ছুটির দিনে লকডাউনের বন্ধ ‘সমন্বয়’ করে নিচ্ছে মালিকরা; শ্রমিক নেতাদের সোচ্চার হওয়ার আহবান
তফাজ্জল হোসেন: বিগত প্রায় দেড় বছর ধরে করোনা মহামারীর মধ্যে দেশে বিভিন্ন সময় লকডাউন আরোপ করা হয়েছে। এইসব লকডাউনের আওতায় গার্মেন্টস সেক্টরকে অন্তর্ভুক্ত না করায় শ্রমিক ও জনগণের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া ঘটে। এর ফলে পূর্ব ঘোষিত গত ২৩ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত ১৪ দিনের কঠোর লকডাউনে গার্মেন্ট সেক্টরকেও আওতাভুক্ত করে সরকার। তবে ঈদুল আযহা’র বন্ধ সমন্বয় করলে দেখা যায় লকডাউনে গার্মেন্ট কারখানাসমূহ মূলত: ৫/৭ দিন বন্ধ থাকে। সর্বশেষ গার্মেন্টস মালিকরা তাও মানতে রাজি নন। সরকারকে বিভিন্নভাবে প্রভাবিত করে ১ আগস্ট থেকে কারখানা চালুর প্রজ্ঞাপণ জারি করিয়ে নেন মালিকরা।
গণপরিবহন বন্ধ রেখে ১ দিনের নোটিশে গার্মেন্ট শ্রমিকদের কারখানায় ফিরতে বাধ্য করা হয়। ফলে ৩১ জুলাই সারাদিন ও রাতে শিল্পাঞ্চল ঢাকা, চট্টগ্রাম, গাজীপুর, ময়মনসিংহ ও ফেরী ঘাট অঞ্চলে শ্রমিকদের উপচেপড়া ভিড় দেখা যায়। গণপরিবহন না থাকায় শ্রমিকরা পায়ে হেঁটে কিংবা রিক্সা, অটোরিক্সা, ট্রাক, পিকআপ, ভ্যান-এসব ঝুঁকিপূর্ণ যানে চড়ে মহাসড়ক পাড় হয়েছেন। ছোট ছোট এসব যানের কারণে দীর্ঘপথ শ্রমিকদের যানজটে ভুগতে হয়। মধ্যরাতে ময়মনসিংহ শহরের ঢাকা বাইপাসে সরেজমিনে দেখা যায়, শম্ভুগঞ্জ ব্রীজ থেকে গাজীপুর পর্যন্ত বিস্তৃত দীর্ঘ যানজটে তীব্র অসহনীয় গরমে কোলের শিশু ও বৃদ্ধ বাবা-মা সহ শ্রমিকরা রাস্তায় আটকে আছেন।
রাত তখন প্রায় ১টা । বাইপাস মোড়ে অসংখ্য যানবাহেেনর মধ্যে কোলের শিশুসহ একটি অটো রিকশায় আটকে আছেন তিনজন নারী শ্রমিক। সকাল ৯টায় তারা বাড়ি থেকে বের হয়েছেন। নেত্রকোণা জেলার বারহাট্টা উপজেলার গ্রামের বাড়ি থেকে তারা আসছেন। ময়মনসিংহের ভালুকা উপজেলার সীমান্তে এস কিউ গ্রুপে তারা চাকুরি করেন। সকালে কারখানায় হাজিরা দিতে হবে। তাই এত প্রতিকূলতার মধ্যেও কোলের শিশুকে নিয়ে বের হয়েছেন। ময়মনসিংহ পর্যন্ত আসতে তাদের কত টাকা খরচ হয়েছে জানতে চাইলে বলেন, বাড়ি থেকেই অটো রিকশায় ভেঙ্গে ভেঙ্গে আসতে তাদের প্রায় ১৫০০ টাকা খরচ। সাধারণ সময়ে এই ৫০ কিলোমিটার রাস্তা আসতে তিনজনের যেখানে পরিবহন খরচ ছিলো বড়জোর তিনশ টাকা। তবু কারখানা পর্যন্ত আরো প্রায় ৫০ কিলো রাস্তা পাড়ি দিতে হবে তাদের। তাতে আরো কত টাকা খরচ হবে জানা নেই তাদের।
দেশের গার্মেন্টস সেক্টরের সবকয়টি জোনের চিত্রই ছিলো এই রকম। এভাবেই সারাদেশে গার্মেন্টস শ্রমিকরা ১ আগস্ট থেকে কারখানায় যোগদান করতে বাধ্য হোন। এরকম দুর্ভোগ পাড় হয়ে যখন সপ্তাহের শুক্রবারে তাদের বিশ্রাম নেয়ার কথা, তখন সপ্তাহান্তে শোনেন শুক্রবার সাপ্তাহিক বন্ধের দিনেও তাদের ডিউটি করতে হবে। কারখানায় কাজের চাপ বেশি এই অজুহাতে বাধ্যতামূলকভাবেই ডিউটি চাপিয়ে দেয়া হয় শ্রমিকদের উপর। কিন্তু সেটা আবার অতিরিক্ত মজুরি বা উক্তরুপ ছুটি আবার প্রদান করার বিনিময়ে নয়। ঈদের ছুটির পর লকডাউনের কারণে ১ আগস্টের মধ্যে যে কয়দিন কারখানা বন্ধ থেকেছে, সেগুলো সমন্বয় করে নিবে বলে কারখানায় নোটিশ ছেঁটে দেয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ শ্রম আইন-২০০৬ (অদ্যাবধি সংশোধিত) এর ১০২(১)-ধারায় কোন প্রাপ্ত বয়স্ক শ্রমিক কোন প্রতিষ্ঠানে সাধারণত: সপ্তাহে আটচল্লিশ ঘন্টার অধিক সময় কাজ করতে পারবে না বা তাকে দিয়ে কাজ করানো যাবে না বলে উল্লেখ রয়েছে । আইনের ১০৩-ধারা অনুযায়ী কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠানে সপ্তাহে ১ দিন শ্রমিকরা সাপ্তাহিক ছুটি প্রাপ্য এবং ১০৪-ধারায় প্রাপ্য ছুটি হতে বঞ্চিত হলে যথাশীঘ্র উক্তরুপ ছুটির সম সংখ্যক ছুটি মঞ্জুর করার কথা বলা হয়।
ছুটির বিষয়ে আইনে এরকম ধারা উল্লেখ থাকলেও গার্মেন্টস শ্রমিকদের সাপ্তাহিক ছুটিকে লকডাউনের বন্ধের সাথে সমন্বয় করা হচ্ছে বলে বিষয়টি নিশ্চিত করেন বিকেএমইএর প্রথম সহ-সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম । তিনি তাঁর ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, ‘সরকার সাধারণ ছুটি না দিয়ে লকডাউনে কারখানা বন্ধ রাখার নির্দেশনা দিয়েছিলো। সে কারণে আমাদের লে-অফে যাওয়ার সুযোগ ছিলো। কিন্তু লে-অফ না করে বন্ধের ছুটিগুলো এখন সমন্বয় করে নিচ্ছি।’ গণপরিবহন বন্ধ থাকা অবস্থায় শ্রমিকদের কারখানায় আনার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘শ্রমিকদের ফেরার জন্য সরকারের কাছে আমরা পরিবহন চালুর অনুরোধ জানিয়ে ছিলাম। কিন্তু সমন্বয়হীনতার কারণে সময়মত পরিবহন না ছেড়ে পরিবহন ছাড়তে সরকার বিলম্ব করেছে।’ সরকার ও মালিকদের সমন্বয়হীনতার দায় শ্রমিকরা কেন নিবে এবং এ প্রেক্ষিতে শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ প্রদান করা হবে কি’না- এ বিষয়ে মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ‘শ্রমিকদের আমরা কর্মস্থল ত্যাগ করতে নিষেধ করেছিলাম। যেহেতু তাদের নিজেদের দায়িত্বে বাড়ি গিয়েছে, সেহেতু নিজেদের দায়িত্বেই তাদের ফেরত আসতে হবে। এক্ষেত্রে আমরা কোন দায়-দায়িত্ব নিবো না।’
সাপ্তাহিক ছুটি সমন্বয় করে নেয়ার ব্যাপারে আইনের ব্যাখ্যা সম্পর্কে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর গাজীপুরের উপ-মহাপরিদর্শক আহমেদ বেলালের কাছে জানতে চাইলে তিনি জানান, ‘এ বিষয়টিতে মহাপরিদর্শক ব্যাখ্যা দিবেন। আমাদের ব্যাখ্যা দেয়ার সুযোগ নেই। ‘ এ ব্যাপারে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের যুগ্ম মহাপরিদর্শক (সাধারণ শাখা) সামশুল আলম খান এর দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বলেন- ‘আইনিভাবে বলার সুযোগ নেই যে শ্রমিকদের ওভারটাইম দেয়া যাবে না বা প্রাপ্য ছুটি হতে বঞ্চিত হলে যথাশীঘ্র উক্তরুপ ছুটির সম সংখ্যক ছুটি মঞ্জুর করা যাবে না। আমাদের কাছে এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আসলে কলকারখানা অধিদপ্তর ব্যবস্থা নিবে। তবে আমরা চাই শ্রমিকরা যেমন বরাবরই কনসিডার করে, মালিকদেরও তেমন করতে হবে। না হলে তো এই সেক্টরে ওয়েলফেয়ার আসবে না। সকলকেই আইন মেনে চলতে হবে।’
এ বিষয়ে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব (অতিরিক্ত দায়িত্ব) সাকিউন নাহার বেগমের সাথে যোগাযোগ করা হলেও তাঁকে পাওয়া যায় নি। পরবর্তীতে মন্ত্রণালয়ের উপসচিব (শ্রম শাখা) ড. মোহাম্মদ আব্দুল কাদের জানান, ‘ছুটির বিষয়গুলি মালিক-শ্রমিকদের মধ্যে আলোচনা করে নিতে হবে। তারপরও কলকারখানা অধিদপ্তর, ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশ বা স্থানীয় পর্যায়ে যারা আছেন তারা বিষয়টিকে নোটিশে আনলে আমরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।’
ছুটি সমন্বয় ও দুর্ভোগের মধ্য দিয়ে কর্মক্ষেত্রে ফেরার বিষয়ে গার্মেন্টস শ্রমিক অধিকার আন্দোলনের সমন্বয়ক শ্রমিক নেতা শহিদুল ইসলাম সবুজ বলেন- ‘সকলেই জানেন গার্মেন্ট শ্রমিকদের অধিকাংশ কারখানায় তাদের আইনগত ছুটি থেকে বঞ্চিত করা হয়। এবার লকডাউন ও স্বাস্থ্যঝুকি উপেক্ষা করে গণপরিবহন বন্ধ থাকা অবস্থায় ১ অগাস্ট শ্রমিকরা কারখানায় ফিরতে বাধ্য হোন। তারপরও বিভিন্ন শ্রমিক অঞ্চল থেকে খবর পাওয়া যাচ্ছে, লকডাউনের কারনে বন্ধ থাকা ছুটির দিন কয়টিও মালিকরা ওভারটাইমের মজুরি না দিয়ে এবং সাপ্তাহিক ছুটির দিনেও অতিরিক্ত কাজ করিয়ে ছুটি সমন্বয়ের অপতৎপরতা চালাচ্ছে। ফলে বিভিন্ন শ্রমিকাঞ্চলের শ্রমিকরা ক্ষোভ প্রকাশ করছেন। আর এই ক্ষোভ থেকে শ্রম অসন্তোষ তৈরি হলে তার দায় তো মালিক ও তাদের পৃষ্ঠপোষক সরকারকেই নিতে হবে। এ বিষয়ে গার্মেন্ট মালিকদের এই অপতৎপরতার নিন্দা জানানোর পাশাপাশি শ্রমিক বন্ধুদের প্রতি আহবান জানাই তারা যেন বিনা পারিশ্রমিকে এক মিনিট সময়ও কাজ না করেন।’
এ বিষয়ে জি-স্কপের সমন্বয়ক ও ঢাকা অঞ্চলের আঞ্চলিক ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট কমিটির সদস্য শ্রমিক নেতা কামরুল আহসান বলেন, ‘লকডাউনের কারনে কারখানা বন্ধ রাখা সরকারি নির্দেশনা। এটা সরকারি ছুটির আওতায় পড়ে, এর জন্য শ্রমিকের কোন দায নেই। বরঞ্চ লকডাউনের নির্ধারিত সময়ের আগে কারখানা খুলে দিয়ে শ্রমিকদের কারখানায় যোগদানের যে অমানবিক অবস্থা তৈরী করা হয়েছিল তার ক্ষতিপুরণ মালিকদের দেয়া উচিৎ। সরকারী ছুটি সমন্বয় করার কোন অধিকার মালিকদের নেই। ছুটির দিনে অতিরিক্ত কাজ করালে তা ওভারটাইম হিসেবে মজুরি দিতে হবে। কোন কোন কারখানা কর্তৃপক্ষ এই ধরনের ব্যবস্থা নিতে গিয়ে শ্রমিকদের বাধার মুখে ব্যর্থ হয়েছেন। ’
বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন সংঘের সাধারণ সম্পাদক ও শ্রমিক-কর্মচারী ঐক্য পরিষদের অন্যতম কেন্দ্রীয় নেতা চৌধুরী আশিকুল আলম এ প্রেক্ষিতে বলেন- “আমরা লক্ষ্য করছি এবং জানতে পারছি রপ্তানি কার্যক্রম সচল রাখতে শ্রমিকরা এই করোনা কালিন সময়ে রাষ্ট্র এবং মালিকদের কাছ থেকে মানবিক আচরণ না পেলেও বেঁচে থাকার এবং চাকরি রক্ষার তাগিদে কাজে যোগদান করেছেন। শ্রমিকরা উৎপাদন প্রক্রিয়া সচল রাখার পরও তাদের দিয়ে ছুটির দিনে জেনারেল ডিউটি করানো হচ্ছে। সরকার ঘোষিত লকডাউনের কারনে কারখানা চালাতে না পারার দায়ে শ্রমিকদেরকে দিয়ে এরকম ডিউটি করানোর কোনো রকম আইনি সুযোগ নাই । আমরা মালিকদের এ ধরনের অনৈতিক মুনাফা লোভী কদর্য ভূমিকার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি। একই সাথে সরকার ও সরকারি সংস্থা সমূহকে এ বিষয়ে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের জোর দাবি জানাচ্ছি ।
এ ধরণের ঘটনা প্রতিরোধে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ভাবে সোচ্চার হওয়ার জন্য শ্রমিক ও তাদের সংগঠন সমূহকে সমন্বিত ভূমিকা নেওয়ার জন্য চৌধুরী আশিকুল আলম সকলের প্রতি আহ্বান জানান।