আন্তর্জাতিক

কোভিড কেড়ে নিচ্ছে বাবা-মা’কে ভারতে বাড়ছে এতিম শিশু

এনএনবি : ভারতের রাজধানী দিল্লির বাসিন্দা পাঁচ বছর বয়সী প্রথম ও তার ১০ মাস বয়সী ভাই আয়ুষের বাবা গত এপ্রিলে কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়ে মারা যান। কয়েকদিন পর দিল্লির আরেকটি হাসপাতালে একই রোগে মারা যায় তাদের মা।
দুই ভাইয়ের গোটা দুনিয়া এখন পাল্টে গেছে। যদিও তা বোঝার ক্ষমতা এখনও তাদের হয়নি। বরং প্রথম বুঝতে পারছে না কেন তার বাবা-মা বাড়ি ফিরতে এত দেরি করছে। স্বজনরা প্রথমকে বলেছে, তাদের বাবা-মা কাজে আটকে গেছে। তাই বাড়ি ফিরতে পারছে না। প্রথম তাদের প্রতিনিয়ত প্রশ্ন করে যাচ্ছে, কখন বাবা-মা বাড়ি ফিরবে।
ছোট্ট আয়ুষের মনে কী চলছে তা বোঝার সাধ্য কারও নেই। পরিস্থিতি দিন দিন কঠিন হয়ে পড়ছে। প্রথমের স্বজনরা এরই মধ্যে দিল্লির একটি এনজিওর সঙ্গে যোগাযোগ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যারা এতিম শিশুদের নিয়ে কাজ করেন।
ওই এনজিও থেকে বলা হয়, তারা আশা করছেন কোনো পরিবার হয়ত প্রথম এবং তার ভাইকে দত্তক নিতে রাজি হবে। ১২ বছরের সোনিয়া ও তার ভাই ৭ বছরের অমিতের অবস্থাও এখন প্রথমদের মত।
গত বছর জুনে ভারতে করোনাভাইরাসের প্রথম ঢেউয়ের সময় সোনিয়া-অমিতের বাবা মারা যান। আর কোভিড-১৯ আক্রান্ত হয়ে এবছর এপ্রিলে মারা যান মা। বর্তমানে তাদেরকে দেখাশোনা করছেন দাদী। নাতি-নাতনির ভবিষ্যৎ নিয়ে দারুণ উদ্বিগ্ন এই বৃদ্ধা তাদেরকে দত্তক দেওয়ার কথা চিন্তাও করতে পারছেন না।
তিনি বলেন, ‘‘আমি না থাকলে এই শিশুদের কে দেখাশোনা করবে? এই শিশুরা আমার ছেলে ও ছেলের বউয়ের উত্তরাধিকারী। অনেক মানুষ তাদের দত্তক নিতে চায়। কিন্তু আমি কিভাবে তাদের দূরে চলে যেতে দেব?”
এরকম একটি বা দুটি ঘটনা নয় বরং ভারতজুড়ে বহু শিশুকে এই দুর্ভাগ্য বরণ করতে হয়েছে এবং হচ্ছে। কোভিড-১৯ মহামারী তাদের বাবা-মা দুজনকেই কেড়ে নিয়ে তাদেরকে এতিম করে দিচ্ছে।
ভারতের নারী ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রী স্মৃতি ইরানি সম্প্রতি এক টুইটে জানান, গত ১ এপ্রিল থেকে ২৫ মে পর্যন্ত ভারতে অন্তত ৫৭৭টি শিশুর বাবা-মা উভয়ই করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন।
যদিও বিশেষজ্ঞদের ধারনা, এমন শিশুদের প্রকৃত সংখ্যা আরও অনেক বেশি। এতিম হয়ে পড়া এসব শিশুদের সহায়তার জন্য ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী একটি তহবিল ঘোষণা করেছেন। যে তহবিল থেকে প্রতিটি শিশুকে প্রায় ১০ লাখ রুপি দেওয়া হবে। যেটা তারা ১৮ থেকে ২৩ বছর পর্যন্ত উপবৃত্তির মত পাবে। ভারতে শিশু দত্তক আইন খুবই কঠিন। সেখানে প্রতিটি রাজ্যে শিশু সুরক্ষা এবং কল্যাণের জন্য একটি কমিশন আছে। কমিশন থেকে প্রতিটি জেলায় কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয়। যারা দত্তক নেওয়া শিশুদের ভালো মন্দের খোঁজ খবর রাখেন। এছাড়া, নানা এনজিও থেকেও কমিশনকে শিশুদের খোঁজ খবর রাখার বিষয়ে এবং কোনও শিশু ঝুঁকিতে রয়েছে কিনা তার খোঁজ রাখা হয়।
ভারতে জাতীয় পর্যায়ে একটি পোর্টাল আছে যেখানে লোকজন শিশু দত্তক গ্রহণের আগ্রহের কথা জানিয়ে নাম নিবন্ধন করেন। রাজ্যের শিশু কল্যাণ কমিটি পূর্ণ খোঁজখবর নেওয়ার পর ‘একটি শিশুকে আইনগতভাবে দত্তক নেওয়ার অনুমতি দেয়’।
যদিও ভারতে শিশুদের তেমন একটা দত্তক নিতে দেখা যায় না। ২০২০ সালের মার্চ পর্যন্ত সেখানে এক বছরে মাত্র ৩,৩১৫টি শিশুকে দত্তক নেওয়া হয়েছে। যেখান ওই সময়ে হাজার হাজার শিশু এতিম হয়েছে।
‘দিল্লি কমিশন ফর প্রোটেকশন অব চাইল্ড রাইটস’ এর প্রধান অনুরাগ কু-ু বলেন, ভারতে করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউয়ে বাবা-মা হারিয়ে এতিম হয়ে পড়া শিশুদের সংখ্যা নাটকীয়ভাবে বেড়ে গেছে।
তিনি বলেন, ‘‘আমি আমার এই জীবনে এত অল্প সময়ে এত মানুষের মৃত্যুর কথা শুনিনি। নিশ্চয়ই তারা পেছনে তাদের সন্তানদের রেখে গেছেন যাদের বয়স ১৮ বছরের কম। সেভাবে বলতে গেলে এর কারণে দেশে জাতীয় জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা উচিত।”
ভারতের সবচেয়ে জনবহুল রাজ্য উত্তর প্রদেশে কোভিড-১৯ মহামারীর কারণে এতিম হওয়া এক হাজারের বেশি শিশুকে খুঁজে পাওয়া গেছে বলে জানান রাজ্যের চাইল্ড ওয়েলফেয়ার কমিশনের সদস্য ডা. প্রীতি ভর্মা।
তিনি বলেন, ‘‘দেশজুড়ে প্রকৃতপক্ষে এই সংখ্যা হয়ত আরও অনেক বেশি। কমিশন থেকে তাদের খুঁজে বের করতে সাহায্যের জন্য পুলিশ কনস্টেবল, গ্রাম পর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবাকর্মী এবং গ্রামের প্রধানদের তালিকা করা হয়েছে।”
পাচার হওয়ার আতঙ্ক : ভারতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এখন যেমন প্রচুর মানুষ হাসপাতালের শয্যা, অক্সিজেন বা ওষুধ চেয়ে নানা পোস্ট দিচ্ছেন। তেমন কোভিডে বাবা-মা হারা এতিম শিশুদের দত্তক নেওয়ার অনুরোধ জানিয়েও অনেকে পোস্ট দিচ্ছেন।
কিন্তু এভাবে সমাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সরাসরি শিশুদের ছবি ও ফোন নম্বর পোস্ট করার ফলে ওই সব শিশুর মানবপাচারকারীদের হাতে পড়ার আশঙ্কা বেড়ে যাচ্ছে বলে মনে করেন কু-ু।
তিনি বলেন, তার দল ফেইসবুকে এমন একটি পাতা খুঁজে পেয়েছে যারা অর্থের বিনিময়ে শিশুদের দত্তক দেওয়ার প্রস্তাব করছে।
‘‘আমার একজন কর্মী ওই ফেইসবুক পাতায় দেওয়া নম্বরে যোগাযোগ করলে তারা একটি শিশুর জন্য প্রায় পাঁচ লাখ রুপি চায়। আমরা পুলিশের কাছে ওই গ্রুপের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানিয়েছি।”
এতিম হয়ে পড়া ওইসব শিশুকে শিশুশ্রম বা যৌনকর্মে বাধ্য করার ঘটনাও ঘটতে পারে। এই শিশুরা এমনকী পরিবারের সদস্যদের কাছেও নির্যাতনের শিকার হচ্ছে।
দিল্লি ভিত্তিক একটি এনজিও জানায়, তারা এমন একটি ঘটনা জানতে পেরেছে যেখানে মা কোভিড আক্রান্ত হয়ে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে বাবা তার মেয়েদের যৌন নিপীড়ন করেছে। কোভিড-১৯ মহামারীর কারণে ভারতজুড়ে এমন অসংখ্য শিশু এতিম হয়ে দুর্বিসহ জীবন যাপনে বাধ্য হচ্ছে।
সূত্র : বিবিসি

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *