জমির বেচাকেনা বন্ধ ও অতিরিক্ত সিটি ট্যাক্সের কারণে বিপর্যস্ত ময়মনসিংহের চরাঞ্চলবাসী
বাবলী আকন্দ: ময়মনসিংহ বিভাগের সদর দপ্তরসহ অন্যান্য স্থাপনার জন্য ভূমি অধিগ্রহণের ঘটনায় জমি বিক্রি এবং রেজিষ্ট্রি বন্ধ থাকায় করোনার এ মহামারীতে বিপর্যয়ে পড়েছে ব্রহ্মপুত্র নদের তীরবর্তী চরাঞ্চলের কৃষকগণ। অধিগ্রহণের মধ্যে না পড়েও জমি কেনাবেচায় নিষেধাজ্ঞা থাকায় পরিবার পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন এলাকার হাজার হাজার মানুষ। এদিকে ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের বর্ধিত এলাকার অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় উক্ত এলাকার মানুষের জীবনমান উন্নয়ন না হওয়া সত্বেও সিটি হোল্ডিং ট্যাক্সসহ অন্যান্য ট্যাক্স তাদের কাঁধে চেপেছে। দরিদ্র কৃষক এবং তাদের পরিবারের কাছে এ যেন “মরার উপর খাড়ার ঘা” হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সরেজমিনে গিয়ে জানা যায়, চরঈশ্বরদিয়া মৌজার বিল্লাল হোসেন ও আজিজুল হক দুই ভাইয়ের ১৮ কাঠা জমির মধ্যে বাড়ির অংশ ছাড়া বেশিরভাগ ধানী জমি। সেই জমি একোয়ারে (অধিগ্রহণে) পড়েছে কি’না তিনি নিজেই জানেন না। তবে নিষেধাজ্ঞা আছে জমি বেচাকেনা করার। পরিবারে অন্যান্য আয়ের উৎস না থাকায় ফসল উৎপাদন না করতে পেরে তাদের অসহায়ত্ব তুলে ধরেন তিনি। খেয়ে না খেয়ে দিন যাপন করছেন তারা। উপরন্তু সিটির হোল্ডিং ট্যাক্সসহ অন্যান্য ট্যাক্সের বোঝা বয়ে বেড়াচ্ছেন। তিনি জানান, “করোনার এ সময়ে লকডাউন দিসে সরকার। না পারতাসি কিছু করবার, না পারতাসি পরিবার লইয়া চলবার। সামনে আত্মহত্যা ছাড়া উপায় নাই। কিছু জমি যে বেচবাম হেইডাও বিভাগের অফিসের লেইগা বেচাবার পারতাসি না।” একইভাবে মিয়াজ উদ্দিন নামে একজন কৃষক জানান, তার ছোট ভাইয়ের স্ত্রী অসুস্থ। চিকিৎসা করানোর মত সঞ্চয় তাদের হাতে নেই। ফলে জমি বিক্রি করাই তাদের একমাত্র উপায়। কিন্তু রেজিস্ট্রি বন্ধ থাকায় সেই জমিও বিক্রি করতে পারছেন না। এরকমভাবে অনেকের ছেলে-মেয়ে বিয়ে দেয়া বা জরুরি প্রয়োজনগুলিতে ভূমি হস্তান্তরের সুবিধা ভোগ করতে না পারায় এক বিপর্যয়কর জীবন-যাপন করছেন চরাঞ্চলের মানুষগণ।
ময়মনসিংহ সিটি কর্পোরেশনের নির্ধারিত হোল্ডিং নিয়ে তীব্র ক্ষোভ বর্ধিত ওয়ার্ডগুলোর বাসিন্দাদের। তাদের দাবি সিটি কর্পোরেশনের কোন সুযোগ-সুবিধাই তারা এখনো পান নি। মোমবাতি জ¦ালিয়ে তাদের অন্ধকার দূরীভূত করতে হয়, নতুন রাস্তাঘাট হয় নি, অনেক জায়গায় জলাশয়ের কারণে তারা ঘর থেকে বের হতে পারেন না এবং জলাশয়ের কারণে মশার আবাসস্থল তৈরি হয়ে রয়েছে- এসবের কোন উন্নতি না করে উচ্চহারে সিটি ট্যাক্স আরোপ তাদের উপর জুলুম হয়েছে বলে বর্ধিত ওয়ার্ডগুলোর বাসিন্দারা বলেন। সিটি কর্পোরেশনের বর্ধিত ৩১ নং ওয়ার্ডের ষাটোর্দ্ধ কৃষক আব্দুর রাজাক জানান, “আমার বাড়িতে ৪ টা ঘর । আগে মাত্র ৫০ টাকা ট্যাক্স দিতাম। এখন আমাকে ট্যাক্স ধরা হয়েছে ৩৫০০ টাকা। এত টাকা আমার আয়ই নেই। ” এদিকে হোল্ডিং ট্যাক্স পুন: নিধারণ করে কাঁচাবাড়িতে ট্যাক্স মওকূফ করেছে সিটি কর্পোরেশন । কিন্তু সরেজমিনে বর্ধিত ওয়ার্ডগুলোতে দেখা যায়, অনেক নিম্নবিত্ত পরিবারেও বসবাসের ক্ষেত্রে টেকসইয়ের কথা চিন্তা করে সেমি পাকা ঘর নির্মাণ করেছে। ফলে তারাও ট্যাক্সের আওতাভুক্ত রয়েছে ।
বর্ধিত ওয়ার্ডের কৃষকরা আরো জানান, সিটি কর্পোরেশনের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার আগে তারা সরকারীভাবে সার, বীজ, কীটনাশকসহ কৃষি উপকরণ ইউনিয়ন পরিষদ থেকে পেতেন। কৃষি কর্মকর্তারাও তাদের কৃষি কাজে বিভিন্ন সহযোগিতা করতেন। কৃষিতে সরকারের ভর্তুকি ও কৃষি ঋণ তারা ভোগ করতেন। কিন্তু সিটি কর্পোরেশনে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পর তাদের সকল সুযোগ-সবিধা বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে কৃষি উৎপাদনের খরচও তাদের অনেক বেড়ে গেছে বলে জানান। এছাড়াও সিটিতে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পর তাদের কৃষি জমির খাজনাও অনেক বেড়ে যাওয়ার কথা বলেন। ৩১ নং ওয়ার্ডের বিভিন্ন জন সমস্যা নিয়ে কথা বলেন মো: লুৎফর রহমান। তিনি বলেন, “পূর্বে ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মওকূফ ছিলো। এর উপরে শতাংশ প্রতি খাজনা ছিলো মাত্র ৫০ পয়সা করে। সিটি কর্পোরেশনের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পর এখন জমির খাজনা শতাংশ প্রতি হয়েছে ৪০ টাকা করে। যা আমাদের জন্য অসহনীয় । এর ফলে আমাদের বাড়ি জমি বিক্রি করে অন্যত্র চলে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। ”
সিটি কর্পোরেশন ইতিমধ্যে বর্ধিত ওয়ার্ডগুলোর বিভিণœ রাস্তা নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। তবে ওয়ার্ড বাসী নব নির্মিত রাস্তাগুলি এলাকার বর্তমান নামানুসারে রাখার দাবি জানিয়ে আসছেন। এ প্রসঙ্গে জনাব লুৎফর রহমান বলেন, আমরা ওয়ার্ডবাসীর পক্ষ থেকে ১৭ টি দাবি মেয়র মহোদয়ের কাছে উত্থাপন করেছি। সেখানে নবনির্মিতব্য রাস্তাগুলিকে এলাকার নামানুসারে করার জন্য দাবি জানিয়েছি।
বর্ধিত ওয়ার্ডগুলোর কৃষকদের সমস্যা প্রসঙ্গে বাংলাদেশ কৃষক সংগ্রাম সমিতির ময়মনসিংহ জেলার সাধারণ সম্পাদক মাস্টার মাহবুব রব্বানী বলেন, “সরকার কৃষি জমিতে শিল্পকারখানা ও অন্যান্য স্থাপনা বন্ধে আইন করেছে। উন্নয়নের নামে কোনভাবেই কৃষি জমিকে দখল বা নষ্ট করা যাবে না। সিটি কর্পোরেশনের বর্ধিত ওয়ার্ডের কৃষকরা তাদের জমিতে যেনো স্ববহাল থাকতে পারে সেজন্য অবিলম্বে জমি রেজিস্ট্রি উন্মুক্ত করা, কৃষকদের সহজ শর্তে ঋণ দেয়া এবং সার, বীজ, কীটনাশকসহ কৃষিউপকরণ বিনামূল্যে সরবরাহ করতে হবে।
চরাঞ্চলের ৫টি মৌজায় ৮০২ দশমিক ৫৭ একর জমিতে প্রশাসনিক ভবন, কর্মকর্তাদের বাসভবন, নভোথিয়েটার, স্পোর্টস কমপ্লেক্সসহ নানা স্থাপনা প্রতিষ্ঠা, ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ প্রদান ও পুনর্বাসন প্রকল্পের প্রশাসনিক অনুমোদন দেয়া হয়েছে গত বছরের অক্টোবরে। ইতিমধ্যেই এ প্রকল্পের ডিপিপি ও অবকাঠামো নির্মাণের জন্য টিএপিপি প্রস্তুত করে প্রেরণ করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে ময়মনসিংহ বিভাগের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার(সার্বিক/রাজস্ব) এস এ এম রফিকুন্নবী দৈনিক আজকের বাংলাদেশকে মুঠোফোনে জানান, “জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কমিটিতে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এ প্রকল্পের ডিপিপি ও অবকাঠামো নির্মাণের জন্য টিএপিপি পাঠানো হয়েছে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে তা প্রধানমন্ত্রী বরাবর পাঠানো হবে। সেখান থেকে অনুমোদিত হয়ে আসলে খুব শীঘ্রই এ জটিলতার নিরসন হবে।”
উল্লেখ্য, ময়মনসিংহ বর্তমান শহরের উত্তরাংশে নদীর তীরবর্তী ৮টি মৌজায় ৪৩৬৬.৮৮ একর ভূমিতে একটি আধুনিক, পরিকল্পিত নতুন বিভাগীয় শহর ও বিভাগীয় সদর দপ্তর প্রতিষ্ঠার জন্য নগর উন্নয়ন অধিদপ্তর একটি ভূমি ব্যবহার পরিকল্পনা প্রণয়ন করে। যা ২০১৬ সালে ১৭ আগষ্ট ১৪টি নির্দেশনাসহ উক্ত ভূমি ব্যবহার মহাপরিকল্পনাটি অনুমোদন করেন বর্তমান সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
এরপর থেকেই ময়মনসিংহের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার রাজস্ব ময়মনসিংহ সদরের চরাঞ্চলের চর ঈশ্বরদিয়া, চর সেহড়া, গোবিন্দপুর, জেল খানার চর, পাড়া লক্ষী আলগী, দুর্গাপুর, চর ভবানীপুর ও টাউন,এর কৃষকদের জমি বিক্রি বন্ধের নির্দেশ দেন। বিপুল সংখ্যক জমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে উক্ত এলাকার কৃষকগণের প্রতিরোধের মুখে সরকার সে চিন্তা থেকে সরে এসে বর্তমানে ৯৪৫ একর জমির মধ্যে অনুমোদন পেয়েছে ৫টি মৌজায় ৮০২ দশমিক ৫৭ একর জমি।