জাতীয় ছাত্রদলের ৪৮ বছর: জাতীয় মুক্তি, স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে অবিচল
সুদীপ্ত শাহিন: ভারতীয় উপমহাদেশে জাতীয় মুক্তি, স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লড়াই দীর্ঘদিনের। ইউরোপীয় বণিকদের আগমনের পূর্বে উপমহাদেশের কৃষক জনগণ সামন্তীয় শোষণ থেকে মুক্তি পেতে স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য লড়েছেন। ব্রিটিশ বেনিয়ারা উপমহাদেশ দখলের পর বিশেষত ছাত্র-যুবকদের মধ্যে জাতীয় মুক্তির সংগ্রাম মূর্ত হয়ে উঠে। আত্মপ্রতিষ্ঠার চিন্তাকে উপেক্ষা করে তখনকার ছাত্র-যুবক-তরুণরা আত্মত্যাগের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন।
অষ্টাদশ শতাব্দীতে ইউরোপে বুর্জোয়া বিপ্লবের অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, সাম্য-মৈত্রী-স্বাধীনতার শ্লোগান বুর্জোয়া শ্রেণী মূলত তাদের পুঁজির বিকাশের স্বার্থে ব্যবহার করেছে। বুর্জোয়া শ্রেণী তাদের অস্তিত্ব রক্ষায় শেষ পর্যন্ত সামন্তদের সাথে আপোসও করেছে। কিন্তু উনবিংশ শতাব্দীর ৩০-৪০ এর দশকে শ্রমিক শ্রেণীর রাজনৈতিক মঞ্চে আবির্ভাব ঘটায় এবং ঐতিহাসিক কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো রচিত হওয়ার পর ঐতিহাসিকভাবে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের গন্তব্য নির্ধারিত হয়ে যায়। বুর্জোয়া বিপ্লবে বুর্জোয়া শ্রেণী যেখানে আটকে যায়, শ্রমিক শ্রেণী সেখান থেকে বিপ্লকে মুক্ত করে শ্রমিক শ্রেণীর একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে অগ্রসর হয়। বিংশ শতাব্দীর গোড়াপত্তনে পুঁজিবাদের একচেটিয়া রুপ সাম্রাজ্যবাদে পরিণত হওয়ার মাধ্যমে সাম্রাজ্যবাদ ও সামন্তবাদ এক নিরবিচ্ছিন্ন শক্তিতে পরিণত হয়। সাম্রাজ্যবাদী শক্তিসমূহ সারা পৃথিবীকে নিজেদের মধ্যে ভাগ-বাটোয়ারা করে নেয়ায় তখন যেকোন দেশের গণতান্ত্রিক বিপ্লব সাম্রাজ্যবাদবিরোধী বিপ্লবে পরিণত হয়। অর্থাৎ সাম্রাজ্যবাদ-সামন্তবাদ বিরোধী জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লবের প্রেক্ষিতে জাতীয় মুক্তি, স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামও নিরবিচ্ছিন্ন হয়ে উঠে।
বিংশ শতাব্দীর ৩০-র দশকে ছাত্র-যুবকদের ব্রিটিশ বিরোধী বিভিন্ন পর্যায়ের আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে সর্বভারতীয় ছাত্র ফেডারেশন গঠিত হয়। শিক্ষাঙ্গণ ও ছাত্র সমস্যার চেয়ে সংগঠনটিকে সাম্রাজ্যবাদ-সামন্তবাদ বিরোধী আন্দোলনেই অধিকতর সক্রিয় থাকতে দেখা যায়। কারণ সেদিনকার ছাত্র-তরুণরা আত্মপ্রতিষ্ঠার চেয়ে ব্রিটিশ বিরোধী লড়াইয়ে জীবন উৎসর্গ করাতেই গৌরবান্বিত বোধ করতেন। ২য় বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটেন উড পলিসির মাধ্যমে সাম্রাজ্যবাদীরা উপনিবেশের পরিবর্তে নয়া-ঔপনিবেশিক ব্যবস্থার প্রবর্তন করে। ফলে উগ্র-সাম্প্রদায়িকতা ও দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত-পাকিস্তানের বিভক্তি ঘটলেও সর্বভারতীয় ছাত্র ফেডারেশনের উপমহাদেশ ব্যাপী জাতীয় মুক্তি, স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম অসমাপ্ত থেকে যায়।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরও সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ ও এদেশীয় আমলাদের শোষণ-নির্যাতন অব্যাহত থাকায় আবারো প্রগতিশীল ছাত্র-কর্মিদের উদ্যোগে ছাত্রাঙ্গণে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠিত হয়। এই সংগঠনটিও ছাত্রাঙ্গণের বিভিন্ন সংকট-সমস্যা নিয়ে আন্দোলন সংগ্রাম গড়ে তোলার সাথে সাথে সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদবিরোধী লড়াইও অগ্রসর করে। ৬০-৭০’র দশকে মার্কিন ও তৎকালীন সোভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ -এই দুই পরাশক্তির বাজার-প্রভাব-বলয় নিয়ে আন্ত:সাম্রাজ্যবাদী দ্বন্দ্বে উগ্র-বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদী শ্লোগানে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়। ফলে এবারো জাতীয় মুক্তি, স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম অসমাপ্ত থাকে।
কিন্তু বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর উগ্র-জাতীয়তাবাদের প্রবল ঝড়ে দেশের ছাত্র-যুবকদের এক বৃহৎ অংশ বিভ্রান্ত হয়ে যায়। সাম্রাজ্যবাদ , সামন্তবাদ ও আমলা-মুৎসুদ্দি পুঁজির শোষণ অব্যাহত রেখেও স্বাধীনতার বুলি আউড়িয়ে ছাত্র-জনতার জাতীয় মুক্তি, স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে আড়াল করা হয়। এমনকি যেসব বাম প্রগতিশীল ব্যক্তি ও সংগঠন প্রকৃত স্বাধীনতার আওয়াজ তুলছিলো তাদের উপর চালানো হয় নির্মম দমন পীড়ন ও নির্যাতন। সে সময়ের স্মৃতিচারণ করে অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম এক সাক্ষাৎকারে বলেন-“দুই ভাবে তখন বামপন্থীদের কোণঠাসা করা হয়েছে। মুজিব বাহিনীর লোকেরা দুইভাবে বামপন্থীদের পর্যুদস্ত করেছে। একটা প্রত্যক্ষভাবে, রক্ষীবাহিনী দিয়ে, গ্রামেগঞ্জে অত্যাচার করে, মেরে। আর এদিকে, যে তরুণরা বামপন্থী হবে তাদের নিয়ে নিচ্ছে। ঠেলে দিচ্ছে তাদের সামনে। এক্সপোজ করে দিচ্ছে। ভবিষ্যতের বামপন্থীদের, তরুণদের তুলে ধরছে যাতে রক্ষীবাহিনী এদের মারতে পারে অনায়াসে। সরাসরি, এবং অপ্রত্যক্ষভাবে- দু’ভাবেই। মুজিব বাহিনী আর জাসদ একই। ষড়যন্ত্রটা পরিষ্কার ছিল না, এখন এটা ক্রমশই পরিষ্কার হচ্ছে।”
১৯৬৭ সালে বিশ্বব্যাপী প্রগতিশীল রাজনীতির এক ঐতিহাসিক বিতর্কে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এর মধ্যে একটি গ্রুপ ১৯৬৯ সালে শ্রমিক কৃষক মেহনতি জনতার সাথে একাত্ম হয়ে গ্রামে-গঞ্জে, কলে-কারখানায় ছড়িয়ে পড়ে। অন্যটি উগ্র-জাতীয়তাবাদী শ্লোগানের জোয়ারে ভেসে যায়। পরবর্তীতে সেটির বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন নামকরণ ঘটে। এর বাইরেও ক্রিয়াশীল থাকে বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়ন ও বাংলা ছাত্র ইউনিয়ন নামে দুটি ছাত্র সংগঠন। এর মধ্যে জাসদ ছাত্রলীগসহ ছাত্রলীগের দুটি অংশ ও ছাত্র ইউনিয়ন তখন আওয়ামী সরকারের রাজনৈতিক অনুকূলে। ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্রলীগ (মুজিববাদ) মিলে এক সংগঠন হয়ে যাওয়ার উপক্রম তখন। অথচ রুশ সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ ও তার দালাল ভারতের মদদে এ দেশের জোতদার-মুৎসুদ্দি শ্রেণীর প্রতিভূ হিসাবে মুজিব সরকার নিপীড়িত শ্রেণীর উপর চালায় জুলুম নির্যাতন। উগ্র-বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের জোয়ার সৃষ্টি করে ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বা সমূহের অধিকার বিলোপ করা সহ প্রগতিশীল রাজনীতিকে স্তব্ধ করার ভূমিকা গ্রহণ করে। এই ঐতিহাসিক বাস্তবতায় জরুরি হয়ে দাঁড়ায় চলমান এ অবস্থার বিরুদ্ধে প্রগতিশীল ছাত্র আন্দোলন গড়ে তোলা।
মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে তখন ‘ন্যাপ’ জাতীয় অঙ্গণে শাসক গোষ্ঠীর স্বরুপ উন্মোচন করে। মুজিব সরকারের নির্যাতন ও তা প্রতিরোধ করার ভূমিকা রাখার প্রেক্ষাপটে ছাত্র অঙ্গণে বাংলা ছাত্র ইউনিয়ন, বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়নসহ প্রগতিশীল ছাত্রগ্রুপ ও সাধারণ ছাত্ররা ঐক্যবদ্ধভাবে মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ১৯৭৩ সালের ২৩ আগস্ট ঢাকা বিশ্বিদ্যালয়ের ছাত্র শিক্ষক কেন্দ্রে গঠণ করা হয় বিপ্লবী ধারার ছাত্র সংগঠন জাতীয় ছাত্রদল। জাতীয় ছাত্রদল তার মূল রাজনৈতিক বক্তব্য হিসাবে সামনে নিয়ে আসে সমাজতন্ত্রের লক্ষ্যে জাতীয় মুক্তি, স্বাধীনতা এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম।
১৯৭৩ সালে জন্ম লগ্ন থেকেই জাতীয় ছাত্রদলের উপর নেমে আসে জুলুম নির্যাতন। সারাদেশে এ সংগঠনের নেতা কর্মিদের উপর হত্যা নির্যাতন চালানো হতে থাকে। অনেক নেতা-কর্মি শহীদ হোন। এ ছাড়া ৭৪-এ বিশেষ ক্ষমতা আইন জারীর পর ব্যাপক গ্রেফতার নির্যাতন চালানো হয়। ৭৫-এর ২০ জানুয়ারী ‘বাকশাল’ গঠিত হলে অন্য সকল বিরোধী দলের মতো জাতীয় ছাত্রদলকেও নিষিদ্ধ করা হয়। জাতীয় ছাত্রদল ও তার রাজনীতিকে স্তব্ধ করে দিতে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানো হয় এবং মুজিব আমলে নিহত হাজার হাজার বামপন্থি কর্মির মধ্যে অনেকেই ছিলেন জাতীয় ছাত্রদলের সদস্য। জাতীয় ছাত্রদল এ সকল বাধা বিপত্তিকে অতিক্রম করে প্রগতিশীল ছাত্র রাজনীতিকে বিকশিত করে চলে। অন্যান্য ছাত্র সংগঠনসমূহের শ্লোগান ও মূলনীতি রাজনীতি বিমূর্ত থাকলেও জাতীয় ছাত্রদলের মূলনীতিগুলো সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক দর্শনের আলোকে রচিত। ফলে জাতীয় আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক গতি প্রকৃতির প্রভাব ছাত্রসংগঠনসমূহের উপর পড়লেও জাতীয় ছাত্রদল তার রাজনৈতিক অবস্থানে অটল থেকেছে। অনেকেই বিভ্রান্ত, বিচ্যুত ও সুবিধাবাদী ধারায় পতিত হয়েছে। কিন্তু জাতীয় ছাত্রদল তার লক্ষ্যের দিকে অবিচল থেকেছে।
১৯৭৭ সালে মমিন-জাপি’র নেতৃত্বে একটি অংশ জিয়া সরকারকে ‘জাতীয় সরকার’ হিসাবে চিহ্নিত করে। ছাত্র অঙ্গণে এরা ছাত্র সমাজের শ্রেণীগত সীমাবদ্ধতাকে অস্বীকার করে ‘মার্কসবাদী লেনিনবাদী’ বক্তব্যকে সামনে আনে। এদের রাজনৈতিক বক্তব্যের সমর্থনে ৭৭ সালে জাতীয় ছাত্রদল থেকে একটি অংশ বের হয়ে ‘জাতীয় ছাত্র আন্দোলন’ গঠন করে। একই বক্তব্য দিয়ে মোবারক ঢালী নামে একটি অংশ বেরিয়ে যায়। পরবর্তীতে এরা কিছুদিন জাতীয় ছাত্রদল (রিজভী-ঢালী) নামে সক্রিয় থাকে। জাতীয় ছাত্রদল জন্মলগ্ন থেকে সাম্রাজ্যবাদ সামন্তবাদ বিরোধী প্রগতিশীল সংগঠন ন্যাপ ভাসানীর সমর্থক ছাত্র সংগঠন হিসেবে সক্রিয় থাকে। কিন্তু ১৯৭৮ সালে মশিউর রহমান যাদু মিয়ার নেতৃত্বাধীন ন্যাপ এবং কাজী জাফরের ইউ পি পি পার্টি জিয়াউর রহমানের সাথে ঐক্যবদ্ধভাবে জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট গঠন করে। তখন মশিউর রহমানের সমর্থক একটি অংশ মোস্তাক আলমের নেতৃত্বে জাতীয় ছাত্রদল থেকে যেয়ে বিএনপি-তে যোগ দেয়। ৭৮’সালে জাতীয় ছাত্রদলের অপর আরেকটি অংশ যেকোন প্রকারেই বামপন্থি ছাত্রদের ঐক্যের কথা বলে আলাদা হয়ে সাইফুল- মিঠুর নেতৃত্বে ‘ছাত্র ঐক্য ফোরাম’ গঠন করে। এদের অনেকে পরবর্তীকালে এনজিও-দের সাথে হাত মিলিয়েছে । এছাড়া ১৯৮০ সালে সুবিধাবাদী তিন বিশ্ব তত্ত্বকে সামনে নিয়ে একটি অংশ জাতীয় ছাত্রদল থেকে আলাদা হয়ে হারুন-মেজবা’র নেতৃত্বে বাংলাদেশ ছাত্রমৈত্রী গঠন করে।
বিভিন্ন মোহ ও প্রবণতায় অনেকে বের হয়ে গেলেও জাতীয় ছাত্রদল সকল চক্রান্তকে মোকাবেলা করে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ, রুশ সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ ও সামন্ত দালাল পুঁজিবিরোধী ছাত্র রাজনীতিকে সমৃদ্ধ করেছে। জিয়া স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে যেয়ে অভ্যন্তরীণ চক্রান্ত মোকাবেলা করার পাশাপাশি পৈশাচিক নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে। এতে অনেক নেতা-কর্মি নিহত-আহত হওয়ার পাশাপাশি জেল-জুলুম ভোগ করেছেন। ৮২’তে এরশাদ ক্ষমতায় আসলে সামরিক স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে প্রথমেই জাতীয় ছাত্রদল প্রতিবাদ সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়। এরশাদ স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে সর্বদলীয় ছাত্র আন্দোলন গড়ে তোলার আহবান জানায় সংগঠনটি । এই স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে প্রথমে গ্রেফতার হন জাতীয় ছাত্রদল নেতা শ্যামল ভৌমিক। এ সময় জাতীয় ছাত্রদল রুশ-মার্কিন বিরোধী ‘সংগ্রামী ছাত্র ঐক্য’ গড়ে তোলার চেষ্টা করলেও কতিপয় বাম ছাত্র সংগঠনগুলোর বিভিন্নমুখী প্রবণতার কারণে ব্যর্থ হয়। ১৯৮৪ সালে এরশাদ নির্বাচনের ঘোষণা দিলে জাতীয় ছাত্রদলই প্রথম স্বৈরাচারের অধীনে সকল নির্বাচন বর্জনের শ্লোগান তোলে। যা পরবর্তীকালে ছাত্রসমাজসহ জাতীয় অঙ্গণে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। এরপর এরশাদ স্বৈরাচার ও নির্বাচন বিরোধী ঐক্যবদ্ধ ছাত্র আন্দোলন গড়ে তোলার আকাঙ্খাকে ধারণ করে জাতীয় ছাত্রদল ২২ ছাত্র সংগঠনে যোগ দেয়। এসময় রচিত হয় ছাত্র সমাজের প্রাণের দাবি ১০ দফা। এছাড়া যুক্ত হয় শ্রমিকের ৫ দফা এবং কৃষকদের ১৭ দফা। সামরিক স্বৈরাচার এরশাদের পতনের পর ছাত্র-শ্রমিক-কৃষকদের উল্লেখিত দাবি পূরণের প্রতিশ্রুতি দিয়ে পরবর্তীতে অনেক নির্বাচিত সরকার আসলেও কেউই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে নি।
জাতীয় ছাত্রদল আজ ৪৮তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন করছে। প্রায় বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সমবয়সী এই সংগঠনটি সুদীর্ঘ সময়ে বিভিন্ন কণ্টকাকীর্ণ প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবেলা করে অগ্রসর হয়েছে। বন্ধুর এই সাংগঠনিক পরিক্রমায় অনেক মেধাবী ও সংগ্রামী ছাত্র নেতৃত্বগণ দায়িত্ব পালন করেছেন। জাতীয় ছাত্রদল থেকে রাজনীতির হাতে খড়ি নিয়ে এখনো দেশে জাতীয় মুক্তি, স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে অনেক প্রথিতযশা রাজনীতিক ব্যাপৃত রয়েছেন। তাঁরা বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষের মাঝে এখনো নিরলসভাবে সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ ও আমলা-দালাল পুঁজিবিরোধী সংগ্রামে অবিচল ভূমিকা রেখে চলেছেন। ৪৮তম প্রতিষ্ঠবার্ষিকী উপলক্ষে জাতীয় ছাত্রদলের উল্লেখযোগ্য সাবেক কয়েকজন নেতৃত্ব তাঁদের সাংগঠনিক দায়িত্ব পালনকালীন রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক অভিজ্ঞতােএবং চ্যালেঞ্জসমূহ কিরুপে মোকাবেলা করেছেন সে সম্পর্কে বর্ণনা করেছেন।
চৌধুরী আশিকুল আলম: এরশাদ ক্ষমতায় এসে সামরিক শাসন জারি করলে বাংলাদেশের ছাত্র সমাজ এর প্রতিবাদে ফুঁসে ওঠে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সামরিক শাসনের প্রতিবাদে মিছিল সমাবেশের মধ্যদিয়ে এর প্রকাশ ঘটে। আমি তখন জাতীয় ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি। সভাপতি ছিলেন মেধাবী ছাত্রনেতা আবু সাঈদ বিশ্বাস এবং সাধারণ সম্পাদক সালাহউদ্দিন আহমেদ । উনারা দুইজনই তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। আমি খুলনায় থাকতাম। সালটা এখন মনে নেই, শিক্ষা জীবন শেষে আবু সাঈদ ভাই চাকরিতে যোগদান করেন। ছাত্রদলের নিয়ম অনুযায়ী তাঁকে অব্যাহতি নিতে হবে , কিন্তু উনি তা নেবেননা । তখন ছাত্র দলের কেন্দ্রীয় কমিটি রাজনৈতিক এবং সাংগঠনিক বিষয়ে কঠোর নিয়ম অনুসরণ করে। দীর্ঘ প্রায় এক বছর কেন্দ্রীয় কমিটির সভাগুলোতে এ নিয়ে আলোচনা চলে। তখন ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় অফিস ছিলো ভিক্টোরিয়া পার্কের পাশে । শেষ পর্যন্ত কেন্দ্রীয় কমিটির সভায় দীর্ঘ আলোচনার পর সাঈদ ভাইকে কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে অপসারণ ( সম্ভবত) করা হয় এবং ১৯৮২ সালে আমাকে ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব দেওয়া হয়। আমি পরবর্তী সম্মেলন ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত এই পদে ছিলাম । ঐ সময়ে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে কয়েক বছর ধরে তিন বিশ্ব তত্ত্ব নিয়ে বেশ একটা লড়াই চলছিলো। আমরা তিনবিশ্ব তত্ত্ব এবং এর অনুসারীদের সংগঠন ভাঙ্গা এবং বিলোপের ষড়যন্ত্র চক্রান্ত মোকাবিলা করে রাজনীতি ও সংগঠনকে রক্ষার সংগ্রামের পাশাপাশি সামরিক স্বৈরাচার এর বিরুদ্ধে লড়াই সংগ্রামে অগ্রণী ভূমিকা পালন করি।
মনসুরুল হাই সোহন: আমি জাতীয় ছাত্রদলের সেক্রেটারির দায়িত্ব গ্রহণ করি ১৯৮৫ সালের ১৬ নভেম্বর জাতীয় সম্মেলনের মাধ্যমে। সম্মেলনে সভাপতি নির্বাচিত হোন সালাউদ্দিন আহমেদ। এরশাদের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে তখন তুমুল আন্দোলন চলছিল। কিন্তু আন্দোলনকে একক ভাবে এগিয়ে নেয়ার মতো সাংগঠনিক শক্তি আমাদের নেই। এমন অবস্থায় শিক্ষাঙ্গনের বিভিন্ন সমস্যার সাথে সাথে সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে সংগঠন। সেই প্রেক্ষিতে ঐক্যবদ্ধ ছাত্র আন্দোলন গড়ে তোলার লক্ষ্যে সারাদেশে বিশেষত শহরাঞ্চলের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে সাংগঠনিক শক্তি বৃদ্ধি করার ওপর গুরুত্ব প্রদান করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ২২টি ছাত্র সংগঠনের মাধ্যমে ইস্যুভিত্তিক আন্দোলনে সংগঠনকে শামিল করা হয়। পাশাপাশি সংগঠনের নিজস্ব বক্তব্য নিয়ে ছাত্র সমাজকে ঐক্যবদ্ধ করার প্রয়াস চালানো হয়। তাছাড়া এককভাবেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে আন্দোলন-সংগ্রাম গড়ে তোলার পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়।
পরবর্তী ১৯৮৮ সালের সম্মেলনে আমি সভাপতি এবং তোজাম্মেল হোসেন সেক্রেটারি নির্বাচিত হোন। ইতিমধ্যে ৯০-এর ছাত্র আন্দোলনের লক্ষণ দেখা দেয় এবং চারদিকে এরশাদ বিরোধী আন্দোলন শুরু হয়। আন্দোলনকে ধারাবাহিকভাবে বেগবান করার জন্য ১৯৯০ সালে অনুষ্ঠিত সম্মেলনেও আমি সভাপতি এবং রেজাউল করিম শিল্পী সেক্রেটারি নির্বাচিত হোন। ১৯৯০ সালের ১০ অক্টোবর সচিবালয় ঘেরাও আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে ছাত্রনেতা জেহাদ ও মুনির নিহত হোন এবং চারদিকে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন তীব্র হয়ে উঠে। জেহাদ-মুনীরের লাশ সামনে রেখে চব্বিশটি ছাত্র সংগঠন ঢাবির অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে এরশাদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক সংগ্রাম গড়ে তোলার লক্ষ্যে সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য গড়ে তোলা হয়। জাতীয় ছাত্রদল উক্ত আন্দোলনে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করে। আন্দোলনের শুরুতেই জাতীয় ছাত্রদলসহ আরো কয়েকটি বামপন্থী ছাত্র সংগঠনের চেষ্টা থাকে আন্দোলনে বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষকে সংগঠিত করার। সে প্রেক্ষিতে সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের উদ্যোগে প্রথমে শ্রমিকদের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে ঢাকার তেজগাঁওয়ে ছাত্র ও শ্রমিক-জনতার বিশাল জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। পরবর্তীতে কৃষকদের সাথেও যৌথ উদ্যোগে নরসিংদীতে ছাত্র-কৃষক-জনসভা করা হয়। এসব জনসভায় কেন্দ্রীয় কৃষক ও ছাত্র সংগঠনের নেতারা বক্তব্য রাখেন।
সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য ও সারাদেশে শ্রমিক-কৃষক-জনগণের দুর্বার আন্দোলন বেগবান হতে থাকায় এরশাদের পতন তখন সময়ের দাবি হয়ে উঠে। সর্বশেষ ১৯৯০ সালের ২৪ শে নভেম্বর জিরো পয়েন্ট (নূর হোসেন চত্ত্বর) এ কয়েক লক্ষ লোকের এক বিশাল ছাত্র-জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। এরশাদের পতনের পূর্বে সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের এটিই ছিল সর্বশেষ সমাবেশ। তৎকালীন ছাত্রলীগের সভাপতি হাবিবুর রহমান হাবিব এর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সংক্ষিপ্ত সমাবেশে জাতীয় ছাত্রদলের সভাপতি হিসেবে আমি, ডাকসুর তৎকালীন ভিপি আমানউল্লাহ আমানসহ আরো দুই একজন বক্তব্য রাখেন। এরশাদের পেটুয়া বাহিনীর আক্রমণের আশংকায় তাড়াহুড়া করে সমাবেশ শেষ করতে হয়। পরদিন ছাত্র নেতাদের বক্তব্য দৈনিক পত্রিকাসমূহে ফলাও করে প্রচার করা হয়। ওইদিন থেকে এরশাদের পতনের আগ পর্যন্ত আর পত্রিকা প্রকাশ হয়নি।
এরশাদের পতনের পদত্যাগের ঘোষণার পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান কে হবেন তা নিয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি’র দ্বন্দ্বে ৪ থেকে ৬ ডিসেম্বর’৯০ সালে দেশে কোন সরকার ছিল না। বলা হয় তখন মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে এবং ছাত্রনেতাদেরও চাপের মুখে পড়ে শাহাবুদ্দিন আহমেদকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে দুই দলই মেনে নেয়। তখন জাতীয় ছাত্রদলের বক্তব্য ছিল সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য, শ্রমিক-কর্মচারী ঐক্য পরিষদ, কৃষক সংগঠনসমূহ, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, বিএমএ ও সাংবাদিক সংগঠনগুলোসহ আন্দোলনরত সকল শ্রেণী-পেশার মানুষের দাবি বাস্তবায়নে একটি ঐক্যবদ্ধ জাতীয় সরকার গঠন করা। যে সরকারের প্রধান কাজ হবে এসব সংগঠনগুলোর দাবি বাস্তবায়ন করা এবং একটি গণতান্ত্রিক সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কার ও পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। কিন্তু নির্বাচন মুখী আওয়ামীলীগ, বিএনপি ও তথাকথিত বামপন্থিদের তিনটি জোটের রূপরেখা অনুযায়ী সংসদীয় সরকার পদ্ধতির দাবিটি প্রাধান্য পায় এবং শাহাব উদ্দিন সাহেবকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান করা হয়। এভাবে জাতীয় ছাত্রদলের দাবিকে উপেক্ষা করা হয়। তবে জাতীয় ছাত্রদল ওই সময়ে বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষদেরকে নিয়ে আন্দোলন গড়ে তোলে এবং জাতীয় গণতান্ত্রিক সরকারের দাবি সামনে আনে। তখন জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্টের ব্যানারে জাতীয় ছাত্রদলের বক্তব্যকে সামনে আনা হয়। এরপরের ঘটনা সবারই জানা । সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে দেশে সংসদীয় সরকার পদ্ধতি চালু হয়, কিন্তু জনগণের দুর্ভোগ কেয়ারটেকার সরকার বা নির্বাচিত সরকার কেউই লাঘব করতে আসে নি। বরং এরশাদ স্বৈরাচারী সরকারের মত পরবর্তীতে তথাকথিত নির্বাচিত সরকারগুলিও জনগণের উপর অত্যাচারের স্টিম রোলার চালাচ্ছে। তাই দু:খ করে কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সাথে গলা মিলিয়ে বলতে হচ্ছে- “শুয়োরের বাচ্চারাই সভ্যতার নামে জিতে গেলো।”
ওবায়দুল্লাহ সাগর: জাতীয় মুক্তি,স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লড়াইকে অগ্রসর করার লক্ষ্যে নানা প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে ,নানা রকম চড়াই-উতরাই, বিভক্তি-বিভাজন এবং জীবনদান সত্ত্বেও জাতীয় ছাত্রদল রাজনৈতিক, সাংগঠনিক কর্মসূচি অগ্রসর করে চলে। ১৯৯২-১৯৯৪ কালপর্বে সংগঠনের সভাপতি হিসেবে আমি দায়িত্ব পালন কালে সাংগঠনিক আদর্শ ও লক্ষ্যে অবিচল থেকে ছাত্রদের ন্যায়সঙ্গত অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম চালিয়ে যাই। এ সময় সংগঠন মূলত যে ভূমিকা পালন করে তা হলো: (ক) সংশোধনবাদী রাজনীতির ধারাবাহিকতায় (১৯৮৯-১৯৯১) সালে পূর্ব ইউরোপ ও রাশিয়ার কথিত সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের পতনের পর, চীনের সংশোধনবাদী ও ভারতের আমাদের জাতীয় স্বার্থ বিরোধী নানাবিধ ভূমিকার বিপরীতে এদেশের ছাত্র অঙ্গনে সাম্রাজ্যবাদ-সামন্তবাদ বিরোধী প্রগতিশীল রাজনীতির পতাকা ঊর্ধ্বে তুলে ধরে। এ সময় সাংগঠনিক শক্তি দৃশ্যমান রূপে বৃদ্ধি পায় । (খ) ক্ষমতাসীন বিএনপি ও ক্ষমতা প্রত্যাশী আওয়ামী লীগের লেজুড় ছাত্র সংগঠনগুলো সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের ১০দফা ধূলায় নিক্ষেপ করলেও জাতীয় ছাত্রদল ১০-দফার ভিত্তিতে ছাত্রদের দাবী-দাওয়া ভিত্তিক ঐক্যবদ্ধ ছাত্র আন্দোলন তৈরির প্রচেষ্টা চালায়। (গ) ১৯৯০ সালে স্বৈরশাসক এরশাদের পতনের পর এদেশে ছাত্র রাজনীতির সরকার বিরোধী ধারা পুরোপুরি বিলুপ্ত করে ক্ষমতাসীনরা । ছাত্র সংগঠনকে সরকারি দলের লাঠিয়ালের ভূমিকায় অবতীর্ণ করে। এখন যা চূড়ান্ত রূপ লাভ করেছে। জাতীয় ছাত্রদল এ ধারার বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক আন্দোলন অব্যাহত রাখার প্রচেষ্টা চালায়। (ঘ) চর দখলের মতো হল ও ক্যাম্পাস দখলের রাজনীতির বিরুদ্ধে নেয়। ফলে, বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ও জেলা শাখায় হামলা-মামলার মুখোমুখি হতে হয়। (ঙ) তৎকালীন ক্ষমতাসীন দল বিএনপি জোট ও ক্ষমতা প্রত্যাশী আওয়ামী লীগ জোটের জাতীয় ও জনস্বার্থ বিরোধী ‘ভারতীয় দালাল নির্মূল কমিটি'(ভাদানিক)এবং ‘ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি'(ঘাদানিক) এর আন্দোলনের বিপরীতে ছাত্রদের ন্যায়সঙ্গত অধিকার ভিত্তিক আন্দোলন তৈরির এবং শ্রমিক, কৃষক, মেহনতি মানুষের আন্দোলনের সাথে থাকার প্রচেষ্টা চালায়। (চ) এ সময় সরকারের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ সহযোগিতায় সাম্প্রদায়িক সংগঠন ছাত্র শিবিরের ব্যাপক উত্থান ঘটে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন ক্যাম্পাস তাদের সন্ত্রাসের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়। এ বিষয়টি কাজে লাগিয়ে ছাত্রলীগ ও কথিত বামপন্থী সংগঠনগুলো সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী ঐক্যবদ্ধ ছাত্র আন্দোলনের কথা বলে। জাতীয় ছাত্রদল এ সময় সাম্প্রদায়িকতা ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সমন্বিত আন্দোলনের প্রস্তাব করলে-এসব সংগঠন তা গ্রহণ করতে অস্বীকার করে। যা এদের রাজনৈতিক চরিত্রের অংশ। (ছ) সরকারের হামলা-মামলার পাশাপাশি সাম্প্রদায়িক শক্তি ও প্রতিবিপ্লবী সন্ত্রাসীদের আক্রমণের মুখোমুখি হয় সংগঠন। তবুও সংগঠন একক কিংবা সমন্বিত কর্মসূচি গ্রহণ করে ছাত্রদের অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা চালায়। এদেশে রঙ-বেরঙের সরকার এসেছে, গেছে। তবুও ছাত্রদের সমস্যার সমাধান হয়নি। মানুষের মৌলিক অধিকার শিক্ষা এখন বেচা-কেনার দামি পণ্য। প্রতিষ্ঠা পায়নি সার্বজনীন, বিজ্ঞান ভিত্তিক, একমুখী শিক্ষার দাবি। তাই, জাতীয় ছাত্রদলের জাতীয় মুক্তি,স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লড়াই আজও অব্যাহত রয়েছে। পথ আঁকাবাঁকা হলেও বিজয় অনিবার্য।
বি এম শামীমুল হক: এদেশে ছাত্র সমাজের মধ্যে জাতীয় মুক্তি, স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের চেতনার বিকাশ, গণমুখী বিজ্ঞান ভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে জাতীয় ছাত্রদল ধারাবাহিকভাবে তার তৎপরতা অব্যাহত রেখেছে। এই তৎপরতার অংশ হিসেবেই আমি সংগঠনের ১৯৯৪ সালে ও ১৯৯৭ সালের সম্মেলনে সভাপতি নির্বাচিত হই। সংগঠনের দায়িত্ব পালন কালীন সময়ে জাতীয় ছাত্রদল ছাত্র সমাজের নিজস্ব দাবি আদায়ের আন্দোলনের সাথে সাথে স্বৈরতান্ত্রিক এ রাষ্ট্রব্যবস্থা ও স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রামেও তৎপর রয়েছে। ফলে সংগঠনের একজন সাবেক কর্মী হিসেবে নিজেকে গর্বিত মনে করি। এ সংগঠন এমন একটি দৃষ্টিভঙ্গি গঠনে সহায়তা করেছে যে, ব্যক্তি ও সমষ্টির স্বার্থের দ্বন্দ্বকে বুঝতে পারা এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির গতি প্রকতিকে যথার্থভাবে মূল্যায়ন করতে পারার সক্ষমতা অর্জিত হয়েছে। ১৯৯০ সালে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের মধ্যদিয়ে ছাত্রসমাজের ১০ দফা দাবী প্রণীত হলেও পরবর্তী কোন সরকার সে দাবি বাস্তবায়ন করেনি। ফলে আমাদের সময়েও ছাত্র সমাজের ১০দফা দাবি আদায়ের আন্দোলন অব্যাহত থাকে।
২০০০ সালের ২০ মার্চ আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের বাংলাদেশ সফরের প্রতিবাদে জাতীয় ছাত্রদল প্রতিবাদ জানায়। এ সময় জাতীয় ছাত্রদলসহ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী ১২টি ছাত্র সংগঠনের জোট গড়ে ওঠে। এ জোটের নেতৃত্বে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও অপরাপর সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী মিছিল, মিটিং ও বিক্ষোভ সমাবেশ করা হয়।
প্রকাশ দত্ত: জাতীয় ছাত্রদলের ১৯৯৭ সালের সম্মেলনে আমি সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হই। পরবর্তীতে ২০০০ সালে ও ২০০৩ সালে সম্মেলনে সভাপতি নির্বাচিত হই। সংগঠনটি প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে সাম্রাজ্যবাদ , সামন্তবাদ ও আমলা-দালাল পুঁজি বিরোধী লড়াইকে অগ্রসর করতে গিয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সকল প্রকার প্রবণতার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক ও সাংগঠনিকভাবে সংগ্রামের মাধ্যমে মোকাবেলা করেই পথ চলতে হয়েছে। ২০০৩ সালে সম্মেলনের পর সংগঠন-সংগ্রাম বিকাশের ক্ষেত্রে সংগঠনের অভ্যন্তরে একটি কুচক্রি মহলের ষড়যন্ত্র মোকাবেলার পাশাপাশি জাতীয় ক্ষেত্রে উগ্র-বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ ও উগ্র-সাম্প্রদায়িকতার জোয়ারের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হয়। একইসাথে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নেতৃত্বে আগাম যুদ্ধ পরিকল্পনার অংশ হিসাবে প্রতিপক্ষের প্রস্তুতির আগেই বিশ্ব বাজার দখলের লক্ষ্যে ২০০১ সালে আফগানিস্তান এবং ২০০৩ সালে ইরাক আক্রমনের মধ্য দিয়ে যে যুদ্ধের সূচনা করে তার বিরুদ্ধে জাতীয় ছাত্রদল যুদ্ধের জন্য দায়ী পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সংগ্রাম বেগবান করতে ছাত্র অঙ্গনে তৎপর থাকে।
১৯৯০ সালে সোভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের উলঙ্গ পতনের পর বিরাষ্ট্রীয়করণের সামগ্রিক যে যাত্রা শুরু হয় তার একটি বড় ক্ষেত্র হয় শিক্ষা ব্যবস্থা। ফলে শিক্ষা ব্যবস্থার বাণিজ্যিকীকরণ, বৈষম্য ও শিক্ষাঙ্গনে একচেটিয়া সরকারদলীয় ছাত্র সংগঠনের দখলদারিত্ব ও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ ছাত্র আন্দোলনের ডাক দিয়ে জাতীয় ছাত্রদল কর্মকান্ড চালাতে থাকে। পাশাপাশি সাম্রাজ্যবাদ ও তার দালালদের স্বার্থে ছাত্র রাজনীতিকে বিরাজনীতিকরণের যে ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত তার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক সংগ্রামকে উর্ধে তুলে ধরে তৎপরতা চালাতে থাকে।