করোনা: ধণিক শ্রেণি ও তাদের রাষ্ট্রসমূহ
অসীম দাদ খান: ভারতের করোনা আক্রান্তদের কষ্ট, আহাজারি, স্বজনদের আর্তনাদের ছবি দেখে মন খারাপ সারা বিশ্বের মানুষের। যেমন করে মানুষ কষ্ট পেয়েছিলো ২০২০ সালে ব্রাজিল,আমেরিকা ও ইতালির অবস্থা দেখে। কিন্তু ভারতের অবস্থা তাদের থেকে আরো ভয়াবহ। প্রতিদিনই বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যা। সাথে সংক্রমণও। অথচ ভারতসহ বিশ্বের অন্যান্য স্বাস্থ্য গবেষকরা এ রকম পরিস্থিতির আশংকা করে অনেক পূর্ব থেকে সতর্ক করেছিলো ভারত সরকারকে। শীত আসলে বাড়তে পারে করোনা- বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার কল্যাণে আমরা তা শুনেছি। কিন্তু শীতে করোনা ভাইরাসের তেমন সংক্রমণ বৃদ্ধি না পাওয়ায় জনমনে এক ধরনের স্বস্থিও প্রকাশ ঘটে। ফলে প্রথম প্রথম সাধারন জনগণ করোনা ভাইরাসের প্রেক্ষিতে আতংকিত হয়ে খুব গুরুত্ব দিলেও পরে অনেকটা উদাসীন হয়ে যায়। অনেকটা পেটের দায়েই স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালনে আর পাত্তা দিতে চাইলো না। এছাড়া ইসলামিক সভা-সমাবেশসহ সামাজিক ও রাজনৈতিক অনুষ্ঠানও চলে পাল্লা দিয়ে। সাধারন অসচেতন মানুষদের মৌলিক প্রয়োজন মেটাতে বিভিন্ন কাজকর্ম পরিচালনা করতে যেয়ে স্বাস্থ্যবিধি না মানার প্রবণতা তৈরি হতে পারে, এটা স্বাভাবিক। কিন্তু রাষ্ট্রকে সে ব্যাপারে সচেতন ও উদ্যোগী থাকতে হয়। ভারত সরকারের উচিত ছিলো বিশেষজ্ঞের মতামতকে গুরুত্ব দিয়ে প্রথমত জনগণকে বিভিন্ন মাত্রায় সতর্ক করা। অর্থাৎ যুদ্ধের পূর্বে মানুষ যেমন প্রস্তুতি নেয় ঠিক তেমন করে করোনার দ্বিতীয় তরঙ্গ মোকাবেলার জন্য সর্বোচ্চ প্রস্তুতি নেয়া । কিন্তু ভারত সরকার কি করলো, তা সকলেই অবগত আছেন। শাসকগোষ্ঠীর ক্ষমতার পালাবদলের জন্য বিরাট বিরাট জনসমাবেশ ঘটিয়েছে, ভোটের রাজনীতিতে লাভের পাল্লা ভারী রাখতে ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান পালনের উৎসাহ যুগিয়ে ব্যাপক মানুষের সমাবেশ ঘটিয়েছে- স্বাস্থ্যবিধি লঙ্ঘন করে এসব কর্মকান্ডের মাধ্যমে ভারত সরকার করোনার ২য় তরঙ্গের বিস্তৃতি দ্রুত ঘটায় বলে এখন বিশেষজ্ঞদের মত। ঠিক একই চিত্র বাংলাদেশের । বাংলাদেশের শাসকগোষ্ঠীও ধর্মীয় সমাবেশ অনুষ্ঠানের আস্কারা দেওয়াসহ রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন কর্মসূচিতে ব্যাপক জনসমাগম ঘটিয়ে করোনার ২য় তরঙ্গ বিস্তৃতি ঘটায়। যা বিশেষজ্ঞরা এখন আশংকা করছেন ভারত ভ্যারিয়েন্টের মাধ্যমে দেশে ৩য় তরঙ্গ বিস্তৃতির ভয়ানক পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। অন্যদিকে সরকারগুলির জনগণের রুটি-রুজির দায়-দায়িত্ব নেয়ার ক্ষেত্রে বরাবরই উদাসীন এবং প্রদর্শনীমূলক কর্মসূচি নিয়ে থাকে। বাংলাদেশে গার্মেন্টস মালিকদেরসহ শিল্পখাতে হাজার হাজার কোটি টাকা প্রণোদনা দেয়া ছাড়া সরকারের উল্লেখযোগ্য আর কিছু চোখে পড়েনি। আর অসহায় ও কর্মহীন মানুষদের নামকাওয়াস্তে ত্রাণ সরবরাহ করার নামে নানা বিষয়ে দুর্নীতির চিত্রও উল্লেখযোগ্যভাবে দৃশ্যমান হচ্ছে।
করোনার দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবেলায় ভারত কতটা প্রস্তুত ছিলো তা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ভারতে বর্তমানে হাসপাতালগুলোতে ১০ হাজার মানুষের জন্য ৫.৩টি বেড রয়েছে । প্রতি এক লাখ মানুষের জন্য ২/৩ টি ক্রিটিক্যাল কেয়ার বেড রয়েছে। এশিয়ায় টাইমসের খবর অনুযায়ী গোটা ভারতের ১৩০ কোটি মানুষের জন্য মাত্র ৪৮ হাজার ভ্যান্টিলেটর রয়েছে। যার মধ্যে শুধু কেরালায় রয়েছে ৩৭৭৬ টি । সরকারী-বেসরকারী খাত মিলিয়ে কেরালা আইসিইউ এর সংখ্যা ৯৭৪৫টি । কেরালায় দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক-সংস্কৃতি অন্য রাজ্যগুলির তুলনায় কিছুটা উন্নত হওয়ায় স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়ে তারা অনেকটা এগিয়ে। কিন্তু ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের করোনা প্রস্তুতি ছিলো একবারে নামেমাত্র। অপরদিকে ভারতের কেন্দ্র শাসিত মোদী সরকার গত বছরে সামরিক খাতে খরচ করেছে ৭৩০০ কোটি মার্কিন ডলার। করোনার প্রভাবে অর্থনীতি ও স্বাস্থ্যসেবা যখন বিশাল ধাক্কা খেলো তখনো সমরাস্ত্র ও গোলাবারুদের পেছনে খরচ বাড়িয়েছে মোদী সরকার। যেনো মানুষকে বাঁচানো নয়, মানুষকে মারাই তাদের লক্ষ্য। গত বছর ভারতে স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় জিডিপির ১.২৬%, যেখানে সামরিক ব্যয় জিডিপির ২.৯%। যা বিশে^র তৃতীয় সর্বোচ্চ। পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায় সামরিক খাতের বিনিয়োগ স্বাস্থ্য খাতের দ্বিগুণের বেশি। ২০২০ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের পরে সামরিক ব্যয়ের দিক থেকে ভারতের অবস্থান তৃতীয়। অস্ত্র আমদানিকারক শীর্ষ দেশের মধ্যে ভারতের অবস্থান দ্বিতীয়। ভারতের সামরিক ব্যয় বেড়েছে ৭২.৯ বিলিয়ন ডলার যা বিশে^র মোট ব্যয়ের ৩.৭%।
ভারতে যখন প্রতিদিন জ্যামিতিক হারে আক্রান্ত মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে, তখন সেখানকার ধনী ও সুপার ধনীরা ভারত থেকে পালাতে ব্যস্ত। বিভিন্ন রুটে কর্মাসিয়াল ফ্লাইটগুিলি বন্ধ হয়ে প্রাইভেট জেট কোম্পানির চাহিদা বেড়েছে। অেেনকে গ্রুপ করে প্রাইভেট জেটে করে পাড়ি জমাচ্ছেন বিভিন্ন দেশে। ভারতের অধিকাংশ ধনীরা গন্তব্য হিসেবে বেছে নিয়েছে দুবাইকে। ভারতে করোনা সুনামি আকারে ছড়িয়ে পড়ার পর থাইল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশে যেতে চাইলেও পাচ্ছে না ফ্লাইট। করোনার কারণে ভারতীয়দের উপরে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে । ল-ন টাইমস এর খবরে জানানো হয়েছে, ভারতে নিষেধাজ্ঞা আরোপের পূর্বেই কমপক্ষে ৮ টি প্রাইভেট জেটে করে ভারতের অনেক সুপার ধনীরা ল-নে অবতরণ করেছেন। এয়ার চার্টারস সার্ভিস ইন্ডিয়ানের একজন মুখপাত্র সংবাদ সংস্থা এএফপিকে বলেন, প্রাইভেট জেটের জন্য মানুষ পাগলের মত ঝাঁপিয়ে পড়েছে। দুবাইতে ১২টি জেট ছিলো, যা মূহুর্তে শেষ হয়ে যায়। আনছাল এভিয়েশনের আরেকজন মুখপাত্র বলেন, আরো প্লেন নামানোর জন্য অনুরোধ করা হচ্ছে । আমরা ৩৮ হাজার ডলার ১৩ সিটের এয়ার জেট ভাড়া করেছি বোম্বাই থেকে দুবাই রুটের জন্য। অনেকে থাইল্যান্ডে ফ্লাইট পরিচালানোর জন্য অনুরোধ করেছেন। অধিকাংশ অনুরোধ করেছে দুবাই যাওয়ার জন্য। এশিয়ান টাইমস এর খবরে বলা হয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাতে ৩৩ লক্ষ ভারতীয় রয়েছে । এদের অধিকাংশ বসবাস করে দুবাইতে । ভারতীয় ধনীক শ্রেণীর হিড়িকে ১০ গুণ বেড়েছে প্লেনের ভাড়া। ২৩ ও২৪ এপ্রিল বোম্বাই টু দুবাই যাত্রী বাহি প্লেনের ভাড়া ছিলো ১০০০ ডলার। স্বভাবতই প্রশ্ন জাগছে, কেন এভাবে পালাচ্ছে সুপার ধনীরা? ভারতে এভাবে দেশত্যাগের কারণ হচ্ছে, করোনা সুনামিতে আক্রান্ত ভারত এখন ভয়ংকর মৃত্যুপুরি। পর্যাপ্ত পরিমাণ ডাক্তার, নার্স, হাসাপাতাল বেড ও জীবন রক্ষাকারী অক্সিজেন নেই। তারা ভাবছে, তারা যদি অসুস্থ হয়, তাহলে কিভাবে বাঁচবে ? মৃত্যুর নারকীয় দৃশ্য ভাসছে তাদের সামনে। সুপার ধনীদের দেশ ত্যাগের খবর নিয়ে ২৫ এপ্রিল ইন্ডিয়ান টাইমস এর একটি খবর ছিলো -ওহফরধহ’ং ংঁঢ়বৎ ৎরপয ভষবব ঁহরসধমরহধনষব যড়ৎৎড়ৎ!’ ১লা মে ২০২১ করোনায় সর্বোচ্ছ মৃত্যু ও সনাক্ত নিয়ে ২৪ ঘন্টায় বিশে^র শীর্ষে অবস্থান করছে ভারত। একদিনে দেশটিতে প্রাণ গেছে ৩৫২২ মানুষের এবং নতুন সনাক্ত হয়েছে ৪ লাখ ২ হাজারেরও বেশি । করোনা সংক্রমণের পর বিশে^র যেকোন দেশের একদিনে সর্বোচ্ছ । বিবিসি সহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম তাদের প্রতিবেদনে বলেছে- ভারতে ২৪ ঘন্টা দিনে রাতে বিভিন্ন শ্মশানে চলছে চিতার আগুন । আকাশ ছেয়ে আছে কমলা রং এর ধোঁয়ায়। আরো বিভিন্ন ঘটনায় প্রমাণিত হয় যে, বাস্তবে আক্রান্ত ও মৃত্যৃও সংখ্যা অনেক বেশি।
২০২০ সালে করোনা যখন ইউরোপ আমেরিকায় ভয়াবহ আকাওে ছড়িয়ে পড়ে তখন বিভিন্ন সুপার এইভাবে ইয়টে গোপন আশ্রয় নিয়েছিলো । অনেক সুপার ধনী কিনে নেয় নির্জন দ্বীপ, সাগর তীরের ভিলা, মাটির তলায় বিলাস বহুল বাংকার। অথচ ধনীক শ্রেণী মহামারীর কারণে বিশ্ব অর্থনীতি ও মানব সমাজে যে সংকট তৈরি হয়, তার দায় চাপিয়ে দিয়েছে কেবল বিশ্ব শ্রমিক শ্রেণী ও জনগণের কাঁধে। এই কারণেই বিশ্বব্যাপী ছাঁটাই, নির্যাতন ও বেকারত্ব বৃদ্ধি করে এবং শ্রম-ঘনত্ব বাড়ানোসহ সামগ্রিকভাবে শোষণ তীব্রতর করে বিশ্ব পুঁজিপতিগোষ্ঠী শ্রমিকশ্রেণীর শত শত বছরের লড়াইয়ের মাধ্যমে অর্জিত অধিকারসমূহ হরণ করেছে। ফলে পৃথিবীব্যাপী অনাহারক্লিষ্ট ও ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা ব্যাপক বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২০ সালে অনাহারে দিন কাটিয়েছে বিশ্বের ২৭ কোটি মানুষ, যা ২০১৮ সালে ছিল ১৫ কোটি এবং ২০১৮ সালে অনাহারে প্রতিদিন যে ২৫ হাজার মানুষের মৃত্যু বরণ করেছে ২০২০ সালে তা আরো পঞ্চাশ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এর বিপরীতে করোনা অতি মহামারীর দিনে আরো ধনী হয়েছে দুনিয়াার অতি ধনীরা। গত বছরের মার্চ থেকে তিন মাসে আমেরিকার বিলিওয়েনাদের ঝুলিতে জমা পড়েছে ৫৬৫ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে জানুয়ারি থেকে আমাজনের মালিক জেফ বেজোসের লাভ হয়েছে ২৫ মিলিয়ন ডলার। কারণ অনলাইনে কেনাকাটা ব্যাপক বেড়েছে। জুলাইয়ের ১০ তারিখে একদিনে বেজোস এর ১৩ বিলিয়ন ডলার লাভ হয়েছে। ২০২০ সালে তার সম্পত্তির পরিমাণ ৭৪ বিলিয়ন ডলার বেড়ে হয়েছে ১৮৯ বিলিয়ন ডলার। অন্যান্য যারা মার্কিন বিলিওয়েনার বিপুল লাভ করেছে তার মধ্যে জুমের সিইও এরিক ইউয়ান এবং মাইক্রোসফটের প্রাক্তন সিইও স্টিভ বালমের অন্যতম । বালমের স্কাইপির মালিক। দুজনেই ভিডিও কনফারেন্স থেকে লাভ করেছে। ফেসবুকের মার্ক জুকারবার্গ এবছর ৯.১ বিলিয়ন ডলার লাভ করেছে। ১০ আগস্ট চতুর্থ বৃহত্তম ধনী ব্যক্তি মুকেশ আম্বানির সম্পত্তি বেড়ে হয়েছে ৭৯ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার। এ বছর তার সম্পত্তি বেড়েছে ২২ বিলিয়ন ডলার। করোনা মহামারীতে ঔষধ কোম্পানিগুলিও ব্যাপক হারে মুনাফা অর্জন করেছে। তাছাড়া নিউইয়র্ক থেকে টোকিও পর্যন্ত শেয়ারবাজার বেড়েই চলেছে। ফটকাবাজদের উৎসব চলছে। স্টক মার্কেটের এমএসসি বিশ্বসূচক ৬.৬ শতাংশ বেড়েছে আগস্টে। বাংলাদেশে করোনা টিকার এজেন্ট চলতি বছরের গত নয় মাসে বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালসের মুনাফা বেড়েছে ৪০ শতাংশ। যার বড় একটা অংশ এসেছে ভারত থেকে ভ্যাকসিন আমদানির মাধ্যমে। ২০২০ সালের জুলাই থেকে ২০২১ সালের মার্চ পর্যন্ত সময়কালে পুঁজিবাজারের তালিকাভুক্ত এই ওষুধ প্রস্তুতকারক কোম্পানিটির মুনাফা ১০৭ কোটি টাকা বা ৪০ শতাংশ বেড়ে ৩৬৯ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। বেক্সিমকোর আর্থিক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ভারত থেকে ৫০ লাখ ডোজ ভ্যাকসিন এনে তা সরকারকে সরবরাহের মাধ্যমে ৩৮ কোটি টাকা লাভ করেছে প্রতিষ্ঠানটি। অর্থাৎ প্রতি ডোজ ভ্যাকসিনে তাদের লাভ হয়েছে ৭৬ দশমিক ৭৪ টাকা বা প্রায় ৭৭ টাকা। ভ্যাকসিন আনার ক্ষেত্রে সরকার ও ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের সঙ্গে ত্রিপক্ষীয় চুক্তির পর পুঁজিবাজারে কোম্পানিটির শেয়ারের দর দ্বিগুণেরও বেশি বেড়েছে। গত বছরের ৫ নভেম্বর তিন কোটি ডোজ ভ্যাকসিন আনার এই ত্রিপক্ষীয় চুক্তি হয়।
পুঁজিবাদের বেসামাল বিকাশ এবং গুটি কয়েকজনের হাতে পুঁজি কেন্দ্রীভূত হওয়ার কারণে তার নিজের মধ্যেই এর ধ্বংসের বীজ নিহিত থাকে। লন্ডনে অনুষ্ঠিত ‘কনফারেন্স অন ইনক্লুসিভ ক্যাপিটালিজম: বিল্ডিং ভ্যালু অ্যান্ড রিনিউয়িং ট্রাস্ট’ শীর্ষক এক আয়োজনে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) প্রধান ক্রিস্টিন লাগার্ড বলতে বাধ্য হয়েছেন যে বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ৮৫ জনকে আটানোর জন্য লন্ডনের একটি দোতলা বাসই যেখানে যথেষ্ট, সেখানে তাঁদের নিয়ন্ত্রণে থাকা মোট সম্পদের পরিমাণ বিশ্বের ৩৫০ কোটি দরিদ্র মানুষের সম্পদের সমান৷ তিনি বলতে বাধ্য হয়েছেন, বৈষম্য যত বাড়বে, পুঁজিবাদ ততটাই কম অংশীদারমূলক হবে৷ অঙ্কের হিসাবে ওই ৮৫ জনের সম্পদের পরিমাণ তুলে ধরা সম্ভব হলেও তা বোঝানো প্রায় অসম্ভব৷ ক্রিস্টিন লাগার্ডের আগে এ কথাগুলো বলেছিল বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা, অক্সফাম৷ তাদের এক প্রকাশনায় তারা এই ৮৫ জনের মোট সম্পদের পরিমাণ অর্থমূল্যে ১ দশমিক ৭ ট্রিলিয়ন ডলার বলে উল্লেখ করে৷ মহামারীর কারণে বিশ্ব অর্থনীতি ও মানব সমাজে যে সংকট তৈরি হয়, তার দায় চাপিয়ে দেয়া হয়েছে কেবল বিশ্ব শ্রমিক শ্রেণী ও জনগণের কাঁধে। এই কারণেই বিশ্বব্যাপী ছাঁটাই, নির্যাতন ও বেকারত্ব বৃদ্ধি করে এবং শ্রম-ঘনত্ব বাড়ানোসহ সামগ্রিকভাবে শোষণ তীব্রতর করে বিশ্ব পুঁজিপতিগোষ্ঠী শ্রমিকশ্রেণীর শত শত বছরের লড়াইয়ের মাধ্যমে অর্জিত অধিকারসমূহ হরণ করেছে। ফলে পৃথিবীব্যাপী অনাহারক্লিষ্ট ও ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা ব্যাপক বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২০ সালে অনাহারে দিন কাটিয়েছে বিশ্বের ২৭ কোটি মানুষ, যা ২০১৮ সালে ছিল ১৫ কোটি এবং ২০১৮ সালে অনাহারে প্রতিদিন যে ২৫ হাজার মানুষের মৃত্যু বরণ করেছে ২০২০ সালে তা আরো পঞ্চাশ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
করোনা অতি মহামারীতে পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী ব্যবস্থা রক্ষায় বিশে^র রাষ্ট্রগুলি শ্রমিক-কৃষক-জনগণকে খাদ্য ও চিকিৎসা প্রদানে ব্যর্থ হলেও বিশ্বব্যাপী পুঁজিপতিদের রক্ষায় বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ঋণ ও অনুদান নামে ক্ষতিপূরণ ও আর্থিক সাহায্য দিতে দিতে নিজেরা দেনায় ডুবে গিয়েছে। বরাবরই সমস্ত সংকটের মতো এবারও সংকটের ভার চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে শ্রমিকশ্রেণীর উপর। বছরের পর বছর ধরে চলতে থাকা ব্যয় সংকোচন ও আক্রমণের পরে আজকের এই পরিস্থিতির শ্রমিক-জনগণের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। তাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বার্লিন,প্যারিস,ভিয়েনা, জুরিখ, কোপেনহেগেনসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে লকডাউনের বিরুদ্ধে ও ছাঁটাই-নির্যাতন-বেকারত্বের বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রতিবাদ অনুষ্ঠিত হয়। একচেটিয়া পুঁজির স্বার্থে প্রণীত মুৎসুদ্দি পুঁজির প্রতিনিধি ভারত সরকারের কৃষক-জনগণ বিরোধী কৃষি বিলের বিরুদ্ধে ভারতের লক্ষ লক্ষ কৃষক-জনগণকে রাজধানী দিল্লি ঘেরাও করতে হয়েছে। বিশ্ব পুঁজিবাদের আজকের পরিস্থিতি গণ-ছাঁটাই, বেকারত্ব, জীবনমানের পতন এবং আক্রমণ ছাড়া শ্রমিকশ্রেণীকে আর কিছুই দেওয়ার নেই। এই পরিস্থিতি বিশে^ শ্রেণী সংগ্রাম তীব্র করতে বাধ্য। যে সংগ্রামের মধ্য দিয়ে শ্রমিক শেনীর একমাত্র করণীয় হবে পুঁজিবাদী-সা¤্রাজ্যবাদী ব্যবস্থার অবসান ঘটিয়ে শ্রমিক শ্রেণীর একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠা করা।
Muchas gracias. ?Como puedo iniciar sesion?