অন্যান্যঅর্থনীতি

নান্দাইলের শেফালি যেন এ যুগের আসমানি

নান্দাইল(ময়মনসিংহ)প্রতিনিধিঃ- সুন্দর সুরভিত ফুলের নামে মা-বাবা তাঁদের মেয়ের নাম রাখেন শেফালি। পুরো নাম শেফালি রাণি বর্মণ। কিন্তু কপালে যে তাঁর কবিতার সেই আসমানির মত দুঃখ দূর্দশা থাকবে সেটা হয়ত তারা জানতেন না। পার্থক্য শুধু আসমানির ঘরের চালে ছিল ভেন্না পাতা ছাউনি আর শেফালির চালে ছিন্নভিন্ন পলিথিন। ঘরের ভিতর আসবাবপত্র যেন আর্বজনার স্তুপ। এই শেফালি বর্মনের (৫৮)বাড়ি নান্দাইল পৌরশহরের আচারগাঁও নাথপাড়া মহল্লায়। সরকারি সব ধরনের সুযোগ সুবিধা বঞ্চিত নিঃসন্তান বিধবা এই সহজ সরল নিভৃতচারী এক নারি। নরসুন্ধা নদের পশ্চিম পাড়ে তাঁর একটি বাড়ি বলতে একটি মাত্র ভাঙ্গা ঘর।

বৃহস্পতিবার(৪ জুলাই) বিকালে পৌর শহরের ৭ নং ওয়ার্ডের আচারগাঁও নাথপাড়া মহল্লায় গিয়ে ছোট্ট একটি ঘরের আকৃতি আর্বজনা ঘেরা একটি স্থাপনা দেখা যায়। দু চালা ঘরের ঝাঁঝড়া টিনের চাল দুটি সেই কবে ভেঙ্গে আড়ার উপর বসে পড়েছে। চালে দিয়ে রাখা পলিথিন কাগজও এখন মন্ডে পরিণত হয়েছে। ঘরের বেড়া বলতে ভাঙ্গা টিন তার উপর ছিন্ন নোংড়া কাপড় চোপড়। আশে পাশের অন্য জমি থেকে ঘরও সামনের উঠানটি অপেক্ষাকৃত নিচু হওয়ায় সেখানে বৃষ্টির পানি জমে কাদায় একাকার। প্রতিবেশিরা জানান, ২ শতক জমির উপর অবস্থিত এ ঘরটিতেই বসবাস করেন শেফালি। স্বামী অনিল বর্মণ নদীতে মাছ ধরে বিক্রি করে সংসার চালাতেন।সূখেই কাটছিল নিঃসন্তান ওই দম্পতির সংসার।
চার বছর পূর্বে মারা যান স্বামী। হাতে টাকা না থাকায় বাড়ি ভিটার ৪ শতক জমির ২ শতক বিক্রি করে স্বামী শ্রাদ্ধে খরচ করেন। এরপর থেকেই একাকি শেফালির জীবন চলতে থাকে দুঃখ কষ্টে-খেয়ে না খেয়ে। কিন্তু এত কিছুর পরেও দরীদ্রদের জন্য চালু সরকারের বিভিন্ন কর্মসূচির আওতায় আসেননি তিনি। তাই প্রতিবেশিদের সহায়তায় চলতে থাকে তাঁর খাওয়া পড়া। কিন্তু স্বামীর হাতে গড়া দু চালা টিনের সেই ঘরটি দীর্ঘদিনেও আর মেরামত করতে পারছেননা তিনি। ফলে শুকনা দিনে কোন রকমে ঘরে বসবাস করতে পারলেও বর্ষার দিনে তাঁকে পড়তে হয় মহা বিপদে। কেউ তাঁকে অন্যত্র নিয়ে যেতে চাইলেও স্বামীর ভিটা ছাড়তে নারাজ শেফালি।
স্থানীয়দের সাথে কথা বলতে বলতেই বাড়িতে আসেন শেফালি। এসেই দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখা বাঁশের ভাংগা স্যাঁতস্যাঁতে দরজাটি খুলেন। তারপর এ প্রতিনিধিকে ঘরের ভিতরে নিয়ে সবকিছু দেখান। দেখা যায় আসবাবপত্র,হাঁড়ি-পাতিল বা কাপড়-চোপড় তেমন কিছুই নেই। ভাঙ্গা একটি চৌকির উপর দু একটি নোংড়া স্যাঁতস্যাঁতে কাঁথা বালিশ। চৌকির উপর চালের নিচেও আবার অন্য একটি নীল রংয়ের পলিথিনের কাগজ দেখে মনে হচ্ছিল যেন মশারি টানানো। চতুরপাশে জন্মানো আগাছা ঘরের ভিতরে প্রবেশ করতে দেখা যায়। ঘরের উপর ও পাশে প্রতিবেশিদের গাছপালা থাকায় সেখানে সর্বক্ষণ অন্ধকারাচ্ছন্ন পরিবেশ বিরাজ করছে। মশায় ভরপুর হলেও শেফালির কোন মশারি নেই। খাবারই জুটেনা মশা তাড়ানোর কয়েল কিনবে কি দিয়ে জানান স্থানীয়রা।
শেফালি জানান,তিনি সরকারি সাহায্যের আশায় বিভিন্ন জনপ্রতিনিধির কাছে বার বার গিয়েছেন কিন্তু সবাই শুধু দেই দিচ্ছি করেন, কিন্তু দেননা। এ কারনে এখন আর তাদের কাছে যাননা। প্রতিবেশিরা যা দেয় তা দিয়েই চলছে তাঁর খাওয়া পড়া। কিন্তু ঘরটি মেরামত বা নুতন করে করা তাঁর পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না।

প্রতিবেশি সুমিতা বর্মণ জানান,শেফালি দরিদ্র হলেও অন্য কারোর বাড়িতে কোন কিছু খাননা। কেউ চাল ডাল দিলে তা বাড়িতে এনে রান্না করে তারপর খান। তবে নিরীহ ও শান্তশিষ্ট স্বভাবে শেফালি কখনও কারোর কাছে কিছু চাননা।
প্রতিবেশি লাল মিয়া মন্ডল জানান,তাঁরা সব সময় সহায়তা করলেও ঘরটি করে দিতে পারছেনা। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন,শেফালি যদি ঘরের জন্য সরকারি সহায়তা না পান তা হলে কারা পাবে।

প্রতিবেশি উত্তম বর্মণ জানান,২ বছর পূর্বে প্রবল বর্ষনের এক রাতে তাঁর খোঁজ নিতে গিয়ে দেখেন ঘরে ভাঙ্গা চৌকির উপর বসে তিনি ভিজছেন। পরদিনই তিনি তাঁর ঘরের চালে পলিথিন কাগজ লাগিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু সে পলিথিনও এখন নষ্ট হয়ে গেছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্থানীয় পৌর কাউন্সিলর গোলাম হায়দার খান রুপক জানান, শেফালিকে বলেছি তাঁকে সত্বর একটি কার্ড করে দেবেন। তিনি আরও জানান,ওই মহিলা কিছুটা লাজুক স্বভাবের-তাদের সাথে যোগাযোগ করেননা। এ কারণে অনেক সময় তার কথা মনেও থাকেনা।

নান্দাইল উপজেলা সমাজ সেবা কর্মকর্তা ইনসান আলী জানান,বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থীর কাছ থেকে বিষয়টি জেনে কয়েকজনসহ শেফালির বাড়িতে গিয়ে যা দেখলাম তা সত্যি অবিশ্বাস্য। এমন একটি ঘরে কি করে বসবাস করেন শেফালি। আগামিতে তাঁর অফিস সহ উপজেলা পরিষদ মিলে শেফালির জন্য যা করার দরকার তাই করবেন বলেও জানান তিনি।

নান্দাইল উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা আহসানউল্লা এ প্রতিনিধিকে জানান,ওই মহিলাকে তাঁর বরাবরে একটি দরখাস্ত করতে বলেন। তিনি জেলা দুর্যোগ ত্রাণ কর্মকর্তার সাথে কথা বলে তাঁকে দু বান্ডেল টিন দেবার চেষ্টা করবেন।

নান্দাইল পৌর মেয়র রফিক উদ্দিন ভূইয়া জানান, শেফালি বর্মনের বিষয়টি তাঁর জানা ছিলনা। তাঁকে ৭ জুন পৌরকার্যালয়ে পাঠাবেন। ওইদিন তাঁকে প্রাথমিক অবস্থায় কিছু চাল দেবেন। এরপর অন্যান্য কার্ড দেবার পাশাপাশি সাধ্যমত যা যা করার দরকারতা করবেন