লকডাউনে বিপর্যস্ত কর্মহীন জনগোষ্ঠী: ত্রাণ-প্রণোদণার তেমন আশ্বাস নেই
সুদীপ্ত শাহিন: চলমান লকডাউনে অভাব অনটনে বিপর্যস্ত নিম্ন আয়ের মানুষগণ। দিন মজুর, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে নিম্ন আয়ের মানুষদের নাভিশ্বাস হয়ে উঠার অবস্থা তৈরি হয়েছে। সাধারণত দৈনন্দিন আয়ের উপর যাদের সংসার চলে কঠোর লকডাউনের কারণে লাগাতার প্রায় দুই সপ্তাহ জুড়ে কর্মহীন থাকায় অর্ধাহারে-অনাহারে চলছে তাদের সংসার। এ প্রেক্ষিতে সরকারের পক্ষ থেকে ত্রাণ তৎপরতার কোন উদ্যোগও পরিলক্ষিত হচ্ছে না। দেশে কর্মরত প্রায় ৬০ লাখ পরিবহন শ্রমিকদের মধ্যে কিছু ত্রাণ বিতরণের উদ্যোগ দেখা গেলেও এ খাতের শ্রমিক নেতারা বলছেন প্রয়োজনের তুলনায় তা খুবই অপ্রতুল । অনেক পরিবহন শ্রমিকদের ত্রাণে পাওয়া চালের মান নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করতেও দেখা গেছে।
অবশ্য সরকারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে লকডাউনে কর্মহীন হয়ে পড়া প্রান্তিক মানুষের জন্য পর্যাপ্ত ত্রাণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এ বিষয়ে ময়মনসিংহ জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, জেলার জন্য মোট ৭৫০ মেট্টিক টন চাল এবং ৮২ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ প্রদান করা হয়েছে। এর মধ্যে জেলার উপজেলার জন্য ৪৫০ মে.টন চাল ও ১২ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা, সিটি কর্পোরেশনের জন্য চাল ১০০ মে.টন ও ৫০ লক্ষ টাকা এবং পৌরসভার জন্য ২০০ টন চাল ও ২০ লক্ষ টাকা বরাদ্দ প্রদান করা হয়েছে।
বিভিন্ন জরিপে দেখা যায়, করোনাকালে নানান বিধি-নিষেধের বেড়াজালে কাজ হারিয়ে নতুন করে দরিদ্র হয়েছেন প্রায় দুই কোটি মানুষ এবং ৬৬% মানুষ কর্মহীন হয়ে যাওয়ার কথা বলা হয়। আর চলমান লকডাউনে রপ্তানিমুখী শিল্প বাদে বাকি প্রায় সব সেক্টরের শ্রমিক ও শ্রমজীবি মানুষেরা কর্মহীন হয়ে পড়ে। ২০১১ সনের আদমশুমারী অনুযায়ী ময়মনসিংহ জেলায় মোট জনসংখ্যা ৫৩,১৩,১৬৩ জন, যা এখন আরো অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা দাবি করেন। বৃহৎ এই জনগোষ্ঠীর বেশিরভাগ মানুষই এখন কর্মহীন। ফলে বিভিন্ন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের কাছে এসব কর্মহীন মানুষেরা ভীড় করলেও জনপ্রতিনিধিরা বলছেন তাদের কাছে চাহিদার তুলনায় অনেক কম বরাদ্দ।
বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন সংঘের ময়মনসিংহ জেলার সভাপতি এডভোকেট হারুন অর রশিদ বলেন, জেলায় গার্মেন্টস শিল্প কারখানা বাদেও প্রায় ৩৫ থেকে ৪০ টি খাতে শ্রমিক ও শ্রমজীবি মানুষেরা কর্মরত রয়েছেন। লকডাউনে তারা প্রায় সবাই কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। আমাদের সংগঠনের সাথে সম্পর্কিত রয়েছে প্রায় ২২ থেকে ২৩ টি শ্রম সেক্টর । তাদের সরকারের পক্ষ থেকে তেমন সহযোগিতার কোনো খবর শোনা যায় নি। এ প্রেক্ষিতে জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্টের ময়মনসিংহ জেলা সভাপতি মাহতাব হোসেন আরজু বলেন, ‘ এখন শুধু শ্রমজীব মানুষেরাই বেকার নয়। নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত সকলই প্রচন্ড অভাব, অনটন ও সংকটের মধ্যে চলছে। কিন্তু জেলার মোট জনসংখ্যার তুলনায় সরকার প্রদত্ত ত্রাণ , প্রণোদণা জনগণের সাথে এক ধরনের প্রহসনের শামিল।’
এদিকে কঠোর লকডাউন কার্যকর করতে পুলিশ, র্যাব, সেনাবাহিনীর সাথে মাঠে সক্রিয় রয়েছে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট গণের নেতৃত্বে ভ্রাম্যমাণ আদালত। জেলা প্রশাসন, উপজেলা প্রশাসন ও ময়মনসিংহ সিটি কর্পোরেশনের উদ্যোগে এসব আদালত পরিচালিত হচ্ছে। এ সময় স্বাস্থ্যবিধি ও প্রজ্ঞাপন ভঙ্গের কারণে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে অর্থদন্ড প্রদান করা হচ্ছে। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সূত্রে জানা যায়, জুলাইয়ের ১ তারিখ থেকে পরিচালিত হওয়া জেলা প্রশাসন, উপজেলা প্রশাসন ও ময়মনসিংহ সিটি কর্পোরেশনের লকডাউন চলাকালে ১–১৫ জুলাই পর্যন্ত মোট ৬৩০টি মোবাইল কোর্ট অভিযানে ৪,৩৯৩ মামলায় ২৯,৯৫,৯৫৫ টাকা অর্থদণ্ড প্রদান করা হয়েছে। । ।এ প্রেক্ষিতে বিভিন্ন শ্রেণী পেশার অনেক ব্যক্তিগণ উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, ‘কর্মহীন সময়ে যখন প্রয়োজন পর্যাপ্ত ত্রাণ-প্রণোদণা কিন্তু তার বদলে মানুষের কাছ থেকে উল্টো জরিমানা আদায় করা হচ্ছে।’
নিম্ন আয়ের মানুষদের দৈন্যদশার কথা বিবেচনা করে তাদের সহায়তায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নতুন পাঁচটি প্রণোদনা প্যাকেজের ঘোষণা দিয়েছেন । প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিম গত ১৩ জুলাই প্রণোদনা প্যাকেজ সম্পর্কে জানান, নতুন পাঁচটি প্রণোদনার মাধ্যমে ৩ হাজার ২০০ কোটি টাকা দেয়া হবে ক্ষতিগ্রস্তদের। প্যাকেজগুলো হলো: ১. দিনমজুর, পরিবহন শ্রমিক, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী এবং নৌপরিবহন শ্রমিকদের জন্য জনপ্রতি নগদ আড়াই হাজার টাকা করে আর্থিক সহায়তার জন্য ৪৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ। ২. শহর এলাকার নিম্নআয়ের জনসাধারণকে সহায়তার জন্য ২৫ জুলাই থেকে ৭ আগস্ট পর্যন্ত ১৪ দিন ৮১৩টি কেন্দ্রে বিশেষ ওএমএস কার্যক্রম পরিচালনার জন্য বরাদ্দ ১৫০ কোটি টাকা। ৩. ৩৩৩-নম্বরে জনসাধারণের অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে খাদ্য সহায়তা দেওয়ার জন্য জেলা প্রশাসকদের অনুকূলে বিশেষ বরাদ্দ ১০০ কোটি টাকা। ৪. গ্রামীণ এলাকার কর্মসৃজনমূলক কার্যক্রমে অর্থায়নের জন্য পল্লী কর্মসংস্থান ব্যাংক ও পিকেএসএফ-এর মাধ্যমে ঋণ সহায়তা দিতে ৪ শতাংশ সুদে আগে বরাদ্দ ৩ হাজার ২শ কোটি টাকার অতিরিক্ত বরাদ্দ এক হাজার ৫০০ কোটি টাকা। ৫. পর্যটন খাতের হোটেল-মোটেল, থিম পার্কের জন্য কর্মচারীদের বেতন-ভাতা পরিশোধের লক্ষ্যে ব্যাংকের মাধ্যমে ৪ শতাংশ সুদে ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল ঋণ সহায়তা দিতে এক হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ।
নৌ শ্রমিকদের প্রণোদণা প্যাকেজের আওতায় আনার বিষয়ে বাংলাদেশ নৌযান শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক চৌধুরী আশিকুল আলম জানান, নৌ-সেক্টরে মোট প্রায় দুই লক্ষ শ্রমিক কর্মরত । এর মধ্যে যাত্রী বাহী নৌ শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ১৫ হাজার। তার মধ্যে মাত্র ১৬০৩ জনকে প্রণোদণার আওতায় আনা হয়েছে। প্রণোদণা প্যাকেজের প্রেক্ষিতে ক্ষোভ প্রকাশ করে বাংলাদেশ হোটেল রেস্টুরেন্ট এন্ড সুইটমিট শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘হোটেল রেস্টুরেন্ট সেক্টরে প্রায় ৩০ লাখ শ্রমিক কর্মরত। লকডাউনের কারণে এর প্রায় ৯৫ ভাগ শ্রমিক বেকার হয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে । অথচ প্রধানমন্ত্রীর প্রণোদণা প্যাকেজের আওতায় হোটেল শ্রমিকদের আনা হয় নি।’
প্রধানমন্ত্রীর প্রণোদণা প্যাকেজ কিভাবে বাস্তবায়ন করা হবে এ সম্পর্কে ময়মনসিংহের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক জানান, এ সম্পর্কে কোন প্রজ্ঞাপন অফিসিয়ালি এখনো জেলা প্রশাসনে আসে নি।