উপ-সম্পাদকীয়

মানুষের প্রতি মানুষের মানবতাবোধ জাগ্রত হোক

মানবাধিকার প্রতিটি মানুষের তার জন্মগত অধিকার। মানব পরিবারের সকল সদস্যের জন্য সার্বজনীন, সহজাত, অহস্তান্তরযোগ্য এবং অলঙ্ঘনীয় অধিকারই হলো মানবাধিকার। মানুষমাত্রই এ অধিকার ভোগ করবে এবং চর্চা করবে। তবে এ চর্চা অন্যের ক্ষতিসাধন ও প্রশান্তি বিনষ্টের কারণ হতে পারবে না। মানবাধিকার সব জায়গায় এবং সবার জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য। এ অধিকার একই সাথে সহজাত ও আইনগত অধিকার।

মানুষের প্রতি মানুষের কর্তব্য দায়িত্ব সর্বোপরি মানবতার প্রতি সম্মান প্রদর্শনই হচ্ছে মানবাধিকার ঘোষণার মূল মন্ত্র। বিশ্বব্যাপী মানবাধিকারের বিষয়টি প্রকটভাবে অনুভূত হচ্ছে। মানুষের অধিকারসমূহ যুদ্ধ, সংঘাত, হানাহানির কারণে বার বার লংঘিত হচ্ছে। প্রথমত একটি পরিবার ও সমাজের কর্তারা তাদের অধিনস্তদের অধিকার রক্ষা করবে। রাষ্ট্র এবং র্আন্তজাতিক প্রতিষ্ঠানসমূহ মানবাধিকার রক্ষায় ভূমিকা পালন করে থাকে।মানবাধিকার হচ্ছে কতগুলো সংবিধিবদ্ধ আইন বা নিয়মের সমষ্টি, যা মানব জাতির সদস্যদের আচার আচরণ ও বিশেষ বৈশিষ্ট্যকে বুঝায় এবং যা স্থানীয় ও র্আন্তজাতিক আইন সমষ্টি দ্বারা সুরক্ষিত যা মৌলিক অধিকারের অবিচ্ছেদ্য অংশ বিষয় হিসেবে ধর্তব্য। এতে কোন মানুষ এজন্য সংশ্লিষ্ট অধিকার ভোগ করবে যে, সে জন্মগতভাবে একজন মানুষ। অন্যকথায় বলা যায়, দৈনন্দিন জীবনে চলার জন্য মানুষের যেসকল অধিকার রাষ্ট্রের সংবিধান কর্তৃক স্বীকৃত তাদেরকে মানবাধিকার বলে। জন্মগতভাবে সকল মানুষ স্বাধীন এবং সমান সম্মান ও মর্যাদার অধিকারী।
বর্তমান বিশ্বে হিউম্যান রাইটস শব্দটি বহুল আলোচিত ও প্রচলিত একটি শব্দ। মানবাধিকারের বিষয়টি স্বতঃসিদ্ধ ও অলঙ্ঘনীয় হলেও সভ্যতার ঊষালগ্ন থেকেই এ নিয়ে চলছে বাক-বিত-া ও দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাত। একদিকে মানবাধিকারের সংজ্ঞা ও সীমারেখা নিয়ে বিতর্কের ঝড় তোলা হচ্ছে, অন্যদিকে মতাধর শাসকরা দেশে দেশে জনগণের স্বীকৃত অধিকারগুলো পর্যন্ত অবলীলায় হরণ ও দমন করে চলছে। আর দুর্বল জাতিগুলোর সাথে সবল জাতিগুলোর আচরণ আজকাল মানবাধিকারকে একটি উপহাসের বস্তুতে পরিণত করেছে।
৫৩৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে পারস্যের রাজা দ্বিতীয় সাইরাস ব্যাবিলন আক্রমণ করেন। ব্যাবিলন আক্রমণের পর তিনি ব্যাবিলনীয়দের দ্বারা নির্যাতিত দাস জনগোষ্ঠীকে মুক্ত করে দেন। তাদের নিজ নিজ দেশে প্রত্যাবর্তনেরও ব্যবস্থা করে দেন। অতঃপর সাইরাসের নির্দেশে একটি সিলিন্ডার তৈরি করা হয়। যা সাইরাস সিলিন্ডার নামে অভিহিত। এতে সাম্রাজ্যজুড়ে ধর্মীয় স্বাধীনতা, সহিষ্ণুতা ও মানবাধিকার বাস্তবায়নের কথা বলা হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের দাবি, এটিই বিশ্বের প্রথম মানবাধিকার সনদ।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাতি-রাষ্ট্রের মধ্যে বিভেদ দূর করার লক্ষ্যে এবং মানুষের প্রতি মানুষের সহমর্মিতা এবং মানবতাবোধকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে ১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলোর সমন্বয়ে ঘোষিত হয় সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণা। জাতিসংঘের ঘোষণা অনুযায়ী ১৯৫০ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৩১৭তম প্লেনারি সভায় ৪২৩(ভি) প্রস্তাবে গৃহীত সিদ্ধান্ত মোতাবেক প্রতিবছর ১০ ডিসেম্বর যথাযোগ্য মর্যাদা ও গুরুত্বের সাথে বিশ্বব্যাপী পালিত হয় বিশ্ব মানবাধিকার দিবস।
বাংলাদেশ ১৯৭৪ সালে জাতিসংঘে যোগদান করে এবং ইউনিভার্সাল ডিক্লারেশন অব হিউম্যান রাইটস্ বা সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণার স্মরণার্থে মানবাধিকার দিবস উদযাপন শুরু করে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশে জাতীয় মানবাধিকার সংগঠনসহ বিভিন্ন সংগঠন দেশের সকল বিভাগীয় শহর, মহানগর, জেলা ও উপজেলায় নানান কর্মসূচির আয়োজন করে। তবে এই দিবস পালনে যতটা আনুষ্ঠানিকতা থাকে তার সামান্যতম অংশও বাস্তবায়িত হলে বিশ্ব থেকে নির্বাসিত হত বিচার বহির্ভূত হত্যা, শিশু ও নারী নির্যাতন,অগ্নিসন্ত্রাস,লুটপাটসহ সকল অপরাধ।
আমাদের দেশের সংবিধানেও মানবাধিকার সংরক্ষণের কথা থাকলেও মানুষ প্রতিনিয়ত শিকার হচ্ছে মানবাধিকার লঙ্ঘনের। সংবিধানের ৭ ধারায় বলা হয়েছে, প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ। অন্যদিকে সংবিধানের দ্বিতীয় অধ্যায়ে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিতে বলা হয়েছে, সরকার যেই গঠন করুকনা কেন, জনগণের জন্য খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষার দায়িত্ব ওই সরকারের উপর বর্তাবে। জাতীয় জীবনে নারী পুরুষের সমান অধিকার নিশ্চিত করা থেকে শুরু করে কৃষক শ্রমিককে শোষণ থেকে মুক্ত রাখার অধিকার এই মহান সংবিধানে অন্তর্ভূক্ত হয়েছে। ক্ন্তিু দুঃখের বিষয় মানবাধিকার সুরক্ষার বারবার বাধাগ্রস্থ্ হচ্ছে।
মানব শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর থেকেই শুরু হয় তার অধিকার প্রতিষ্ঠার যাত্রা। পরিবার, সমাজ, দেশ ও জাতিভেদে মানব শিশু তার অধিকার পায়। তবু এই মানবই আরেক মানবকে অধিকার থেকে বঞ্চিত করছে। দেশের মানুষ এখন চরম হিংস্রতা, সহিংসতায়, বর্বরতায় নিমজ্জিত। বিবেক বর্জিত সকল কাজ করে চলেছে। পরিবার, সমাজ, দেশ ও জাতিভেদে মানব জীবনের প্রতিটা ক্ষেত্রে মানবাধিকার লংঘন হচ্ছে। আমাদের দেশে কখনও সন্ত্রাসী কর্তৃক হত্যা, কখনও ধর্মীয় গোড়ামিতে হত্যা ও লুণ্ঠনসহ নানাবিধ কারণে মানবাধিকার লংঘিত হচ্ছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই রাষ্ট্র প্রকৃত অপরাধীদের আইনের আওতায় আনতে পারছে না। যা মানবাধিকারের চরম লংঘন।
আমাদের দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি খুব একটা সুখকর নয়। গৃহ থেকে রাষ্ট্রীয় পর্যায় নানা ক্ষেত্রে নানাভাবে মানবাধিকার লংঘিত হচ্ছে। অবস্থাভেদে মানবাধিকার লংঘনের ঘটনা কম বেশি হলেও মানবাধিকার পরিস্থিতি এখানে সব সময়ই উদ্বেগজনক। দেশে নারীরা অবহেলিত, এদেশের শিশু, প্রবীণরা মৌলিক অধিকার থেকে সুবিধাবঞ্চিত, বঞ্চনা আর অবহেলার শিকার। এই অবহেলা দেশ, জাতি ও ধর্ম নির্বিশেষে চলে আসছে। তাই যুগ যুগ ধরে মানাবধিকার সনদ বা রাষ্ট্রীয় আইন ও নীতিমালা থাকা সত্ত্বেও পদে পদে লংঘিত হয় মানুষের অধিকার এবং শোষিত হয় ক্ষমতাবানদের হাতে। তবুও কিছু বেসরকারি সংস্থা, সমাজের বিবেকবান মানুষ সোচ্চার হয় আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সনদ এবং রাষ্ট্রীয় নীতিমালার আলোকে আইনের সঠিক বাস্তবায়ন ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং শিক্ষার মাধ্যমে নারী, শিশু ও দরিদ্রদের অধিকার প্রতিষ্ঠায়।

বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ। এখানে বেশিরভাগ লোকই দারিদ্র্য সীমার নিচে বসবাস করে। মানবাধিকার বিষয়টি অনেকেরই অজানা, অচেনা। তৃণমূল পর্যায়ে সাধারণ মানুষ মানবাধিকার বিষয়ে জাগ্রত হচ্ছে না। যারা তাদের অধিকার সম্পর্কে অসচেতন তারা কোন প্রতিকার পাচ্ছে না। তাই সরকারি কিংবা বেসরকারিভাবে মাঠ পর্যায়ে মানবাধিকারের তাৎপর্য তুলে ধরতে হবে। সকলকে অবগত করতে হবে তাদের অধিকার সম্পর্কে।আর যখনই সাধারণ মানুষ তাদের অধিকার সম্পর্কে অবগত ও সচেতন হবে তখনই প্রতিষ্ঠা পাবে মানবাধিকার।এজন্য আমাদের সুশীল সমাজ ও মিডিয়াগুলোকেও এগিয়ে আসতে হবে। সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় জন সাধারণকে মানবাধিকার সম্পর্কে অবগত করা ও অধিকার সম্পর্কে সচেতন করে তোলা সম্ভাব হবে। আর সাধারণ মানুষ তার অধিকার সম্পর্কে অবগত ও সচেতন হলে তখনই প্রকৃত অর্থে প্রতিষ্ঠা পাবে মানবাধিকার।

(লেখক: প্রকাশ ঘোষ বিধান, সাংবাদিক ও কলামিস্ট)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *