বাবু, সাহেবের যোগসাজশে সংঘবদ্ধ চক্র লুটপাট ও হত্যাচেষ্ঠা চালায় সুনছড়া চা বাগানের শ্রমিকদের উপর
নিজস্ব প্রতিবেদক: চা-শ্রমিক নেতা হরিনারায়ন হাজরা ও স্বপন নায়েক। ডানকান ব্রাদার্সের পরিচালনাধীন মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার আলীনগর চা-বাগানের ফাঁড়ি সুনছড়া চা-বাগানের এরা দুজনই স্থায়ী শ্রমিক। কমলগঞ্জ উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান ও চা-শ্রমিক ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক রামভজন কৈরীর প্রতিবেশীও এরা। কিন্তু বাগানের শ্রমিকদের মানবেতর জীবন ও তাদের সমস্যা-সংকট নিয়ে আগ্রহ নেই রামভজন কৈরী ও চা শ্রমিক ইউনিয়নের । শ্রম আইন স্বীকৃত অধিকারগুলোও ভোগ করতে পারছে না বাগানের শ্রমিকরা। ফলে শ্রমিকদের সংকট-সমস্যা নিয়ে কথা বলা ও তাদের আইন স্বীকৃত অধিকারগুলো বাস্তবায়নে ভূমিকা গ্রহণ করে হরিনারায়ন হাজরা ও স্বপন নায়েক। বয়সে নবীন হলেও সৎ ও আপোসহীন ভূমিকা নেয়ায় অল্প সময়েই এরা শ্রমিকদের আস্থা অর্জন করে। কিছুদিন আগেই যখন মন্দিরের চাঁদা দাবি করে অন্যায়ভাবে শ্রমিকদের কাছ কয়েকশো করে টাকা আদায় করছিলো বাগান কর্তৃপক্ষ, তখন এই দুইজন শ্রমিকই কর্তৃপক্ষের অন্যায় তৎপরতার বিরোধীতা করে আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করে শ্রমিকদের কাছ থেকে অবৈধ টাকা নেয়া বন্ধ করছিলো। এইভাবেই হরিনারায়ন হাজরা ও স্বপন নায়েক বাগান কর্তৃপক্ষের চক্ষুশূল হয়ে উঠছিলো এবং এটাই তাদের সর্বনাশের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ফলে বাগান কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন রকম ষড়যন্ত্র করতে থাকে এবং এদের বাগান থেকে বহিস্কার করার জন্য বিভিনরকম্ন ফন্দি আঁটতে থাকে। শেষপর্যন্ত সুযোগ একটা বাগান কর্তৃপক্ষের কাছে ধরা দেয়। আর এটার সদ্বব্যবহার করতে ছাড়ে নি ‘সাহেব’ খ্যাত বাগানের সহকারী ব্যবস্থাপক এবং ‘বাব’ু খ্যাত বাগানের হেড ক্লার্ক ।
ঘটনাটি ঘটে গত ২৮ মে দিবাগত রাত প্রায় ৯ ঘটিকার সময়। একটি সংঘবদ্ধ চক্র দীর্ঘদিন যাবত বাগানের প্ল্যান্টেশন এরিয়ার কাঁচাপাতা ও ছায়াবৃক্ষ চুরি করছিল এবং এই সংঘবদ্ধ চক্রের সাথে বাগান কর্তৃপক্ষেরও অশুভ আতাঁত রয়েছে বলে আশপাশের লোকজন মনে করেন। ২৮ মে বিকেলে প্রায় সাড়ে তিনটার দিকে বাগানের বস্তি সংলগ্ন ১০ নং সেকশনের প্ল্যান্টেশন এরিয়া থেকে এই চক্র কাঁচাপাতা চুরি করে নিয়ে যাচ্ছিল। বাগানের কিছু শ্রমিক তা দেখে বাগানের হেড ক্লার্ক ‘বাব’ু গোপাল চক্রবর্তীকে বিষয়টি অবগত করেন। গোপাল চক্রবর্তী সাথে সাথে চোরদের সতর্ক করে দেন এবং চুরির সংবাদদাতা শ্রমিকের নামও সংশ্লিষ্টদের জানিয়ে দেন। এরপর চা-শ্রমিক নেতা হরিনারায়ন হাজরা ও স্বপন নায়েক বাগান সংলগ্ন বাজারে গেলে আলীনগর ইউনিয়নের টিলাগাঁও গ্রামের মঈনুল আহমেদ তাদের মারধোর ও বেঁধে নির্যাতন করতে থাকে। এ সংবাদ বাগানে পৌঁছালে বাগানের শ্রমিকরা এসে নির্যাতিত শ্রমিকদের উদ্ধার করেন। এতে উপস্থিত লোকজনের ধারণা হয় যে, এই মঈনুল আহমেদই চুরি করতে গিয়েছিলো এবং বাগানের হেডক্লার্ক এর সাথে সম্পৃক্ত। ফলে এই ঘটনার প্রতিকার চেয়ে বাগানের শ্রমিকরা হেড টিলা ক্লার্ক গোপাল চক্রবর্তীর সাথে দেখা করতে যান। কিন্তু গোপাল চক্রবর্তী শ্রমিকদের ডাকাডাকিতে কর্ণপাত করে নি। ফলে শ্রমিকরা বাধ্য হয়ে বাগানের সহকারী ব্যবস্থাপকের বাংলোয় যান, কিন্তু তিনিও শ্রমিকদের সাথে সাক্ষাত করেননি। এতে শ্রমিকরা ক্ষুব্ধ হয়ে উঠে। কিন্তু এর কিছুক্ষণ পর পরই সন্ত্রাসী মঈনুলের নেতৃত্বে চিতলীয়া গ্রামের রশীদ উল্লা, ইব্রাহিম মিয়া, সেলিম মিয়া, মন্নান আলী, হানান মিয়া, সাকেলসহ সন্ত্রাসী চা পাতা চোরদল চক্র চা-শ্রমিকদের বাড়িতে সশস্ত্র হামলা চালায়। সন্ত্রাসীদের হামলায় চা-শ্রমিক হরিনারায়ন হাজরা, স্বপন নায়েক রক্তাক্ত জখম ও কানাইলাল হাজরা আহত হওয়াসহ অনেকে আহত হন। সন্ত্রাসীরা হরিনারায়ন হাজরার বাড়িতে নির্দয় হামলা-ভাংচুর চালায়। হরিনারায়ন হাজরার মা রাজকুমারী হাজরাকে ধারালো দা দিয়ে খুটির সাথে আটকিয়ে হত্যার হুমকি দেয়। সন্ত্রাসীরা হরিনারায়ন হাজরার স্ত্রীকে মারধোর করে। এই সময় সন্ত্রাসীরা হরিনারায়নের ঘর থেকে ৭ টি গরু, একটি বড় রাম ছাগলসহ ৫ টি ছাগল, দোকানের ক্যাশ থেকে নগদ ৩০ হাজার টাকা ও একটি দানবাক্স লুট করে নিয়ে যায়। হরিনারায়ন হাজরারকে জানে মেরে ফেলার চেষ্ঠা করে। মারাত্মক আহত শ্রমিকদের হাসপাতালে নিয়ে যেতে চাইলেও হামলাকারী সন্ত্রাসীরা রাস্তা অবরোধ করে রাখে। এতে কোনভাবেই আহতদের হাসপাতালে পাঠানো যায়নি। অসহায় শ্রমিকরা বাগান কর্তৃপক্ষ, স্থানীয় প্রতিনিধিসহ সবার সাথে যোগাযোগ করে। কাউকে না পেয়ে উপায়ান্ত না দেখে ৯৯৯ কল দিয়ে পুলিশকে ডেকে আনেন। কিন্তু দূর্ভাগ্যজনকভাবে রাত ১১ টায় পুলিশ বাগানে এসে ক্ষতিগ্রস্থ বসত বাড়ি পরিদর্শন না করে বাগানের বাংলোয় ম্যানেজারের সাথে বৈঠক করে চলে যেতে যান। এসময় শ্রমিকরা আহত শ্রমিকদের চিকিৎসার দাবি জানালে পুলিশের সহযোগিতায় আহত হরিনারায়ন হাজরা ও স্বপন নায়েককে কমলগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্ত্তি করা হয়। হরিনারায়ন হাজরার মাথায় ৬ টি এবং স্বপন নায়েকের মাথায় ১ টি সেলাই লাগে। চিকিৎসাধীন অবস্থায় সন্ত্রাসীদের নানারকম হুমকিতে হাসপাতলে চিকিৎসা অসম্পূর্ণ রেখেই হরিনারায়ন হাজরা ও স্বপন নায়েককে হাসপাতাল থেকে চলে আসতে হয়। এইদিকে বাগান কর্তৃপক্ষ বহিরাগত সন্ত্রাসীদের হাত থেকে শ্রমিকদের রক্ষায় কার্যকর ব্যবস্থা তো গ্রহণ করেই নি, উপরন্তু বহিরাগতদের দ্বারা বাংলোর ফুলের টব ভাংচুরের ঘটনায় হরিনারায়ন হাজরা এবং তার ভাইদেরসহ স্বপন নায়েক, মিলন নায়েকসহ ৭ জনের নাম উল্লেখ করে মিথ্যা মামলা দায়ের করেছেন। অপরদিকে সন্ত্রাসীরা লুটপাট ও হত্যাচেষ্ঠা চালানোর প্রেক্ষাপটে শ্রমিকরা থানায় মামলা করতে গেলে অভিযোগকারী হরিনারায়ন হাজরার ছোটভাইকে গ্রেফতার করা হয়। উল্লেখ্য যে, কমলগঞ্জ উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান ও চা-শ্রমিক ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক রামভজন কৈরীর পাশের বাাড়িতে বহিরাগত সন্ত্রাসীরা দ্বারা দুঃসাহসী হামলা করার পরও তিনি নির্বিকার। শ্রমিকরা থানায় অভিযোগ দিলেও এখন পর্যন্ত কাউকে গ্রেফতারও করে নি পুলিশ ।
এ ঘটনায় সুনছড়া চা শ্রমিকদের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে মৌলভীবাজার জেলার বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন সংঘ ও চা শ্রমিক সংঘ । সংগঠনগুলোর নেতৃবৃন্দ তাদের পৃথক পথক বিবৃতিতে উল্লেখ করেন- মূলত বাগান কর্তৃপক্ষের বিভিন্ন অনিয়ম, চা পাতা চুরি, ছায়াবৃক্ষ চুরি, শ্রমিকদের বিভিন্ন অধিকার নিয়ে কথা বলার কারণে হরিনারায়ন হাজরা, স্বপন নায়েকসহ কয়েকজনের উপর স্বার্থান্বেষীমহল রূষ্ট ছিলেন। এর আগেও বিভিন্ন সময় চার্জশীট, কাজ বন্ধ রাখাসহ হরিনারায়ন হাজরা ও তার ভাইদের বাগান কর্তৃপক্ষ নানাভাবে নাজেহাল করেন। নেতৃবৃন্দ চা-শিল্প রক্ষা ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখার স্বার্থে অবিলম্বে চা-বাগানের কাঁচা পাতা চুরি, ছায়াবৃক্ষ নিধন বন্ধ, শ্রমিকদের নামে দায়েরকৃত মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার, বাড়িঘরে ভাংচুর, গবাদি পশু ও অর্থ লুটপাটের সাথে জড়িত বহিরাগত সন্ত্রাসী ও তাদের মদদদাতাদের আইনের আওতায় এনে শাস্তি নিশ্চিত করা এবং ক্ষতিগ্রস্থ শ্রমিকদের যথাযথ ক্ষতিপুরণ এবং লুটপাটকৃত গবাদি পশু ও অর্থ উদ্ধারের দাবি জানান। এ প্রেক্ষিতে বাগানের শ্রমিকদের গণস্বাক্ষরে একটি স্মারকলিপিও জেলা প্রশাসনসহ প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে প্রদান করা হয় বলে জানা যায়।