সারোয়ার চৌধুরী ও জাতীয় গণতান্ত্রিক সাংস্কৃতিক আন্দোলন
সুদীপ্ত শাহিন:
এক বালক আশপাশের যা কিছুই দেখে, তার দিকেই কৌতুহলী হয়ে ওঠে। ঘর থেকে বের হলে কিংবা স্কুলে আসা-যাওয়ার পথে কোনো এক ফেরিওয়ালা দেখে বা লালসালু পরিহিত কোন সন্ন্যাসী অথবা দোতারা হাতে কোন বাউল দেখে তার পিছু পিছু ছুটতে থাকে। পিছু নিতে নিতে হয়তো একসময় অজানা লোকটির সাথে বালকটির ভাব জমে গেল এবং তার যন্ত্রপাতি ধরে ছুঁয়ে দেখে নিজের কৌতুহল মিটিয়ে চলে আসলো। আরেকদিন হয়ত পাড়ার ক্লাবে, থিয়েটারে সিনিয়রদের কোন একটা নাটক দেখে আসলো। পরের দিন ভাইবোনদের নিয়ে বাসার আঙিনাতে এই নাটক আবার মঞ্চস্থ হলো। শুধু নির্দেশক পাল্টে গেল। নতুন মঞ্চায়নে, নতুন নির্দেশক হলো ডানপিটে বালকটি। এই বালকটিই পরবর্তীতে নাট্যতত্ত্ব গবেষণা, নির্দেশনা ও মঞ্চায়নে জীবনের প্রায় পুরো ঢেলে দিয়েছেন। আলো জ্বালিয়ে গেছেন ময়মনসিংহ অঞ্চল তথা দেশের গোটা নাট্যজগতে। এছাড়াও সুরকার, গীতিকার, নৃত্য-পরিচালনা, নজরুল গবেষণা, লোকসংস্কৃতি চর্চা ও গবেষণা -এরকম বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী সেদিনকার নাছোড় বালকটিই হলেন, এদেশের শ্রমিক-কৃষক-মেহনতী মানুষের অকৃত্রিম বন্ধু, সংস্কৃতিজন সারোয়ার চৌধুরী।
প্রকৃতপক্ষে শিল্প সৃষ্টির প্রেরণা অন্তর্নিহিত থাকে মনুষ্যস্বভাবের বিশিষ্টতার মধ্যে। ক্ষুধা-তৃষ্ণা জৈবিক চাহিদা পশুপাখি এবং মানুষ- উভয় প্রাণীর মধ্যেই আছে। উভয়ই সেগুলো সংগ্রহ করে প্রকৃতির অফুরন্ত ভান্ডার থেকে। পশুপাখিরা পরিতৃপ্তি খুঁজে অবিকৃত বা অসংস্কৃত দ্রব্যের মধ্যে আর মানুষ নেয় নিজের মন মতো রূপ নিয়ে। যেমন- সে খাদ্য গ্রহণ করে মুখরোচক রান্নার পর, পোশাক বানায় নিত্য নতুন পদ্ধতিতে, জৈবিক চাহিদা নিবৃত্তির জন্য পথ খুঁজে নেয়। অন্যান্য প্রাণীর মতো মানুষও পরিশ্রম করে। তবে তার শ্রম সৃষ্টিক্ষম, নতুন সৃষ্টির প্রেরণায় উদ্বেল। বলা যায়, মনুষ্য প্রজাতির মানুষ হয়ে ওঠার নেপথ্য কাজ করেছে তার শ্রমের অন্তর্গূঢ় সৃষ্টিশীল ক্ষমতা। এই ক্ষমতার প্রেরণায় সে নিজেকে ছাড়িয়ে যেতে চায়, বড় কিছু করার স্বপ্ন দেখে। আরো বড় কথা, জড় জগতকে নিজের মতো মানবীয় ও শোভন করার বা প্রকৃতি জগতকে নিজের মতো করে আকাঙ্ক্ষা মানুষের স্বভাবের অন্তর্গত। মানুষের হাতে পাখি কথা কয়, সমুদ্র ক্রন্দন করে, চাঁদ শিশুর মামা হয়। সেজন্য শিল্পসৃষ্টির উৎস হচ্ছে মানব স্বভাবের দ্বৈত প্রেরণা তথা শ্রমের সৃষ্টিক্ষম বৈশিষ্ট্য ও পরিবেশের মানবিকীকরণের আকাঙ্ক্ষা। সাহিত্য ও শিল্পকলার প্রাণভোমরা লুকিয়ে থাকে মানবিকতার মধ্যে – সেটা সৃষ্টি হয় মানুষের দ্বারা ও মানুষের জন্য এবং বেঁচে থাকে মানুষের মধ্যে মাধ্যমে।
মানুষের প্রথম যুগের সমাজ ছিলো সম-অধিকারের, সমবন্টনের ও সমসুযোগ ভোগের বৈশিষ্ট্যে চিহ্নিত। কালপরিক্রমায় সমাজের পরিধি বাড়লে সম্পর্ক জটিল রূপ নেয়, সমবন্টনের সুযোগ নষ্ট হয়ে অধিকাংশের ওপর অল্পের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। শুরু হয় শ্রেণীবিভক্ত শোষণমূলক সমাজ ব্যবস্থা। স্বাধীন অবস্থায় জন্মগ্রহণ করে প্রতিটি শিশুই তখন আটকে পড়ে শোষণের সহস্ত্র জালে। জীবনের পথে সে যতই এগোতে থাকে বন্ধন ততই তীব্রতা পায়। বিরূপ বিশ্বের প্রভাবে তার ব্যক্তিত্ব হয় খন্ডিত, প্রতিভা থাকে অবিকশিত, মানবীয় সৌরভ প্রকাশের পথ না পেয়ে গুমরে গুমরে কাঁদে। এ অবস্থা থেকে মুক্তি দেবার সাধনায়, শোষণের নাগপাশ ছিন্ন করে মানুষের যথার্থ স্বাধীনতায় উপনীত হওয়ার চিন্তায় কমিউনিস্টরা গড়ে তুলে সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠার পথ। সারোয়ার চৌধুরী জীবনভর খুঁজে ফিরছিলেন এ সত্য ও ন্যায়ের পথ। তাঁর সমসাময়িক পরিপাশের্বর রাজনৈতিক পরিমণ্ডল, সামাজিক ও পারিবারিক শ্রেণী অবস্থান এবং সময়ের প্রতিকূলতার মধ্যে সে পথের সন্ধান পেয়েছিলেন একেবারেই জীবনের শেষ ভাগে। তাই বলা যায়, সারোয়ার চৌধুরী জীবনের সিংহভাগ কাটিয়েছেন সত্য ও সংগ্রামের পথের সন্ধান করে। অন্ধকারে হাতড়িয়েও কাটিয়েছেন জীবনের দীর্ঘ সময়। তাঁর সুদীর্ঘ বর্ণাঢ্য জীবনে শিল্প-সাহিত্যে সৃষ্টি ও অবদান অনেক। এসব সৃষ্টিতে তিনি ধরে তুলে ধরেছেন বিদ্যমান সমাজ ও জীবনের যন্ত্রণা ও অস্থিরতার চিত্র। কিন্তু দর্শন ও রাজনীতিতে তাঁর দৃষ্টি স্পষ্ট না থাকায় তুলে ধরতে পারেননি ওইসব যন্ত্রণা থেকে মুক্তির যথাযথ উপায়। যখন প্রয়োজন পড়েছিল জাতি, ভৌগোলিক সীমারেখা, বর্ণ-গোত্র ছাড়িয়ে বিশ্বদৃষ্টিভঙ্গি আঁকড়ে ধরে থাকা। অথচ সেখানে তিনি আটকে গিয়েছিলেন প্রচলিত দৃষ্টির সীমারেখায়, অনেকটা জাতীয়তাবাদী চেতনায়। এর প্রভাব পড়ে তাঁর অনবদ্য নিপুণ শৈল্পিক শিল্পকর্মগুলোতে। যেসব শিল্পকর্মের অভিব্যক্তি ছিল পূর্ণতার অভাবে অতৃপ্তি আর অসমাপ্তিতে সীমিত। যেমন তিনি নিজেও এই তৃপ্ত হওয়ার জন্য ছুটতেন দিকবিদিক। খুঁজে বেড়াতেন কোথায় লুকিয়ে আছে তাঁর শিল্পকর্মের যথাযথ উপসংহার। ফলে শ্রেণী সচেতন রূপে তার শিল্পের প্লট নির্ধারিত না হলেও মুক্তির অন্বেষা থেকে তিনি শিল্পের প্লট বানিয়েছিলেন সাধারণ গরীব দুঃখী, ছিন্নমূল মানুষ ও শ্রমিক-কৃষকের দুর্দশাগ্রস্থ জীবনপুঞ্জকে। তাই তার জীবনের গতিই তাঁকে নিয়ে দাঁড় করায় শ্রেনীহীন সমাজের প্রকৃত স্বাধীন শিল্পকর্ম প্রতিষ্ঠার বিভোর স্বপ্ন দুয়ারে। জীবনের শেষ ভাগে এসে তিনি সামিল হন জাতীয় গণতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির উন্নত সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠার জাতীয় গণতান্ত্রিক সাংস্কৃতিক আন্দোলনে। এই প্রত্যয় নিয়ে যুক্ত হন ধ্রুবতারা সাংস্কৃতিক সংসদ এর সাথে। সংস্কৃতি হচ্ছে মূলত সামাজিক রাজনীতির দীর্ঘ পর্যালোচনাসহ ও রুপ, সুতরাং আর্থসামাজিক অবস্থার গুণগত পরিবর্তন ব্যতিরেখে সংস্কৃতিরও গুণগত পরিবর্তন করা যায় না -এই উপলব্ধি থেকে তিনি যুক্ত হলেন প্রচলিত সমাজব্যবস্থার নিয়ামক সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ, আমলা-মুৎসুদ্ধি পুঁজিবিরোধী জাতীয় গণতান্ত্রিক সংগ্রামে।
গত শতাব্দীর ৪০-এর দশকের শেষের দিকে ময়মনসিংহের একটি সাংস্কৃতিক পরিবারে সারোয়ার চৌধুরীর জন্ম। তাঁর পিতা প্রয়াত বজলুর রহমান চৌধুরী ময়মনসিংহ মূক-বধির স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা। মাতা ইজামন নেছা। তাঁর অন্যান্য ভাইবোনেরাও সংস্কৃতি ও ক্রীড়া জগতে বিশেষ অবদান রেখেছেন। সারওয়ারচৌধুরী বাংলা একাডেমিতে দীর্ঘদিন লোকজ সাহিত্য সঙ্গীত সংগ্রাহকের কাজ করেছেন। তিনি বিভিন্ন গণমাধ্যমে সঙ্গীত পরিচালক ও স্ক্রিপ্ট রাইটারের কাজ করেছেন। নজরুল ও লোক গবেষক হিসেবে তিনি সৃজনশীল প্রতিভার পরিচয় দেন। বহু নৃত্যনাট্য, নাটক রচনা ও পরিচালনা করেছেন। কখনো সুরকার, কখনো যন্ত্রশিল্পী, কখনো প্রাবন্ধিক, কখনো বা গীতিকার, কবি, নাট্যকার -এরকম বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী সারোয়ার চৌধুরী। সাহিত্য সংগীতের বিভিন্ন শাখায় অনায়াসে বিচরণ করেছেন নিজের মতো করে। ময়মনসিংহের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শত বছর পূর্তিতে এবং বড় বড় খেলার আসরে তার রচনা ও সুরারোপ করা থিম সং পরিবেশিত হয়েছে। বিদ্রোহী কবি নজরুল বিষয়ে তার নৃত্যনাট্যসমূহ এবং লোকজ বিষয়ে রচনা ও পরিবেশনাগুলো সুধী মহলে ব্যাপক প্রশংসিত হয়েছে। তাঁর রচিত দুখু বন্দনা “দুখু দুখু দুখুরে” গানটি এবং “ক্ষুদিরাম” নাটকটি ইউটিউব এর মাধ্যমে ছড়িয়ে যাওয়ায় দেশ-বিদেশে ব্যাপক প্রশংসিত হয়েছে। ময়মনসিংহ বিধৌত ব্রহ্মপুত্রকে নিয়ে রয়েছে তাঁর শতাধিক “মরমি গান”। এছাড়া তাঁর উল্লেখযোগ্য মঞ্চায়িত নাটকগুলো হচ্ছে ঃ ফেরারি জবানবন্দী, কাক-তাড়ুয়ার পালা, এখনো মীরজাফর (পুরস্কারপ্রাপ্ত), লিলি পাগলি-হান্টার ওয়ালি, খুশি বিবি, ঘর-শত্রু, শিকার, চলো স্কুলে যাই, গাইনের গীত (লোকনাটক)। মঞ্চায়িত নৃত্যনাট্য হচ্ছে ঃ যদি আর বাঁশী না বাজে, উড়া পঙ্খির দ্যাশে, জহর বেদের পালা, মধুমালা, জননী-বর্ণমালা এবং মিউজিক্যাল ড্রামাঃ বনের জলসায়। প্রকাশিত গ্রন্থসমূহ হচ্ছে ঃ জীবনের আহ্বান, মানুষের কবি নজরুল। ছাড়াও তিনি রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব রফিকউদ্দিন ভুঁইয়া, ভাষা সৈনিক শামসুল হককে নিয়েও পুস্তক প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছিলেন।
শিল্প ও সাহিত্য বিষয়ে শিল্পী ও সাহিত্যিকদের দায় আছে। এ দায়ের প্রাথমিক কর্তব্য হচ্ছে জনগণকে বোঝা ও ভালো করে জানা। বাস্তবতা দেখা যায়, প্রচলিত লেখক ও শিল্পীরা শ্রমিক-কৃষককে ভালোভাবে জানেন না, জনগণের সমৃদ্ধি ও প্রাণবন্ত ভাষার সঙ্গে তাদের পরিচয় নেই। তারা জনগণ থেকে দূরে অবস্থান করেন এবং ফাঁপা জীবনযাপন করেন। এর ফলে তাদের রচনা যে কেবল ভাষার দিক দিয়ে নিরস তাই নয়, উপরন্তু তাদের ভাষায় এমন অনেক মনগড়া অনুপযুক্ত শব্দ থাকে যা অর্থহীন। তারা “একজন বীর যার শক্তি প্রদর্শনের কোন জায়গা নেই” অর্থাৎ “বীর যোদ্ধার” ভাবসাব নিয়ে জনগণের সামনে এমনভাবে আসেন এবং “বীরের” ভূমিকায় অবতীর্ণ হন যে তাদের ভাষা ও শিল্প কর্ম জনগণ বুঝতে পারে না। এ প্রসঙ্গে ম্যাক্সিম দু’কাঁপ নামক একজন সাহিত্যিক দুঃখ প্রকাশ করে বলেছিলেন- “আঙ্গিক সুন্দর, সত্য, যদি তার পেছনেও ভাব থাকে। কপাল যদি সুন্দর হয় তবে তা দিয়ে কি করবে, যদি পিছনে কোন মগজ না থাকে?” তবে সারওয়ার চৌধুরী কপালের পিছনে যে উর্বর মস্তিস্ক ছিল সেটা প্রমাণ করেছেন কাজ ও জীবন যাপন দিয়ে। তিনি সাদামাটা আটপৌরে জীবন যাপন করেছেন এবং গরীব মেহনতী মানুষের সাথে ছিল তাঁর গভীর সাংস্কৃতিক সম্পর্ক। যাদের ভাষা ও জীবন দুই- ই তিনি বুঝতেন।
শ্রেণী সংগ্রাম ও জাতীয় সংগ্রামের বাস্তব অবস্থা নির্ধারণ করছে আজ বিপ্লবী সাহিত্যিকদের চিন্তা ও অনুভূতিকে। কিন্তু গতানুগতিক সাহিত্যিকরা ভাবেন- সবকিছুর উৎস হওয়া উচিত প্রেম- বিমূর্ত স্বাধীনতা, বিমূর্ত সত্য ও বিমূর্ত মানব প্রকৃতি প্রভৃতি হলো তাদের অন্বিষ্ট। এতে প্রমাণিত হয় যে, অত্যন্ত গভীরভাবে এসব সাহিত্যিকরা বুর্জোয়াদের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন। এই প্রভাব থেকে আগাগোড়া মুক্ত হওয়ার জন্য প্রয়োজন বিনীতভাবে বিপ্লবী সাহিত্য অধ্যয়ন করা। সারওয়ার চৌধুরী ছিলেন এক্ষেত্রে “ছাত্রা নাং অধ্য নং তপঃ”। ম্যাক্সিম গোর্কি, বার্টল্ট ব্রেখট, ওমর খৈয়াম, মায়াকোভসকি, নাজিম হিকমত -এঁর জীবনী ও সাহিত্য ছিল তাঁর আরাধনার বিষয়।
আমাদের দেশে প্রগতিশীল শিল্পী-সাহিত্যিক নামে যঁারা শিল্প ও সাহিত্য চর্চা করেন তাঁদের অনেকেই সাহিত্য ও শিল্প কাদের জন্য সে সম্পর্কে পরিচ্ছন্ন ধারণা পোষণ করেন না। প্রকৃতপক্ষে আমাদের সমাজের পরতে পরতে এমন সাহিত্য ও শিল্পকর্ম ছড়িয়ে রয়েছে যেগুলো মূলত শোষক ও অত্যাচারীদের পক্ষেই সাফাই গায়। শিল্পের শ্রেণী অবস্থান অন্বেষণ করলে দেখা যায়- ভূস্বামী শ্রেণীর জন্য রচিত শিল্প ও সাহিত্য হল সামন্ত শিল্প-সাহিত্য, বুর্জোয়া শ্রেণীর জন্য রচিত সাহিত্য শিল্পের নাম বুর্জোয়া সাহিত্য শিল্প এবং সাম্রাজ্যবাদের পক্ষে কাজ করে যে সাহিত্য-শিল্প সেগুলোকে আমরা জাতীয় স্বার্থবিরোধী দেশদ্রোহীর সাহিত্য-শিল্প বলি। যারা বলেন সাহিত্য ও শিল্পকলা শ্রেণীকে অতিক্রম করে যায় প্রকৃতপক্ষে তারা বুর্জোয়া সাহিত্য শিল্পকে ওপরে তুলে ধরে এবং সর্বহারা সাহিত্য-শিল্প কে বাধা দেয়। আজকের যুগের বিপ্লবী ও প্রগতিশীল শিল্পসাহিত্য হচ্ছে শ্রমিকশ্রেণির নেতৃত্বাধীন সাম্রাজ্যবাদবিরোধী, সামন্তবাদ বিরোধী জনগণের সংস্কৃতি।। বুর্জোয়াদের নেতৃত্বাধীন কোন কিছুই জনগণের জন্য হতে পারে না। জনগণ বলতে নিপীড়িত শোষিত সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী শ্রমিক-কৃষক মেহনতি মানুষ। সারওয়ার চৌধুরী তথাকথিত প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীদের সমাবেশে ঘোরাফেরা করলেও তিনি মূলত খুঁজে বের করতেন শ্রমজীবি মানুষদের মধ্য থেকেই সাংস্কৃতিক প্রতিভাকে। মহান মে দিবসে গণসঙ্গীতের জন্য টিম প্রস্তুত করতে তিনি খুঁজে বের করেন রংমিস্ত্রি শ্রমিকদের মধ্য থেকে শিল্পী এবং তাদেরকে যন্ত্র ও সুরে প্রস্তুত করেন গণসংগীত পরিবেশনের উপযোগী করে। দর্জি সেক্টরে কর্মরত লোকদের নিয়ে তিনি উদ্যোগ নেন ডীপ ড্রামা তৈরির। বিভিন্ন নাটক মঞ্চায়নের জন্য তিনি শিল্পী নির্বাচিত করেন কোনো ইলেকট্রিক মিস্ত্রি বা রাজমিস্ত্রী অথবা বস্তিতে জীবন কাটনো কোন ক্ষুরধার শিল্পীকে কিংবা হতদরিদ্র কোন কিশোর-কিশোরীকে।
শেষ বিচারে সাহিত্য ও শিল্পের উৎস একটি মৌলিক বিষয়। আদর্শগত কাঠামোরূপে সাহিত্য ও শিল্পকলা হল মানব মস্তিষ্কে বিশেষ সমাজ জীবনের প্রতিফলনের ফসল। বিপ্লবী সাহিত্য ও শিল্পকলা হল বিপ্লবী লেখক ও শিল্পীদের মস্তিষ্কে মনুষ্য জীবনের প্রতিফলনের ফসল। গণমানুষের জীবন সবসময় সাহিত্য ও শিল্পের জন্য। এর বাইরে প্রাচীন যুগের ও ভিনদেশের সাহিত্য শিল্পও গুরুত্বপূর্ণ উৎস। প্রকৃতপক্ষে প্রাচীনকালের সাহিত্য ও শিল্প উৎস নয়, বরং একটি স্রোতধারা বিশেষ-তাদের কালের ও স্থানের জনসাধারণের জীবনে প্রাপ্ত সাহিত্যিক শৈল্পিক কাঁচামালের ভিত্তিতে আমাদের পূর্বপুরুষ ও ভীনদেশিরা সেগুলো রচনা করেছিলেন। সাহিত্যিক ও শৈল্পিক ঐতিহ্যের সব সুন্দর জিনিসকে অবশ্যই গ্রহণ করা উচিত। প্রাচীন ও বিদেশী সম্ভারকে পরিত্যাগ না করে সেগুলো থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে অগ্রসর হতে হবে। হতে পারে সেগুলো- বুর্জোয়া বা সামন্ত শ্রেণীর সৃষ্টি। কিন্তু উত্তরাধিকারকে গ্রহণ করার সময় বা সেগুলোকে উদাহরণ হিসেবে ব্যবহার করতে গিয়ে আমাদের নিজস্ব সৃজনশীল কর্মের স্থানে সেগুলোকে স্থাপন করার ক্ষেত্রে সতর্ক ও সচেতন থাকা দরকার। কেননা নির্বিচারে তা গ্রহণ ও নকল করা হলে সাহিত্য ও শিল্পে সর্বাধিক বন্ধ্যা ও ক্ষতিকর গোঁড়ামিবাদ প্রতিষ্ঠিত হবে। তাই সম্ভাবনাময় লেখক ও শিল্পীদের অবশ্যই জনগণের মধ্যে যেতে হবে, জনসাধারনের, জীবন ও সংগ্রামের প্রাণবন্ত সর্বাধিক রূপরীতিকে, সাহিত্য ও শিল্পের পর্যবেক্ষণ, উপলব্ধি, সমীক্ষা ও বিশ্লেষণ করার জন্য তাদেরকে দীর্ঘ সময়ের জন্য নির্দ্বিধায় ও সর্বান্তকরণে শ্রমিক-কৃষক-জনতার মধ্যে, সংগ্রামের উত্তপ্ত এলাকায় প্রবেশ করতে হবে। প্রবেশ করতে হবে বৃহত্তম ও সমৃদ্ধতম একমাত্র উৎসে। অন্যথায় শুধু অন্তঃসারশূন্য লেখক ও শিল্পী তৈরী হবে।
বিষয়বস্তুর দিক থেকে মানুষের সমাজ জীবন তুলনাহীন ভাবে প্রাণবন্ত ও সমৃদ্ধ হলেও জনগণ কিন্তু শুধু জীবন নিয়ে তৃপ্ত হতে চায় না। তারা একই সঙ্গে সাহিত্য ও শিল্পের অভিজ্ঞতাও পেতে চায়। কারণ সাহিত্য ও শিল্পে প্রতিফলিত জীবন উচ্চতর মার্গের, তীব্রতর, অধিকতর সংহত, বেশি প্রতিনিধিত্বশীল ও আদর্শরূপের অধিকতর নিকটবর্তী হতে পারে। সে জন্যই দৈনন্দিন জীবনের চেয়ে তা বাস্তব ও অধিকতর সর্বজনীন মনে হয়। যেমন-সমাজে একদিকে আছে ক্ষুধা, শৈত্য ও নির্যাতন। অপরদিকে মানুষের উপর মানুষের শোষণ ও নির্যাতন। এ সত্য সর্বত্র বিরাজিত এবং মানুষ এগুলোকে গতানুগতিক ঘটনা হিসেবে দেখে। লেখক ও শিল্পীরা এ ধরনের দৈনন্দিন ঘটনাকে কেন্দ্রীভূত করেন, সেগুলোর মধ্যকার দ্বন্দ্ব ও সংগ্রামকে প্রতিনিধিত্বশীল রূপ দেন এবং এমন ধরনের শিল্প সৃষ্টি করেন-যা জনগণকে জাগ্রত করে। জনগণের মধ্যে উৎসাহের আগুন জ্বালায় এবং পরিবেশকে বদলানোর জন্যই একতাবদ্ধ হতে ও সংগ্রাম করতে বাধ্য করে। বিভিন্ন দুর্বলতা সত্ত্বেও সাররোয়ার চৌধুরী এ কাজটি নিপুণভাবে করার চেষ্টা করেছেন। তিনি গ্রামে গ্রামে বা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ঘুরে ঘুরে যেমন বিভিন্ন লোকজ ও সমকালীন সাংস্কৃতিক উপাদান গুলিকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছেন, তেমনি খেটে খাওয়া মানুষের বাস্তব জীবন উপলব্ধিতে নিয়ে ও শিল্পের দায় থেকে তৈরি করেছেন বিভিন্ন শিল্পকর্ম। ময়মনসিংহ চরাঞ্চলের মানুষদের ভূমি অধিগ্রহণের নামে বসতভিটা ও জমি থেকে উচ্ছেদের প্রেক্ষাপটে তিনি প্রতিবাদী গান ও পথনাটক নিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন চরাঞ্চলের হাজার হাজার অসহায় মানুষের পাশে। আবার রোহিঙ্গাদের উপর জাতিগত নিপীড়নের সময় রোহিঙ্গা জাতিসত্বা সহ সকল জাতিসত্বা তথা জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের অংশ হিসেবে জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট ও ধ্রুবতারা সাংস্কৃতিক সংসদের উদ্যোগে বিভিন্ন জায়গায় অনুষ্ঠিত করেছেন প্রতিবাদী সাংস্কৃতিক সমাবেশ, গান ও কবিতা।
এই মানুষটি আমাদের মধ্যে আজ আর নেই। কিন্তু রেখে গেছেন তাঁর অবিনাশী কর্মকাণ্ড, যা প্রগতিশীল সংস্কৃতিকর্মীদের জন্য অনুপ্রেরণা হয়ে কাজ করবে। সারোয়ার চৌধুরী প্রমাণ করে গেছেন জীবনের শেষ প্রান্তে এসেও সঠিক পথ খুঁজে পাওয়া যায়। তিনি অন্তত এই সান্ত্বনাটুকু নিয়ে জীবনের শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। সারা জীবন যে পথের সন্ধানে তিনি নিরন্তর পথিক হয়ে ছুটে চলেছিলেন, শেষে এসে তিনি তাঁর আদর্শের বিশ্বস্ত পথের ঠিকানা খুঁজে পেয়েছিলেন। তাই, সারোয়ার চৌধুরী অম্লান হয়ে থাকবেন এদেশের গণমানুষের সংস্কৃতি ও মুক্তিকামি মানুষের মাঝে।