অন্যান্য

মুক্তিযোদ্ধাদের মরণোত্তর গার্ড অব অনার-এ নারী না রাখায় অর্থনীতি সমিতির প্রতিবাদলিপি

নিউজ ডেষ্কঃ

জাতীয় সংসদের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি ১৯তম বৈঠকে কোনো বীর মুক্তিযোদ্ধার মৃত্যুর পর তাঁকে রাষ্ট্রীয় সম্মানের অংশ হিসেবে ‘গার্ড অব অনার’ দেওয়ার সময় সরকারের নারী কর্মকর্তাদের উপস্থিতি নিয়ে যে আপত্তি তুলেছে এবং নারী কর্মকর্তাদের সরকারি এই আনুষ্ঠানিকতায় না রাখার যে সুপারিশ করেছে—মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সিক্ত, শোভন সমাজ-অর্থনীতি￾রাষ্ট্র এবং ধর্মনিরপেক্ষ ও আলোকিত মানুষের বাংলাদেশ গঠনে সংকল্পবদ্ধ বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির নির্বাচিত কার্যনির্বাহী কমিটি তার তীব্র নিন্দা জানাচ্ছে। বাংলাদেশের পাঁচ সহ¯্রাধিক
অর্থনীতিবিদের প্রতিনিধিত্বকারী একমাত্র এই সংগঠন সবসময়ই সংবিধান ও মুক্তিযুদ্ধের
চেতনাবিরোধী এ ধরনের যেকোনো সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে।

বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি মনে করে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে এবং পবিত্র সংবিধানে
সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও বৈষম্যের বিষয়ে স্পষ্ট করেই বলা হয়েছে: “সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী
বাংলাদেশের জনগণ নির্বাচিত প্রতিনিধিদের প্রতি যে ম্যান্ডেট দিয়েছেন সে ম্যান্ডেট মোতাবেক আমরা,
নির্বাচিত প্রতিনিধিরা, আমাদের সমবায় গণপরিষদ গঠন করে পারস্পরিক আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে
বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্যে
বাংলাদেশকে একটি সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্র ঘোষণা করছি।” [স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র]। বাংলাদেশের
পবিত্র সংবিধানের চার মূলনীতির প্রস্তাবনার শুরুতেই বলা হয়েছে: “আমাদের রাষ্ট্রের অন্যতম মূল লক্ষ্য হইবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা- যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে;”। সংবিধানের প্রাধান্যে বলা হয়েছে: “৭। (১) প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ; এবং জনগণের পক্ষে সেই ক্ষমতার প্রয়োগ কেবল এই সংবিধানের অধীন ও কর্তৃত্বে কার্যকর হইবে।” “(২) জনগণের অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তিরূপে এই সংবিধান প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন এবং অন্য কোন আইন যদি এই সংবিধানের সহিত অসমঞ্জস হয়, তাহা হইলে সেই আইনের যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ, ততখানি বাতিল হইবে।” সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিতে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রশ্নে বলা হয়েছে: “১১। প্রজাতন্ত্র হইবে একটি গণতন্ত্র, যেখানে মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা থাকিবে, মানবসত্তার মর্যাদা ও মূল্যের
প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নিশ্চিত হইবে…।” সংবিধানের সুযোগের সমতায় বলা হয়েছে: “১৯। (১) সকল
নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা নিশ্চিত করিতে রাষ্ট্র সচেষ্ট হইবেন। (২) মানুষে মানুষে সামাজিক
ও অর্থনৈতিক অসাম্য বিলোপ করিবার জন্য, নাগরিকদের মধ্যে সম্পদের সুষম বন্টন নিশ্চিত করিবার জন্য এবং প্রজাতন্ত্রের সর্বত্র অর্থনৈতিক উন্নয়নের সমান স্তর অর্জনের উদ্দেশ্যে সুষম সুযোগ-সুবিধাদান নিশ্চিত করিবার জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন। (৩) জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে মহিলাদের অংশগ্রহণ ও সুযোগের সমতা রাষ্ট্র নিশ্চিত করিবেন।]” সংবিধানের তৃতীয় ভাগে নাগরিকের মৌলিক
অধিকার আইনের দৃষ্টিতে সমতার বিষয়ে বলা হয়েছে: “২৭। সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান
এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী।” ধর্ম ও প্রভৃতি কারণে বৈষম্যের বিষয়ে সংবিধানে
বলা হয়েছে: “২৮। (১) কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারীপুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোন
নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করিবেন না। (২) রাষ্ট্র ও গণজীবনের সর্বস্তরে নারীপুরুষের
সমান অধিকার লাভ করিবেন। (৩) কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী পুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে
জনসাধারণের কোন বিনোদন বা বিশ্রামের স্থানে প্রবেশের কিংবা কোন শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে ভর্তির বিষয়ে কোন নাগরিককে কোনরূপ অক্ষমতা, বাধ্যবাধকতা, বাধা বা শর্তের অধীন করা যাইবে না। (৪) নারী বা শিশুদের অনুকূলে কিংবা নাগরিকদের যে কোন অনগ্রসর অংশের অগ্রগতির জন্য বিশেষ বিধান-প্রণয়ন হইতে এই অনুচ্ছেদের কোন কিছুই রাষ্ট্রকে নিবৃত্ত করিবে না।” সংবিধানে সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে বলা হয়েছে: “২৯। (১) প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ-লাভের ক্ষেত্রে সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা থাকিবে।” “(৩) এই অনুচ্ছেদের কোন কিছুই- (ক) নাগরিকদের যে কোন অনগ্রসর অংশ যাহাতে প্রজাতন্ত্রের কর্মে উপযুক্ত প্রতিনিধিত্ব লাভ করিতে পারেন, সেই উদ্দেশ্যে তাঁহাদের অনুকূলে বিশেষ বিধান-প্রণয়ন করা হইতে, (খ) কোন ধর্মীয় বা উপ-সমপ্রদায়গত প্রতিষ্ঠানে উক্ত ধর্মাবলম্বী বা উপ-সমপ্রদায়ভুক্ত ব্যক্তিদের জন্য নিয়োগ সংরক্ষণের বিধান-সংবলিত যে কোন আইন কার্যকর করা হইতে, (গ) যে শ্রেণীর কর্মের বিশেষ প্রকৃতির জন্য তাহা নারী বা পুরুষের পক্ষে অনুপযোগী বিবেচিত হয়, সেইরূপ যে কোন শ্রেণীর নিয়োগ বা পদ যথাক্রমে পুরুষ বা নারীর জন্য সংরক্ষণ করা হইতে, রাষ্ট্রকে নিবৃত্ত করিবে না।” সংবিধানের পরতে পরতে এমনতর স্পষ্টীকরণের পরও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটি নারী কর্মকর্তাদের মুক্তিযোদ্ধাদের মরণোত্তর ‘গার্ড অব অনার’-এ না রাখার সুপারিশ করছে—এতে সমিতি গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছে।

বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি মনে করে, নারী প্রসঙ্গ তুলে অহেতুক ধর্মীয় বিতর্ক সৃষ্টি করে সরকারি
কোনো কার্যক্রম থেকে নারীকে দূরে সরিয়ে রাখার যেকোনো পরিকল্পনা ও উদ্যোগ কখনোই
গ্রহণযোগ্য নয়। এতে করে মানুষে মানুষে সামাজিক অসাম্য বিলোপ করার সংবিধানের অঙ্গীকার
ভূলুণ্ঠিত করা হবে। যারা এ ধরনের চিন্তা-চেতনা পোষণ করেন, তারা কোনোভাবেই মহান মুক্তিযুদ্ধের
চেতনা হৃদয়ে ধারণ করেন না। তবে তাদের জেনে রাখা উচিত, তাদের আদর্শিক রাষ্ট্র পাকিস্তানে
নারীরা নিয়মিতই মৃতের জানাজায় অংশ নিয়ে থাকেন। তথাপি জানাজার বাইরে সরকারের একটি
আনুষ্ঠানিকতা নিয়ে অহেতুক ধর্মীয় বিতর্ক সৃষ্টি করাকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও শোভন বাংলাদেশ
বিনির্মাণের প্রচেষ্টায় নিয়োজিত বাংলাদেশে অর্থনীতি সমিতি মনে করে গভীর উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও ষড়যন্ত্রমূলক। মুক্তিযোদ্ধাদের মৃত্যুর পর গার্ড অব অনার প্রদান করা কোনো ধর্মীয় অনুষ্ঠান-রীতি নয়। সরকারি নীতিমালা অনুযায়ী মুক্তিযোদ্ধাদের মৃত্যুর পর শেষবারের জন্য তাঁদের রাষ্ট্রীয়ভাবে সম্মান জানিয়ে শেষকৃত্য সম্পন্ন করা হয়। সরকারের প্রতিনিধি হিসাবে জেলা বা উপজেলা প্রশাসনের ডিসি বা ইউএনওরা গার্ড অব অনার দিয়ে থাকেন। বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি মনে করে, এখানে ধর্মীয় ভাবাবেগকে টেনে আনা মৌলবাদী চিন্তা-চেতনা উৎসারিত এবং মহান মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও চেতনার পুরোপুরি বিরোধী ।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার এ ধরনের
কোনো হঠকারী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে না বলেই বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি আশা করে।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় গড়ে ওঠা বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি সবসময়ই শোভন সমাজ-অর্থনীতি-রাষ্ট্রীয়
উপাদানসমৃদ্ধ শোভন একটি বাংলাদেশ বিনির্মাণের স্বপ্ন ধারণ করে। যেকোনো পশ্চাৎপদ চিন্তাধারার
বিপক্ষে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির অবস্থান সবসময়ই অটুট থাকবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *