সশস্ত্র লকডাউন, নিরস্ত্র মানুষের পেটের দায় কার?
সুদীপ্ত শাহিন: ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টের উচ্চ সংক্রমণ বৃদ্ধিতে সরকার কঠোর লকডাউন চলমান রেখেছে। লকডাউনের কঠোরতা কার্যকর রাখতে র্যাব, পুলিশ, বিজিবি’র সাথে সরকার সেনাবাহিনীকেও মাঠে নামিয়েছে। রাস্তায় রাস্তায় দেখা যাচ্ছে সেনাবাহিনীর লোকজন অস্ত্র তাক করে দাঁড়িয়ে আছে। সেনাটহল পরিদর্শন করতে সেনাবাহিনীর প্রধানও ইতিমধ্যে বিভিন্ন টহল পরিদর্শন করেছেন। রাস্তায় বের হলেই দেখা যায়, র্যাবের সৈনিকদের মটরসাইকেলের বহর হুঁইশেল বাজাতে বাজাতে এক অঞ্চল থেকে আরেক অঞ্চলে সশ্রস্ত্র পাহারা দিচ্ছে। সাথে ম্যাজিস্ট্রেটগণকে দেখা যাচ্ছে, পথচারী বা কোন শ্রমজীবি মানুষকেই রাস্তায় পেলে আটকিয়ে ভ্রাম্যমান কোর্টের মাধ্যমে তাদের কাছ থেকে জরিমানা আদায় করছে। দেখা যায়, ম্যাজিস্ট্রেটগণ অর্থ-খাদ্য সহায়তা পৌছে দেবার বদলে বরং লকডাউন না মানায় মামলা ঠুকতেই বেশি উৎসাহী। লকডাউনের ২য় দিনে শুধু ময়মনসিংহের জেলা প্রশাসন , উপজেলা প্রশাসন ও সিটি কর্পোরেশন মোট ৫৭০ টি মামলা দায়ের করে ৪,০৬,৬৯৫ টাকা অর্থদন্ড প্রদান করেছে। জেলা প্রশাসক বা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাগণের ফেসবুক পেজে এইসব মামলা তৎপরতার দৃশ্যই এখন চোখে পড়ছে।
প্রশ্ন হলো প্রশাসনের এই সাজ সাজ রব এবং আতংক ছড়ানো কার জন্য? করোনা একটি ভাইরাসের নাম, খালি চোখে এটিকে দেখাও যায় না। এই অণুজীবটিকে ভয় পাওয়ানোর জন্যই কি এত কিছু ? এত মামলা, এত কামান দাগা? কিন্তু অণুজীবটি কি এসব কান্ড দেখে ভয় পাচ্ছে, নাকি আরো মজা নিচ্ছে? কারণ ভয় এবং জরিমানা হচ্ছে তো জনগণের উপর । তাতে অণুজীবের কি? অণুজীবের অপরাধ সে মানুষকে সংক্রমিত করছে এবং মানুষকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এই অপরাধে প্রচলিত আইনে তারও মৃত্যুদন্ড আইনসম্মত। কিন্তু বাস্তবিকে মৃত্যুদন্ডগুলি কাকে দেয়া হচ্ছে ? চলমান লকডাউনে কাজ হারিয়ে সন্তানদের মুখে খাবার দিতে না পারার কষ্ট নিয়ে আত্মহত্যা করেছে মুন্সিগঞ্জের দিনমজুর দ্বীন ইসলাম। করোনা ভাইরাসের শক্তি দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে আর সরকার প্রশাসনের মৃত্যুদন্ডগুলো দিন দিন কার্যকর হচ্ছে দ্বীন ইসলামদের বিরুদ্ধে ।
দেশে মোট জনগোষ্ঠীর কয়েক লাখ লোক ব্যতীত বাকি সবাই ব্যক্তিগত প্রচেষ্টা ও বেসরকারী ব্যবস্থাপনায় জীবন নির্বাহ করে। তাদের সংসার চালানোর খরচ সরকার দেয় না, কিন্তু সরকার তাদের কাছ থেকে নিয়েই প্রতিবছর বিরাট বিরাট আকারের বাজেট বানাচ্ছে। মেগা প্রকল্প চালু করছে, সরকারী কর্মকর্তাদের সুযোগ-সুবিধা যেনোতেনোভাবে বাড়াচ্ছে। সে সবে জনগণের আপত্তি থাকলেও এইসব অব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে জনগণের তেমন প্রতিরোধ ছিল না। কারণ শ্রমজীবি মানুষদের গতর খাটানোর সুযোগ থাকলে আর কিছু নিয়ে ভাবে না । তাদের একমাত্র সম্বল গতরটা খাটাতে পারলে যারা তাদের খাটায় তারা তাদের কত পাই দিয়ে ওরা কত ক্রোড় পেলো তা নিয়ে ভাবে না শ্রমজীবি মানুষগণ । তাদের কিছু ‘পাই’ দিয়ে কোনরকমে কিছু একটা খেয়ে পড়ে সংসার চললেই হয়! এখন সেই কোনোরকমের সংসারটাও চলছে না। তাই দিশেহারা হয়ে দ্বীন ইসলামের মত পরপারের পথই তাদের সামনে ভেসে উঠছে।
একটি দৈনিক পত্রিকার রিপোর্টে দেখা যায়, চলমান লকডাউনে ত্রাণ সহায়তার জন্য ১৮ লাখ সাত হাজার ৩০১টি ফোন আসে ৩৩৩ নম্বরে। এর বিপরীতে নামকাওয়াস্তে সহায়তা দেওয়া হয়েছে মাত্র ৫৯ হাজার ১৬০ পরিবারকে। একদিনে সহায়তা চেয়ে ফোন দিয়েছিলেন ১৪ হাজার ৫০ জন, কিন্তু তার বিপরীতে এক ব্যক্তিকেও ত্রাণ সহায়তা দেওয়া হয়নি। চলমান লকডাউন ঘিরে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় ২৭ জুন ৬৪ জেলায় ২৩ কোটি ৬০ লাখ ৭৫ হাজার টাকা বরাদ্দ দিয়েছে এবং পরে আরো পৌনে আট কোটি টাকা ও ২৩ হাজার টন চাল বরাদ্দ দেওয়া কথা বলেছে। কিন্তু শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অধীনে গঠিত ময়মনসিংহ অঞ্চলের ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট কমিটির মাধ্যমে এখনো ময়মনসিংহ বিভাগের কোন শ্রমিক বা শ্রমজীবি মানুষকে এক টাকাও সহযোগিতা করা হয় নি। তবে ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট কমিটির এক কেন্দ্রীয় সভায় শ্রম সচিব অবগত করেন যে, করোনা প্রভাবের শুরু থেকে এ পর্যন্ত তাদের মাধ্যমে মোট এক লাখ শ্রমিককে ত্রাণ সহযোগিতা করা হয়েছে! তাতে ত্রাণের পরিমাণ কি ছিলো বা একজন শ্রমিক কয়বার কতটুকু সহযোগিতা পেয়েছে তা উল্লেখ না করলেও দেশে মোট ৬ কোটি ৮২ লক্ষ শ্রমিকের মাঝে গত দেড় বছরে শ্রমিকদেরকে এ সহযোগিতা নিশ্চয়ই ইতিহাসে মাইলফলক হয়ে থাকবে!
সশস্ত্র মানুষ দেখে নিরস্ত্র মানুষেরা ভয় পায়! তাই সরকার কিছু সশস্ত্র মানুষকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে নিরস্ত্র মানুষদের ভয় দেখিয়ে, জুলুম করে ঘরে বন্দি রাখতে। ফলে নিরস্ত্র মানুষেরা ঘরবন্দি রয়েছে ঠিক- এই সফলতায় সরকার হয়তো আত্মতৃপ্তিতে ভুগতে পারে ! বিশ্বের দরবারে হয়তো আরেকটি পুরস্কারও পেয়ে যেতে পারে একটি কঠোর লকডাউন সফল করার জন্য! কিন্তু বিশ্ব জুড়েই সাধারণ মানুষের আজ ক্ষোভ বিরাজমান। মানুষ স্বাস্থ্যবিধি মানতে চায়, সেটা যদি তার পেটের নিশ্চয়তা বিধান করে হয়। কারণ পেট মানুষের শরীরের এমন একটি অন্ত্র, সেটিকে শান্ত না করলে শরীরের অন্যান্য সকল অরগ্যান অশান্ত হয়ে যায়। তখন ইস্ট নিস্ট কোন কিছুই আর মানুষ মানতে চায় না। ক্ষুধার তীব্রতা কি ক্ষিপ্ততা তৈরি তার চমৎকার বর্ণনা দিয়েছেন কবি রফিক আজাদ। “আমার ক্ষুধার কাছে কিছুই ফেলনা নয় আজ ভাত দে হারামজাদা, তা না হলে মানচিত্র খাবো।”- ক্ষুধার্ত মানুষের জন্য এটি এক অমোঘ বাণী।