ময়মনসিংহে ব্যাংক ডাকাতির প্রস্তুতিকালে জেএমবি’র সদস্যরা র্যাবের হাতে আটক
স্টাফ রিপোর্টার ঃ ময়মনসিংহে র্যাবের অভিযানে জেএমবি’র অভিযোগে ৪ জন সক্রিয় সদস্যকে গত ৪ আগষ্ট ভোররাতে র্যাবের সাথে গুলিবিনিময় কালে গ্রেফতার করা হয়। গতকাল মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন এক প্রেস ব্রিফিংয়ে জানায়, ব্যাংক ডাকাতির র্যাব সদর দপ্তরের গোয়েন্দা শাখা ও র্যাব-১৪ এর অভিযানে ডাকাতি প্রস্তুতিকালে জেএমবি’র সক্রিয় সদস্য (১) জুলহাস উদ্দিন ওরফে কাদেরী, মেহেদী (৩৪), ময়মনসিংহ, (২) মোহাম্মদ রোবায়েদ আলম ওরফে ধ্রুব ওরফে রুব (৩৩), ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়া, (৩) মোঃ আলাল ওরফে ইসহাক (৪৮), ময়মনসিংহ এবং (৪) মোঃ আবু আইয়ুব ওরফে খালিদ (৩৬), রংপুর’দেরকে ময়মনসিংহের খাগডহর এলাকা হতে গ্রেফতার করা হয়। উক্ত অভিযানে জব্দ করা হয় ০১ টি বিদেশী পিস্তল, ০১ টি ম্যাগাজিন, ০৩ রাউন্ড গোলাবারুদ, ০৮ টি বোমা সদৃশ্য বস্তু, ০৪ টি ব্যাগ, দরজা ও লক ব্রেকিং বিভিন্ন সরঞ্জামাদি এবং একটি ইঞ্জিন চালিত নৌকা। গ্রেফতারকালীন সময়ে জঙ্গিদের সাথে র্যাবের গুলিবিনিময়ের ঘটনা ঘটে।
র্যাবের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতারকৃতরা তাদের জঙ্গি সংশ্লিষ্টতা ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে তথ্য প্রদান করে। গ্রেফতারকৃতরা নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন জেএমবি’র এহসার সদস্য। এই স্তরের সদস্যরা বিভিন্ন জঙ্গি অপারেশনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করে থাকে। গ্রেফতারকৃতরা সাংগঠনিক সিদ্ধান্তে আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ডাকাতি’র জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত হয় বলে জানায়। এ বিষয়ে জামালপুরের একটি গোপন আস্তানায় বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।
গ্রেফতারকৃতরা আরো জানায়, বর্ণিত অপরাধ সংগঠনে বাছাইকৃত ১০-১৫ জনের একটি সংঘবদ্ধ জঙ্গি দল গঠন করা হয়েছে। ইতিমধ্যে ময়মনসিংহের কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান, এনজিও, স্বর্ণালঙ্কার দোকান সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করে একটি টার্গেট নির্ধারণ করেছে। জল ও স্থলপথের সমন্বয় ঘটিয়ে ঘটনাস্থলে আগমনের পরিকল্পনা করা হয়। এক্ষেত্রে পরিকল্পনায় নৌকা, মাইক্রোবাস ও বাইক ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত ছিল। লুটকৃত অর্থ ময়মনসিংহের একটি এলাকার অপর একটি দলের নিকট হস্তান্তর করার পরিকল্পনা ছিল।
গত ৩১ আগস্ট ২০২১ তারিখ জামালপুরের মাদারগঞ্জের একটি আস্তানায় তারা জড়ো হয়। পরবর্তীতে পরিকল্পনা অনুযায়ী গত ০১ সেপ্টেম্বর ২০২১ তারিখ বিকেলে জামালপুরের জামতলা চর এলাকা হতে ব্রহ্মপুত্র নদী দিয়ে ইঞ্জিন চালিত নৌকাযোগে যাত্রা শুরু করে। গোপনীয়তা বজায় রাখতে পথিমধ্যে তারা বিভিন্ন চরে যাত্রা বিরতি করে। অতঃপর অদ্য মধ্য রাতে ব্রাহ্মপুত্র নদী দিয়ে ময়মনসিংহের খাগডহর এলাকায় পৌছায়। ডাকাতির নেতৃত্বে ছিল গ্রেফতারকৃত জঙ্গি জুলহাস @ কাদেরী @ মেহেদী। তার নেতৃত্বে কয়েকটি দলে বিভক্ত হয়ে দায়িত্ব পালনের পরিকল্পনা করেছিল। দলের সদস্যদের ওয়াচম্যান, হাউজ ও লক ব্রেকিং, নিরাপত্তা প্রদান এবং লুটতরাজসহ বিভিন্ন দায়িত্বে বন্টন ও বিভাজন করা হয়। গ্রেফতারকৃত রোবায়েদ এর সিটিটিভি ও তথ্য প্রযুক্তির বিষয়াদি দেখভাল করার দায়িত্ব ছিল। গ্রেফতারকৃত জঙ্গি জুলহাস @ কাদেরী @ মেহেদী ২০০৫ সালে মুক্তাগাছা, ময়মনসিংহ হতে আলিম পাশ করে। ২০০২ সালে জামালপুরে একটি মাদ্রাসায় দাখিল অধ্যায়ণরত অবস্থায় এক ট্রেইলার মাষ্টারের মাধ্যমে জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হয়। উক্ত টেইলারের দোকানে সে নিয়মিত যাতায়াত করত এবং সেখানে বিভিন্ন উগ্রবাদী ওয়াজ ও গজল শুনত। অতঃপর মুক্তাগাছা একটি মাদ্রাসায় আলিম অধ্যায়ণরত অবস্থায় সে জেএমবি’তে যুক্ত হয়। সেসময় মুক্তাগাছার একজন আঞ্চলিক নেতার অধীনে সে বায়াত গ্রহণ করে। উক্ত বায়াত গ্রহণে ১০ জন জেএমবি সদস্য অংশগ্রহণ করে। উক্ত ১০ জেএমবি সদস্যরা বিভিন্ন সময়ে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী দ্বারা গ্রেফতারও হয়েছে। কেহ কেহ এখনও আত্মগোপনে রয়েছে। বায়াত প্রদানকারী আঞ্চলিক নেতা বাংলা ভাইয়ের একজন ঘনিষ্ঠ সহচর। উক্ত নেতার মাধ্যমে গ্রেফতারকৃত জুলহাস এর বাংলা ভাই ও শীর্ষ জঙ্গি নেতা সালাউদ্দিন সালেহীন এর সাথে পরিচয় ঘটে। বাংলা ভাই ও জঙ্গি নেতা সালাউদ্দিন সালেহীন বিভিন্ন সময়ে ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইলে অবস্থানকালীন সময়ে জঙ্গি বিভিন্ন সহায়তা করত। সে ২০০৭ হতে ২০০৯ সাল পর্যন্ত জঙ্গি সংশ্লিষ্টতায় ২ বছর কারা অন্তরীণ ছিল। অতঃপর সে নিজ এলাকায় জঙ্গিবাদ প্রচারের উদ্দেশ্যে একটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা ও সেখানে শিক্ষকতা শুরু করে। উক্ত মাদ্রাসার দুইজন শিক্ষক জঙ্গিবাদে সংশ্লিষ্টতা থাকায় গ্রেফতার হয়। তখন সে সম্ভাব্য গ্রেফতার এড়াতে ২০১২ সালে আত্মগোপনে চলে যায়। ফলে মাদ্রাসাটি বন্ধ হয়ে যায়। সে টাঙ্গাইলে ও সিরাজগঞ্জ এলাকায় ছদ্মনামে বিভিন্ন মাদ্রাসা, মসজিদে ইমামতি ও শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত থেকে জঙ্গি কার্যক্রমে সক্রিয় ছিল। এসময় সে জঙ্গিবাদ প্রচার প্রচারণার মাধ্যমে উদ্বৃদ্ধ করণে যুক্ত ছিল। এছাড়া জঙ্গিদের উত্তরবঙ্গ ও ঢাকা গমনাগমনে টাঙ্গাইলে সেল্টার প্রদান করত। পাশাপাশি সে টাঙ্গাইল, গাজীপুর, বগুড়া ও ময়মনসিংহের জঙ্গিদের গোপন আস্তানার সমন্বয় সাধন করত। এমন কয়েকটি আস্তানায় ইতিপূর্বে র্যাব অভিযান পরিচালনা করেছে। গ্রেফতারকৃত জঙ্গি রোবায়েদ @ ধ্রুব @ রুব ময়মনসিংহের একটি কলেজ হতে অনার্স সম্পন্ন করে। ময়মনসিংহে অধ্যায়ণরত অবস্থায় এক সহপাঠীর মাধ্যমে জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হয়। অতঃপর সে জেএমবি’তে যোগদান করে। ২০১৩ সালে ময়মনসিংহে একটি নাশকতা মামলায় বেশ কয়েকদিন কারা অন্তরীণ ছিল। এছাড়াও সে ২০১৫ সালে ঢাকার একটি বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হতে ইংরেজীতে এমএ সম্পন্ন করে। পরবর্তীতে সে কম্পিউটারের বিভিন্ন প্রোগ্রামের উপর প্রশিক্ষণ নেয়। সে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ঢাকা ও টেকনাফে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত ছিল। সে শিক্ষকের ছদ্মবেশেও উক্ত এলাকা ও প্রতিষ্ঠানে জঙ্গিবাদ প্রচার করত। সে জেএমবি সাইবার দলের সাথে সম্পৃক্ত থেকে বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করেছে। সে করোনাকালীন সময়ে অনলাইন দাওয়াতি কার্যক্রম পরিচালনা করে বেশ কয়েকজনকে জঙ্গিবাদে অন্তর্ভুক্ত করেছে গ্রেফতারকৃত জঙ্গি আইয়ুব @ খালিদ (৩৬) উত্তরবঙ্গের একটি বিশ্ববিদ্যালয় হতে বিএসসি (অনার্স) সম্পন্ন করে। ২০১৯ সালে উত্তরবঙ্গের সাইবার দলের প্রধানের মাধ্যমে জেএমবি’তে অন্তর্ভুক্ত হয়। সে উত্তরাঞ্চলের একটি নির্দিষ্ট শ্রেণীর মধ্যে জেএমবি দাওয়াতি কার্যক্রম পরিচালনার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়। দ্রুততম সময়ে স্বল্প শিক্ষিতদের জেএমবি’তে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য একটি বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া হয়। ইতিমধ্যে সে পঞ্চগড়, দিনাজপুর ও নীলফামারিতে বেশ কয়েকজন শ্রমিক, অটোচালক, টেইলার ইত্যাদি শ্রেণীর পেশাজীবীদের জঙ্গিবাদে অন্তর্ভুক্ত করেছে। উত্তরবঙ্গের উক্ত জেএমবি নেতা তাকে বর্ণিত ডাকাতিতে নির্বাচিত করার জন্য শীর্ষ এক নেতার কাছে সুপারিশ করে।
গ্রেফতারকৃত জঙ্গি আলাল ওরফে ইসহাক (৪৮) সে ২০১০ সালে জুলহাসের মাধ্যমে জেএমবি’তে অন্তর্ভুক্ত হয়। জুলহাস সহ যে দশজন একত্রে জেএমবি’তে বায়াত নিয়েছিল, সে তাদের বিশেষ সহযোগী হিসেবে বিভিন্ন সাংগঠনিক কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করত। সাংগঠনিক প্রয়োজনে সে ময়মনসিংহ, জামালপুর, টাঙ্গাইল ও কিশোরগঞ্জে সফর করেছে। বর্ণিত ঘটনায় তার নৌকা চালান সহ ডাকাতিতে অংশগ্রহণের দায়িত্ব ছিল।