প্রস্তাবিত বাজেটে তৃতীয় লিঙ্গের জীবনমানের উপর কর ছাড়ের প্রস্তাবের জন্য বাংলাদেশ সরকারকে আর্টিকেল নাইনটিন-এর সাধুবাদ
২০২১-২২ প্রস্তাবিত বাজেটে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের কর্মসংস্থান, মানসম্পন্ন জীবনযাপন এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিতে বিশেষ কর ছাড়ের প্রস্তাবের জন্য বাংলাদেশ সরকারকে যুক্তরাজ্যভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা আর্টিকেল নাইনটিন সাধুবাদ জানিয়েছে। প্রস্তাবটিকে ইতিবাচক হিসাবে আখ্যায়িত করে, আর্টিকেল নাইনটিন আশা করে অর্থমন্ত্রীর এই প্রস্তাব সমাজে বৈষম্যমূলক আচরণের শিকার তৃতীয় লিঙ্গোর জনগোষ্ঠীকে অর্থনীতির মূলধারায় আনতে সহায়তা করবে এবং দেশের উন্নয়নে তারা ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে। এছাড়াও তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের করমুক্ত আয়সীমাও বাড়ানোর প্রস্তাবকেও স্বাগত জানায় আর্টিকেল নাইনটিন। আর্টিকেল নাইনটিন আশা করে যে অন্যান্য ভিন্ন যৌন পরিচয়ধারীদের ক্ষেত্রেও সরকার ও সমাজ একই ধরনের মানবিক দৃষ্টিকোণ বজায় রাখবে।
আজ গণমাধ্যমে প্রেরিত এক বিবৃতিতে, আর্টিকেল নাইনটিন দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক ফারুখ ফয়সল বলেন, “২০২১-২০২২ অর্থবছরের জন্য ঘোষিত বাজেটে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের কর্মসংস্থান বাড়ানোর লক্ষ্যে বেসরকারি খাতকে বিশেষ প্রনোদনা দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। অর্থমন্ত্রী প্রস্তাব করেছেন, যদি কোনো প্রতিষ্ঠান তার মোট কর্মচারীর ১০ শতাংশ বা ১০০ জনের বেশি তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তিদের নিয়োগ দেয়, তবে ওই কর্মচারীদের পরিশোধিত বেতনের ৭৫ শতাংশ বা প্রদেয় করের ৫ শতাংশ, যেটি কম, তা নিয়োগকারীকে কর রেয়াত হিসেবে প্রদানের জন্য প্রয়োজনীয় বিধান সংযোজনের প্রস্তাব করছি।’ নতুন অর্থবছরের বাজেটে নেওয়া এই পদক্ষেপের ফলে তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীর বেসরকারি খাতে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাবে এবং তাদের সম্পর্কে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন সাধিত হবে। প্রান্তিক ও সুবিধাবঞ্চিত ও অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে থাকা এই জনগোষ্ঠী দেশের উৎপাদনমুখী কর্মকাণ্ডে অবদান রাখার পাশাপাশি তাদের জীবন মানের উন্নয়ন ঘটবে।“
ফারুখ ফয়সল আরও বলেন, “সরকারি হিসাব মতে দেশে হিজড়ার সংখ্যা ১০ হাজার। তবে বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মতে এ সংখ্যা প্রায় দেড় লাখ। সরকার তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীর বৈষম্য দূর করতে ও সমাজের মূলধারায় তাদেরকে সম্পৃক্ত করাতে ২০১৩ সালে নভেম্বরে হিজড়া জনগোষ্ঠীকে তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। ২০১৪ সালে ২৬ জানুয়ারি হিজড়াদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দিয়ে গেজেট প্রকাশ করা হয়। সরকারিভাবে ৫০ ও ৫০ উর্ধ্ব বয়সী হিজড়াদের জন্য মাসিক ভাতা প্রদান, বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তাদের দক্ষতা বৃদ্ধি প্রভৃতি উদ্যোগের মাধ্যমে তাদেরকে মূল স্রোতধারায় আনার চেষ্টা করছে। তবে তা সকল কাঙ্খিত জনগোষ্ঠীর নিকট পৌছায়নি। ফলে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে হিজড়া জনগোষ্ঠীকে নিয়ে নেতিবাচক মনোভাব এখনও বিদ্যমান। তাদের অধিকার ও নাগরিক সুযোগ-সুবিধা এখনও বাস্তবায়িত হয়নি। এই জনগোষ্ঠীর মানুষের প্রতি সাধারণ মানুষের অবহেলা, মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন এবং বৈষম্য লক্ষ্যণীয়। সরকারি বেসরকারি বিভিন্ন দপ্তরে হিজড়া জনগোষ্ঠীর সেবা পাবার ক্ষেত্রে যে ভোগান্তি বা প্রতিবন্ধকতা রয়েছে তা দূর করতে এই জনগোষ্ঠী সম্পর্কে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কর্মরতদের অজ্ঞতা দূর করতে হবে।“
প্রস্তাবিত বাজেটে তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানের উদ্যোগ প্রশংসার দাবিদার। তবে পাশাপাশি তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীকে শিক্ষিত করে তোলার উদ্যোগ গ্রহণ করা জরুরী। কেননা একাডেমীক কোয়ালিফিকেশন তাদের জীবিকার ক্ষেত্রে, সুস্থ কর্ম বা চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা ও জটিলতা সৃষ্টি করবে। অন্যদিকে চাকরির ক্ষেত্রে তাদের জীবন-জীবিকা যেন স্বাচ্ছন্দে চলে সে বিষয়টি তদারকি করতে হবে এবং বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। নইলে, চাকরিতে যোগদানের পর তারা চাকরি ছাড়তে বাধ্য হলে সমাজের চোখে এই জনগোষ্ঠী সম্পর্কে আরও একটি নেতিবাচক প্রভাব পরবে ।
ফারুখ ফয়সল বলেন, “বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী দেশের সব মানুষ সমান। অন্যদিকে মানবাধিকার ঘোষণাপত্রে বলা হয়েছে, ‘সকল মানুষ স্বাধীনভাবে এবং সমান মর্যাদা ও অধিকার নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। তারা যুক্তি ও বিবেকের অধিকারী এবং ভ্রাতৃত্বের মনোভাব নিয়ে তাদের একে অপরের প্রতি আচরণ করা উচিত।’ জাতি-বর্ণ-লিঙ্গ-ভাষা-ধর্ম, রাজনৈতিক বা অন্যান্য মতামত, জাতীয় বা সামাজিক সূত্র, সম্পত্তি, জন্ম বা অন্যান্য মর্যাদা-নির্বিশেষে প্রত্যেকে এই ঘোষণাপত্রে বর্ণিত সব অধিকার এবং স্বাধীনতার দাবিদার। ফলে, হিজড়াদের তৃতীয় লিঙ্গের স্বীকৃতি, কর্মসংস্থান, মানসম্পন্ন জীবনযাপন এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিতে বিশেষ কর ছাড়ের প্রস্তাব প্রশংসার দাবি রাখে । তবে এটি তাদের প্রতি দয়া বা অনুকম্পা নয়। এটি তাদের ন্যয়সঙ্গত অধিকার। যা দেরিতে হলেও সরকার বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। তবে এই উদ্যোগই যথেষ্ট নয়। পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী হিসাবে তাদের শিক্ষা, চিকিৎসাসহ সকল ক্ষেত্রে বাড়তি নজর দিতে হবে, যাতে তাঁরা ক্রমান্বয়ে সক্ষমতা অর্জন করে মূল জনগোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পৃক্ত হবেন। সরকারি-বেসরকারি সকল প্রতিষ্ঠানকে এ বিষয়ে এগিয়ে আসতে হবে ।”