অন্যান্য

বাংলাদেশ কর্তৃক আন্তর্জাতিক পানিপ্রবাহ কনভেনশন ১৯৯৭ অনুস্বাক্ষর করা একান্ত জরুরী -ইমতিয়াজ আহমেদ

নদীমাতৃক বাংলাদেশ। যার বুক ছিঁড়ে প্রায় ৪০৫টি নদী প্রবাহিত। এই নদীগুলোর মধ্যে ৫৭টি আন্ত:দেশীয় নদী। তন্মধ্যে, ভারতের সাথে ৫৪টি এবং মায়ানমারের সাথে ০৩টি অভিন্ন আন্ত:দেশীয় নদী রয়েছে। ভারতের সাথে ৫৪টি আন্ত:দেশীয় নদীর মধ্যে ৬টি নদী বেতনা-কোদালিয়া, আত্রাই, পূনর্ভবা, তেঁতুলিয়া, টাংগন, কুলিক বা কোকিল নদী বাংলাদেশ হতে ভারতে প্রবেশ করেছে এবং তন্মধ্যে বেতনা-কোদালিয়া, আত্রাই, পুনর্ভবা নদী বাংলাদেশ হতে ভারতে প্রবেশ করে আবার বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। অবশিষ্ট ৪৮টি নদী ভারত হতে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে এবং তন্মধ্যে ২টি নদী নাগর ও ডাহুক ভারত হতে বাংলাদেশে এসে আবার ভারতে প্রবেশ করেছে। শুধুমাত্র মহানন্দা নদী ভারত হতে বাংলাদেশে এসে আবার ভারতে গিয়েছে এবং ভারত হতে পুনরায় বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। আন্ত:দেশীয় নদী ব্যবহারের ক্ষেত্রে জাতিসঙ্ঘ কর্তৃক প্রণীত আইন রয়েছে। যে আইনে সংশ্লিষ্ট প্রতিটি দেশের পক্ষে অধিকারের কথা স্পষ্টভাবে বর্ণিত।

২১ মে ১৯৯৭ তারিখে অনুষ্ঠিত জাতিসঙ্ঘের সাধারণ পরিষদের সভায় আন্তর্জাতিক পানিপ্রবাহ কনভেনশন UN Convention on Non-Navigation Uses of International Water Courses (UN Water Courses Convention) গৃহীত হয়। কনভেনশনের পক্ষে ১০৩টি দেশ ভোট দেয়। পাকিস্তান ও ভারত ভোটদানে বিরত থাকে এবং চীন, তুরস্ক ও বুরুন্ডি কনভেনশনের বিরোধিতা করে। কনভেনশনটি গৃহীত হওয়ার পর সদস্য রাষ্ট্রগুলো কর্তৃক এটি অনুসমর্থন, গ্রহণ, অনুমোদন বা সংযোজনের জন্য উন্মুক্ত রাখা হয়।
শর্ত অনুযায়ী ৩৫তম দেশ হিসেবে ভিয়েতনাম অনুস্বাক্ষর করায় কনভেনশনটি ২০১৪ সালে আন্তর্জাতিক আইনে পরিণত হয়, যা ১৭ আগস্ট ২০১৪ তারিখ হতে কার্যকর হয়েছে। কিন্তু ভাটির দেশ হওয়া সত্ত্বেও অদৃশ্য কারণে বাংলাদেশ অদ্যাবধি কনভেনশনটি অনুস্বাক্ষর করেনি। অথচ বাংলাদেশের জন্য এ আইন অত্যন্ত জরুরি ও ফলপ্রসূ। কনভেনশনের ধারাসমূহে উজানের দেশ থেকে ভাটির দেশে প্রবাহিত নদীর পানি কীভাবে ব্যবহার
হবে, তার স্পষ্ট দিকনির্দেশনা রয়েছে।

কনভেনশনের ২ নং ধারায় বলা হয়েছে, (ধ) পানিপ্রবাহ মানে হলো যে পদ্ধতিতে ওপরের পানি ও ভূগর্ভস্থ পানি তাদের মধ্যে সম্বন্ধ সৃষ্টি করে প্রবাহিত হয় সে অঞ্চলের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয় সর্বসাধারণের জন্য; (ন) আন্তর্জাতিক পানিপ্রবাহ তাকে বলে যা একই নদী বিভিন্ন দেশের ওপর দিয়ে প্রবাহিত।’ ধারা নং ৫-এ বলা হয়েছে- ‘(র) পানি প্রবাহিত অঞ্চলের রাষ্ট্রগুলো তাদের সীমানায় আন্তর্জাতিক বিধিবিধান মেনে তার পানি ব্যবহার করবে। তাতে স্বচ্ছতা, সমতা অনুসরণ করে ব্যবহার করতে হবে। প্রাপ্য পানির সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার করতে হবে। যেসব রাষ্ট্র প্রবাহিত নদীর পানি ব্যবহার করবে তারা ডেভেলপ করবে এবং সর্বোচ্চ পানির প্রবাহ নিশ্চিত করবে। পানির সদ্ব্যবহার হতে হবে। পানি ব্যবহারের সময় সব রাষ্ট্রের চাহিদার দিকে খেয়াল রাখতে হবে। কোন রাষ্ট্রের স্বার্থের ক্ষুন্ন করতে পারবে না।’

কনভেনশনের ৭ নং ধারায় বলা হয়েছে, ‘নদীটি প্রবাহিত রাষ্ট্রগুলোর আন্তর্জাতিক পানিপ্রবাহের ব্যবহারে সর্বাত্মক চেষ্টা করবে, যাতে নদীর গতিপথের কোনো পরিবর্তন না হয় এবং অন্য রাষ্ট্রের প্রবাহিত বেসিনের কোনো ক্ষতি না হয়।’ অর্থাৎ এই জনসম্পদ ব্যবহারের ক্ষেত্রে অন্য দেশের জনগোষ্ঠী যেন কোন প্রকারের প্রাকৃতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষতির শিকার না হয় সে দিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। কনভেনশনের এই ধারাটি একটি অভিন্ন নদীর প্রবাহের ওপরে ঐতিহাসিকভাবে নির্ভরশীল অববাহিকাবাসীর অধিকারের স্বীকৃতি প্রদান করে। কনভেশনের ১১ নং ধারায় বলা হয়েছে, “Water Course stator Shall exchange information and Consult each She and if necessary, negotiate on the possible effects of planned measures on the Condition of an intentional water course.” ১২ নং ধারায় বলা হয়েছে, ‘কোন একটি পানিবাহিত রাষ্ট্র কোনো পরিকল্পনা কার্যকর করতে গেলে বা কাউকে কিছু কার্যকর করতে দিলে তাতে যদি প্রতিবেশী রাষ্ট্রের পানিপ্রবাহে উল্লেখযোগ্য কোন ক্ষতি হয়, তবে সে ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্যাদি তাদেরকে অবহিত করতে হবে। এ ধরনের তথ্য প্রদানের সাথে কারিগরি ডাটা, তথ্যাবলীসহ পানি পরিবেশের ওপর তার প্রতিক্রিয়া বিস্তারিতভাবে অবহিত করবে, যাতে তথ্যপ্রাপ্ত দেশটি সময় মতো প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিয়ে ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পেতে পারে।’এই কনভেনশন রাষ্ট্র নির্বিশেষে আন্ত:দেশীয় নদী অববাহিকার জনগোষ্ঠীকে নাব্যতা ও ক্ষমতার ভিত্তিতে এবং যুক্তিসঙ্গতভাবে অভিন্ন নদীর পানিসম্পদ ব্যবহারের অধিকার দিচ্ছে।

আন্তর্জাতিক পানিপ্রবাহ কনভেশন ১৯৯৭ এর উপরে বর্ণিত ধারাসমূহ পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, প্রতিটি ধারাই ভাটির দেশের অনুকূলে। অথচ বাংলাদেশ অদ্যাবধি কনভেনশনে অনুস্বাক্ষর করেনি। কেন অনুস্বাক্ষর করেনি তা আজ প্রশ্নের সৃষ্টি করেছে। বিভিন্ন দেশ আন্তর্জাতিক রীতিনীতি তথা আইন মেনে অভিন্ন নদীর পানি ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করছে। এক্ষেত্রে দানিয়ুব নদীর কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায়। মধ্য ও পূর্ব ইউরোপের ১২টি দেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত এ নদীর তীরবর্তি অঞ্চলকে রক্ষণাবেক্ষণ করছে তারা। দানিয়ুবের তীরে গড়ে উঠেছে অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনা, হাঙ্গেরির রাজধানী বুদাপেস্ট, সার্বিয়ার রাজধানী বেলগ্রেডসহ জার্মানী থেকে রূমানিয়ায় বিস্তৃত নয়নাভিরাম শহর-বন্দর। নর্থ সী’র তীর থেকে ব্ল্যাক সী’র তীর পর্যন্ত দানিয়ৃব নদীতে নাব্যতা ও জাহাজ চলাচলের সব সুযোগ সুবিধা রয়েছে। এছাড়া এ অঞ্চলে মিঠা পানির মাছ ও পানীয় জলের অন্যতম উৎস হিসেবে দানিয়ুব নদী ব্যবহার হচ্ছে। এতকাল যাবত পারস্পরিক অঙ্গীকার, দায়িত্বশীলতা ও আন্তর্জাতিক রীতিনীতি আইনকানুনের আলোকে দানিয়ুব নদীর সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করছে সংশ্লিষ্ট দেশগুলো। এটা আমাদের জন্য বিশেষভাবে শিক্ষণীয়। এক দানিয়ুব নদী যদি ইউরোপের ১২টি দেশ আইন মেনে ভোগ করতে পারে তাহলে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রবাহিত আন্ত:দেশীয় নদীগুলোর হিস্যা নির্ধারণ ও বাস্তবায়ন করা যায় না কেন?

আন্তর্জাতিক পানিপ্রবাহ আইন অমান্য করে ভারত আন্ত:দেশীয় নদীর ওপর বিভিন্ন ধরনের ড্যাম, ব্যারেজ ও বিদ্যুৎ প্রকল্প গড়ে তুলছে একতরফাভাবে। একতরফাভাবে পানি প্রত্যাহার করছে। ফলে বাংলাদেশ চরমভাবে বঞ্চিত হচ্ছে তার আন্ত:দেশীয় নদীসমূহের পানিপ্রবাহের হিস্যা প্রাপ্তি থেকে। ভারতের পানি আগ্রাসনের কারণে বাংলাদেশে প্রবাহিত আন্ত:দেশীয় নদীগুলো নাব্যতা হারাচ্ছে। বাংলাদেশ কখনো বন্যার পানিতে ডুবছে, আবার কখনো খরায় পুড়ছে। আন্তর্জাতিক আইন থাকা সত্ত্বেও এমন হবে কেন?

ভারত বলে থাকে আন্ত:দেশীয় নদীতে এমন কোন কাজ করবে না, যাতে বাংলাদেশের ক্ষতি হয়। কিন্তু তাদের প্রকৃতিবিরোধী কর্মকাণ্ড অর্থাৎ বাঁধ, ড্যাম, ব্যারেজ নির্মাণ বাংলাদেশের মারাত্মক ক্ষতির কারণ হচ্ছে। ভারত কেবল অভিন্ন আন্ত:দেশীয় নদীগুলোর ওপর বাঁধই দিচ্ছে না, আন্তঃনদী সংযোগ অঞ্চলের মাধ্যমে তাদের পূর্বাঞ্চল থেকে পশ্চিমাঞ্চল ও দক্ষিণাঞ্চলে আন্তর্জাতিক আইন অমান্য করে সব ক’টি হিমালয়বাহিত নদীর পানি প্রত্যাহার করছে। পরিবেশ ও প্রকৃতিবিরোধী এ প্রকল্প বাঁধ অববাহিকায় অদূর ভবিষ্যতে প্রাকৃতিক বিপর্যয় ও দুর্যোগ সৃষ্টি করবে বলে আশংকা দেখা দিচ্ছে। তার আলামতও ইতোমধ্যে স্পষ্ট।

১৯৯৭ সালের আন্তর্জাতিক পানিপ্রবাহ কনভেনশনটি ২০১৪ সালে এসে আইনে পরিণত হয়েছে। তথাপি বাংলাদেশ অদ্যাবধি তাতে অনুস্বাক্ষর না করায় আন্ত:দেশীয় নদীগুলো হতে পানিপ্রবাহের হিস্যার জন্য বিশ্ব দরবারে দাবী জানাতে পারছেে না। ভারত কর্তৃক আন্ত:দেশীয় পানিপ্রবাহ সংক্রান্ত অপরাধের বিষয়ে অভিযোগ দায়ের করতে পারছে না। তাহলে বাংলাদেশ কেন কনভেনশনটিতে অনুস্বাক্ষর করছে না? ভাটির দেশ হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশ কেন নিজের স্বার্থ দেখছে না? কেন আইনের সুবিধা নিচ্ছে না? আন্ত:দেশীয় নদীসমূহ হতে নিজের প্রাপ্যতা পেতে হলে বাংলাদেশকে অবশ্যই ১৯৯৭ সালের আন্তর্জাতিক পানিপ্রাবহ কনভেনশনটিতে অনুস্বাক্ষর করতে হবে। এর কোন বিকল্প নেই।