উপ-সম্পাদকীয়

শিক্ষার্থীদের সাথে শিক্ষকদের সম্পর্ক উন্নয়ন জরুরি!

একজন শিক্ষককে জোরপূর্বক পদত্যাগে বাধ্য করানো, হেনস্থা করা কিংবা আরও যেসব বাড়াবাড়ি সেসবে অন্য সবার চেয়ে আমার হৃদয়ে রক্তক্ষরণ বেশি হয়। যেহেতু আমিও শিক্ষক পরিবারের একজন সদস্য সেহেতু বাংলাদেশের যেকোন প্রান্তের, যে কোন স্তরের একজন শিক্ষকের অপমানে আমার অপমান নয়- এমন দাবি করার নৈতিক ভিত্তি নাই। শিক্ষার্থীরা শিক্ষকদের যেভাবে পদত্যাগে বাধ্য করেছে তা আপত্তিকর। শিক্ষকদরকে বিদায় জানানোর পদ্ধতি ভিন্নভাবেও হতে পারতো। শিক্ষকের এই অপমানে শিক্ষাগুরুর মর্যাদা বিষয়ক অনুভূতি ও চেতনা জাগ্রত হওয়াই স্বাভাবিক।

শিক্ষকদের বেতন সংক্রান্ত দাবিতে নিক্ষিপ্ত পানি কামানের আঘাতে আমরা নিশ্চুপ ছিলাম। পেনশন বিষয়ক জটিলতায় রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ যখন বলেছে ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত হোক তারপর দাবি শুনবো- তখনো আমরা কিছু বলিনি। একজন শিক্ষক অবসরে যাওয়ার পর তাঁর পেনশন তুলতে জীবন ক্ষয়ে যায় অথচ আমাদের সম্মিলিত প্রতিবাদ নাই। পদোন্নতি বঞ্চিত হয়েও, অন্যান্যদের দ্বারা লাঞ্ছিত-অপমানিত হয়েও আমাদের একাত্মতা হয়নি। বরং দলাদলিতে বিভক্ত হয়ে একটি সুবিধাভোগী শিক্ষকদের দল রাজনীতিবিদদের মত দলীয় রাজনীতির ঝান্ডা উড়িয়েছে। প্রকাশ্যে বলেছে, আমার প্রতিষ্ঠান ছাত্রলীগ উৎপাদনের ফ্যাক্টরি!

শিক্ষক হিসেবে শিক্ষার্থীদের দ্বারা লাঞ্ছিত হয়ে খুব সহজে বলে দিতে পারি- ওরা কোনদিন মানুষ হবে না। অথচ শিক্ষক হিসেবে যে মর্যাদায় থাকা উচিত ছিল সে মর্যাদায়, সে আদর্শে এবং নিরপেক্ষতায় আমরা নিজেদের রেখেছিলাম? প্রাইমারী থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত যতজন শিক্ষককে পদত্যাগ করতে জোড়াজুড়ি করা হয়েছে, বাধ্য করা হয়েছে কিংবা তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে তাদের সবার ব্যাপারেই প্রকাশ্য অভিযোগ ও ক্ষোভ দীর্ঘদিনের। শিক্ষক হিসেবে সর্বাগ্রে শিক্ষার্থীদের স্বার্থ সুরক্ষা দেওয়া যে কোন শিক্ষকের দায়িত্ব। তবে শিক্ষক যখন তার আদর্শ শিকেয় তুলে অন্যপক্ষের স্বার্থ চরিতার্থ করার অপচেষ্টা চালায় তখন তাকে সুরক্ষা দেবে এমন সাধ্য কার।

সমগ্র দেশে এই ক’দিনে কতজন শিক্ষককে ফোর্স পদত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে? শতকরা হারে সেটা কত শতাংশ হবে? অথচ এমনও তো দেখেছি, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি যাতে পদত্যাগ না করে তার জন্য শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করছে। এই প্রজন্ম থেকে শিক্ষকের মর্যাদা পেতে হলে শিক্ষককে অবশ্যই নিরপেক্ষ থাকতে হবে। সে যদি কোন পক্ষের দালাল হয়, দণীয়করণ করে দায়িত্ব পেয়ে রাজনৈতিক ক্যাডারের ভূমিকায় শিক্ষার্থীদের সামনে উপনীত হয় তবে সে শিক্ষকের সম্মান রক্ষা করবে- এমন সাধ্য কার?

শিক্ষকদের সাথে যা ঘটেছে তা নিন্দনীয়। আমরা এমন বিশৃঙ্খলা আশা করি না। তবে পরিস্থিতিও তো বুঝতে হবে। যে শিক্ষার্থীদের ক্ষোভের মুখে মহা প্রতাপশালী সরকার উৎখাত হয়ে পালিয়ে গেছে সেই শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে গিয়ে শিক্ষক কেন শয়তানও টিকে থাকতে পারবে না। শিক্ষকদের মধ্যে নিরপেক্ষতা, শিক্ষার্থী বান্ধব মনোভাব এবং সততা থাকলে সে সম্মানিত হবে। অতীতে যে সুনাম কুঁড়িয়েছে, শিক্ষার্থী ও সুশিক্ষার পক্ষে থেকেছে এমন একজন শিক্ষককে পদত্যাগ করতে হয়েছে বা পদত্যাগের দাবি উঠেছে- প্রমাণ দেখান। একজন ভালো শিক্ষককেও বিন্দু পরিমান অপমানিত বা লাঞ্ছিত হতে হয়নি। গণিতের শিক্ষক হয়ে ৫ বছর কোন নেতার আত্মজীবনী ক্লাসে পড়াবেন, পরীক্ষায় সেসব বিষয়ে প্রশ্ন করবেন এবং শিক্ষার্থীরা তা মেনে নেবে- এমন ঠাকুর প্রজন্ম এই দেশের মাটি কখনোই সৃষ্টি করেনি। শিক্ষার্থীদের দমনে কর্তৃত্ববাদের দোসর ছাত্রসংগঠনকে লেলিয়ে দিয়ে তামাশা করবেন আর সাধারণ শিক্ষার্থীরা ভগমান মানবে তা জেন-জি থেকে আশা করলে দিবা স্বপ্ন হবে।

শিক্ষার্থীদের দ্বারা শিক্ষকদের পদত্যাগ, লাঞ্ছনা যতদূর হয়েছে এখানেই থামা উচিত। ভবিষ্যতেও যারা আবার অন্ধভাবে দলকানা হবো তাদের জন্য অনাকাঙ্খিত ঘটনাগুলোতে শিক্ষাগ্রহনের রসদ রেখে গেছে। শিক্ষক যদি বিদুষী না হয়, সত্য প্রকাশে যদি সাহসী না হয় এবং অন্যায়ের প্রতিরোধে যদি বুক পেতে দাঁড়াতে না পারে তবে তার খেসারত গোটা জাতিকে দিতে হবে। শিক্ষকদের মহান আদর্শ থাকুক, শিক্ষার্থীদের মঙ্গল কামনা তাদের ব্রত হোক। কোন শিক্ষার্থীকে বদদোয়া দেওয়া, মানুষ হতে পারবে না বলে তিরস্কার করা- এসব শিক্ষকদের মহানুভবতার সাথে মানানসই নয়। প্রফেসর মানেই প্রফেট- এমন ধ্যান-ধারণা থেকে বের হতে হবে। যে যতটুকু নেমেছে সে ততটুকুন ভিজেছে। সমাজ সংস্কার ও রক্ষায় অন্যান্যদের চেয়ে শিক্ষকদের ভূমিকা অনেক বেশি। কাজেই তাকে বেশি পবিত্র থাকা উচিত।

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের কারনে শিক্ষকদের চেয়ে প্রশাসকগণ এবং পুলিশ কিংবা রাষ্ট্রে অন্যান্য স্টেক হোল্ডারদের অনেকেই ছাত্রদের দাবির বেশি বিরোধিতা করেছে না? অবশ্যই করেছে। তাদের একজনকেও শিক্ষার্থীরা গিয়ে পদত্যাগ করিয়েছে বা করতে চাপ দিয়েছে? শিক্ষকদের কাছ থেকে শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা অনেক বেশি। রাষ্ট্রের আর সব অর্গান বিকল হতে পারে, পচন ধরতে পারে চিন্তাা ও মস্তিষ্কে কিন্তু শিক্ষক যদি ন্যায়কে সঙ্গ না দেয়, সত্যের পক্ষে না বলে তবে সে আঘাত শিক্ষার্থীদেরকে বেশি যন্ত্রণা দেয়। সেটার বহিঃপ্রকাশেই এইসব অনাকাঙ্খিত ঘটনাগুলো ঘটেছে। শিক্ষার্থীদের দাবির সাথে যারা একাত্মতা ঘোষণা করেছিল কিংবা যারা নিরপেক্ষ ভূমিকায় অবলোকন করেছিল সমগ্র ঘটনাকে তাদের কাউকে শিক্ষার্থীরা দুর্ঘটনায় ঠেলে দিয়েছে? দেয়নি। বরং মাথার তাজ করে রেখেছে।শিক্ষকদেরকে চিরকাল ন্যায্য কথা বলতে হবে; চাকুরিতে থেকেও বলতে হবে। নয়তো জাতি মাথা উঁচিয়ে বাঁচার শিক্ষা পাবে না। মেরুদন্ড সোজা করে দাঁড়াতে পারবে না। শিক্ষক তাঁর ভুল পথ ছেড়ে শিক্ষার্থীদের আপন থাকুক- তবেই দেশ এগুবে।

রাজু আহমেদ , কলাম লেখক।
raju69alive@gmail.com