পড়ুয়া জাতি পথ হারায় না!
অর্ন্তবর্তীকালীন সরকারের কাছে জনগণের আাকাঙ্ক্ষিত দাবি সংস্কার। সরকারও সংস্কার করতে বদ্ধ পরিকর। সংস্কারের পদক্ষেপে সব জনগণ সন্তুষ্ট কি না- সেটা বড় প্রশ্ন! সরকারও যে সংস্কারগুলো চাইছে সেগুলো ঠিকঠাক পারছে কিনা- সেটাও বিবেচ্য। সংস্কারের রূপরেখা নিয়ে যেসকল আলোচনা চলছে তাতে নীতি-পদ্ধতি, আইনের পরিবর্তন বিষয়ক তর্ক-বিতর্ক চলছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, সংস্কারকৃত নিয়ম-পদ্ধতি, আইন-প্রথা যারা বাস্তবায়ন করবে এবং যাদের মধ্যে বাস্তবায়িত হবে তাদের সংস্কার নিয়ে কোন পদক্ষেপ গৃহীত হয়েছে? মন্দ মানুষের হাতে একটি ভালো আইনেরও অপপ্রয়োগ হতে পারে। আবার একজন ভালো মানুষের কাছে কুনীতি এড়ানোর অনেকগুলো পথ থাকে। ঠেকে যাওয়া এবং ঠেকিয়ে দেওয়া- এটা খুব ভালো মানুষের জন্য এবং একেবারে বাজে লোকের জন্য প্রযোজ্য। কিন্তু যাদের মধ্যে কিছু ভালো এবং কিছু মন্দের ব্যাপার আছে, তাদের ভালোগুণগুলোকে আরও বিকশিত করার জন্য যে সংস্কার দরকার তা সরকার আদৌ উপলব্ধি করছে কিংবা পদক্ষেপ নিচ্ছে?
গাইডবই মুখস্ত করে বড় বড় চাকুরি পাওয়া যায়, নোট-গাইড চর্চা করে ভালো শিক্ষক হওয়া যায়, সুললিত কণ্ঠ এবং ভাসাভাসা জ্ঞান দিয়েও ইসলামিক পন্ডিত সাজা যায় কিন্তু মূল্যবোধ-নৈতিকতার যে পাঠ তা হৃদয়ের মধ্যে না থাকলে মানুষ হওয়া মুশকিল। মানুষকে মানুষ করার জন্য স্ব স্ব ধর্মের কাছে ফেরাতে হবে এবং পাঠাভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। শুধু আইনের সংস্কার করে, নীতির বদল করে টেকসই পরিবর্তন সম্ভব নয়। সোনার দেশ গড়ার জন্য সোনার মানুষ তৈরি করা জরুরি। স্কুল কলেজে শুধু পাঠ্যবই দিয়ে সার্টিফিকেটধারী মানুষ পাওয়া সম্ভব কিন্তু আদর্শিক মানুষের জন্য ইতিহাস-সাহিত্যের কাছে ভীড়তে হবে। পারিবারিক শিক্ষায় যদি নৈতিকতার পাঠ না থাকে, সামাজিকভাবে যদি দুর্নীতিবাজদের ঘৃণা করার না হয় এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে যদি সৎ অফিসারদের পুরস্কৃত করা না হয় তবে সৎ মানুষের দেখা মিলবে না। রাষ্ট্র যদি ভালোমানুষ উৎপাদনে ব্যর্থ হয় তবে সকল সংস্কার দু’দিনের। তৃতীয় দিনে যেই লাউ সেই কদুতে ফেরত আসবে!
সরকারের কাছে দেশের সকল পাবলিক লাইব্রেরিগুলোতে পাঠক উপস্থিতির পরিসংখ্যান থাকা দরকার। শতকোটি টাকা বিনিয়োগে কেনা বই কেউ পড়ছে কিনা নাকি চাকুরির জন্য গাইড বই এবং পত্রিকার পৃষ্ঠা উল্টানোতেই জ্ঞানচর্চা সীমাবদ্ধ হয়ে আছে তা জানা দরকার। স্কুল কলেজের গ্রন্থাগারে শিক্ষার্থীদের যাতায়াত কেমন নাকি ক্লাস-প্রাইভেটেই শিক্ষার্থীরা নাকানিচুবানি খাচ্ছে? উপজেলা পর্যায়ে, ইউনিয়ন পর্যায়ে কিংবা গ্রাম পর্যায়ে পাঠাগার আন্দোলনের কোন কার্যক্রম আদৌ চলছে কিনা? মানুষ যদি বই না পড়ে তবে আলোকিত মানুষে পরিণত হওয়া মুশকিল। দুই মলাটের মধ্যে কালো অক্ষরে যে আলো বাঁধা সেখানে চোখ না পড়লে মস্তিষ্ক চিন্তার খোরাক পাবে না। মানুষের কাছে সম্পদের যে তালিকা ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে সেখানে জ্ঞান কিংবা বই স্থান পায়নি! আমাদের শিক্ষা কারিকুলামে কিংবা কিছু প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব সিদ্ধান্তে এতো বেশি বই সংযুক্ত করা হয়েছে যাতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে সৃষ্টি করছে শিক্ষা ভীতি এবং লাভবান করছে গাইড বইয়ের লেখক-প্রকাশককে। অথচ মস্তিষ্ক গঠনের এই সুযোগে শিশুদের মজার ছড়া, কবিতা ও গল্প পড়ার পরিবেশ তৈরি করা দরকার ছিল। আমাদের অপরিকল্পিত শিক্ষা ব্যবস্থার পাঠ্যসূচি ৪-৬ বছরের শিশুদের মুখস্ত করায় তাবৎ দুনিয়ার রাজধানী, মুদ্রা এবং আইনসভার নাম! শহরে-গ্রামে ভাড়া করা বদ্ধঘরে গজিয়ে ওঠা এইসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ব্যাপারে সরকারের নজর দেওয়া উচিত। সাথে সাথে শিক্ষা বিক্রির এই গুদামগুলো বন্ধ করা দরকার। যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের খেলাধুলার জন্য বিস্তৃত আঙিনা নাই, খেলার মাঠ নাই সে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো থেকে পড়াশুনা করে আদতে কেমন প্রজন্ম গড়ে উঠবে তা বিতর্ক সাপেক্ষ।
এমনও অনেক স্কুল-কলেজ আছে যেখানে পাঠাগারগুলোতে জনম তালা লেগে আছে। বইগুলোর শরীর ধুলায় ধূসরিত। শিক্ষার্থীরা জানেই না যে ক্লাসের বাইরেও কিছু বই পড়তে হয়! শ্রেণীপাঠ্যসমূহ যে জ্ঞানের ক্ষুদ্র ক্ষেত্র এবং বাইরের জগত বিষয়ক বই জ্ঞানের রাজ্য তা শিক্ষার্থীদের না জানালে মানবিক মানুষ তৈরি করা প্রায় অসম্ভব। এই যে কলেজ বনাম কলেজ শিক্ষার্থীদের মারামারি, শিক্ষার্থী বনাম জনতার ধাওয়াধাওয়ি এর অধিকাংশ থাকবে না যদি শিক্ষার্থীদেরকে পাঠাগার মুখী করানো যায়। পাঠাগার যে মানুষ বানানোর কেন্দ্র। দেশ নেশায় তলিয়ে যাচ্ছে, প্রজন্ম পথ হারাচ্ছে- কত কত অভিযোগ কিন্তু আমরা কি শিক্ষার্থী, তরুণ-যুবকদের বিকল্প দিতে পেরেছি? উপজেলা শহরে পাঠাগারের নাজুকতা জাতি হিসেবে আমাদের লজ্জিত করার কথা। ইউনিয়ন পর্যায়ে সরকারি-বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় পাঠাগার নাই বললেই চলে। এছাড়াও বিভিন্নভাবে খেলার মাঠগুলোর দখল আমাদের জাতিগত কাপুরষতা প্রমাণ করে। তরুণ-যুবকরা তাদের অবসর কোথায় কাটাবে? সেই তো মোবাইল। ফলাফল তো উম্মুক্ত!
মাত্র দশক দেড়েক আগেও যেভাবে গ্রামে গ্রামে পাঠাভ্যাস দেখা যেত, পাঠাগার আন্দোলন ছিল, ঘরে ঘরে বই পড়ার সংস্কৃতি ছিল কিংবা বৃদ্ধ-তরুণের মধ্যে বই নিয়ে আলোচনার আসর ছিল তা এখন অনুপস্থিত। এই তো সেদিন ক্লাসের বইয়ের মধ্যে উপন্যাস লুকিয়ে রেখে পড়ার সেই এখনো অমলিন। আজকের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সেটা কল্পনা করা যায়? তাদের বইয়ের মধ্যেও অন্যকিছু লুকানো আছে এবং সেটা মোবাইল! বাংলার ঘরে ঘরে রবীন্দ্র-নজরুল, সমরেশ-হুমায়ুন নিয়ে আলোচনা নাই। এমনকি মুসলিম পরিবারগুলো থেকে সকাল বেলা পবিত্র কুরআন তিলাওয়াতের যে শব্দ ভেসে আসতো তাও এখন চরমভাবে অনুপস্থিত। মোবাইল-ইন্টারনেট আমাদের অনেকগুলো ভালো অভ্যাস সমূলে বিনাশ করে দিচ্ছে। যে প্রজন্ম সারাদিন মোবইল নিয়ে বসে থাকে, ফেসবুক-হোয়াটসঅ্যাপ, শর্টস-রিলসে যাদের সময় কাটে তাদের দিযে ১০০ পৃষ্ঠার একটি বই পড়ানো খুব কঠিন কাজ। বই পড়ার জন্য যে আগ্রহ এবং ধৈর্য দরকার তাও দেখা যায় না। অথচ বই না পড়লে চরিত্রের সৌন্দর্য, মানবিকতা বোধ, নৈতিকতা গড়ে উঠবে না। মানব সভ্যতার ইতিহাসের বিশেষ করে গ্রিক সভ্যতা থেকে যতগুলো মানব সভ্যতা বিকশিত হয়েছে এর প্রত্যেকটিতেই ক্রীড়ানকের ভূমিকা পালন করেছে জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা। ইতিহাস থেকে জানা যায় যে, খ্রিষ্টপূর্ব ৩২৩ অব্দে আলেকজান্দ্রিয়ায় বিখ্যাত পাঠাগার প্রাচীন বিশ্বের জ্ঞান চর্চার কেন্দ্র হিসেবে কাজ করেছে। এছাড়াও মুসিলম সম্রাজ্য, পারসিক ও সিন্ধু সাম্রাজ্য, রোমান ও মিশরীয় সম্রাজ্য- সর্বত্রই জাতিগত বিকাশের কেন্দ্র ছিল পাঠাগার এবং মানবিক উৎকর্ষের ক্ষেত্র ছিল পাঠাভ্যাস।
কাঙ্ক্ষিত সংস্কারকে যদি টেকসই করতে হয় তবে দেশব্যাপী পাঠাগার আন্দোলনকে ব্যাপৃত করতে হবে। সরকারি এবং বেসরকারি উদ্যোগে বই পড়াকে আন্দোলনে পরিণত করতে হবে। এজন্য সারা দেশব্যাপী সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা, সচেতনতামূলক প্রচারণ এবং বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের অনুরূপ প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে পাঠাভ্যাস এবং জ্ঞানচর্চা বৃদ্ধি করতে না পারলে সোনার বাংলার জন্য সোনার মানুষ গড়ে তোলা মুশকিল। আমাদের দেশে সার্টিফিকেধারী শিক্ষিত মানুষের অভাব নাই কিন্তু মানবিক, উদার, অসাম্প্রদায়িক, সহনশীল, সৎ, নৈতিক ও সচ্চরিত্রবান মানুষের শূণ্যতা আমাদেরকে ভীষণভাবে ভোগায়। মানুষের মধ্যে ইতিবাচকতার অনুপস্থিতির জন্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সংকটগুলো বৃহদাকার ভাঙন তৈরি করে। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ইস্যু নিয়ে এমন হুজুগ বাঁধানো হয় যা উত্তেজনকার ধ্বংসাত্মক পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। মানুষ যখন বইমুখী হবে তখন তাদের মধ্যে ভালো-মন্দ, উচিত-অনুচিতের পার্থক্যকরণের বিচারবোধ তৈরি হবে।। তাতে এই যে গুজবে উম্মাদনা সৃষ্টি করা, ধর্মীয় উগ্রতা প্রচার করা কিংবা অরুচিকর বিষয়গুলোর প্রচার কমে আসবে। উন্নত বিশ্বের জনগণ বাস স্টপেজে, রেলে, বিমানবন্দরে এমনিক উম্মুক্ত প্রান্তরে বই হাতে নিবিষ্ট চিত্তে অধ্যয়ণ করছে। ট্রেনের কম্পাটমেন্টগুলোতে ভ্রমনকালে যাত্রীরা বই পড়ছে- এই দৃশ্য বিদেশে অতি সাধারণ। সভ্যতা-ভদ্রতার মাপকাঠিতে আমাদের চেয়ে তাদের অবস্থান বেশ সরস। বইয়ের সাথে যোগাযোগ ব্যতীত মানুষ তাদের দায়িত্ব সম্পর্কের সচেতন হয় না। জাতীয়তাবোধ ও দেশাত্মবোধ জাগ্রত হয় না। যে জাতি যত বেশি পড়ে সে জাতির মধ্যে অপরাধ প্রবনতা তত কম। এমনকি পড়ুয়ারা নিজেদেরকে নতুনভাবে আবিষ্কার করতে পারে।
অন্তর্র্বতীকালীন সরকারকে সংস্কারের সফলতার জন্য পাঠাগার আন্দোলনকে বেগবান করার উদ্যোগ নিতে হবে। শহর-নগর-বন্দর, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান-অফিস, মসজিদ এবং পরিবারে পাঠাভ্যাসের সংস্কৃতি গড়ে তুলতে না পারলে নীতিবান প্রজন্ম, সচেতন নাগরিক গড়ে তোলা সম্ভব নয়। পাঠাভ্যাসের কোন বিকল্প নাই। জ্ঞানের বিকল্প কেবলমাত্র জ্ঞান এবং জ্ঞানের বৃহত্তর উৎস বই। একটি জাতির সামগ্রিক উন্নতির জন্য নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মত বইকেও নিত্যসঙ্গী করতে হবে। এজন্য ভালো লেখকেদের লেখার জন্য উৎসাহিত করতে হবে, প্রকাশকদেরকে ভালো বই প্রকাশের জন্য প্রণোদনা দিতে হবে এবং পাঠকে বই কিনতে আগ্রহী করে তুলতে হবে। শিশুদের হাতে মোবাইল ফোন তুলে দেওয়ার বদলে মজার মজার গল্প কবিতার বই দিতে হবে। এমনকি সন্তান-নাগরিক মোবাইল-ইন্টারনেট কীভাবে ব্যবহার করলে সেটা উপকারী হবে সে জ্ঞানও বইতে আছে। আধুনিক সরঞ্জামাদি ব্যবহারের বদলে আমরা অপব্যবহার করছি বেশি। স্কুল-কলেজের বার্ষিক ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে উপহার হিসেবে বই দিতে হবে। যেকোন উৎসবে উপহারের থলেতে থাকবে ভালো ভালো বই। তরুণ-যুবকদের সাথে বিশ্বসাহিত্যকে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নিতে হবে। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে পাঠাগার কেন্দ্রিক উপসনাগৃহে পরিণত করতে হবে। যে পরিবারের শিশুরা বড় হতে হতে বাবা-মা ও পরিবারের বড় সদস্যদেরকে বই পড়তে দেখে তার্ াবইয়ের পোকা হয়ে বাড়ে। জাতির জাতীয় উন্নতির জন্য এটা বড্ড জরুরি। দীর্ঘ কয়েক দশকে মোবাইল ফোনের অপব্যবহার জাতি দেখেছে এবং সেসবের খেসারতও্ তুমুলভাবে দিচ্ছে। এবার রাষ্ট্রীয়ভাবে নাগরিকদের কাছে বই তুলে দেওয়া এবং পাঠাভ্যাসের সংস্কৃতি তুলে দেওয়ার পালা। প্রয়োজনে পাঠাভ্যাস চাপিয়ে দিতে হবে। যে জাতি পড়ে সে জাতি পথ হারায় না। সকল ধরণের সংস্কার বিফল হবে যদি জনগণ সচেতন না হয়। জনগণকে সচেতন করার একমাত্র প্রতিষেধক পাঠাভ্যাস। ভালো বই পাঠকের জীবনদর্শন বদলে দিতে পারে। জ্ঞানীরা বলেছেন, বইয়ের চেয়ে উপকারী কোন বন্ধু নাই। পড়ুয়ার যেমন শত্রু কম তেমনি তার দম্ভ-অহংকারও কম। দুঃখ থেকে মুক্তির জন্য মনের মধ্যে ভুবন সৃষ্টি করতে হবে এবং সে ভুবল সৃজন হতে পারে বইয়ের সাথে সম্পর্কের মাধ্যমে। মানুষ হওয়ার পাঠশালাতে সঙ্গী হিসেবে বই রাখতেই হবে। যার জ্ঞান নাই, সম্পদ তার শত্রু হতে পারে এমনিক ধ্বংস করতেও পারে। কেননা সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহারের জন্য জ্ঞান থাকা দরকার।
রাজু আহমেদ। কলাম লেখক।
Raju69alive@gmail.com