শ্রমিকদের জিম্মি করে পরিবহন সেক্টরে নৈরাজ্যিকতা
তফাজ্জল হোসেন: শফিকুল ইসলাম (ছদ্মনাম) একজন গার্মেন্টস কর্মি। রবিবার থেকে তার কারখানা খোলা। তাই শনিবার সকালে নেত্রকোনা মোহনগঞ্জে তার গ্রামের বাড়ি থেকে রওয়ানা হয়েছেন গাজীপুর বাঘের বাজারে তার কর্মস্থলের উদ্দেশ্যে। ট্রেনে সিট না পেয়ে তিনি ঠিক করলেন বাসে যাবেন। কিন্তু যাত্রীর ভীড়ের চাপে তিনি কোন টিকেট পাচ্ছেন না। তারপরও নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে দ্বিগুন বাসের ভাড়া। ঘন্টা দেড়েক অপেক্ষার পর বাসে উঠতে না পেরে তিনি গেলেন সিএনজি স্ট্যান্ডে। মোহনগঞ্জ থেকে ময়মনসিংহ সাধারণ সময়ে ২২০ টাকা ভাড়া। ঈদ উপলক্ষে কোনভাবেই ৫৫০ টাকার নিচে যাবে না। কোন উপায়ন্তর না পেয়ে এই ভাড়াতেই তিনি সিএনজিতে উঠলেন।
শফিকুল ইসলামের সাথে কথা বলে জানা যায়, ১ বছর হয় নি তার চাকুরির বয়স। তাই কারখানা থেকে উৎসব বোনাসও দিতে চায় নি কারখানা কর্তৃপক্ষ। কারখানায় তার মত আরো কয়েকশো শ্রমিক রয়েছে যাদের চাকুরির বয়স এক বছর হয় নি। আইন অনুযায়ী এরা কেউই বোনাস পাবে না-কর্তৃপক্ষের এরকম সিদ্ধান্ত জানতে পেরে শ্রমিকরা আন্দোলন করলো। দুই দিন কাজ বন্ধ রাখলো। অবশেষে যাদের চাকুরির বয়স এক বছরের নিচে তাদেরকে মালিক ১ হাজার টাকা করে বোনাস দিতে রাজি হয়। শফিকুল ইসলামও এক হাজার টাকা বোনাস পান। কিন্তু ঈদে বাড়ি আসা এবং যাওয়া বাবদ অতিরিক্ত ভাড়া হিসেবে এক হাজার টাকার বেশি লেগেছে বলে জানান শফিকুল ইসলাম। খুব আক্ষেপ করে তিনি বলেন, খুব রিস্ক নিয়ে আন্দোলন করে এক হাজার টাকা বোনাস আদায় করেছিলাম। অথচ বাড়িতে আসা-যাওয়ার সময় ৫ টাকার অটো ভাড়া দিতেও ১০ টাকা বাড়তি ভাড়া দিতে হয়। তিনি অটোচালক বা রিকশা চালকদের প্রতি সহমর্মিতা জানিয়েও বলেন- “এটা বুঝি তারাও আমাদের মত গরিব মানুষ। যাদের টাকা পয়সা আছে তারা এমনিতেই কিছু বাড়তি ভাড়া দিতে পারে। কিন্তু আমরা তো শ্রমিক। আমাদের জন্য খুব কষ্ট হয়ে যায়। ”
ঈদে আসা-যাওয়ার ক্ষেত্রে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ে কষ্ট পায় শুধু গার্মেন্টস কর্মি শফিকুল ইসলামই নয়। গার্মেন্টস কর্মি ছাড়াও সীমিত আয়ের মানুষদের জন্যও এটা অনেক বড় ভোগান্তি। গ্রামের রিকশা বা অটোচালকরা হয়ত ৫ টাকা ১০ টাকা বাড়তি নেয়, কিন্তু বাসের মালিকরা ঈদ উপলক্ষে একেকজন যাত্রীর কাছ থেকে শত শত টাকা অতিরিক্ত আদায় করে। এক্ষেত্রে আক্ষরিক অর্থে কোন নজরদারি নেই। পরিবহন মালিকরা যাত্রীদেরকে দিনে দুপুরে জিম্মি করলেও প্রশাসন এসব মালিকদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নিচ্ছে না। টিভি বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রদর্শনীস্বরুপ বিভিন্ন বাসস্ট্যান্ডে ভ্রাম্যমাণ আদালতকে দেখা যায়। কিন্তু একদিক দিয়ে ভ্রাম্যমাণ টিম চলে যায়, অন্য দিক দিয়ে আগের মতই নৈরাজ্যিকতা চালায় পরিবহন মালিকরা। তাছাড়া ভ্রাম্যমাণ টিমের কাজ শুধু কয়েকটি বাসস্ট্যান্ড বা সিএনজি স্ট্যান্ডেই সীমাবদ্ধ। অথচ স্ট্যান্ডের বাইরে যাত্রী উঠানামাসহ পুরো রাস্তাতেই এই নৈরাজ্যিকতা চালাচ্ছে পরিবহন মালিকরা।
পরিবহন মালিকরা যাত্রীদের উপর হয়রানির ক্ষেত্রে কাজে লাগায় পরিবহন শ্রমিকদের। এ সেক্টরের শ্রমিকদেরও মালিকরা এমনভাবে জিম্মি করে রেখেছে, যে কারণে শ্রমিকরা মালিকদের যেকোন অন্যায় আবদার রাখতে বাধ্য হয়। সড়ক পরিবহন শ্রমিকদের কোন নিয়োগপত্র বা পরিচয় পত্র মালিকরা দেয় না। ফলে যখন তখন কাজ বন্ধ করে দেয় মালিকরা। দেশের নামীদামী পরিবহন কোম্পানির গাড়ি চালকরাও অনিশ্চয়তায় থাকে ট্রিপ নিয়ে যাওয়ার পর পরের দিন সে ট্রিপ পাবে কি’না? ৬০ লক্ষ শ্রমিক সড়ক পরিবহন সেক্টরে। এই শ্রমিকদের মালিকরা জিম্মি করে রাখলেও এ সেক্টরে বিদ্যমান শ্রমিক ইউনিয়ন বা ফেডারেশন এসব শ্রমিকদের অধিকারের ক্ষেত্রে নিরব। এ সেক্টরের শ্রমিক সংগঠনগুলো শ্রমিকদের নিয়োগপত্র, পরিচয়পত্র বা মজুরি নিয়ে কোন দাবি দাওয়া কখনো করে না। শ্রমিক সংগঠনগুলোও মালিকদের স্বার্থেই ভূমিকা নেয়। কোন রুটে কোন গাড়ি চলবে, কোন রুটে কত ভাড়া হবে- এসব কাজে শ্রমিকদের ভাড়াটে মাস্তান হিসেবে মালিকরা শ্রমিক সংগঠনগুলোকে দিয়ে ব্যবহার করে। সড়ক খাতের শ্রমিক সংগঠনগুলোতেও যারা নেতৃত্বে আসে তারাও কোন না কোন পরিবহনের মালিক। এসব কারণেই পরিবহন খাতের শ্রমিকরা অনেক বেশি অসহায় এবং মালিকদের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এর ফলে যাত্রী তথা সাধারণ মানুষের সাথে পরিবহন শ্রমিকদের একটা সাংঘর্ষিক অবস্থা সৃষ্টি হয়। প্রায়শই দেখা যায়, কোন কোন জায়গায় শ্রমিকরা সংঘবদ্ধ হয়ে কোন সাধারণ যাত্রীকে মারধোর করছে। আবার কোন কোন জায়গায় সাধারণ যাত্রীরা সংঘবদ্ধ হয়ে পরিবহন শ্রমিকদের মারধোর করছে। এ অবস্থাটি বিদ্যমান থাকলে মালিকদের জন্য সুবিধা, কিন্তু শ্রমিকদের জন্য দিন দিন ক্ষতির পরিমাণ বাড়বে। শ্রমিকদের মিত্র বা কাছের মানুষ হচ্ছে সাধারণ মানুষ। সাধারণ মানুষরাই সর্বহারা হয়ে শ্রমিকে উন্নীত হয়েছে। শ্রমিকরা সংঘবদ্ধ থাকে। এ সংঘবদ্ধ শক্তিই অধিকার আদায়ে সক্ষম। কিন্তু সাধারণ মানুষ অসংগঠিত। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধিসহ প্রতিদিনকার সংকট সমস্যায় সাধারণ মানুষের নাজেহাল অবস্থা। কিন্তু সংগঠিত নয় বলে এসব মানুষেরা প্রতিরোধ গড়তে পারে না। অথচ সংঘবদ্ধ শক্তি হিসেবে শ্রমিকরা জনগণের অগ্রভাগে দাঁড়ালে জনগণ নেতৃত্ব সংকট থেকে মুক্তি পায়। অথচ সেই জনগণ এবং শ্রমিকদের মধ্যেই সংঘাত সৃষ্টি করে চতুর মালিকরা শ্রমিক এবং জনগণ উভয়কেই দূর্বল করে রাখে।
এ অবস্থা থেকে বের হওয়ার জন্য সড়ক পরিবহন শ্রমিকদের নিজেদেরই চেষ্টা করতে হবে। তাদের অধিকারের কথা বলে এমন সংগঠন বা ট্রেড ইউনিয়নে শ্রমিকদের সংগঠিত হতে হবে। নিজেদের শ্রেণি সচেতন এবং রাজনৈতিক সচেতন হওয়ার বিকল্প নেই। শ্রমিকদের রাজনৈতিক অসচেতনতার সুযোগ নিয়ে শ্রমিকদের প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক শক্তি শ্রমিকদেরকে তাদের কায়েমি স্বার্থে ব্যবহার করছে। বিগত আওয়ামিলীগ সরকারের সময় শাহজাহান খান পরিবহন সেক্টরে পরিবহন শ্রমিকদের তার ইচ্ছামতো ব্যবহার করেছে। বর্তমানে শাহজাহান খান না থাকলেও পরিবহন সেক্টরের সংগঠনগুলোতে শ্রমিকদের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা হয় নি। মূলত মালিকদের সিন্ডিকেটই এসব শ্রমিক সংগঠনগুলোতে নেতৃত্বের জায়গা দখল করে বসে আছে। এ কারণেই পরিবহন সেক্টরে নৈরাজ্যিকতা অব্যাহত রয়েছে। পরিবহন শ্রমিকদেরকেই এই নৈরাজ্যিকতা ভেঙ্গে জনগণের নেতা এবং শক্তি হিসেবে সামনে আসতে হবে। মনে রাখতে হবে সরকার কখনো এই নৈরাজ্যিকতা বন্ধ করবে না। কারণে সরকার এবং মালিক পরস্পর মাসতুতো ভাই।
ট্রেড ইউনিয়নকর্মী