অবিলম্বে চা-শ্রমিকদের ন্যায্য দাবি মেনে নিতে হবে- চা শ্রমিক সংঘ
স্টাফ রিপোর্টার: (সারাদেশে আন্দোলনরত চা শ্রমিকদের দাবির প্রতি সংহতি জানিয়ে তা অবিলম্বে মেনে নেয়ার আহবান জানিয়েছে চা শ্রমিক সংঘ। এ প্রেক্ষিতে চা শ্রমিক সংঘের পক্ষ থেকে একটি লিফলেট প্রকাশ করা হয়। লিফলেটের বক্তব্যটি হুবহু তুলে ধরা হলো।)
বাজারদরের সাথে সংগতিপূর্ণ অবিলম্বে মজুরি বৃদ্ধি, পর্যাপ্ত রেশন, সুচিকিৎসা ও ভূমির অধিকারসহ ন্যায্য দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত ধর্মঘট অগ্রসর করুন।
সংগ্রামী বন্ধুগণ,
আমাদের দেশের চা-শ্রমিকরা দেশের সবচেয়ে নিষ্পেষিত ও অবহেলিত শ্রমিক। বর্তমান দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন উর্দ্ধগতির বাজারেও একজন চা-শ্রমিক সর্বোচ্চ দৈনিক ১২০ টাকা মজুরি পান। এই মজুরি দিয়ে বর্তমান বাজারে ১ লিটার তেলও পাওয়া যায় না। এমন কি চা-শ্রমিকদের উৎপাদিত ২৫০ গ্রাম চা-পাতার মূল্যও খোলা বাজারে এর থেকে বেশি। চা-শিল্পের ১৬৮ বছরের ইতিহাসে চা-শ্রমিকদের মজুরি ১৬৮ টাকাও হয়নি। অথচ শ্রমিকদের হাড়ভাঙ্গার পরিশ্রমের ফলশ্রুতিতে চা-উৎপাদনে বাংলাদেশ ৯ম স্থানে উঠে এসেছে। করোনাকালে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চা-শ্রমিকরা উৎপাদনে সক্রিয় থাকায় ২০২১ সালে দেশে ৯৬ দশমিক ৫০৬ মিলিয়ন কেজি চা-উৎপাদনের ফলে নতুন রেকর্ড সৃষ্টি হয়। ফলশ্রুতিতে মালিকদের মুনাফা এবং সাহেব-বাবুদের সুযোগ-সুবিধা বাড়লেও দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন উর্দ্ধগতির এই সময়ে শ্রমিকদেরকে দেওয়া হচ্ছে দৈনিক মাত্র ১২০ টাকা। মালিকদের চুক্তি অনুযায়ী যে মজুরির মেয়াদ ২০২০ সালের ডিসেম্বরে উত্তীর্ণ হয়ে গেছে। চুক্তি অনুযায়ী ২০২১ সালে ১ জানুয়ারি হতে চা-শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি করা কথা, কিন্তু চুক্তির মেয়াদ প্রায় ২০ মাস অতিক্রান্ত হতে চললেও চা-শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি করা হচ্ছে না। এর কারণ হচ্ছে মালিকদের অতিমাত্রায় শোষণমূলক প্রবৃত্তি ও চা-শ্রমিক ইউনিয়নের আপোসকামিতা। বর্তমান দ্রব্যমূল্যের বাজারে দৈনিক তিন বেলা অতি সাধারণভাবে আহারের জন্য ১৫০(৩০+৬০+৬০) টাকায়ও পেট ভরে না। ৫/৭ জনের একটি পরিবারের জন্য ন্যূনতম যেখানে ৬৭০-৭০০ টাকা দরকার সেখানে চা-শ্রমিক ইউনিয়ন দাবিই করেছে মাত্র ৩০০ টাকা। এমন কি ২০২০ সালেও তারা ৩০০ টাকা মজুরির দাবি জানিয়েছিল; দ্রব্যমূল্য কয়েকগুণ বাড়ার পরও তারা ৩০০ টাকা মজুরির দাবিতে আটকে আছে । অথচ প্রতিবেশি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের চা-শ্রমিকরা দৈনিক ২৩২ রুপি(২৭৭ টাকা) পেয়েও মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে আন্দোলন করছেন। চা-বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী দেশের ১৬৭ টি চা-বাগানে ৫ লক্ষাধিক চা-জনগোষ্টির মধ্যে স্থায়ী শ্রমিক প্রায় ১ লাখ, সেই হিসেবে একজন শ্রমিকের মজুরি দিয়ে কমপক্ষে ৫ জনকে ভরনপোষণ করতে হয়। বর্তমান দুর্মূল্যের বাজারে ৩০০ টাকা মজুরি পেলেও তো সেটা সম্ভব না। সরকার দলীয় এমপি উপাধ্যক্ষ ড. আব্দুশ শহীদ জাতীয় সংসদে একাধিকবার চা-শ্রমিকদের জন্য কমপক্ষে ৫০০ টাকা মজুরির পক্ষে বক্তব্য তুলে ধরেছেন, সেখানে চা-শ্রমিক ইউনিয়নের এই ভূমিকা প্রশ্নসাপেক্ষ। প্রতিবেশি ভারত, শ্রীলঙ্কা, নেপালসহ শীর্ষ চা উৎপাদনকারী দেশ চীন ও কেনিয়ার চেয়ে আমাদের দেশের চা-শ্রমিকদের মজুরি অনেক কম। আমাদের দেশের সরকার কথায় কথায় উন্নয়নের ফিরিস্তি দিয়ে থাকে এবং বিভিন্ন অর্থনৈতিক সূচকে প্রতিবেশিদের থেকে বাংলাদেশ অনেক এগিয়ে থাকার কথা বলে। অথচ পাশর্^বর্তী দেশগুলোর চা শ্রমিকদের চেয়ে আমাদের দেশের চা শ্রমিকের মজুরি অনেক কম। এমন কি দেউলিয়া হয়ে যাওয়া শ্রীলঙ্কার চা-শ্রমিকরাও আমাদের চা-শ্রমিকদের চেয়ে বেশি মজুরি পান। সরকারি তথ্য মতে, দেশে মাথাপিছু আয় ২,৮২৪ ডলার অর্থাৎ ২ লাখ ৬৮ হাজার ২৮০টাকা (১ ডলার =৯৫ টাকা হিসেবে); সেখানে আমাদের চা-শ্রমিকদের সর্বোচ্চ আয় মাসিক ৩,৬০০ টাকা হিসেবে বার্ষিক মাত্র ৪৩,২০০ টাকা।
সংগ্রামী বন্ধুগণ,
চা-শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে চলমান আন্দোলনে শ্রমিকদের সর্বাত্মক অংশগ্রহণে ইতিহাস সৃষ্টি হয়েছে। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত এই আন্দোলনকে লাগাতার ধর্মঘটে পরিণত করে বাজারদরের সাথে সংগতিপূর্ণ মজুরি আদায় করতে হবে। এক্ষেত্রে মালিকপক্ষ এবং বিবদামান বিভিন্ন পক্ষের ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত সম্পর্কে সজাগ সচেতন থেকে আপোসহীন সংগ্রাম চালাতে হবে। চা-শ্রমিক ইউনিয়নের নেতৃত্বের ক্ষমতা দখলের দ্বন্দ্বে বিবদমান একপক্ষ সরকারি দল ও প্রশাসনের সাথে সর্ম্পকিত হয়ে ক্ষমতায় যেতে যেমন সচেষ্ট; তেমনি অন্যপক্ষও ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য তৎপর। এক্ষেত্রে আন্দোলনকারী শ্রমিকদের সচেতন থাকতে হবে যাতে কোন পক্ষের উদ্দেশ্যমূলক লক্ষ্য হাসিলের জন্য আন্দোলনকে ব্যবহার করতে না পারে।
বন্ধুগণ,
গুঞ্জন শুনা যাচ্ছে, ২০ টাকা মজুরি বৃদ্ধি করে সমঝোতা হতে পারে। আবার যে সমঝোতা হবে তার মেয়াদ হবে আগামী ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত, এভাবে প্রতিবারই বিলম্বিত চুক্তির কারণে শ্রমিকদের একটার্মের মজুরি বৃদ্ধি মার খাচ্ছে। নির্ধারিত সময়ে মজুরি বৃদ্ধি হলে এই ২০ মাসে শ্রমিকরা তার সুফল পেত। তা থেকে বঞ্চিত করে দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন বৃদ্ধির এই সময়ে নামকাওয়াস্তে মজুরি বৃদ্ধির সমঝোতা শ্রমিকদের পিঠে ছুরিকাঘাত করার সামিল হবে। আর এই মুহুর্তে এরকম আপোসকামী চুক্তি/সমঝোতা হলে নিকট ভবিষ্যতে আরও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির ভয়াবহ দিনগুলোতে শ্রমিকদের কি দশা হবে? তাই চলমান আন্দোলনে চা-শ্রমিকদের ঐক্যবদ্ধ থেকে সকল ধরনের আপোসকামিতা ও ষড়যন্ত্র-চক্রান্তের বিরুদ্ধে সজাগ, সচেতন থেকে কোন রকম ছাড় না দিয়ে ৩০০ টাকা মজুরি আদায়ে অটল থেকে ধর্মঘট চালিয়ে যেতে হবে।
সাথীরা,
বর্তমান বাজারদরের আস্বাভাবিকতা ও অস্থিতিশীলতা বিচ্ছিন্ন কোন বিষয় নয়। বিশ্বব্যাপী চলমান মন্দায় করোনা পরিস্থিতি এবং ইউক্রেনকে কেন্দ্র করে ন্যাটো ও রাশিয়ার আন্তঃসাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ বিশ^ পরিস্থিতিকে আরও জটিল, কঠিন ও অনিশ্চিত করে তুলেছে। এর সাথে তাইওয়ানকে কেন্দ্র করে মার্কিন-চীন মুখোমুখি অবস্থান বিশ^ জনগণের জীবন ও জীবিকাকে আরও অনিশ্চিত করছে। এই অবস্থায় শ্রীলঙ্কার মতন পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার আশংকায় বাংলাদেশসহ ১২ টি দেশ হুমকির সন্মুখীন। দেশের অর্থনীতি দেওলিয়াত্ব অবস্থায় পতিত হলে দুর্ভিক্ষ অত্যাবশ্যক হিসেবে সামনে আসবে। উদ্ভুত পরিস্থিতিতে একদিকে আমাদের না খেয়ে মরতে হবে; অন্যদিকে যুদ্ধের গুলি ও বোমার আঘাতে মরতে হবে।
বন্ধুগণ,
শ্রমিক আন্দোলনকে সফল করতে হলে অপরিহার্য হচ্ছে সৎ, সংগ্রামী, আপোসহীন, শ্রেণি সচেতন সংগঠন ও নেতৃত্ব। আমাদের দেশে চা-শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাসে শ্রমিকনেতা মফিজ আলীর নেতৃত্বে চা-শ্রমিকদের আপোসহীন আন্দোলন আজও স্মরণীয়। চা-শ্রমিক সংঘের পতাকাতলে সমবেত হয়ে চা-শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরিসহ অধিকার আদায়ে সংগঠিত ও ঐক্যবদ্ধ হয়ে বৃহত্তর আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। এজন্য শ্রমিকস্বার্থ বিরোধী নেতৃত্বকে প্রত্যাখান করে বাগানে বাগানে, ভ্যালীতে ভ্যালীতে চা-শ্রমিক সংঘের কমিটি দাঁড় করিয়ে অগ্রসর হতে হবে।
চা-শ্রমিক সংঘ
৩/১৩ সুরমা মার্কেট(২য় তলা), ক্বীনব্রিজ সংলগ্ন, সিলেট-৩১০০। তারিখঃ ১৪ আগষ্ট ২০২২।