অগ্নিকান্ডের দায় এড়িয়ে যেতে চায় সরকারী দপ্তরগুলি: শ্রমিক সংগঠনের দাবি কাঠামোগত হত্যাকান্ড
তফাজ্জল হোসেন: সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশিত নারায়নগঞ্জের রূপগঞ্জে সজীব গ্রুপের হাসেম ফুড লিমিটেডের মালিকের এক বক্তব্য পাওয়া যায়। সেখানে তিনি দাবি করেছেন, কারখানা হলে দুর্ঘটনা হতেই পারে। আর দুর্ঘটনায় শ্রমিক মারা যেতেই পারে। এই দায় তিনি কেন নিবেন ? তার এই বক্তব্যকে বিভিন্ন সমাজতাত্ত্বিকগণ তার শ্রেণী অবস্থানের স্বপক্ষের সাধারণ নীতি হিসেবেই দেখছেন। চিরায়ত শাস্ত্রের অর্থনীতিবিদগণ মনে করেন, পুঁজির ধর্মই মুনাফা । তাই একজন পুঁজিপতি তার পুঁজিকে রক্ষার জন্য যেনোতেনোভাবেই মুনাফা আদায় করতে চায় । সেখানে মানুষ ও মনুষ্যত্বের বিশেষ কোন মানদন্ড থাকে না।
পুঁজির উপর যেহেতু পুঁজিপতির নিয়ন্ত্রণ নেই, সে কারণে লাগামহীন মুনাফার দৌড়ে পুঁজিপতি এক সময় সর্বনাশের খাদে গিয়ে পড়ে এমনটা মনে করেন অর্থনীতিবিদরা। অর্থাৎ যে শ্রমিককে দিয়ে মালিকের এত মুনাফা অর্জন , অতিরিক্ত মুনাফার জন্য সেই শ্রমিককেই মালিক গিলে খায়। এতে করে একটা সময় সিস্টেম ক্রাশ করে প্রচলিত ব্যবস্থাটাই মুখ থুবরে পড়ে। এ কারণে পুঁজির মালিকরা চায় তাদের নিয়ন্ত্রিত রাষ্ট্র এবং সেই রাষ্ট্রের যন্ত্রসমূহ তাদের স্বার্থ রক্ষার মাধ্যমে তাদের ব্যবস্থাকে রক্ষা করবে। বিশ্লেষকরা মনে করেন, এই ব্যবস্থা রক্ষার জন্যই মূলত বিশ্বব্যাপী বৃহৎ একচেটিয়া পুঁজির মালিকরা ডলার ব্যয় করে শ্রম অধিকার, সুষ্টু কর্মপরিবেশ ও কর্মক্ষেত্রের নিরাপত্তা ইত্যাদি বিষয়ে বিভিন্ন সংস্থা গড়ে তুলেছে।
বাংলাদেশের শ্রম আইন, বিধিমালা এবং দেশে অণুসমর্থিত বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ঘোষণা ও কনভেনশন প্রতিপালন করতে কয়েকটি বিশেষায়িত সংস্থা রয়েছে। এছাড়া বিদেশী একচেটিয়া পুঁজি এবং দেশীয় দালাল পুঁজির অতন্দ্র প্রহরী হিসেবে সরকারও সজাগ সচেষ্ট রয়েছে বলে রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মত। এরকম অবস্থায় শ্রমিকদের নিরাপত্তা ও কর্মক্ষেত্রের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকার ও সরকারী সংস্থা গুলোর দায় রয়েছে বলে শ্রম বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।
বাংলাদেশে শিল্পক্ষেত্রে মূলত: বিদেশী লগ্নী পুঁজি বিনিয়োগ। তাই বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীর চাপে লগ্নী পুঁজির মালিকদের তাগিদে এখানে কারখানার নিরাপত্তা ব্যবস্থার প্রেক্ষিতে কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করা হয় বলে শ্রম বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। এর মধ্যে কিছু কিছু সংস্থা লগ্নী পুঁজির মালিকদের নিজস্ব তদারকিতে চলে এবং কিছু দেশের সরকারের তদারকিতে কার্যক্রম চলে। কারখানা পরিদর্শন সংশ্লিষ্ট বা শিল্প কারখানায় নিরাপদ কর্মপরিবেশ (কমপ্লায়েন্স) দেখভালের জন্য আইএলওসহ বিদেশী সংস্থাগুলোর মধ্যে অ্যাকর্ড, এলায়েন্স অন্যতম। অন্যদিকে সরকার নিয়ন্ত্রিত সংস্থাগুলোর মধ্যে রয়েছে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের আওতাধীণ কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর, শ্রম অধিদপ্তর। এছাড়াও কারখানা সংশ্লিষ্ট নিরাপত্তায় রয়েছে ফায়ার সার্ভিস ও পরিবেশ অধিদপ্তর সহ প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ের নজরদারি।
কর্মক্ষেত্রের নিরাপত্তা বিষয়ে বাংলাদেশের শ্রম আইনে একটি সুনির্দিষ্ট অধ্যায় রয়েছে। অধ্যায়ের ধারা-৬১ অনুযায়ী ভবন ও যন্ত্রপাতির নিরাপত্তার প্রেক্ষিতে বলা হয়েছে , কোন প্রতিষ্ঠানের কোন ভবন বা এর অংশ অথবা এর কোন পথ , যন্ত্রপাতি বা প্ল্যান্ট বা ভবনের অভ্যন্তরীণ বৈদ্যুতিক ব্যবস্থা মানুষের জীবন বা নিরাপত্তার জন্য বিপজ্জনক অবস্থায় থাকলে শ্রম আইনে উল্লেখিত সংশ্লিষ্ট পরিদর্শক প্রতিষ্ঠানের মালিককে লিখিত আদশে দ্বারা ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। তা সত্ত্বেও সংশ্লিষ্ট ত্রুটি মেরামত করা না হলে ঐ প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়ার বিধান রয়েছে।
সরেজমিনে বা বিভিন্ন মাধ্যমে প্রকাশিত উদ্ধার অভিযানে অংশগ্রহণকারী ফায়ার সার্ভিসের এক কর্মকর্তার ভাষ্যমতে, হাসেম ফুড অ্যান্ড বেভারেজের ফুডস ফ্যাক্টরিতে (সেজান জুসের কারখানা) কোন অগ্নিনির্বাপন ব্যবস্থা বা বহির্গমন পথের ব্যবস্থা ছিলো না। কারখানার লাইসেন্স প্রদানের সময় বহির্গমন পথের নকশা (evacuation plan) নিশ্চিত করার দায়িত্ব কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের। সেজান জুসের কারখানার লাইসেন্স প্রদানের সময় কারখানা নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছিলো কি’না কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের নারায়ণগঞ্জের দায়িত্বরত উপমহাপরিদর্শক সৌমেন বড়ুয়ার কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ বিষয়টি দেখার দায়িত্ব ফায়ার সার্ভিসের। কারখানার লাইসেন্স প্রদানের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এই কারখানা ২০ বছর আগে লাইসেন্স নিয়েছে।’ তবে লাইসেন্স নবায়ন করার বিষয়টি তিনি এড়িয়ে যান। অবশ্য কারখানা পরিদর্শনে নিরাপত্তার বিষয়টি লক্ষ্য করা হয়েছিলো কি’না সংশ্লিষ্ট এলাকার শ্রম পরিদর্শক (সাধারণ)নেছার উদ্দিন আহম্মেদ জানান, ‘আমাদেরকে বিগত দুই বছর ধরে শুধু কোভিড সংক্রান্ত নিরাপত্তা পরিদর্শনের কথা বলা হয়েছে’।
কারখানাসমূহের অগ্নি নির্বাপন ও নিরাপত্তার দায়িত্বে রয়েছে বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর। এ বিষয়ে দপ্তর থেকে নিরাপত্তা নিশ্চিত করে কারখানা লাইসেন্সও প্রদান করা হয়ে থাকে। সেজান জুসের কারখানায় ফায়ার সার্ভিস থেকে লাইসেন্স প্রদান করা হয়েছিল কি’না নারায়ণগঞ্জ-০১ এর উপসহকারী পরিচালক মোঃ আব্দুল্লাহ্ আল আরেফীন কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এ বিষয়টি পরিদর্শকরা জানে।’ অগ্নি নিরাপত্তার বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলেও তিনি এড়িয়ে যান। পরবর্তীতে ফায়ার সার্ভিসের সংশ্লিষ্ট পরিদর্শকের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনিও উপসহকারী পরিচালকের কাছে জানার কথা বলে এড়িয়ে যান।
সেজান জুস কারখানায় অগ্নিকান্ডের ঘটনায় ইতিমধ্যে তিনটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এর একটি গঠন করা হয়েছে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অধীনে। তদন্ত কমিটির আহবায়ক হিসেবে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে অধিদপ্তরের যুগ্ম মহাপরিদর্শক (সেফটি শাখার) প্রকৌশলী ফরিদ আহাম্মদকে। তদন্ত কমিটি কি কি বিষয়ে তদন্ত করবে এ বিষয়ে ফরিদ আহাম্মদ জানান, “আমাদের প্রথম কাজ হবে দুর্ঘটনার কারণ উদঘাটন । তারপর দোষীদের চিহ্নিত করা এবং সে প্রেক্ষিতে উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের কাছে সুপারিশ প্রেরণ।”
করোনা ভাইরাস সংক্রমণজনিত কারণে শ্রম পরিস্থিতি মোকাবেলায় শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অধীনে ২৩ টি আঞ্চলিক ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিতে শ্রমিক, মালিক প্রতিনিধিদের সহিত কলকারখানা ও শ্রম অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের রেখে ত্রি-পক্ষিয় করা হয়েছে। কমিটির কার্যাবলীতে কারখানা পরিদর্শনেও শ্রমিক, মালিক প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণ করার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু কারখানা পরিদর্শনে শ্রমিক প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণ তেমন নিশ্চিত করা হয় না বলে কমিটির শ্রমিক প্রতিনিধিদের অভিযোগ রয়েছে। নারায়ণগঞ্জ অঞ্চলের ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট কমিটির শ্রমিক প্রতিনিধি কাওসার আহমেদ পলাশও সে অভিযোগ করেন। তিনি অভিযোগ করে বলেন, “আমাদের কমিটিতে রাখলেও কারখানার কোন সমস্যায় আমাদের অংশগ্রহণ করানো হয় না। অনেক কারখানার বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ থাকলেও কলকারখানা অধিদপ্তরের পরিদর্শকরা এসি রুমে বসে চা-নাস্তা খেয়ে পরিদর্শন করে চলে আসেন। “ এ বিষয়ে নারায়ণগঞ্জ অগ্নিকান্ডের ৩দিন পর ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট কমিটির আহবায়ক ও আঞ্চলিক শ্রম দপ্তরের উপ-পরিচালক মহব্বত হোসাইনের কাছে অগ্নিকান্ড সম্পর্কে ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট কমিটির ভূমিকা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, , ‘অগ্নিকান্ডের ঘটনার পর আমরা এখনো মিটিং করতে পারি নাই। আমরা মিটিংয়ের উদ্যোগ নিচ্ছি। ”
সেজান জুস কারখানায় অগ্নিকান্ডের ঘটনায় ইতিমধ্যে কারখানার মালিকসহ সিনিয়র কয়েকজন কর্মকর্তাকে হত্যা মামলায় গ্রেফতার করা হয়েছে। দেশের শ্রমিক সংগঠনগুলো এ ঘটনাকে কাঠামোগত হত্যাকান্ড বলে দাবি করছে। এ সম্পর্কে বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন সংঘের সাধারণ সম্পাদক এবং শ্রমিক কর্মচারী ঐক্য পরিষদের অন্যতম নেতা চৌধুরী আশিকুল আলম বলেন, বিগত সময়ে মালিকদের দায় দায়িত্বহীনতার কারণে তাজরিন ফ্যাশনে অগ্নিকান্ড, স্পেকট্রাম কারখানায় ধ্বস, রানা প্লাজায় ধ্বস, স্ট্যান্ডার্ড গ্রুপের কারখানায় আগুন, হামীম গ্রুপের কারখানায় আগুন, পুরান ঢাকার কেমিক্যাল কারখানাসহ বিভিন্ন কারখানায় দুর্ঘটনার নামে শ্রমিক হত্যার ঘটনা ঘটলেও দায়ী মালিকদের যথাযথ বিচারের আওতায় আনা হয় নি এবং নিহত আহত শ্রমিকদের যথাযথ ক্ষতিপূরণ প্রদান করা হয় নি। এর ফলে সেজান জুস কারখানায় অগ্নিকান্ডের নামে অর্ধশতাধিক শ্রমিক হত্যা করার ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। এই কাঠামোগত হত্যাকান্ডের জন্য কারখানা মালিককে দায়ী করে তিনি বলেন, কারখানার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট কিছু দপ্তরের সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব রয়েছে। এই হত্যাকান্ডের দায় তারাও এড়িয়ে যেতে পারে না।
চৌধুরী আশিকুল আলম আরো বলেন, প্রতিটি অগ্নিকান্ডের পর তদন্ত কমিটি গঠন এবং নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নানা রকম আলোচনা হলেও কিছুদিন পরই তা থেমে যায় এবং বাধ্য হয়ে শ্রমিকদের অনিরাপদ পরিবেশেই জীবিকার তাগিদে জীবনকে তুচ্ছ করে কাজ করতে হয়। তিনি এই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করে দায়ীদের দৃষ্ঠান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন। এ ছাড়া তিনি মর্মান্তিকভাবে মৃত্যুবরণকারী সকল শ্রমিকদের আইএলও কনভেনশন-১২১ অনুযায়ী একজীবনের আয়ের সমপরিমান ক্ষতিপুরণ, আহত শ্রমিকদের সুচিকিৎসা, উপযুক্ত ক্ষতিপুরণ ও পুর্নবাসন, নিখোঁজ শ্রমিকদের অবিলম্বে উদ্ধার এবং তার সংখ্যা প্রকাশ এবং কর্মরত শ্রমিকদের বেতন বোনাস পরিশোধের আহবান জানান।
এছাড়াও অনুমোদনহীন ও ঝুঁকিপূর্ণ সকল কারখানা বন্ধ করে দেওয়াসহ সকল শ্রমিকদের নিরাপদ কর্মপরিবেশ ও অবাধ ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার নিশ্চিত করার দাবি জানান দেশে সুপরিচিত শ্রমিক নেতা।