মাতৃত্বের এক অনন্য দৃষ্টান্ত ফাতেমা খায়রুন্নেসা খানম
সুদীপ্ত শাহীন:
“দুনিয়ার যত বড় বড় জয় বড় বড় অভিযান
মাতা ভগ্নী বধূদের ত্যাগে হইয়াছে মহীয়ান।”
সমাজ সভ্যতায় নারীদের অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ কবি নজরুলের এই অমোঘ বাণী। আমাদের নয়া ঔপনিবেশিক আধা- সামন্ততান্ত্রিক সমাজে এখনো নারীদের উৎপাদন কাজে অংশগ্রহণ করানো হয় কম। তারপরও সস্তা শ্রমের লোভে সম্প্রতি মুৎসুদ্দি পুঁজিপতিরা যেটুকু মাত্রায় নারীদের কাজে অংশগ্রহণ করাচ্ছে, সেটুকুতেই সংগ্রামের স্বমহিমায় জেগে উঠেছেন নারীরা। অনেকেই জীবন সংগ্রাম করতে যেয়ে রাজনৈতিক সংগ্রামের খাতায় নাম লিখিয়েছেন। তবে দেশের গ্রামে-গঞ্জে লুকিয়ে আছেন এমন অসংখ্য নারী যাঁরা রাজনৈতিক সংগ্রামে প্রকাশ্যে না আসলেও রাজপথের সৈনিকদের শক্তি, সাহস যুগিয়েছেন অন্দরমহলে থেকেই। মহলবাসী এরকম একজন সাহস সঞ্চারিণী মাতা ফাতেমা খায়রুন নেসা খানম। সুনামগঞ্জ জেলার ধরমপাশায় সেলবরষ গ্রামে তাঁর জন্ম। পঞ্চম শ্রেণিতে বৃত্তিপ্রাপ্ত হয়ে দশম শ্রেণি পর্যন্ত ছিল তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা। এ সময়ে নারী শিক্ষার বিস্তারের লক্ষ্যে তাঁর নিজ বাড়িতে বর্তমান সেলবরষ প্রাথমিক বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত করে সমবয়সী ফাতেহা বেগম, সালেহা বেগমসহ বছর কয়েক শিক্ষকতাও করেন। রাজনৈতিক কোন সভা-সেমিনারে বা কাগজে-কলমে উল্লেখ করার মতো কোনো পদবি তাঁর ছিল না। কিন্তু অনেক মহতী সভার সহযোগী ছিলেন তিনি। যারা জীবনকে হাতের মুঠোয় নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন পথে-প্রান্তরে তাদের অনেকেরই আশ্রয়স্থল ছিলেন তিনি। অনেক প্রগতিশীল কর্মীকে মাতৃত্বের পরম মমতায় শ্রান্তি ও শোভা বিলিয়েছেন এই জননী । তাই প্রগতিশীল আন্দোলনের কর্মীদের অনেকেই তাঁকে মা বলেই সম্বোধন করতেন।
মাত্র ৩৮ বছর বয়সে স্বামী হারা হোন এই মমতাময়ী মা। সাড়ে ছয় মাসের গর্ভে এক মেয়েকে নিয়ে তিনি তখন এক পুত্র ও ৫ কন্যার জননী । সবার বড় তাঁর একমাত্র ছেলে খায়রুল বসর (বর্তমানে তিনি বাংলাদেশ কৃষক সংগ্রাম সমিতির কেন্দ্রীয় কমিটির আইন বিষয়ক সম্পাদক) তখন কেবল সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র। গোষ্ঠীবদ্ধ গ্রাম থেকে দূরে বাদশাগঞ্জ বাজারে মনাই নদীর তীরে আলাদা বিচ্ছিন্ন একটি বাড়িতে এরকম ছোট ছোট সন্তানদের নিয়ে সেদিন অথৈ সাগরে পড়েন এই মধ্যবয়সী নারী। সামাজিক নিরাপত্তার ছিল যেমন অভাব, তার চেয়েও বেশি অভাব তখন সংসারের হাল ধরার লোকের।
বাংলাদেশ নামক ভূখণ্ডটির তখন সবেমাত্র জন্ম। চারিদিকে শুধু বিশৃংখলা আর বিশৃংখলা। একদিকে খুন, রাহাজানি, চুরি-ডাকাতি এবং অন্যদিকে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও খাদ্যের অভাবে বিপর্যস্ত সারা দেশের মানুষ। এই সময় মানুষকে আবার নতুন করে স্বপ্ন দেখান এবং উদ্দীপ্ত করে তোলেন এলাকার শিক্ষিত কয়েকজন যুবা-তরুণ। তরুণ শিক্ষক সামসুল আলম ( প্রয়াত), দেওয়ান সাজেদুর রহমান সাজু ( প্রয়াত), আব্দুল ওয়াহাব ( প্রয়াত), আব্দুল ওয়াহাব লিলু মিয়া ( প্রয়াত), গোলাম আহম্মদ( প্রয়াত) এবং মতিয়র রহমান ( কৃষক সংগ্রাম সমিতির ধর্মপাশা উপজেলা কমিটির সভাপতি) এরকম কয়েকজন প্রগতিশীল আন্দোলনের কর্মী সর্বদা সরব থাকেন এলাকার জেলে-কৃষকদের দুঃখ-দুর্দশায়। ” বলি দা” নামে লালা শরদিন্দু তখন ইপিসিপি( এম- এল) পার্টির সার্বক্ষণিক কর্মী হিসেবে এলাকায় মানুষজনের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত হয়ে উঠেন । এই সময়ে আব্দুল ওয়াহাব ও তাঁর ভাই আছাব আলী ( নওধার গ্রামের) বাদশাগঞ্জ বাজারে সরকার নির্ধারিত টিসিবির একটি কাপড়ের দোকান পরিচালনা করেন। প্রগতিশীল আন্দোলনের নেতা কর্মীরা তখন সামসুল আলম এর ফার্মেসি আর এই দোকানেই চালাতেন তাদের সভা ও আলোচনা। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে ন্যাপ-ভাসানীর নেতৃত্বে এসব কর্মীরাই এলাকায় গড়ে তুলেছিলেন দুর্বার আন্দোলন। ফলে ৭১ পরবর্তী রাজনৈতিক বৈরী পরিবেশে এসব কর্মীদের অনেকেই হয়ে উঠেন রাষ্ট্রীয় রোষানলের শিকার। তাই নিজেদের বিশ্বস্থ বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানেই চলতো তাদের রাজনৈতিক আলোচনা ও আড্ডা । সদ্য পিতৃহারা কিশোর খায়রুল বসর তখন সংসারের হাল ধরতে আসাব আলী ও আব্দুল ওয়াহাবের এই টিসিবির দোকানে টুকটাক ব্যবসার সাথে যুক্ত হন। সেই সুবাদে প্রগতিশীল আন্দোলনের নেতাকর্মীদের সাথে গড়ে ওঠে তার সখ্যতা ও যোগাযোগ । পরবর্তীতে এসব নেতাকর্মীরাই হয়ে ওঠেন তাঁর ও তাঁর পরিবারের নির্ভরযোগ্য অভিভাবক। মা ফাতেমা খায়রুন্নেসা তখন এইসব কর্মীদের নিজ সন্তানের মতোই স্নেহ করেন। আর সংগঠনের কর্মিরাও মাতৃস্নেহের প্রশ্রয় পেয়ে তাদের সামগ্রীক কার্যক্রমর প্রয়োজনীয় কাজের অংশীজন হিসেবে গড়ে তোলেন অন্দর মহলের ধর্মানুরাগী এই মাকেও। রাজনীতির প্রতি আগ্রহ বা জানাশোনা না থাকলেও সন্তানতুল্য এসব কর্মীদের বিদ্যা, বুদ্ধি, সততা ও ত্যাগ তাঁকে আকৃষ্ট করে তোলে। ফলে তিনিও পরোক্ষভাবে তাদের কাজের সহযোগী হয়ে কর্মি ও সংগঠনের আস্থাবান হয়ে ওঠেন। সংগঠনের প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ও বইপত্র খুব যত্নের সহিত তিনি সংরক্ষণে রাখতেন। ফলে তৎকালীন কমিউনিস্ট আন্দোলনের নেতারাও ধীরে ধীরে তাঁর বাড়িতে যাওয়া আসা শুরু করেন। কমিউনিস্ট আন্দোলনের কিংবদন্তী নেতা কমরেড আবদুল হক, কমরেড অজয় ভট্টাচার্য, কমরেড দীলিপ সোম এঁর সাথেও তাঁর পরিচিতি ঘটে। এভাবেই কমিউনিস্ট ও প্রগতিশীল আন্দোলনের অনেক নেতাকর্মীদের সাথে তাঁর পরিচয় ও যোগাযোগ গড়ে উঠে।
সংসার আগলে রাখার অসামান্য গুণ ছিল ফাতেমা খায়রুন্নেসা খানম- এঁর। আর্থিক অভাব অনটনের মধ্যেও সন্তানদের আগলে রেখেছেন দৃঢ় বন্ধনে। অভাব-অনটন মোকাবেলা করেছেন তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তায়। রাষ্ট্রীয় অবহেলা আর অযত্নে কৃষি আবাদে কৃষকদের আস্থা থাকে নি। তাই অনেক জমিই পড়ে থাকতো পতিত অবস্থায়। সেই সময় বিধবা এই নারী আত্মীয়-স্বজনদের সহযোগিতা নিয়ে কিছু জমি আবাদ করিয়ে নেন, যা দিয়ে তিনি মোকাবেলা করেন ৭৪-র ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ। যখন মানুষ ভাতের অভাবে লতাপাতা খেয়ে কোনরকম দিন যাপন করেছে। অনাহারে থেকে মৃত্যবরণ করেছেন অনেকে। কষ্টের এই সময়গুলোতে ফাতেমা খায়রুন্নেসা খানম সর্বদা পাশে পেয়েছেন তাঁর পিতা আব্দুল মান্নান চৌধুরীকে। পারিবারিক সকল সংকট সমস্যায় অকৃত্রিম সহযোগিতা পেয়েছেন আসাব আলী, আব্দুল ওয়াহাব ও সামসুল আলম মাস্টারের কাছ থেকে। যাঁদের তিনি আজীবন কৃতজ্ঞতা ভরে স্মরণ রেখেছেন। সমস্ত প্রতিকূলতা মোকাবেলা করেও তিনি সন্তানদের পড়ালেখা করানোর অদম্য চেষ্টা চালিয়ে যান। একমাত্র ছেলে খায়রুল বসর ঠাকুর খানের স্কুলে পড়াকালীন সময়েই ব্যবসা-বাণিজ্যের সাথে যুক্ত হতে হয় পরিবারের হাল ধরতে । তবুও প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশুনা থেকে তাঁকেও ছিটকে যেতে দেননি বিদ্যানুরাগী এই মা। মেয়েদেরকেও সততা ও নৈতিকতা শিক্ষা দেওয়ার পাশাপাশি একাডেমিক শিক্ষায় শিক্ষিত করার চেষ্টা করেছেন যথাসাধ্য। তার আপ্রাণ চেষ্টার সাথে সহায়ক হয়ে উঠে প্রগতিশীল রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের সাহচর্য। ফলে পরিবারের মেয়েদের মধ্যেও গড়ে উঠে সততা ও নৈতিকতা বোধ। এভাবেই দীর্ঘ জীবন সংগ্রামে পরীক্ষিত হয়ে একজন সাধারণ নারী হয়ে উঠেন সর্বজন শ্রদ্ধার পাত্র। তাঁর অদম্য চেষ্টা এবং রাজনৈতিক সংস্কৃতির সংস্পর্শে শোভন ও পরিশীলিতার দিক দিয়ে এলাকায় তাঁর পরিবারটি হয়ে উঠে একটি দৃষ্টান্তস্বরূপ।
শ্রেণিবিভক্ত সমাজে স্বাভাবিক জীবনযাপন ও সাধারণ নৈতিকতাও টিকিয়ে রাখার জন্য প্রয়োজন হয় মন্দের সাথে ভালোর অবিরাম দ্বন্দ্ব-সংগ্রামের। সমাজের বৈরিতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হয় অবিরত। অবচেতন বা অসচেতনভাবে এই সংগ্রামকে অস্বীকার করলে নিমিষেই সমাজের গতানুগতিকতার স্রোত ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারে পঙ্কিলতার অতল গহ্বরে। নিজস্ব জীবনের বন্ধুর পথ অতিক্রমণই অনেককে জীবনের গতি নির্ধারণ করে দেয়, আবার অনেকেই রাজনৈতিক- সাংস্কৃতিক সচেতনতার মাধ্যমে জীবনকে পরিচালনায় পায় সঠিক দিশা। তবে জীবনের সঠিক পথ ও সিদ্ধান্ত নিতে হয় দ্বান্দ্বিকতার আবর্তে আপেক্ষিক সত্য উদঘাটন করার মাধ্যমে। বস্তুর বিকাশের গতিও এভাবে নির্ধারিত হয়। আর পুরনো, বদ্ধমূল চিন্তা অবকাঠামো বস্তুর বিকাশকে গতি রুদ্ধ করে রাখে। সমাজ বিকাশের প্রকৃতির এই নিয়মের মত করে ব্যক্তি ও পরিবারের গতিও নির্ধারিত হয়। ভাঙ্গা-গড়ার মধ্য দিয়েই ব্যক্তি ও পরিবার সমূহ অগ্রসর হয়। আজকের জন্য যা সত্য, কালকে যেন তা মিথ্যাও প্রমাণিত হতে পারে। কেননা, প্রতিটা ব্যক্তিই এক একটা বাস্তব সত্তা। তার অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ নিহিত থাকে এই সত্তার মধ্যেই। ফতেমা খায়রুন্নেসা খানম তাঁর বাস্তব জীবনের অতীত সংগ্রামের নির্যাস দিয়েই সাজিয়ে তুলেছিলেন তাঁর বর্তমানকে। আর ভবিষ্যত নির্ধারিত হবে তাঁর উত্তরসূরিদের আপেক্ষিক সত্য অনুধাবনের মধ্যে। ২০১৯ সালের ১৬ মে এই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে যান সংসার সংগ্রামী এই নারী। পরহিতৈষী ও পরোপকারী হিসেবে তিনি বিশেষভাবে সমাদৃত থাকবেন প্রজন্মের পর প্রজন্মের কাছে। ১৯৯৪ সালে বাদশাগঞ্জ ডিগ্রি কলেজ প্রতিষ্ঠার সময় প্রতিষ্ঠানের নামে জমি প্রদানে ভূমিকা রেখেও স্বাক্ষর রেখেছেন বিশেষ শিক্ষা অনুরাগীর। ৮৫ বছরের ঘটনাবহুল তাঁর দীর্ঘ জীবনের পরতে পরতে রেখে গিয়েছেন তাঁর ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য বিশাল পাঠ। এই পাঠ কে অধ্যয়ন করবে আর কে করবে না – সেটা একান্তই প্রজন্মের দায়। কিন্তু ফাতেমা খায়রুন্নেসা খানম ছিলেন সকল দৃষ্টান্তের এক অনন্য দৃষ্টান্ত।