উপ-সম্পাদকীয়

যে আগুনের আঁচ লাগে না কর্ণধারদের গায়ে

প্রকাশ দত্ত:  শ্রেণি বিভক্ত সমাজের অভ্যন্তরে যে আগুন জ্বলছে তা আপাতদৃষ্টিতে চোখে দেখা না গেলেও তার তাপ খুবই ভয়ঙ্কর। এটা শোষিত শ্রেণির জনগণ কতটা উপলব্ধি করে তা জা না গেলেও, শোষক শ্রেণি ঠিকই সেই উত্তাপ উপলব্ধি করে। তাই বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে শোষিত শ্রেণিকে শায়েস্তা করতে তাদের বিরুদ্ধে নানা ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। তারই একটি হচ্ছে বস্তিতে আগুন লাগিয়ে বস্তি উচ্ছেদ। বস্তি গড়ে তোলার পিছনে যেমন কার্যকারণ থাকে। তেমনি বস্তি উচ্ছেদের পিছনেও থাকে নানা কার্যকারণ। এ ধরনের কাজ শোষক শ্রেণি করে থাকে তার নিপীড়ক দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই। এই দূরদৃষ্টি থাকার কারণেই তাদের কাছে আগাম অনেক সংবাদ পৌঁছে যায়।
যখন বস্তিবাসী গরিব মানুষের ঘরে আগুন লাগে তখন খুব সহজেই দেখতে পাওয়া যায়। সকলে সহমর্মিতা আর করুণার দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে। বস্তিতে আগুন লাগে তখন মানুষ শুধু সহমর্মিতা দেখিয়েই শেষ করে না। আগুনের কারণ নিয়ে নানা জনে নানা মন্তব্য করে, বলতে থাকে নানা কথা। কিন্তু যে কথাটি সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত হয় তাহল আগুনের পিছনে রয়েছে স্বার্থান্বেষী মহলের কারসাজি। কথিত এই স্বার্থন্বেষী মহল থাকে সমাজের ওপর তলায় আর রাষ্ট্র তাদেরকে রাখে আগলিয়ে। যে কারণে বস্তির আগুনের ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত হয় না বা অগ্নিকা- প্রতিরোধে কোন কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। সারাদেশে মোট বস্তির সংখ্যা কত তা না জানা গেলেও ২০১৪ সালের বস্তি শুমারী অনুযায়ী ঢাকা শহরের ২ সিটি করপোরেশনে মোট বস্তির সংখ্যা ছিল ৩,৩৯৪টি। সুরম্য অট্টালিকায় ভরা ঢাকা শহরে বস্তিবাসীর এই চিত্রই বলে দেয় ব্যাপক মানুষের ঘর-সংসার উজাড় হয়ে গড়ে উঠছে গুটিকয়েক মানুষের আলিসান ভিলা। শ্রেণি বিভক্ত এই সমাজে জ্ঞান, বিজ্ঞান, শিল্প, সাহিত্য, শক্তি, সম্পদ সবকিছুই শোষক শ্রেণির দখলে থাকে। তা রক্ষা করতে জ্ঞান, বুদ্ধি, বিশ্বাস আর মতাদর্শের বেড়াজাল দিয়ে প্রতিনিয়ত আড়াল করা হচ্ছে প্রকৃত সত্যকে। যার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হচ্ছে বস্তিবাসীর জীবন আর আগুন লাগার জন্য দায়ী হচ্ছে কপাল। এই কথাটাই যখন বেশিরভাগ বস্তিবাসী বিশ্বাস করে তখন রাষ্ট্র ও সরকার নিরাপদ থাকে। কিন্তু যখন প্রশ্ন উঠে বস্তির দখল নিয়ে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব অথবা বড় কোনো সুপার মার্কেট গড়ে তোলার জন্য আগুন লাগানো হয় বস্তিতে। তখন রাষ্ট্র ও সরকার অস্বস্তিতে পড়ে। বস্তিতে আগুন লাগলে পুড়তে যেমন বেশি সময় লাগে না। তেমনি বস্তির আগুনের খবর খুব বেশি সময় পত্রিকার পাতায় বা আলোচনায় থাকে না। আলোচনায় থাকে বা রাখা হয় যদি কায়েমি স্বার্থে তা প্রয়োজন পড়ে। তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হচ্ছে তাজরিন গার্মেন্টস অগ্নিকা-। আর এই অগ্নিকান্ডে তাপ লেগেছিল প্রধানমন্ত্রীর গায়েও। আজও তাই স্বীয়স্বার্থে লগ্নিপুঁজির প্রয়োজনে তাজরিন অগ্নিকা-কে পুঁজি করে দর কষাকষি করছে ব্র্যান্ড ও বায়ররা। আর বস্তিতে আগুন লাগলে প্রগতিশীল ব্যক্তি ও শক্তিসমূহের বিবৃতি, প্রতিবাদ-বিক্ষোভ থামাতে কখনো কখনো পুলিশকে বেগ পেতে হয় কিন্তু ক্ষমতার মসনদে তার কোন প্রভাব পড়ে না। এছাড়া বস্তিতে আগুন লাগলে ভোট বেপারীরা ছুটে আসে ভোটের আশায়। এর বাইরে কখনো কখনো চামড়া বাঁচাতে আর মুখ রক্ষা করতে হাতে কিছু শুকনো খাবার নিয়ে আসে মেয়র আর স্থানীয় সংসদ সদস্যরা। আর প্রচ- শীত হলে সম্বলহীন মানুষের জন্য আসে কম্বল। কিন্তু এই বস্তির মানুষগুলোরই ঘর ছিল, জমি ছিল। শোষণের যাতাকলে পিষ্ট হয়ে শেষ আশ্রয়স্থল হিসেবে বেছে নিতে বাধ্য হয়েছে আজ বস্তির জীবন। “উন্নয়ন”এর স্মারক দেখাতে যখন পদ্মা সেতুর স্প্যান দেখানো হয় তখন টিভির পর্দায় খবর আসে বস্তিতে আগুন লেগে পুড়ে গেছে জরিনা, সখিনা আর বিন্দুমাসীর সংসার। সম্প্রতি পর পর কয়েকটি বস্তিতে আগুন লেগে পুড়ে গেছে সহায় সম্বলহীন মানুষের শেষ সম্বল।
২০২০ সালে অক্টোবরে কল্যাণপুরে নতুন বাজার বস্তির ৭ নং সেকশন এলাকায় অগ্নিকান্ডে দু’জন দগ্ধ হয়। ২৩ নভেম্বর মহাখালীর সাততলার বটতলার মসজিদ রোডের বস্তিতে আগুন লেগে পুড়ে যায় আড়াই শতাধিক ঘর। ২৪ নভেম্বর মঙ্গলবার মোহাম্মদপুর জহুরি মহল্লায় বিজলি বস্তিতে আগুন লেগে শতাধিক ঘর পুড়ে যায়। একইদিনে কয়েক ঘন্টার মাথায় রাত আনুমানিক সোয়া ২টার দিকে কালশি বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন বাউনিয়া বাঁধ বি-ব্লকের বস্তিতে আগুন লেগে অন্তত ৪৩টি বস্তিঘর এবং ১২টি দোকান পুড়ে যায়। ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ১০ মাসে ৯৩টি বস্তিতে আগুন লাগে বা লাগানো হয়। ২০১৯ সালে সারাদেশে ১৭৪টি, ২০১৮ সালে ৫২৫টি, ২০১৭ সালে ২৫৪টি বস্তিতে আগুন লাগে। ২০১৭ থেকে ২০১৯ তিন বছরে সবচেয়ে বেশি অগ্নিকা- ঘটেছে চট্টগ্রামের ৬০২টি বস্তিতে, ঢাকায় ঘটেছে ৯৬টি বস্তিতে। গত পাঁচ বছরে দেশের বস্তিগুলোয় ১,২০০টির বেশি অগ্নিকান্ড ঘটলেও একটিও অভিযোগপত্র দাখিল করেনি পুলিশ। ২০১০ থেকে ২০১৮ সালে সর্বোচ্চ অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটেছে রাজধানী ঢাকায়। ২০১০ থেকে ২০১৮ সালে সারাদেশে ছোট-বড় ১৬,০০০ অগ্নিকান্ডে মারা গেছে ১,৫৯০ জন। শুধু গত বছরেই রাজধানীসহ সারাদেশে অন্তত ৩২টি বস্তিতে আগুন লাগে। আর এতে মারা গেছে নারী-শিশুসহ ২০ জন। তথাকথিত উন্নয়ন অভিযানের নামে কোথাও উচ্ছেদ করা হয় বস্তি, কোথাও কেড়ে নেওয়া হয় কৃষকের ফসলি জমি, কোথাও উচ্ছেদ হয় ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষ। যেমন সম্প্রতি পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবনের চিম্বুক পাহাড়ে নাইতংপাড়ায় পাঁচতারা রিসোর্ট নির্মাণের নামে উচ্ছেদ করা হবে ম্রো সম্প্রদায়ের মানুষকে।
মানুষের বেঁচে থাকার সংগ্রামের মধ্যদিয়ে যে সকল আবিষ্কার তার মধ্যে আগুনের আবিষ্কার গুরুত্বপূর্ণ। তখন কি মানুষ জানতো একদল কায়েমি স্বার্থবাদীদের স্বার্থে আগুনে ভস্মীভূত হবে তাদের জীবন। জীবন-জীবিকার প্রয়োজন ছাড়াও প্রচ- শীতের দিনে শীতবস্ত্রহীন অসহায় মানুষের কাছে আগুন সোনার মত দামী। কিন্তু বস্তির আগুন আজ শাসক-শোষকগোষ্ঠীর কাছে লাভ আর লোভের হাতিয়ার। শ্রেণি বিভক্ত সমাজে এ হচ্ছে বিজ্ঞানের অপব্যবহারের নিষ্ঠুর বাস্তবতা। প্রচলিত সমাজে জীবনের সব চাওয়া আর স্বপ্নকে ভুলে গিয়ে ভারবাহী পশুর মত যারা বস্তিতে জীবন-যাপন করছে তারা রাষ্ট্রের কাছে নিছক পরিসংখ্যান ছাড়া আর কিছুই নয়। কোলের সন্তানকে ঘুমের মধ্যে রেখে খুব সকালে উঠে শহরের বাসাবাড়িতে বাবুদের সংসার সাজাতে ছুটে বেড়ানো সেই মানুষগুলোর শেষ আশ্রয় হচ্ছে এই বস্তিগুলো। অভাবের তাড়নায় বস্তির শিশুকে ছাড়তে হয় পরম মমতায় ঢাকা মায়ের কোল। যে কারণে শিশুকাল তাদের জীবনে হয়েছে শিশুশ্রমের কাল। আমাদের দেশের দৈনিক পত্রিকাগুলোর সাহিত্য পাতায় খুব বেশি থাকে না বস্তি নামক মানুষের জীবন কথা। নিষ্ঠুর সত্য হচ্ছে মুনাফার ক্রুশে বিদ্ধ অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় সব চাওয়া-পাওয়া পুঁজির চাওয়া-পাওয়ার সাথে জড়িত। পুঁজির শোষণ যেমন মানুষকে পাঠিয়েছে বস্তিতে আবার পুঁজির স্বার্থে আগুন জ্বালানো হয় বস্তিতে। তাই আগুনের চেয়েও নির্মম নিষ্ঠুর হচ্ছে পুঁজির শোষণ। পুঁজির স্বার্থে গড়া এই পৃথিবীর তাবৎ ঘটনার বিষয়বস্তুর প্রেক্ষিতে সকল ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার মধ্যদিয়ে প্রতিফলিত হয় শ্রেণির স্বার্থ। যেমন বস্তির আগুন আর বসুন্ধরা সিটিতে লাগা আগুন। এই দু’টি অগ্নিকান্ডের ঘটনায় রাষ্ট্রের ভূমিকা লক্ষ্য করলে বোঝা যায় রাষ্ট্র কার স্বার্থের পাহারাদার।
সাম্রাজ্যবাদী লগ্নিপুঁজির সাথে দালালপুঁজি মিলে যে পুঁজিপতি শ্রেণির সৃষ্টি হচ্ছে তাকে রক্ষা করতে আর পুষ্টি জোগাতে রাষ্ট্র আজ মরিয়া। যে কারণে বসুন্ধরা সিটিতে আগুন লাগলে কে না ছুটে আসে তার পাশে? প্রধানমন্ত্রীও সমবেদনা জ্ঞাপন করেন। প্রতিপক্ষকে দমন করতে আগুন সন্ত্রাসী আখ্যা দিলেও ক্ষমতাসীন আর ক্ষমতাপ্রত্যাশীরা সাম্রাজ্যবাদী লগ্নিপুঁজি ও দালালপুঁজির স্বার্থে মানুষের জীবন ও জীবিকা নিয়ে আগুনের চেয়েও ভয়াবহ খেলা খেলছে। কিন্তু মানুষকে জমি থেকে, বাড়ি থেকে, বস্তি থেকে উচ্ছেদ করে কায়েমি স্বার্থবাদীদের পুঁজি স্ফীত করতে শাসক-শোষকগোষ্ঠীর ক্ষমতাসীন ও ক্ষমতাপ্রত্যাশীরা একই রেখায় দাঁড়িয়ে আছে। যে কারণে বস্তির আগুনের আঁচ লাগে না প্রধানমন্ত্রীর গায়ে। আজ তাই মানুষের মত জীবন, নিরাপদ পৃথিবী আর শিশুর মুখের নির্মল হাসির জন্য দরকার মুনাফার শিকলে বাঁধা পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী বিশ্ব ব্যবস্থা উচ্ছেদে বস্তিবাসী, হকার, মুটে-মজুর, শ্রমিক, শ্রমজীবী, কৃষক, ছাত্র, শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী তথা ব্যাপক জনগণকে এক কাতারে দাঁড়িয়ে লড়তে হবে অভিন্ন শত্রুর বিরুদ্ধে।
(সূত্র: সাপ্তাহিক সেবা ॥ ৪০ বর্ষ ॥ সংখ্যা- ০৫ ॥ রবিবার ॥ ২৮ অগ্রহায়ণ ১৪২৭ ॥ ১৩ ডিসেম্বর ২০২০)

One thought on “যে আগুনের আঁচ লাগে না কর্ণধারদের গায়ে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *