১৯৭১ সালে বাংলাদেশ যুদ্ধে ভারতীয় বাহিনীর সাফল্যের কৃতিত্ব কার – জেনারেল অরোরা নাকি জেনারেল জেকবের?
বিবিসি প্রতিবেদন:
দিল্লির ব্যস্ত রাস্তায় এক বৃদ্ধ দম্পতির গাড়ির সঙ্গে ধাক্কা লেগেছিল একটা মোটর সাইকেলের। মুহুর্তের মধ্যে লোক জড়ো হয়ে গিয়েছিল চারদিকে।
বেশ সুন্দর স্যুট পড়া এক শিখ ভদ্রলোক নেমে এলেন।
মোটর সাইকেল আরোহীকে তিনি বললেন, “আমার গাড়ির সঙ্গে ধাক্কা লাগায় আপনার যা ক্ষতি হয়েছে, দয়া করে আমার বাড়িতে এসে খরচটা নিয়ে যাবেন। আমার নাম জগজিৎ সিং অরোরা।”
হঠাৎই ভিড়ের মধ্যে থেকে কেউ একজন প্রশ্ন করলেন, “বাংলাদেশের সেই জগজিৎ সিং অরোরা নাকি?”
মাথা নুইয়ে সায় দিলেন ওই শিখ ভদ্রলোক।
মুহুর্তের মধ্যে পরিবেশটা বদলে গেল। সকলেই লজ্জিত হলেন। উল্টো ওই মোটর সাইকেল আরোহীকে ধমক দিতে শুরু করলেন কেউ কেউ। তিনিও মি. অরোরার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিলেন।
অনেক দিন পরে জগজিৎ সিং অরোরার ওই ঘটনাটার কথা মনে পড়েছিল। চোখের কোনটা একটু চিকচিক করে উঠেছিল। বলেছিলেন, “সরকার তার কর্তব্য ভুলে গিয়ে থাকতে পারে, কিন্তু মানুষ এখনও মনে রেখেছে।”
৭১-এর জয়ের দাবীদার কে?
উনিশ’শ একাত্তর সালে বাংলাদেশ যুদ্ধে জয়ের কৃতিত্বের বেশ কয়েকজন দাবীদার রয়েছেন। রাজনৈতিক নেতৃত্বের ভূমিকা তো ছিলই, কিন্তু সেনাবাহিনীর মধ্যেও কয়েকজনের ভূমিকা বেশ বাড়িয়ে দেখানো হত। উল্টোদিকে ফিল্ড কমান্ডারদের কৃতিত্বকে কিছুটা ছোট করে দেখানোর একটা চেষ্টা শুরু হয়েছিল।
জেনারেল অরোরার চিফ অব স্টাফ জেনারেল জেএফআর জেকবের লেখা বই ‘সারেন্ডার অ্যাট ঢাকা’ প্রকাশ পায় ১৯৯৭ সালে।
ওই বইতে জেনারেল জেকব দেখানোর চেষ্টা করেছিলেন যে ১৯৭১-এর যুদ্ধ জয়ের ক্ষেত্রে জেনারেল অরোরার থেকেও তাঁর নিজের ভূমিকা বড় ছিল।
অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল অশোক মেহতার কথায়, “আমি যখন ওঁর বাড়িতে গিয়েছিলাম দেখা করতে, তখন এই প্রসঙ্গটাই তুলেছিলাম কথায় কথায়। জিজ্ঞেস করেছিলাম, আপনার যে সম্মান পাওয়া উচিত, সেটা কি পেয়েছেন?”
“চোখের পলক পড়ার আগেই জেনারেল অরোরা জবাব দিয়েছিলেন, ‘আমি তো অনেক বেশী সম্মান পেয়ে গেছি। বাংলাদেশ সরকার আমাকে সম্মান দিয়েছে, ভারত সরকার পদ্মভূষণ দিয়েছে। আকালী দল আমাকে তাদের প্রতিনিধি করে রাজ্যসভায় পাঠিয়েছে।'”
অশোক মেহতা বলছিলেন, “এটা তাঁর শিষ্টতা যে একবারের জন্যও স্যাম মানেকশ’ আর জেনারেল জেকবের সম্বন্ধে একটা শব্দও উচ্চারণ করলেন না। উল্টোদিকে জেনারেল জেকব তো চারদিকে বলে বেড়াতেন যে আমার যা প্রাপ্য সম্মান, তা পাইনি।”
“আমার তো মনে হয় জেনারেল জেকব অনেক কিছুই পেয়েছেন। এটা জানার চেষ্টা করেছিলাম জেনারেল অরোরার কাছ থেকে যে সরকার কেন তাঁকে প্রাপ্য সম্মান থেকে বঞ্চিত করল। জবাবে তিনি বলেছিলেন আপনার হুইস্কি শেষ হয়েছে, আরেক পেগ বানিয়ে নিন। এটাই জেনারেল অরোরা,” বলছিলেন অশোক মেহতা।
‘আসল কাজটা তো করেছে জগ্গি’
স্যাম মানেকশ’ও একটা সাক্ষাতকারে বলেছিলেন যে ৭১-এর যুদ্ধে বাহবা কুড়িয়েছেন তিনি, তবে আসল কাজটা তো করেছে ‘জগ্গি’।
জেনারেল অরোরাকে সেনাবাহিনীর সিনিয়র অফিসাররা ‘জগ্গি’ নামেই ডাকতেন।
প্রাক্তন নির্বাচন কমিশনার মনোহর সিং গিল বলছিলেন, “আজকাল তো দেখি অনেক জেনারেল রাজ্যপাল হয়ে যাচ্ছেন বা উঁচু সরকারী পদে বসছেন। কিন্তু দু:খের বিষয় এটাই যে সরকারের কাছ থেকে জেনারেল অরোরার অনেক কিছু পাওয়ার ছিল। কোনও উঁচু পদে তাঁকে রাখা হয়নি, শুধুমাত্র পদ্মভূষণ নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে তাঁকে।”
“সেনানায়কদের তো এই জন্য সম্মান দেখানো হয় যাতে যুব সমাজের কাছে তাঁদের রোল মডেল হিসাবে তুলে ধরা যায়। এজন্য ইংল্যান্ডের নানা জায়গায় সেনাপতিদের ভাস্কর্য রাখা থাকে। বার্মা যুদ্ধের সেনাপতি জেনারেল স্লিমকে লর্ড স্লিম এজন্যই করা হয়েছিল। মন্টগোমারিও একইভাবে লর্ড মন্টগোমারি হয়েছিলেন। জগজিৎ সিং যদি আজ ব্রিটেনে থাকতেন তাহলে নি:সন্দেহে লর্ড অরোরা হয়ে যেতেন,” বলছিলেন মি. গিল।
জেনারেল অরোরার ভাতিজা গুরপ্রীত সিং বিন্দ্রা ৭১-এর যুদ্ধের সময়ে তাঁর সঙ্গেই থাকতেন। তিনি বলছিলেন, “জেনারেল অরোরা তো কমান্ডার ছিলেন আর জেনারেল জেকব তাঁর চিফ অব স্টাফ। আদেশ তো কমান্ডারই দেন। চিফ অব স্টাফ সেই আদেশ পালন করেন মাত্র। এই প্রথমবার শুনতে পেলাম স্টাফ অফিসার নিজেই নাকি সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন।
“আমার সামনে তো এমন অনেক ঘটনা দেখেছি, যখন জেনারেল অরোরা যুদ্ধের খুঁটিনাটি নিয়ে নির্দিষ্ট নির্দেশ দিচ্ছেন। আমি জেনারেল জেকবের প্রতি সম্পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখেই বলছি ‘৭১-এর যুদ্ধে তিনি নিশ্চয়ই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন, কিন্তু সমস্ত সিদ্ধান্ত তাঁর নিজের, এটা তো অসত্য।”
জেনারেল অরোরার হেলিকপ্টারে হামলা
উনিশ’শ একাত্তর-এর যুদ্ধ আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হওয়ার আগে ২৩শে নভেম্বর ভারতীয় সেনাবাহিনী তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে একটা অপারেশন চালিয়েছিল।
‘জগ্গি’ অরোরার অভ্যাসই ছিল যুদ্ধক্ষেত্রের পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে তিনি নিজে যেতেন সেখানে। সেই সময়েই জেনারেল অরোর হেলিকপ্টারে হামলা চালিয়েছিল পাকিস্তান।
জেনারেল অরোর এডিসি, যিনি পরে লেফটেন্যান্ট কর্ণেল হিসাবে অবসর নিয়েছিলেন, সেই মহিন্দর সিং একটা কাহিনী শুনিয়েছিলেন।
“আমাদের হেলিকপ্টারের ওপরে পাকিস্তানি স্যাবর জেটগুলোর হামলা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। আমরা বাঙ্কারে ঢুকে গিয়েছিলাম। ওখান থেকে ফিরেই জেনারেল অরোরা সেনাপ্রধান জেনারেল মানেকশ’-কে ফোন করে বলেন যে পূর্ব পাকিস্তানের অপারেশনে বিমানবাহিনী লাগবেই। সেই অনুমতি চান তিনি।”
‘বিমানবাহিনী না পেলে আমার বাহিনীকে ফিরিয়ে নেব’
জেনারেল মহিন্দর সিং বলছিলেন, “মানেকশ’ জেনারেল অরোরাকে বোঝানোর চেষ্টা করেন যে ‘জগ্গি, আমরা পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ করছি না’। ‘জগ্গি’ জবাব দেন, এইসব কথা আপনি দিল্লিতে রাজনীতিবিদদের কাছ থেকে শুনেছেন সম্ভবত। কিন্তু এটা আমার সৈন্যদের বোঝাতে পারব না আমি। যদি বিমানবাহিনী ব্যবহারের অনুমতি না দেন, তাহলে আমি পূর্ব পাকিস্তান থেকে বাহিনী ফিরিয়ে আনব।”
“এক ঘন্টার মধ্যেই অনুমতি চলে এসেছিল দিল্লি থেকে। কলাইকুন্ডা বিমানঘাঁটি থেকে ভারত যুদ্ধবিমান পাঠিয়ে পাকিস্তানের তিনটে স্যাবর জেট বিমান ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছিল সেদিন।”
তেসরা ডিসেম্বর, ১৯৭১ – যেদিন পাকিস্তান ভারতের ওপরে প্রথম বিমান হামলা চালালো, সেদিন ইন্দিরা গান্ধী কলকাতা ময়দানে একটা জনসভায় ভাষণ দিচ্ছিলেন।
জেনারেল অরোরার ভাতিজা গুরপ্রীত সিং বিন্দ্রা বলছিলেন, “যখনই খবর এলো যে পাকিস্তান হামলা চালিয়েছে, জেনারেল অরোরা ময়দানে চলে গিয়েছিলেন। একটা ছবি রয়েছে সেই সময়ের। জেনারেল অরোরাকে তখন বেশ গম্ভীর লাগছিল। ইন্দিরা গান্ধী ভাষণ শেষ করে নীচে নামতেই জেনারেলকে জিজ্ঞাসা করেন, কী ব্যাপার? কী হয়েছে?”
“সব ঘটনা পরিষ্কার করে প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়েছিলেন জেনারেল অরোরা। মিসেস গান্ধী পাল্টা প্রশ্ন করেন, জেনারেল আপনি নিশ্চয়ই সব সামলাতে পারবেন! জবাবে জেনারেল বলেন, ‘নিশ্চিন্ত থাকুন, আমি সামলে নেব। আপনাকে এসকর্ট করে নিয়ে যাওয়ার জন্য একটা ফাইটার বিমানের ব্যবস্থা করেছি।”
“প্রধানমন্ত্রীকে দিল্লি রওনা করে দিয়েই জেনারেল অরোরা নিজের দপ্তরে চলে গেলেন। এডিসি মহিন্দর সিংকে ডেকে বললেন সেনা ক্যান্টিন থেকে সবচেয়ে ভাল হুইস্কির বোতল নিয়ে আসতে। নিজের দপ্তরের সেনা অফিসারদের সঙ্গে নিয়ে সেটি শেষ করলেন। ‘নাউ জেন্টলমেন, দেয়ার ইজ আ ওয়ার টু বি ফট। লেটস্ গেট ডাউন টু বিজনেস,’ হুইস্কিটা শেষ হওয়ার পরে অফিসারদের বলেছিলেন জেনারেল অরোরা,” এভাবেই স্মরণ করছিলেন গুরপ্রীত সিং বিন্দ্রা।
‘১৬ই ডিসেম্বর ১৯৭১, ব্রেকফাস্ট টেবিলে’
পুরো যুদ্ধচলাকালীন জেনারেল অরোরা ১৮ থেকে ২০ ঘন্টা কাজ করতেন। প্রতিদিন কোনও না কোনও অ্যাডভান্সড পজিশনে নিজে যেতেন তিনি।
মিঃ বিন্দ্রার কথায়, “প্রতিদিন সকাল ৮টার সময়ে মিটিং করতেন। সেজন্য আমরা ব্রেকফাস্ট করে নিতাম সকাল ৭টা সোয়া ৭টার মধ্যে। ১৬ই ডিসেম্বর যখন তিনি টেবিলে এলেন, তখন শুধু এটুকুই বলেছিলেন যে ভোর সাড়ে ৫টায় জেনারেল নিয়াজির একটা ওয়্যারলেস মেসেজ এসেছে। তিনি যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব পাঠিয়েছেন।”
“এটুকু জানিয়েই জেনারেল অরোরা বলেন ‘আমার ব্রেকফাস্টটা পড়ার ঘরে পাঠিয়ে দাও’। সকাল ৮টার সময়ে ফের জানালেন যে জেনারেল নিয়াজিকে মেসেজ পাঠিয়ে দিয়েছেন – তিনি যদি সারেন্ডার করতে তৈরী থাকেন, তাহলে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব মেনে নিতে পারি,” ১৬ই ডিসেম্বর সকালের ঘটনা জানাতে গিয়ে বলছিলেন মি. গুরপ্রীত সিং বিন্দ্রা।
“সকাল ৯টায় জেনারেল নিয়াজির উত্তর চলে এলো। অতি দ্রুত যুদ্ধবিরতি চেয়েছিলেন তিনি। এদিক থেকে জবাব গেলো আমরা আপনাদের সারেন্ডারের প্রস্তাব মেনে নিচ্ছি। আমার দু’জন স্টাফ অফিসার – জেনারেল জেকব আর কর্নেল এম এস খারাকে আপনার কাছে পাঠাচ্ছি সব ব্যবস্থা সম্পূর্ণ করার জন্য। ততক্ষণে দিল্লি থেকে আত্মসমর্পণের দলিল চলে এসেছে।”
‘বাংলাদেশের মানুষের সামনেই হবে আত্মসমর্পন’
মি. বিন্দ্রা আরও জানাচ্ছিলেন, “জেনারেল অরোরা আত্মসমর্পনের দলিলটা ভাল করে পড়ে নিয়ে বললেন যদি আমার সামনে কোনও পাকিস্তানি অফিসার বা সৈনিক আত্মসমর্পন করেন, তাহলে আমি যে তাদের জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী সুরক্ষার গ্যারান্টি দেব – এই কথাটাও আত্মসমর্পণের দলিলে লেখা উচিত।”
মি. বিন্দ্রার কথায়, “ওই আত্মসমর্পণের দলিলটা যদি ভাল করে পড়েন, তাহলে দেখবেন তৃতীয় অনুচ্ছেদে এই বিষয়টার উল্লেখ রয়েছে।”
তিনি বলছেন, এরপরে দুপুর ১টা নাগাদ ফোর্ট উইলিয়াম থেকে হেলিকপ্টারে করে তিনি পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পনের জন্য রওনা হয়েছিলেন। তিনি রওনা হওয়ার আগে এটাও নিশ্চিত করেছিলেন যে ঢাকা রেককোর্স ময়দানের নিরাপত্তার দায়িত্ব নেবে ভারতীয় বাহিনী। সেখানেই আত্মসমর্পনের আনুষ্ঠানিকতা হওয়ার কথা হয়েছিল যাতে বাংলাদেশের মানুষ চোখের সামনে দেখতে পারেন যে তারা স্বাধীন হয়ে গেলেন।
“‘আমি কোনও ঘরের মধ্যে আত্মসমর্পন করাতে চাইনা পাকিস্তানি বাহিনীর। বাংলাদেশের মানুষ গোটা প্রক্রিয়াটা দেখুন – এটাই চাই,’ বলেছিলেন জেনারেল অরোরা।”
জেনারেল নিয়াজিকে আত্মসমর্পন করানোর জন্য ঢাকা রওনা হওয়ার সময়ে স্ত্রী ভগওয়ন্ত কৌরকেও সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন জেনারেল অরোরা।
তবে এই সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেছিলেন জেনারেল অরোরা কয়েকজন সঙ্গী অফিসার।
জেনারেল জেকব তাঁর বই ‘সারেন্ডার অ্যাট ঢাকা’-তে লিখেছেন, “আমি যখন নিজের হেলিকপ্টারে উঠছিলাম, হঠাৎই খেয়াল করি যে মিসেস অরোরাও আরেকটা হেলিকপ্টারে উঠছেন। তিনি আমাকে বলেন ঢাকায় দেখা হবে। আমি তো চমকে উঠেছিলাম। আমার মনের ভাব বুঝতে পেরে মিসেস অরোরা বলেছিলেন, ‘আমি আমার স্বামীর হেলিকপ্টারে যাচ্ছি’।”
“আমি দৌড়ে জেনারেল অরোরার কাছে ফিরে গিয়ে জানতে চাই, ‘সত্যিই কি স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছেন আপনি?’ তিনি জবাব দিয়েছিলেন, ‘এর জন্য স্যাম মানেকশ’র কাছ থেকে অনুমতি নিয়েছি। ‘আমি বলেছিলাম ঢাকা থেকে এখনও তো লড়াইয়ের খবর আসছে। একজন নারীকে সেখানে নিয়ে যাওয়া যথেষ্ট ঝুঁকির ব্যাপার হবে। জবাবে তিনি বলেন ‘ওঁর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব আমার” -নিজের বইতে লিখেছেন জেনারেল জেকব।
জেনারেল অরোরার ঘনিষ্ঠ অফিসার পুষ্পিন্দর সিং জানাচ্ছিলেন, “স্ত্রীকে ঢাকায় আত্মসমর্পনের অনুষ্ঠানে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তের ফলে বেশ কিছু অফিসার অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন। তবে জেনারেল অরোরার মনোভাবটা ছিল যে ওই যুদ্ধটা তো ভয়াবহ ছিল, অনেক নারীর ওপরে অত্যাচার হয়েছিল। তারই বিপরীতে একটা প্রতীক হিসাবে নিজের স্ত্রীকে নিয়ে যাচ্ছিলেন সবাইকে এটা দেখাতে যে আমরা নারীদের কতটা সম্মান করি।”
‘নিয়াজি পুরো নাম সই করার মুহুর্তেই স্বাধীন হয়ে গেল বাংলাদেশ’
জেনারেল নিয়াজিকে ১৬ই ডিসেম্বর সারেন্ডার করানোর জন্য হেলিকপ্টার কলকাতা থেকে প্রথমে আগরতলা, তারপরে সেখান থেকে ঢাকায় পৌঁছেছিল।
জেনারেল অরোরার সঙ্গে সেদিন গিয়েছিলেন বিমানবাহিনীর পূর্ব কমান্ডের প্রধান এয়ার মার্শাল দেওয়ান আর নৌবাহিনীর পূর্ব কমান্ডের প্রধান অ্যাডমিরাল এন কৃষ্ণান।
অ্যাডমিরাল কৃষ্ণান তাঁর আত্মজীবনী ‘আ সেইলার্স স্টোরি’তে লিখেছেন, “ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে একটা ছোট টেবিল আর দুটো চেয়ার রাখা ছিল। ওই দুটোতে জেনারেল অরোরা আর জেনারেল নিয়াজি বসেছিলেন। আমি, এয়ার মার্শাল দেওয়ান, জেনারেল সগত সিং, জেনারেল জেকব – সবাই তাদের পিছনে দাঁড়িয়েছিলাম। আত্মসমর্পনের দলিলের ৬টা প্রতিলিপি বানানো হয়েছিল। সেগুলো বেশ মোটা কাগজে টাইপ করা ছিল।”
“প্রথমে জেনারেল নিয়াজি দলিলে সই করেন, তারপরে জেনারেল অরোরা। জানি না, জেনারেল নিয়াজি জেনেশুনেই করেছিলেন না-কি খেয়াল করেননি ব্যাপারটা, তবে তিনি নিজের পুরো নাম সই করেননি – শুধু এ. কে. লিখেছিলেন।”
“আমার নজরে পড়তেই জেনারেল অরোরাকে বললাম ব্যাপারটা। অরোরা তখনই নিয়াজিকে অনুরোধ করেন যে পুরো নাম সই করতে। যেই নিয়াজি পুরো নাম সই করলেন, সেই মুহুর্তেই বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে গেল,” আত্মজীবনীতে লিখেছেন ৭১-এর যুদ্ধের সময়ে ভারতীয় নৌবাহিনীর পূর্ব কমান্ডের প্রধান অ্যাডমিরাল এন কৃষ্ণান।
তিনি আর লিখেছেন, “সই করার পরেই নিয়াজির চোখে পানি এসে গিয়েছিল। টুপি খুলে দিলেন, আর রিভলবার থেকে গুলি বের করে সেগুলো জেনারেল অরোরার সামনে সমর্পন করলেন। তারপরে মাথা নামিয়ে জেনারেল অরোরার মাথায় ছোঁয়ালেন – জেনারেল অরোরার অধীনতা স্বীকার করে নিলেন পাকিস্তানি জেনারেল।”
স্বর্ণ মন্দিরে সেনা অভিযান সমর্থন করেননি জেনারেল অরোরা
যুদ্ধের দু’বছর পরে, ১৯৭৩ সালে সেনাবাহিনী থেকে অবসর নেন জেনারেল অরোরা।
সেনাপ্রধান হতে পারেন নি তিনি।
অবসরের প্রায় এক দশক পরে, ১৯৮৪ সালে যখন ভারতীয় সেনাবাহিনী ‘অপারেশন ব্লু স্টার’-এর সময়ে অমৃতসরের স্বর্ণ মন্দিরে প্রবেশ করল, তার জোরালো বিরোধীতা করেছিলেন জেনারেল অরোরা।
বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাতকারে জেনারেল অরোরা বলেছিলেন, “দরবার সাহেবে হামলা চালিয়ে সেনাবাহিনী শিখদের মনে যতটা দুঃখ দিয়েছে, সম্ভবত এত দুঃখ আর কেউ দেয়নি। মিসেস ইন্দিরা গান্ধী সেই সময়ে বিষয়টা বুঝতে পারেননি।”
“তারপরে যদি মিসেস গান্ধী যদি শুধু এটুকু বলতেন যে ওই অপারেশনটা ভুল হয়েছিল আর ওই অপারেশনের অনুমতি দিতে আমি বাধ্য হয়েছিলাম, তাহলে শিখরা তাঁকে ক্ষমা করে দিত।”