টাকার জন্য সন্তানদের স্কুলে ভর্তি করাতে পারছেন না ম্যাজিস্ট্রেট মুহাম্মদ ইউসুফ
শামসুন নাহার: শাহজালাল বিমানবন্দরের ভ্রাম্যমাণ আদালতের আলোচিত ম্যাজিস্ট্রেট মুহাম্মদ ইউসুফ। বিমানবন্দরে একের পর এক অনিয়ম প্রতিরোধ করে খুব দ্রুতই আলোচনায় আসেন এই নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট। সৎ থাকার কারণে বারবার ঘরে-বাইরে হুমকির সম্মুখীন হলেও এবার তিনি নিজের ব্যক্তিগত জীবনেই পড়েছেন দারুণ সমস্যায়। টাকার অভাবে নিজের দুই বাচ্চাকে স্কুলে ভর্তি করাতে পারছেন না। গত ৬ দিন থেকে উত্তরার বিভিন্ন স্কুলে চেষ্টা করেও ভর্তি করাতে পারেননি তিনি।
শাহজালালে যাত্রীদের আস্থার অপর নাম হয়ে ওঠা ইউসুফ। বাধ্য হয়েই সোশ্যাল মিডিয়া ফেসবুকের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর দ্বারস্থ হয়েছেন এই সরকারি কর্মকর্তা। ফেসবুকে তিনি লিখেছেন-
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, অবাক লাগতো, সরকারি অফিসাররা কেন দুর্নীতি করে! আজ আর লাগে না। ক্ষোভ হয়। কেন আসলাম সরকারি চাকরিতে! দেশের সেবা করতে এসেছি, আমার পরিবার সন্তান কি এদেশের বাইরে? ক্লাস সিক্সের এক সন্তানকে ভর্তি করাতে ১৮ হাজার টাকা দিতে হয়, মাসে ২-৩ হাজার টাকা বেতন দিতে হয়। অথচ আপনি আমাকে দিচ্ছেন দুই বাচ্চার জন্য মাসে মাত্র এক হাজার টাকা শিক্ষা ভাতা, অর্থাৎ প্রতি বাচ্চার জন্য মাসে ৫ শ টাকা। এই অবস্থায় আমি কি করতে পারি? ১.দুর্নীতির আশ্রয় নিতে পারি ২.বাচ্চাদের পড়াশোনা বন্ধ করে দিতে পারি।
লিখেছেন, ম্যাজিস্ট্রেট ইউসুফের সাথে এ বিষয়ে কথা বললে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, আমাকে ভাড়া বাসায় থাকতে হয়। চাকরি থেকে যে বেতন পাই তার অধিকাংশ টাকাই চলে যায় বাসা ভাড়ায়। এরপরে যে টাকা থাকে সেটা দিয়ে সংসারের ৩০ দিনের খাবারের তালিকা করতে হয়। ভর্তা, আর ডাল দিয়েই চালাতে হয় মাসের অধিকাংশ সময় এই অবস্থায় আমি কীভাবে এতো টাকা দিয়ে বাচ্চাকে পড়াবো?
ইউসুফ বলেন, আমার সরকারি বাসা পাবার কথা। আমার নামে সিভিল এভিয়েশন থেকে একটা বাসাও বরাদ্দ করা হয় কিন্তু বাসা আমাকে বুঝিয়ে দেওয়া হয় নি। অন্যজন সেই বাসায় থাকে। আমার নামে বরাদ্দ হলেও আমি বাসা পাই না। সেটাও বড় কথা না। আমাকে এয়ারপোর্টের কাছাকাছি থাকতে হয়। এই এলাকায় সরকারি স্কুল তেমন নেই। কাল উত্তরা গার্লস স্কুলে বাচ্চাকে ভর্তি করাতে গিয়ে আমি চোখের পানি ধরে রাখতে পারি নি। আমার মতো অনেকেই বাচ্চাদের ভর্তির জন্য পায়ে ধরার মতো অবস্থা। কিন্তু উপায় নেই।
ইউসুফ সাংবাদিকদের বলেন, এই অবস্থায় আমি আবেদন করবো আমাকে যেন খাগড়াছড়ি, বান্দরবান বদলি করা হয় যেখানে অন্তত স্কুলে বাচ্চাদের পড়াতে মাসে এতো টাকা লাগবে না। প্রতিবছর ১৮-২২ হাজার টাকা ভর্তি করাতে লাগবে না।
ম্যাজিস্ট্রেট ইউসুফ প্রতিবেদকের সাথে কথা বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন। তিনি বলেন আজ আমার বাচ্চারা তার নানি বাসায় চলে গেছে। গত ৬ দিন থেকে স্কুলে ভর্তি করানোর কথা বলে আসছিল, আর আমিও গোটা উত্তরা এলাকায় আমার দুই বাচ্চাকে ভর্তি করাতে ব্যর্থ হয়ে চলে এসেছি। আমার বাচ্চারা মেধাবী। উত্তরার আশেপাশে সরকারি স্কুল এভেইলেবল না। আমি কীভাবে উত্তরার বাইরে নিয়ে গিয়ে তাঁদের ভর্তি করাবো? আমাকে তো অফিসের বিষয়ে ২৪ ঘণ্টা এলার্ট থাকতে হয়।
ইউসুফ বলেন, শুধু আমি নই সারা ঢাকা শহরে হাজার হাজার বাচ্চার অভিভাবক চিন্তিত। এতো টাকা দিয়ে বাচ্চাদের পড়াবেন কী করে। আমাদের কাছে তো ১৮ হাজার এবং প্রতিমাসে ২-৩ হাজার টাকা অনেক টাকা।
ইউসুফ ফেসবুকে প্রধানমন্ত্রীর নিকট আবেদন জানিয়ে লিখেছেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। আমি বলবোনা, আমাদের এই গরীব দেশে দুই বাচ্চার জন্য শিক্ষাভাতা ১ হাজার টাকার বেশী হোক। আমরা চাই, সরকারি বেসরকারি স্কুলগুলোর এই লাগামহীন বেতনবৃদ্ধির লাগাম টেনে ধরা হোক, যাতে আমার মত আর কাউকে সন্তানের পড়ালেখা বন্ধের সিদ্ধান্ত না নিতে হয়।’
উল্লেখ্য, ম্যাজিস্ট্রেট ইউসুফ শাহজালাল বিমানবন্দরের অনিয়ম দুর্নীতি রোধে কঠোরভাবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন, যার ফলে বিমানবন্দর এলাকায় যাত্রী হয়রানি থেকে শুরু করে সমস্ত অনিয়ম অনেকটাই কমে গেছে। সোশ্যাল মিডিয়াতেও ইউসুফের কর্মকাণ্ড ব্যাপকভাবে প্রশংসিত। গত কয়েক মাস পূর্বে ইউসুফ অসুস্থ শুনে মাত্র ৩ দিনে ১০ লাখ টাকা যোগাড় করে ফেলে ফেসবুক ব্যবহারকারীরা। মাত্র কয়েকদিনে ইউসুফের নামে ফান্ডে জমা হয় ৩০ লাখ টাকা। পরে অবশ্য বড় কোনো অসুস্থতা পরীক্ষা ধরা না পড়ায় সেই ৩০ লাখ টাকা ব্যয় হয় গরিব দুঃস্থদের চিকিতসায়। যাত্রীদের আস্থার অপর নাম হয়ে ওঠে ইউসুফ।
ম্যাজিস্ট্রেট ইউসুফের বাড়ি নোয়াখালী জেলার হাতিয়া থানায়। তিনি নোয়াখালীর সূবর্ণচরে মাত্র কয়েক কাঠা জমি কিনে বাড়ি করেন। বর্তমানে ঢাকায় বিমান বন্দরের কাছাকাছি ভাড়া বাসায় থাকেন।
(লেখকঃ এডিটর, জনকন্ঠ নিউজ)