দেশীয় পণ্যের উদ্যোক্তা তাহমিনা কবির ও নারী উদ্যোক্তাদের চ্যালেঞ্জ
অনিমেষ রায়: মানবজাতির সূচনাপর্বে আদিম সমাজের পুরোভাগে নেতৃত্ব দিয়েছেন নারী। শ্রম, ঘাম ও মাতৃত্ব দিয়ে সভ্যতা বিকাশের যুগে পৃথিবীকে টেনে এনেছে নারী জাতি। এমনকি পৃথিবীতে প্রথম ভূমিকর্ষণ করে আজকের সুজলা-সুফলা বসুন্ধরা বিনির্মাণের কারিগরও এই নারী জাতিই। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে নিজেদের গর্ভজাত এই সভ্য সমাজেই বন্দি পড়েছে নারী। একদিকে যেমন পুরুষতন্ত্রের জোয়ালে ঘরোয়া দাসত্বে বন্দি, আরেক দিকে শ্রেণী বৈষম্যের সমাজে সস্তা শ্রমের পণ্য হয়ে শৃংখলিত । এই দ্বিবিধ পীড়নের পর্বতসম বাধা ঠেলে ঠেলে জীবন ক্ষয় করতে করতে আজকের পর্যায়ে এসেছেন একেকজন মা-মেয়ে, বোন-ভাগ্নী ও প্রিয়তম স্ত্রীসহ নারীকূলের অন্যান্যরা। স্বচ্ছল বা অস্বচ্ছল সকল ক্ষেত্রেই যেনো নারীজনিত সমস্যাগুলি সার্বজনীন। অনেকটা শ্রেণীবিভক্ত পুরুষতান্ত্রিক সমাজের ইচ্ছা-অনিচ্ছার উপর প্রবাহমান তাদের জীবন। ফলে নারীজাতির পূর্বেকার শক্তি, সামর্থ্য ও যোগ্যতাগুলি যেনো মাটিচাপা পড়েছে। তবুও এক আশ্চর্য্যরকমের যোগ্যতায় তারা অনন্ত দু:খ-কষ্টের মাঝেও সুখ পাখিটিকে খোঁজে বের করতে পারেন। বিরাট হতাশার মাঝেও আশার আলো দেখাতে পারেন। এখানেই যেনো পুরুষতন্ত্রের সব দাম্ভিকতা দুমড়ে মুছড়ে পড়ে। কিন্তু যে শ্রেণী বিভক্ত সমাজ নারীকে পুরুষের ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে পরিণত করেছে, সেই সমাজ উচ্ছেদ বিনা নারী মুক্তি কি সম্ভব? ইতিহাসের পাতায় দীর্ঘসময় ধরে সমাজের শ্রম বণ্টনে পুরুষ নারীকে দিয়েছে ঘরের কাজ। আর বাহিরের যা আছে তার দখল নিয়েছে পুরুষ। ফলে কর্তৃত্ব যা, তা পুরুষের । কিন্তু এবার বাহিরের হালও ধরেছে নারী। অফিস-আদালত, ব্যবসা-বাণিজ্য, মিছিল-মিটিং সর্বত্র ছড়িয়েছে নারী। যদিও নারীর এই বের হওয়াটাকে পুঁজি করে মুনাফা খোঁড়েরা তাদের কাছ থেকে নিংড়ে নিচ্ছে সস্তা শ্রম, তবুও নারী অধিকার ও নারী মুক্তির পথ এখান থেকেই নারীদের খোঁজে বের করতে হবে। যখন উৎপাদন ও কর্মক্ষেত্রগুলিতে নারীরা প্রবেশ করছে তখন উৎপাদন ব্যবস্থা নির্ধারণের ক্ষেত্রেও নিশ্চয় তারা ভূমিকা রাখবে। তথ্য ও প্রযুক্তির কল্যাণে নতুন নতুন কর্মক্ষেত্র তৈরি হওয়ার খানিক সুযোগেও নারীরা উদ্যোগী হয়ে উঠছেন। এরকম একজন উদ্যোগী ও উদ্যমী নারীর নাম তাহমিনা কবির। ডাক নাম মুমু। ময়মনসিংহ শহরের পন্ডিতপাড়া এলাকার বাসিন্দা এই গৃহিনী খুব অল্প সময়েই সুখ্যাতি অর্জন করেছেন তার অনলাইন ব্যবসায়। দেশীয় প্রযুক্তি ও পণ্যের এক সৃজনশীল পরিবেশনা অনলাইন ব্যবসা জগতে তাকে বিশেষ পরিচিতি দান করেছে। দুটো ছেলে-মেয়ে এবং ঘর-সংসারের কাজ সামলিয়েই তাঁকে এ পরিচিতি অর্জন করতে হয়েছে।
উদ্যোক্তা মানে যিনি উদ্যোগী। প্রাণী মাত্রই উদ্যোগী ও উদ্যোমী। প্রকৃতি জগতে কোন প্রাণীই আপনা-আপনি বাঁচে না। বেঁচে থাকার জন্য প্রত্যেকের সংগ্রাম করতে হয়, নতুন নতুন উদ্যোগের মধ্যে থাকতে হয়। প্রকৃতি জগতের পরিবর্তনের সাথে নিজেদের পরিবর্তনের উদ্যোগে যারা পিছিয়ে যায় প্রকৃতি জগত থেকেও তারা নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। তা সে যত বড় প্রাণীই হোক। যেমন বিশালাকার প্রাণী ডাইনোসর নিজেকে পরিবর্তন করতে না পেরে বিলুপ্ত হয়ে গেলো । অথচ স্মার্ট একটি ক্ষুদ্র প্রাণী তেলেপোকা আজো আমাদের রাজা-প্রজা সকলের ঘরে রাজত্ব করে যাচ্ছে। এভাবে মানুষও প্রকৃতির প্রতিকূলতাকে জয় করে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষা করেছে। মেরু অঞ্চলে বরফ জমেছে তো মানুষ চলে এসেছে মরু অঞ্চলে। আবার মরু অঞ্চলে গরম পড়েছে তো মানুষ চলে এসেছে শীতাঞ্চলে। এইভাবেই মানুষ আজ তাদের উপযোগী বাসস্থান বিনির্মাণ করেছে। তবে পৃথিবীর সিংহভাগ মানুষের সংকট আজ তাদের জীবিকা নিয়ে। ব্যক্তিমালিকানার যে সমাজ মানুষ আজ প্রতিষ্ঠিত করেছে তাতে হাতে গোণা কিছু লোকের হাতে জমা হচ্ছে বাদ বাকি বিশে^র সম্পদ। ফলে জেফ বেজোজ, এলন মাস্ক, জ্যাক মা, বিল গেটস-রা দিন দিন সম্পদের পাহাড় গড়ে তুললেও বাকি বিশ^ দিন দিন সর্বহারা হচ্ছে। ব্যাপকভাবে কমে যাচ্ছে মধ্যবিত্তের সংখ্যা। আমাদের দেশেও আজ নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্তদের মধ্যে বিশেষ পার্থক্য থাকছে না। সকলেই জীবন পরিচালনা নিয়ে প্রতিনিয়ত আতংক-আশংকার মধ্যে থাকছে। ফলে একটু ভালো থাকা ও একটু নিশ্চয়তার জন্যে গৃহকর্তার সাথে গৃহকর্ত্রীও যেনো চেষ্ঠা চালাচ্ছে কিছু একটা করার। কিছু একটা চাইলেই তো আর করা যায় না। তার জন্য কিছু একটা মাধ্যম লাগে। তাহমিনা কবিরেরও উদ্যোক্তা হতে একটা মাধ্যম লেগেছে। ২০১৯ সালের ৯ সেপ্টেম্বর দিনটি তাহমিনা কবিরের জন্য একটি বিশেষ দিন। অলসভাবে ফেসবুক ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ তার চোখ পড়ে উই’ নামক একটা পেজে। পুরো নাম women e-commerce entrepreneurs(WE) । এখানে তাঁর মতোই গৃহিনী বা অন্যান্য মেয়েরা বাহারী রকমের বিজ্ঞাপন দিয়ে যাচ্ছেন। কেউ শাড়ী-থ্রি পিছ, কেউ পুডিং-বিরিয়ানী, কেউ বা কোন শো-পিছ টাইপ জিনিসের বিজ্ঞাপন দিচ্ছেন। এসব দেখে তাহমিনা কবিরের আগ্রহ হলো। ঘরে বসে থেকে এরকম একটা উদ্যোগ তিনিও তো চালাতে পারেন? বরঞ্চ তাঁর জন্য এটা অন্যদের চেয়ে সহজ হওয়ার কথা। কারণ তাঁর সাথে যে ভদ্রলোক একই ছাদনীতলায় বাস করেন তিনিও যে আইটি রিলেটেড লোক। সুতরাং একটা পেজ বা একটা ওয়েব সাইট তো তিনি ঐ ভদ্রলোককে দিয়েই সহজে করিয়ে নিতে পারেন। সমস্যাটা বাঁধতো যদি সংশ্লিষ্ট ভদ্রলোক তাঁর ‘মহাশয়ার’ উদ্যোগ নিয়ে আপত্তি তুলতেন। যে পুরুষ নিজে বাহিরে থেকে ঘরে স্ত্রীকে বন্দি রাখতে চান এই ভদ্রলোক অন্তত সেই পুরুষ নন। তাই তাহমিনা কবিরের জন্য তাঁর উদ্যোক্তা হওয়ার প্রথম দরজাটা খুলে গেলো সহজেই। কিন্তু বিষয়টি যখন ব্যবসা, সেখানে তো সম্মতি বা টেকনিক্যাল সাপোর্টই যথেষ্ট নয়। তাই এরপর কড়া নাড়তে হলো প্রাথমিক পুঁজি সংগ্রহের দরজায়। সেটাও তিনি সংগ্রহ করে নিলেন তাঁর মায়ের কাছ থেকে। মানুষ তার স্বপ্নের চেয়েও বড় হতে পারে ঠিক, তবে তার জন্য একটা প্রভাবক লাগে। যা তাকে প্রতিনিয়ত তাড়া করে বেড়ায় তার স্বপ্নের দিকে। তাহমিনা কবিরের এই তাড়না ছিলো তাঁর পিতৃবিয়োগ। দুটো বোন, একটি মাত্র ভাই। আর সবার বড় তাহমিনা কবির। ছোট দুটো ভাই-বোন কিছু করার মত বয়সে নেই এখনো। ফলে বাবার দায় অনেকটা তার উপর এসে বর্তায়। নিজের পছন্দে বিয়ে করেছিলেন। তখন বাবাই তাদের মাথার উপর ছাতা হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। সংসারে বাবা না থাকার অভাব অনেকটা পূরণ করেছিলেন তাঁর পার্টনার এহসানুল কবির সাহেব। কিন্তু নিজের একটা আইডেন্টি, নিজের খেয়াল খুশি মতো কিছু করতে পারার আনন্দটাই যে আলাদা! তাই যেদিন মায়ের জমানো কিছু টাকা থেকে তাহমিনা কবির তাঁর উদ্যোক্তা হওয়ার প্রথম যাত্রা শুরু করেছিলেন, সেদিনই মনে মনে পণ করলেন- যেমন করেই হোক এর ফিডব্যাক তাকে আনতেই হবে। বলতে গেলে এটাই তার আজকের উদ্যোক্ত হওয়ার প্রথম প্রেরণা। আজ থেকে প্রায় দুই বছর আগে তিনি তৈরি করেছেন বুনন কুটির। পুরো নাম https://bunonkutir.net যেটির ফেসবুক পেজ https://www.facebook.com/groups/1330468493817293 । প্রথম দিকে তিনি পাটের হ্যান্ডমেইড ব্যাগ বিক্রি চালু করেন। কিছুদিন করার পর সংকটে পড়লেন এর কাঁচামাল সংগ্রহের। ভালো পাট না পেলে ভালো ব্যাগ সম্ভব হয় না। ফলে পাট সংগ্রহের পর্যাপ্ত সোর্সের অভাবে তিনি পাটের ব্যাগ বিক্রি বেশি দিন চালিয়ে যেতে পারেন নি। এরপরেই তিনি ধরেন দেশীয় শিল্পের তাঁতের শাড়ী, দেশীয় থ্রী-পিছ ও দেশীয় প্রযুক্তির হ্যান্ডমেইড জুয়েলারী। আমাদের দেশে শিল্প ও বাণিজ্যে বিদেশী প্রযুক্তি ও পণ্যের ছড়াছড়ি । আমাদের দেশের সস্তা শ্রম নিংড়ে নিয়ে তৈরি হয় বিদেশী পণ্য । সেই পণ্যই আবার বিক্রি হয় আমাদের ক্রেতা-ভোক্তাদের কাছে। আমাদের ভোক্তারাও একরকম সৌখিনতায় ভুগেন যে, তারা বিদেশী পণ্য ব্যবহার করছেন! অথচ এই সৌখিনতার আড়ালে মার খেয়ে যাচ্ছে দেশী পণ্য, শিল্প ও বাণিজ্য। আসন গেড়েছে বিদেশী পুঁজির গড়ে তোলা মার্কেট, শপিং মল। সেটির রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ হচ্ছে অর্থনৈতিক অঞ্চল, বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল, বেপজা, হাইটেক পার্ক ইত্যাদি। যেখানে বিদেশী একচেটিয়া পুঁজির হাতে মার খেয়ে ঘরে বসেছে দেশীয় শিল্প-বাণিজ্য। করোনা মহামারীর কারণে শফিং মল ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় গত বছর থেকে মূলত অনলাইনে নারী উদ্যোক্তাদের সংখ্যা বাড়ে। কিন্তু শুরুতেই চ্যালেঞ্জ ছিলো উদ্যোক্তাদের মাঠে টিকে থাকা। কেননা ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত উদ্যোগ যাই থাকুক রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ ও পরিকল্পনা তার সাথে যুক্ত না হলে টিকে থাকা কঠিন। ফলে নারী উদ্যোক্তাদের ক্ষেত্রে সেই সংকটই শুরু হয়েছে। সংশ্লিষ্টদের পরিসংখ্যান অনুযায়ী গত বছর ময়মনসিংহ শহরে যেখানে প্রায় ২৫০-৩০০ উদ্যোক্তা তৈরি হয়েছিলো, এখন তার প্রায় অর্ধেকই বিভিন্ন কারণে নিস্ক্রিয় হয়ে গেছে। তার মধ্যে ই-কমার্সের মাধ্যমে কিছু অসুস্থ প্রতিযোগিতা ও গ্রাহকদের সাথে প্রতারণার ঘটনা ই-কমার্সের ব্যবসায়ের নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য চ্যালেঞ্জ বৃদ্ধি করছে। এসবের মধ্যেই সততা ও নিষ্ঠা নিয়ে মাটি কামড়ে ধরে থাকার মতো তাহমিনা কবিরেরা দেশের আনাচে-কানাচে অস্তিত্ব জানান দিয়ে যাচ্ছে দেশীয় পণ্যের উপর ভর করে। তবে আমাদের ভোক্তা-ক্রেতারা যদি তাহমিনা কবিরদের পাশে দাঁড়ায় তাহলে হয়তো এরাই একদিন আবার ফিরিয়ে আনবে পুরনো মসলিনের যুগ। অবলা বলে যে নারীরা ছিলো এতদিন মহলে বন্দি, আজ তারা বলতে বাহির হয়েছে নিজেদের অতীত, ঐতিহ্য আর অস্তিত্বকে জানান দিতে। এঁদের অস্তিত্ব মানেই আমরা ও আমাদের অস্তিত্ব । সুতরাং আমাদেরও কাজ এঁদের পাশে থাকা সহযোদ্ধা, সহমর্মি ও সহকর্মি হয়ে।