয়নে কিছু করতে চান। তারই লক্ষে প্রথমে ফরিদা মাহমুদ ঝর্ণা পাঠাগার তৈরী করলেন। নবপ্রতিষ্ঠিত পাঠাগারে বিশিষ্ট সাহিত্যিক কলাম লেখক কাদের মাহমুদ এর সাথে প্রথমে যারা যুক্ত ছিলেন তাদের মধ্যে তাঁর চাচাতো ভাই গুরুদয়াল কলেজে ডিগ্রীতে অধ্যয়নরত মাজহারুল ইসলাম,ভাতিজী বেবী নাজনীন ও হেলেনা আক্তার (মহিলা কলেজে অধ্যয়নরত), চাচাতো ভাই শহীদুল্লাহ (রাষ্ট্রবিজ্ঞানে মাস্টার্স), চাচাত ভাই আজিজুল ইসলাম চুন্নু ( ভূমি অফিস হোসেনপুর), চাচাত ভাই আ. মান্নান (সচিব, বড়িবাড়ি ইটনা), ভাতিজা তাহের সাদেক ও চাচাতো ভাই আমিনুল ইসলাম। আমি ছিলাম একজন সহকারী গ্রন্থাগারিক হিসেবে। এই গ্রন্থাগারটি কিভাবে নিবন্ধন করা যায় তাই তিনি গঠনতন্ত্র ও একটি কার্যকরী পরিষদ তৈরী করে তা গ্রন্থাগারিক শহীদুল্লাহ ভাইয়ের মাধ্যমে আমাকে দেন। আমি পাঠাগারটিকে নিবন্ধনের জন্য ফরমে স্থানীয় চেয়ারম্যানের কাছে স্বাক্ষর আনতে গেলে তিনি বললেন স্থানীয় ইউপি সদস্য’র সুপারিশ নিয়ে আসো। তাই স্থানীয় মহিলা সদস্য ফজিলা মেম্বারের কাছ থেকে সুপারিশ নিয়ে চেয়ারম্যান লিয়াকত আলী ভাইয়ের কাছে গেলে তখন তিনি আবেদন ফরমে পাঠাগারটির কার্যক্রম সন্তোষজনক লিখে স্বাক্ষর করে দেন। আমি সেই ফরমটিসহ অন্যন্য কাগজাদি কিশোরগঞ্জ জেলা সরকারী গণগ্রন্থাগারে জমা দিয়ে দেই। পরবর্তীতে তা রেজি:করণ করা হয়। এরই মাঝে পাঠাগারটির মাধ্যমে ২০১০ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর জেলা পাবলিক লাইব্রেরীতে বেসরকারী গণ গ্রন্থাগার সম্মেলনে যোগদান করি। পরবর্তীতে কাদের মাহমুদ সাহেব বাংলাদেশে আসলে সেই বছরের ২০১০ সালের ২৫ ডিসেম্বর জেলা বেসরকারী গণগ্রন্থাগার সমিতির জেলা সম্মেলনে অতিথি হিসেবে অংশ গ্রহণ করেন । সেখানে ফরিদা মাহমুদ পাঠাগারের প্রতিনিধি হিসেবে আমি ও শহীদুল্লাহ ভাই অংশ নেই। তিনি তার প্রতিষ্ঠিত পাঠাগারের উদ্যোগে গ্রামে ও বিভিন্ন স্কুলে শিক্ষাবৃত্তি প্রদান করেন। আয়োজন করেন নরসুন্দা নদীর তীরের বাড়িতে সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতার। সেখানে আমিও অংশ নিলে একটি বই ও লন্ডনী আল্ট্রা পাকো রব্বানী কোম্পানির একটি আধুনিক ঘরি উপহার দেন। যা আজও আমি সজতেœ রেখেছি। সে বছরের পর থেকে উত্তরপাড়ায় আর যাওয়া হয় না। এরপরের থেকে তিনিও কখনো একরাশ অভিমান নিয়ে আর গ্রামে আসেননি। একুশের বইমেলায় আসলেও আবার ফিরে যেতেন লন্ডনে। আমারও ব্যস্ততায় আর যাওয়া হয় না। তবে হুয়াটসএপে যোগাযোগ ছিলো সব সময়। নিজে তদারকী না করায় তাঁর প্রতিষ্ঠিত পাঠাগারটিরও দূরবস্থা চলতে থাকে। এরমধ্যে জেলা সরকারী গণগ্রন্থাগারে জাতীয় গ্রন্থাগার দিবস উদযাপন অনুষ্ঠানের প্রস্ততি সভায় অংশ গ্রহণ করলে এ পাঠাগারের সভাপতি হিসেবে শহীদুল্লাহ ভাই মো: ফিরোজ উদ্দীন ভুঁইয়ার নাম প্রস্তাব করলে আমরাও তাঁকে সভাপতি হিসেবে সমর্থণ করি।

ইতোমধ্যে ২০১১ সালে যেহেতু আমার চ্যালেঞ্জিং কাজ মহিনন্দের ইতিকথা বইটি প্রকাশ করতে পেরেছি তাই বই সংরক্ষণের লক্ষ্যে বইয়ের প্রতি ভালোবেসে আমিও নিজের বাড়িতে মহিনন্দ ইতিহাস ঐতিহ্য সংরক্ষণ পাঠাগার নামে একটি পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করি। সে পাঠাগারের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বাবার বন্ধু বিশিষ্ট ব্যাংকার ফিরোজ উদ্দীন ভুঁইয়া বললেন আমরা যে কাজটি করতে পারিনি সেই কাজটি সাদী করেছে। অর্থাৎ উত্তরপাড়ায় কাদের মাহমুদ লাইব্রেরীর বইগুলো নষ্ট হচ্ছে সেজন্য জায়গাও খুঁজে পাচ্ছেন না। এদিকে স্থানীয় চেয়ারম্যান লিয়াকত আলী সাহেবকে বললে তিনি পরিষদে লাইব্রেরীটি স্থানান্তরের জন্য আহবান করলে ২০২২ সালে তা পুণ:প্রতিষ্ঠা করা হয়। এবারে ফিরোজ কাকা বললেন মনোনীত সভাপতি না হয়ে গণ মানুষের উপস্থিতি সভাপতি হওয়া দরকার। এতে আমি হই বা যে কেউ হতে পারে। যেই কথা সেই কাজ। ফিরোজ উদ্দীন কাকা ইউনিয়নের গন্যমান্য ব্যক্তিবর্গদের ডেকে সবার উপস্থিতিতে একটি কার্যকরী কমিটি গঠন করলেন। এতে তিনি সভাপতি ও সুজিত কুমার দে সাধারণ সম্পাদক করা হয়। একটি উপদেষ্টা কমিটি করা হলে স্থানীয় চেয়ারম্যানসহ সেখানে আমাকেও রাখা হলো একজন উপদেষ্টা হিসেবে।

কাদের মাহমুদ সাহেবের মৃত্যুর সংবাদটি আমার প্রতিষ্ঠিত পাঠাগারের হিতাকাঙ্গী প্রভাষক আবুল হাসেম স্যার জানালে আমি প্রথমে শহীদুল্লাহ ভাইকে ফোন দিই। তিনি মৃত্যুর সংবাদটির সত্যতা নিশ্চিত করলে আমি বিবিসি বাংলার খ্যাতনামা আমাদের প্রতিবেশী ইউনিয়নের কৃতি সন্তান আতাউস সামাদের ভাতিজা সাংবাদিক ও লেখক রেজাউল হাবীব রেজা ভাইকেসহ উনার শুভার্থীদেরকে এ সংবাদটি জানাই। যোগাযোগ করি উনার নাম্বারে। কথা হয় ছেলে যোশান মাহমুদের সাথেও। তিনি জানালেন বাবার অন্ত্যুষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন হতে কিছু প্রক্রিয়া আছে। সেগুলো হলেই লাশ দাফন হবে লন্ডনেই।
কাদের মাহমুদ মূলত একাধারে সাংবাদিক, কবি, ছড়াকার, গল্পকার, শিশুতোষ লেখক, প্রগতিশীল চিন্তা চেতনার প্রবন্ধকার। জীবনের শেষ সময়ের ছিলেন একজন গীতিকার। লিখেছেন কয়েক শতাধিক গানও। কাদের মাহমুদ স্মরণে গত ১৩সেপ্টেম্বর শুক্রবার ভোরের আলো কার্যালয়ে ভোরের আলো সাহিত্য আসরের উদ্যোগে সাংবাদিক ও গীতিকার কাদের মাহমুদের মৃত্যুতে শোক প্রস্তাব গৃহিত হয়। কাদের মাহমুদের জীবনী নিয়ে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন কবি মোতাহের হোসেন। আসরের প্রতিষ্ঠাতা রেজাউল হাবিব রেজার উপস্থাপনায় প্রধান আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন মহিনন্দ ইতিহাস ওইতিহ্য সংরক্ষণ পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা আমিনুল হক সাদী। সভাশেষে মরহুমের আত্মার মাগফিরাত কামনা করা হয়। অপরদিকে গত ১৩ সেপ্টেম্বর বিকেলে জেলা সদরের মহিনন্দ ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ে স্থাপিত ফরিদা মাহমুদ ঝর্ণা পাঠাগারের আয়োজনে আলোচনাসভা ও মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করা হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন পাঠাগারের সভাপতি সমাজসেবক মো: ফিরোজ উদ্দীন ভূঁইয়া। প্রধান অতিথি ছিলেন ইউপি চেয়ারম্যান মো: লিয়াকত আলী। প্রধান আলোচক ছিলেন জেলা বেসরকারী গণগ্রন্থাগার সমিতির সভাপতি মো: রুহুল আমিন। বিশেষ অতিথি ছিলেন মহিনন্দ বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ফজলুল কবীর, মহিনন্দ ইতিহাস ঐতিহ্য সংরক্ষণ পরিষদ ও পাঠাগারের প্রতিষ্ঠাতা আমিনুল হক সাদী, ফরিদা মাহমুদ ঝর্ণা পাঠাগারের সম্পাদক সুজিত কুমার দে, মরহুমের ভাতিজি শিখা, আফজালুর রহমান খান প্রমুখ।

তার মৃত্যুতে কিশোরগঞ্জ ইতিহাস ওইতিহ্য সংরক্ষণ পরিষদ, মহিনন্দ ইতিহাস ঐতিহ্য সংরক্ষণ পরিষদ ও পাঠাগার, ফরিদা মাহমুদ ঝর্ণা পাঠাগার, ভোরের আলো সাহিত্য আসর ও জাতীয় সাংবাদিক সংস্থা পক্ষ হতে শোক জানিয়েছে এবং শোক সন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করেছে।

আমিনুল হক সাদী
সাংবাদিক ও লেখক