গণমাধ্যম কর্মীদের গলা চেপে ধরছে গণমাধ্যম কর্মী আইন: জরুরিভিত্তিতে পদক্ষেপ প্রয়োজন
তফাজ্জল হোসেন: গত ২৮ মার্চ ২০২২ সোমবার ‘গণমাধ্যম কর্মী (চাকরির শর্তাবলি) আইন, ২০২২’ শিরোনামে বিল সংসদে উত্থাপন করা হলো। উত্থাপনের পর পরই আইনটি পরীক্ষা নিরীক্ষার জন্য ৬০ দিন সময় দিয়ে সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে পাঠানো হয়েছে। দেশে গণমাধ্যম কর্মীদের জন্য প্রথম আইন করা হয় ১৯৭৪ সালে-The Newspaper Employees (Condition of Service) Act 1974 । তখন গণমাধ্যম বলতে ছিল শুধু সংবাদপত্র। রেডিও এবং টেলিভিশন ছিল শুধু সরকারি এবং সেসব প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের জন্য আলাদা আইন ছিল। ফলে ১৯৭৪ এর আইনটি কেবল সংবাদপত্রের কর্মীদের জন্য প্রযোজ্য ছিলো। ২০০৬ সালে বাংলাদেশ শ্রম আইন তৈরি করার পর এই আইনটি বাতিল হয়ে যায়। ২০০৬ এর শ্রম আইনের ৭২ ধারায় গণমাধ্যম কর্মীদেরকে সংবাদপত্র শ্রমিক হিসেবে উল্লেখ করা হয়। সেখানে অনলাইন, ব্রডকাস্ট অর্থাৎ রেডিও, টেলিভিশন কর্মীদেরকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।
শ্রম আইনে সংবাদপত্র শ্রমিক হিসেবে উল্লেখ করায় গণমাধ্যম কর্মিদের কেউ কেউ আপত্তি তুলেছিলেন। তাদের ভাষ্যমতে, কায়িক শ্রমের সাথে তাদের বুদ্ধিবৃত্তির ফারাক রাখা হয় নি। যেমনটি শিক্ষক, আইনজীবি, চিকিৎসক, প্রকৌশলী প্রমুখদের ক্ষেত্রে করা হয়। এসব গণমাধ্যম কর্মিদের সান্ত¡না দেয়ার জন্য এবার গণমাধ্যম কর্মী আইন-২০২২ সামনে আনা হলো। আশ্চর্য্যের বিষয় হচ্ছে- এই আইনটি ইতিমধ্যে বিল হিসেবে সংসদে উত্থাপিত হয়ে আইন হিসেবে স্বীকৃতি পেতে যাচ্ছে, অথচ দেশের সচেতন গণমাধ্যম কর্মীদের কোন প্রকার উচ্চবাচ্য নেই। এমনকি সাংবাদিক ইউনিয়ন ও ফেডারেশনগুলোরও এ নিয়ে কোন সাড়াশব্দ নেই। তাহলে যে বুদ্ধিবৃত্তির স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য গণমাধ্যম কর্মীরা শ্রমিক হতে অনিচ্ছুক, সেইসব বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মীরাই বুদ্ধি ও সচেতনতায় রয়েছেন শ্রমিকদের চেয়ে অনেক পিছিয়ে। সাধারণত শ্রম আইন বা অন্য কোন শ্রম সেক্টরে এ ধরণের কালো আইন তৈরির তৎপরতা চললে এতদিনে এর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়া হতো। কিন্তু গণমাধ্যম কর্মীদের সেই প্রতিক্রিয়া নেই।
কি আছে এই গণমাধ্যম কর্মী আইনে? এই আইনের মাধ্যমে সংবাদ কর্মীদের কি কি অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হবে? আমরা জানি, আইএলও কনভেনশন ৮৭ ও ৯৮ অনুযায়ী প্রত্যেক কর্মীর অবাধ ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার রয়েছে। পৃথিবীর অনেক দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও এই ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার সংরক্ষণ ও চর্চা করছেন। দাবি ও অধিকার আদায়ের ক্ষেত্রে ট্রেড ইউনিয়নের বিকল্প নেই। অথচ উল্লেখিত গণমাধ্যম কর্মী আইনের ধারা-২(৫) এ ট্রেড ইউনিয়নের বিকল্প হিসেবে “গণমাধ্যম কল্যাণ সমিতি”র স্বীকৃতি দিয়েছে। যা কোনভাবেই ট্রেড ইউনিয়নের বিকল্প নয়। সবচেয়ে বড় কথা, সাংবাদিকদের দেশব্যাপী যেসব ট্রেড ইউনিয়নগুলি ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে, সেগুলিকেও এই আইনের সাথে সমন্বয় করে নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। অর্থা ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার খর্ব করা হয়েছে। এমনকি শ্রম আইনের ধারা-২১১ অনুযায়ী ধর্মঘট করার অধিকার থাকলেও কথিত গণমাধ্যম আইনে সেই অধিকারও নেই। ফলে এক অর্থে গণমাধ্যম কর্মিদের তাদের দাবি ও অধিকার নিয়ে আন্দোলন করার অধিকারই থাকছে না।
গণমাধ্যম কর্মী আইন-২০২২ এর ধারা-৩ এ বলা হয়েছে আপাতত বলবৎ অন্য কোন আইনে যাহা কিছুই থাকুক না কেন বেসরকারী গণমাধ্যম ও গণমাধ্যম কর্মীদের নিয়োগ, কর্মের শর্ত এবং চাকুরি সংক্রান্ত আনুষাঙ্গিক সকল বিষয়ে এই আইনের বিধানাবলী প্রাধান্য পাইবে। অথচ দেশের মূল আইনগুলি প্রবর্তিত হয় রাষ্ট্রের সংবিধানের আলোকে। প্রচলিত নিয়ম রয়েছে যে, সংবিধানে নাগরিকের যে সব অধিকারের স্বীকৃতি দেয়া রয়েছে রাষ্ট্রের কোন মৌলিক আইনে এর কম সুবিধা নির্ধারণ করতে পারবে না। আবার রাষ্ট্রের মূল আইনগুলোতে যেসব অধিকার ও সুবিধা প্রদান করা হয়েছে এর কোন কম সুবিধা দিয়ে কোন সেক্টরভিত্তিক আইন তৈরি করতে পারে না। অথচ ২০০৬ সালের শ্রম আইনে সংবাদপত্র শ্রমিকদের যেসব সুবিধা প্রদান করা হয়েছে তথাকথিত গণমাধ্যম কর্মী আইন-২০২২ চূড়ান্ত হলে দেশের প্রচলিত শ্রম আইন ও অনুসমর্থিত আইএলও কনভেনশন প্রদত্ত গণমাধ্যম কর্মীদের সেসব অধিকার ও সুযোগ-সুবিধা হতে বঞ্চিত করা হবে।
শ্রম আইনের ৪-ধারায় ৭ ধরণের শ্রমিকের স্বীকৃতি থাকলেও উত্থাপিত গণমাধ্যম কর্মী আইন-২০২২, ৫-ধারায় কেবল অস্থায়ী, শিক্ষানবীশ এবং স্থায়ী- এই ৩ ধরণের শ্রমিকের স্বীকৃতি দিয়েছে। গণমাধ্যমের জন্য জরুরি প্রয়োজন কর্মিদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ । সে কারণে শ্রম আইনে প্রশিক্ষণার্থী হিসেবে উপযুক্ত ভাতার বিনিময়ে শিক্ষাধীণ শ্রমিকের কাজ করার সুযোগ রয়েছে। কিন্তু গণমাধ্যম কর্মী আইনে তা রাখা হয় নি। এছাড়াও শ্রম আইনে চাকরী স্থায়ী করার জন্য সংবাদ কর্মিদের জন্য শিক্ষানবীশকাল রয়েছে যেখানে ৩ মাস এবং করণীকদের জন্য ৬ মাস, সেখানে গণমাধ্যম কর্মী আইনে করা হয়েছে যথাক্রমে ১ বৎসর ও ২ বৎসর ।
প্রস্তাবিত গণমাধ্যম কর্মী আইনে দৈনিক ৮ ঘণ্টা হিসেবে সপ্তাহে ৪৮ ঘণ্টা কাজের নিয়ম রাখা হয়েছে। তবে ওভারটাইম হিসেবে ৪৮ ঘন্টার অতিরিক্ত কাজ করারও সুযোগ করে দেয়া হয়েছে। কিন্তু অতিরিক্ত বলতে কতটুকু সময় তা নির্ধারণ করা হয় নি, যা বাংলাদেশ শ্রম আইনের ধারা-১০০, ধারা-১০১ এবং ধারা-১০২ এ সুস্পষ্ট করা হয়েছে। ফলে সংবাদ কর্মিরা যেখানে নিয়মিত বেতন হিসেবে ওয়েজ বোর্ডের সুবিধাই পায় না, সেখানে অনির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত কাজ করিয়ে অতিরিক্ত শ্রম শোষণ করার সুযোগ রেখে দেয়া হয়েছে প্রস্তাবিত আইনে।
প্রস্তাবিত আইনের ১২-ধারায় গণমাধ্যম কর্মী ছাঁটাইয়ের ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণ হিসেবে প্রতি বছরের জন্য ৩০ দিনের মূল বেতন নির্ধারণ করা হয়েছে। অথচ প্রচলিত শ্রম আইনে গ্র্যাচুইটির অর্থাৎ ৪৫ দিনের মজুরি পাওয়ার সুযোগ রযেছে। মূল বেতন ও মজুরির মধ্যেও ফারাক রযেছে। মূল বেতন বলতে ওয়েজ বোর্ড নির্ধারিত বেসিক। কিন্তু মজুরির ক্ষেত্রে বাড়ী ভাড়া, যাতায়াত ও চিকিৎসা ভাতা বাদে অন্তর্বতীকালীন মজুরি ও মহার্ঘ্য ভাতাও বিবেচ্য হবে। ফলে প্রস্তাবিত আইনে ক্ষতিপূরণ হিসেবে ছাঁটাইকৃত কর্মী কম সুবিধা প্রাপ্ত হবেন।
শ্রম আইনের ২৩ ও ২৪- ধারাকে কালো ধারা হিসেবে গণ্য করা হয়। কারণ মালিকদের স্বৈরতান্ত্রিক আচরণের স্বীকৃতি দিয়ে এই ধারায় কথিত “অসদাচরণের” দায়ে একজন শ্রমিককে বিনা দোষে বরখাস্ত করে দেওয়ার বিধান রাখা হয়েছে। প্রস্তাবিত আইনের ১২-ধারায় আরো ভয়াবহ রুপে তা উপস্থাপন করা হয়েছে। কারণ এখানে “অসদাচরণ” বলতে কোন কোন আচরণকে বোঝাবে তা নির্দিষ্ট করা হয় নি। ফলে কোন কর্মী তার কোন অধিকার নিয়েও কথা বললেও তা অসদাচরণের মধ্যে ফেলা হবে। তাছাড়া শ্রম আইনের আরেকটি কালো ধারা হচ্ছে ধারা-২৬। যেখানে কর্মির কোন দোষ না থাকা সত্ত্বেও কেবল কর্তৃপক্ষের ইচ্ছামাফিক যে কোন কর্মীকে টার্মিনেশন করে দিতে পারে। প্রস্তাবিত আইনের ১৫(৩)-ধারাতেও মালিকের সেই একচ্ছত্র ক্ষমতা প্রদর্শনে উৎসাহিত করা হয়েছে। এমনকি শ্রম আইনে প্রাপ্ত গ্য্যাচুইটির অধিকার প্রস্তাবিত আইনে কর্তন করা হয়েছে, যা পরবর্তী ১৬-ধারা এবং ২০-ধারাতেও এর প্রতিফলন ঘটেছে।
আইনে যা কিছইু থাকুক না কেন যদি সংশ্লিষ্ট সেক্টরের কর্মীদের কথা বলার অধিকারই না থাকে তাহলে সবকিছুই বিফল। প্রস্তাবিত গণমাধ্যম কর্মী আইনে গণমাধ্যম কর্মীদের সেই কথা বলার সুযোগই বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। প্রস্তাবিত আইনের ৪৭-ধারায় বলা হয়েছে, মালিকের বিনা অনুমতিতে কোন কর্মী সমিতির কোন কাজে গেলে তাকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা বা অনাদায়ে ৬ মাসের কারাদন্ড ভোগ করতে হবে। একই সাথে ৪৩-ধারা অনুযায়ী কোন কর্মীর মিথ্যা বিবৃতির জন্য ৫০ হাজার টাকা জরিমানা এবং অনাদায়ে ৩ মাসের কারাদন্ড ভোগ করার কথা বলা রয়েছে। এতে কোন কর্মীই ভয়ে কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে কোন কথা বলা বা সমিতির কোন কাজ কর্মে অংশগ্রহণ করবে না। ফলে ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার খর্ব করার সাথে সাথে কথিত গণমাধ্যম কল্যাণ সমিতির তৎপরতাও এক অর্থে অকার্যকর থাকবে।
তবে হাস্যকর দিক হলো, প্রস্তাবিত আইনের ৪৮-ধারায় বলা হয়েছে গণমাধ্যম আদালত ব্যতীত অন্য কোন আদালত এই আইনের অধীন কোন অপরাধ বিচারার্থ গ্রহণ করতে পারবে না। আবার ধারা- ৩৬(৯) অনুযায়ী গণমাধ্যম আদালত প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত শ্রম আদালতে মামলা পরিচালনা করা হবে। ফলে একই আদালতে কি দুই আইন প্রযোজ্য হবে? এরকম হাজার প্রশ্ন ও অসংগতি নিয়ে ‘গণমাধ্যম কর্মী (চাকরির শর্তাবলি) আইন, ২০২২’ বিল হিসেবে সংসদে উত্থাপিত হচ্ছে। আইনটি পাশ হয়ে চূড়ান্ত হয়ে গেলে গণমাধ্যম কর্মীদের এর খেসারত দিনের পর দিন দিয়ে যেতে হবে। তাই সকল গণমাধ্যম কর্মীদের এখনই এই কালো আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও সংশোধানী জানানো জরুরি কর্তব্য বলে মনে করছি।
লেখক: সাংবাদিক ও ট্রেড ইউনিয়ন কর্মী; ই-মেইল:sudipto.mym@gmail.com