ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট মোকাবেলায় বিশেষ প্রস্তুতি নেই , নাজুক স্বাস্থ্যব্যবস্থায় মৃত্যুর হার বাড়ছেই
তফাজ্জল হোসেন: সম্প্রতি বাংলাদেশে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টের (ডেল্টা) উচ্চ সংক্রমণ বিস্তৃতি ঘটছে। সংক্রমণ মোকাবেলায় সরকার কঠোর লকডাউন কর্মসূচি কার্যকর করছে। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে লকডাউনের কার্যকারিতা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে বিভিন্ন মহলে। সংক্রমণ যখন গ্রাম থেকে শহরে বিস্তৃতি ঘটিয়েছে, তখন শুধু শহর পর্যায়ে কার্যকর করতে পারা এই লকডাউনে সংক্রমণ কতটুকু প্রশমিত হবে তা নিয়েও বিভিন্ন মহলে সন্দেহ রয়েছে। তবে বিশেষজ্ঞদের মতামত হচ্ছে, এ পর্যায়ে শারীরিক দূরত্ব নিশ্চিত করা কঠিন । বিকল্প উপায় হচ্ছে স্বাস্থ্যখাতের সামর্থ্য বাড়িয়ে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা ব্যবস্থার নিশ্চয়তা বিধান করা।
দেশে বিদ্যমান করোনাভাইরাসের বিভিন্ন ধরনের মধ্যে ‘ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট’র প্রাধান্য সুস্পষ্ট। গত মার্চে সিকোয়েন্সকৃত নমুনার ৮২ শতাংশে এ ভ্যারিয়েন্টের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। এরপর জুনে করোনায় আক্রান্ত ৭৮ শতাংশের নমুনায় ভারতের ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)। যা মে মাসে ছিলো মোট নমুনার ৪৫ শতাংশ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিচালক ড. ট্রেড্রস আধানম গেব্রেইয়েসুস বলেন কমপক্ষে ৯৮টি দেশে ভারতে প্রথম শনাক্ত করোনাভাইরাসের ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট ছড়িয়ে পড়েছে। ড. গেব্রেইয়েসুস বলেন, “ভ্যারিয়েন্টটি অত্যন্ত বিপজ্জনক। এটির কাঠামোগত এবং চারিত্রিক রূপান্তর ঘটে চলেছে।’ তিনি বলেন, ‘উন্নয়নশীল বিশ্বে এত কম মানুষ ভ্যাকসিন পেয়েছে যে তাদের সামনে চরম বিপদ অপেক্ষা করছে। ডেল্টা যখন ব্যাপকভাবে ছড়াতে শুরু করবে, দ্রুত ঐসব দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় বিপর্যয় তৈরি হবে, যদি না দ্রুত টিকা কর্মসূচির প্রসার না হয়।।“
বাংলাদেশের ভ্যাকসিনের অভাবে এপ্রিলে টিকা দেওয়া স্থগিত করে দিতে হয়। চীনের কাছ থেকে অনুদান হিসাবে পাওয়া কিছু ভ্যাকসিন দিয়ে ২২শে জুন থেকে স্বল্প মাত্রায় টিকা শুরু করেছে বাংলাদেশ। অবশ্য সরকার বলছে তাদের কাছে সিনোফার্ম, মডার্না এবং ফাইজারের ৫৭ লাখ ডোজ টিকা এসেছে যা দিয়ে যত দ্রুত সম্ভব নতুন করে পুরোমাত্রায় টিকা দেওয়া শুরু হবে। তবে জুনের শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৩ শতাংশেরও কম মানুষের দুই ডোজ টিকা হয়েছে।
মার্চ-এপ্রিলে সংক্রমণ বৃদ্ধির পর দেশের হাসপাতালগুলো থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ৮টি বিভাগে মোট কোভিড ডেডিকেটেড শয্যাসংখ্যা ১২ হাজার ৩৬৫টি এবং মোট আইসিইউ শয্যা সংখ্যা ১০৮৪টি’র তথ্য পাওয়া যায়। সম্প্রতি ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণ বৃদ্ধি ঘটায় হাসপাতালগুলোর উল্লেখিত সক্ষমতা নিয়ে পরিস্থিতি সামলানো কঠিন বলে মনে করছেন চিকিৎসার সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যাক্তিবর্গরা। এ প্রেক্ষিতে দেশের হাসপাতালগুলোতে কিছু কোভিড শয্যা ও আইসিইউ বাড়ানো হলে কোভিড রোগী বৃদ্ধির তুলনায় তা নিতান্তই কম । সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতে কোভিড শয্যা সংখ্যা ও আইসিইউ সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে কি’না স্বাস্থ্যমন্ত্রীর একান্ত সচিব ( উপসচিব) কামরুল ইসলামের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “মন্ত্রী মহোদয় বিভিন্ন হাসপাতালে কোভিড শয্যা সংখ্যা বাড়ানোর কথা বলেছেন। কিন্তু এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য দিতে পারবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।”
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক নাসিমা সুলতানা বলেছেন, চাহিদার সাথে তাল মিলিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা তারা নিচ্ছেন। তিনি বলেন, উপজেলা হাসপাতালগুলোতে সিলিন্ডার সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে এবং সেগুলোতে ১৫ থেকে ২০ লিটার অক্সিজেন সাপোর্ট দেয়া যাচ্ছে।
সম্প্রতি দেশে প্রতিদিনই মৃত্যুর সংখ্যা দেড় শতাধিক হচ্ছে। চিকিৎসকরা এ পরিস্থিতিকে উদ্বেগজনক মনে করছেন। কারণ গ্রামের ক্ষেত্রেও সংক্রমণ দ্রুতহারে বৃদ্ধি ঘটছে বলে চিকিৎসকরা জানান। তাদের মধ্য থেকেও মৃত্যুর হার আশংকাজনক। মৃত্যুর হার বৃদ্ধির প্রেক্ষিতে চিকিৎসকরা বলছেন, গ্রামের অনেকে করোনা উপসর্গ নিয়ে অসুস্থ হলেও তারা করোনা পরীক্ষা করাতে পারছেন না। গ্রাম থেকে উপজেলা হাসপাতালে এসে স্যাম্পল দিতেও তাদের অনীহা লক্ষ্য করা যায়। এর কারণ হিসেবে জানা যায়, উপজেলা হাসপাতালে আসতেও তাদের যে টাকা-পয়সা প্রয়োজন তা সকলের জন্য সংগ্রহ করা কঠিন। তারপর করোনা পজিটিভ ধরা পড়লে ট্রিটমেন্ট খরচ সংগ্রহ করতে পারবে না বলে গ্রামের অধিকাংশ রোগীরা চিকিৎসা নিতেই আসেন না বলে চিকিৎসকরা জানান। তবে অবস্থা একেবারেই মূমুর্ষ অবস্থায় দাঁড়ালে তারা সরাসরি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালগুলোতেই ভর্তি হচ্ছেন বলে চিকিৎসকরা জানান। এ প্রেক্ষিতে ময়মনসিংহের দায়িত্বপ্রাপ্ত সিভিল সার্জন নজরুল ইসলাম জিজ্ঞেস করলে তিনি জানান, ‘পরিস্থিতি আশংকাজনক বিবেচনা করে যেসব রোগীর অক্সিজেন লেভেল ৯০ এর উপরে রয়েছে, সে সমস্ত রোগীদের যেনো উপজেলা কমপ্লেক্সগুলোতেই ট্রিটমেন্ট দেয়া হয়, সেরকম নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।”
এ প্রেক্ষিতে ৫০ শয্যাবিশিষ্ট ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কর্মরত নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন মেডিক্যাল অফিসার জানান, ‘আমাদের হাসপাতালে করোনা রোগীর জন্য পূর্বে নির্ধারিত যে ৫টি আইসোলেশন বেড এবং ১০টি সাধারণ অক্সিজেন সিলিন্ডার ছিলো, সেগুলোই রয়েছে। নতুন শুধু একটি পালস অক্সিমিটার দেয়া হয়েছে।’ তিনি জানান, এসব অক্সিজেন সিলিন্ডারে প্রতি মিনিটে ৫/৬ লিটার পর্যন্ত অক্সিজেন সাপোর্ট দেয়া যায়।’ অন্যদিকে রোগীর চাপ সামলাতে হিমসিম খাচ্ছে ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল। বৃহত্তর ময়মনসিংহ ছাড়াও ঢাকা ও সিলেট বিভাগের অনেকাংশের করোনা রোগীর জন্য সেন্ট্রাল অক্সিজেনের ব্যবস্থা রয়েছে একমাত্র এই হাসপাতালটিতে। সাধারণত রোগীর অক্সিজেন লেভেলে ৮০ এর নিচে নেমে আসলে অক্সিজেন সরবরাহের জন্য হাই-ফ্লো ক্যানুলা ব্যবহার করতে হয়। যা বৃহত্তর এই অঞ্চলের জন্য এই হাসপাতলেই সরবরাহ করা হয়। অথচ রোগীর চাপ সামলাতে না পেরে হাসপাতালটিতে ২১০ টি করোনা শয্যার সাথে মাত্র ৮৬টি করোনা শয্যা ও ৯টি আইসিইউ শয্যা বাড়িয়ে জটিল রোগীদের জন্য ২২টি নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ) স্থাপন করা হয়েছে।
সারাদেশে স্বাস্থ্যব্যবস্থার করুণ চিত্র তুলে ধরে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ লেনিন চৌধুরী বলেন, ৬৪ টি জেলার মধ্যে সবমিলিয়ে মাত্র ৩৫টি জেলায় কেন্দ্রীয় অক্সিজেন ব্যবস্থা রয়েছে। তিনি বলেন, আমাদের দেশে পর্যাপ্ত অক্সিজেন রয়েছে কিন্তু সেই অক্সিজেন বিপণন ও সরবরাহের যে বৈষম্য রয়েছে কিংবা অক্সিজেন সরবরাহের যন্ত্রের সমস্যার কারণে মৃত্যুর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে।” দেশে করোনা আক্রান্তদের চিকিৎসার জন্য ঢাকাসহ সারাদেশে ১০০টি সরকারি হাসপাতাল নির্ধারিত আছে৷ কিন্তু এই হাসপাতালের ৪৮টি হাসপাতালে আইসিইউ আছে, ৫২টিতে নেই৷ আইসিইউ সুবিধা নাই এমন হাসপাতালের ৩৫টিই আবার ঢাকার বাইরের জেলা সদরগুলোতে৷
করোনা মহামারীর মধ্যে উত্থাপিত ২০২১-২০২২ অর্থবছরের বাজেটে স্বাস্থ্যখাতকে বিভিন্ন মহল থেকে প্রাধান্য দেয়ার কথা বলা হলেও স্বাস্থ্যখাতে মাত্র ৩ হাজার কোটি টাকা বাড়িয়ে বরাদ্দ প্রস্তাব করা হয় ৩২ হাজার ৭৩১ কোটি টাকা । যা খাত ভিত্তিক বরাদ্দে মোট বাজেটের মাত্র ৫.৪ শতাংশ। অথচ খাত ভিত্তিক বরাদ্দে সবচেয়ে এগিয়ে সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য জনপ্রশাসন খাতে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে মোট বাজেটের ১৮.৭ শতাংশ। সব মেডিকেল যন্ত্রপাতি ও সামগ্রীর (অ্যানালাইজার, ক্যাথল্যাব, ইসিজি, ইকোকার্ডিওগ্রাম, ডিফিবরিলেটর, ভেন্টিলেটর, কার্ডিয়াক মনিটর, সিটি অ্যাপারাটাস হাসপাতাল শয্যা, ব্লাড ব্যাংক, সিরিঞ্জ পাম্প, সার্জিকেল স্টেরাইল গ্লোভস, বায়োসেফটি কেবিনেট ইত্যাদি) ওপর আরোপিত সব ধরনের শুল্ক, অগ্রিম ইনকাম ট্যাক্স (AIT) এজেন্সি ট্যাক্স (AT) প্রত্যাহার করে নেয়ার জন্য বিভিন্ন মহল থেকে দাবি জানিয়ে আসলেও বাজেটে তার প্রতিফলন ঘটে নি। ফলে এ সমস্ত কারণে করোনা চিকিৎসার ব্যয় অনেক বেশি হওয়ায় অনেকেই চিকিৎসার অসামর্থ্যতার জন্যই মারা যাচ্ছে বলে বিভিন্ন জনস্বাস্থ্য ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন।