জাতীয়

গৌরীপুরে ৫৩ বছরেও মুক্তিযোদ্ধা সনদ পায়নি শহিদ সিরাজের পরিবার!

গৌরীপুর প্রতিনিধি: ময়মনসিংহের পলাশকান্দা যুদ্ধে পাকবাহিনী ধরে নিয়ে যায় একেএম সিরাজুল হক। ১৯৭১ সালের ৩০ নভেম্বর এই দিনে ব্র‏হ্মপুত্র নদের তীরে নিয়ে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে বিষাক্ত যন্ত্রণা দিয়ে তাঁকে হত্যা করা হয়। হত্যার পরে তার পরিবারের নিকট ফেরত দেয়া হয়নি। তিনি ছিলেন মুক্তিযুদ্ধে মুজিব বাহিনীর গেরিলা দলের সদস্য। বিজয়ের ৫৩ বছর কেটে গেলেও মুক্তিযোদ্ধা শহীদ পরিবারের সদস্য হিসাবে তাঁদের পরিবার পায়নি কোনো সরকারি সুযোগ-সুবিধা, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা সনদপত্রও। এ নিয়ে তাদের আক্ষেপ ও ক্ষোভের অন্ত ছিলোনা। বড় ভাই হারানোর সেই স্মৃতি কথা বলতে বলতে বারবার কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন তার ছোট একেএম এমদাদুল হক। ক্ষুব্দ প্রতিক্রিয়ায় জানান, পলাশকান্দা না গিয়েও এ যুদ্ধে অংশ গ্রহণের ভুয়া তথ্য দিয়ে অনেকেই মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পেয়েছেন। তারা ভাতাও পাচ্ছেন, অথচ আমার ভাই শহিদ হওয়ার পরেও কোনো সুযোগ সুবিধা আমরা পাইনি।

শুক্রবার বিষয়টি নিয়ে গণমাধ্যম কর্মীরা অনুসন্ধানে নামার পর বেরিয়ে আসে চাঞ্চল্যকর আরও তথ্য। জানা গেলো ভারতীয় লালমুক্তিবার্তা ও বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধা গেজেটে শহিদ মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে একেএম সিরাজুল হকের নাম তালিকাভুক্ত আছে। তালিকাভুক্তির বিষয়টি নিশ্চিত করেন উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রহিম। তিনি বলেন লালমুক্তিবার্তা ও বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা গেজেটে মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে একেএম সিরাজুল হকের নাম রয়েছে। তার লালমুক্তিবার্তা ক্রমিক নং ০১১৫১০৩২৪। বাংলাদেশ অতিরিক্ত গেজেটে তার ক্রমিক নং ৫০৪৮।

১৯৬০ সালে বাবাকে হারায় এ পরিবারটি। মা’ও চলে যান স্বাধীনতার ৪ বছর আগে। বড় ভাই একেএম সিরাজুল ইসলাম তখন গৌরীপুর সরকারি কলেজ থেকে সবে বি.কম পাস করেন। পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তি তিনিই একমাত্র। ছোট ভাই একেএম এমদাদুল হক, একেএম মঞ্জুরুল হক আর বোন আলেয়া আক্তার খাতুনের ভরসা। ৭১’র মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে চলে যান একেএম সিরাজুল হক। তার বাড়ি ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলার বোকাইনগর ইউনিয়নের কাজীপাড়া গ্রামে। তার বাবার নাম মৃত মনফর উদ্দিন আর মাতা মৃতফিরুজেরন্নেসা।

সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ১৯৭১ সালের নভেম্বর মাস। মুজিব বাহিনীর কমান্ডার মো. মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা দল ময়মনসিংহ-কিশোরগঞ্জ মহাসড়ক দিয়ে চলাচলকারী পাক হানাদার বাহিনীর কনভয়ে হামলা করার জন্য গৌরীপুর ও ঈশ্বরগঞ্জের সীমান্তবর্তী পলাশকান্দা গ্রামে অবস্থান নেয়। প্রায় ৪০ সদস্যের মুজিব বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধা দলে ছিলেন একেএম সিরাজুল হক। মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান জানতে পেরে ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে হানাদার বাহিনীর ক্যাম্প এর পাক হানাদার, রাজাকার ও আলবদরের সম্মিলিত বাহিনী পলাশকান্দা গ্রামে মুজিব বাহিনীর ওপর আক্রমণ করে। এসময় যুদ্ধরত অবস্থায় জসিম উদ্দিন হানাদার বাহিনীর ব্রাশ ফায়ারে শহীদ হন। এ সময় হানাদারের হাতে আহত অবস্থায় ধরা পড়েন আনোয়ারুল ইসলাম মনজু, মতিউর রহমান ও একেএম সিরাজুল ইসলাম। ধরাপড়া তিনজন মুক্তিযোদ্ধাকে হানাদার ক্যাম্পে নিয়ে অমানুষিক নির্যাতন করে পরে ব্রহ্মপুত্রের নদীর চরে তাদের চোখ বেয়নট দিয়ে খুচিয়ে চোখ উপরে ফেলে পরে তারপর হত্যা করে। ভাইকে হারানোর কষ্টের কথা বলতে গিয়ে রোববার কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন বেঁচে থাকা একমাত্র ভাই একেএম এমদাদুল হক। তার আরেক ছোট ভাই একেএম মঞ্জুরুল হকও বড় ভাইয়ের শহীদ মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতির জন্য ছুটেছেন বহুস্থানে। তিনিও সড়ক দুঘর্টনায় চিরবিদায় নেন ২০১৬সালের ২৯মার্চ। একেএম এমদাদুল হক জানান, ভাইয়ের সেই লাশ খোঁজতে ব্র‏‏হ্মপুত্র নদে পাড়ে ১৭দিন ছিলাম। দেশে বিজয় মিছিল হচ্ছে.. তখনও আমি নদের পাড়ে ছুটে চলছি, কিছু দেখলেই মনে হতো। এই তো মনে হয় বড় ভাইয়ের লাশ ভেসে উঠলো। অনেক লাশ দেখেছি, তবে ভাইয়ের লাশ খোঁজে পাইনি। মঞ্জুরুল হকের স্ত্রী লুৎফুনন্নেসা বলেন, আমার স্বামী জীবনদশায় তার ভাইয়ের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির জন্য অনেক চেষ্টা করেছেন। তবে কিছুই হয়নি। বীরমুক্তিযোদ্ধা মো. ইকবাল হাসান খান বলেন, গৌরীপুর শহীদ সিরাজ-মঞ্জু স্মৃতি পৌর প্রাথমিক বিদ্যালয়টির নাম ৭৫’র পটপরিবর্তনের পর রাখা হয় গৌরীপুর পৌর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। যা বর্তমানে গৌরীপুর পৌর মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিচিত। দ্রুত সময়ের মধ্যে বিদ্যালয়টির নাম গৌরীপুর শহীদ সিরাজ-মঞ্জু স্মৃতি পৌর মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় নামকরণের দাবি জানাচ্ছি।

এলাকাবাসী জানায়, শহিদ সিরাজের নামে এ ইউনিয়নের প্রধান সড়কটির নামকরণ করা হয়েছে। তবে পরিবার স্বীকৃতি সনদ ও সরকারি ভাতাদি না পাওয়া অত্যন্ত দুঃখজনক। শহিদ সিরাজ সংস্কৃতিমনা ছিলেন, সংগীতের ওস্তাদও। ময়মনসিংহের মুকুলফৌজ ও গৌরীপুরে কচিকাচার আসরে সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।
অপরদিকে এ কিল্লাবোকাইনগর ফাযিল মাদরাসারটির সামনেই পড়ে আছে শহিদ সিরাজের সেই পরিত্যক্ত ভবন। যা সংরক্ষণের দাবিও জানান তার ছোট ভাই একেএম এমদাদুল হক। এলাকাবাসীও শহীদ মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের ভাতাদি ও তার নাম নতুন প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দিতে স্থায়ীভাবে স্মৃতিফলক নির্মাণেরও দাবি জানান।