ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনে আপোসকামীতার স্বরুপ
তফাজ্জল হোসেন: আইনের চেয়ে কম সুবিধা নিয়ে শ্রমিক স্বার্থবিরোধী চুক্তিতে স্বাক্ষর করাকে ‘অপরাধ’ হিসেবে শ্রমিকদের কাছে বিবেচিত হলেও কথিত শ্রমিক নেতারা দাবি করছেন তারা শ্রমিকদের পক্ষেই ভূমিকা নিচ্ছেন। তাদের পক্ষে তারা যুক্তি উত্থাপন করেন যে- “যেটুক মালিকরা দিতে চেয়েছে সেটুকুতে চুক্তি না করলে শ্রমিকরা তাও পেতো না।” কোন কারখানা বা প্রতিষ্ঠানপুঞ্জ এরিয়ার শ্রমিকদের দাবি-দাওয়া আদায়ের ক্ষেত্রে কমবেশ হতে পারে। সেই ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কারখানা বা প্রতিষ্ঠানপুঞ্জ এরিয়ার শ্রমিকরা তাদের সংশ্লিষ্ট মালিকদের সাথে দ্বিপাক্ষিক সাময়িক সমঝোতা করে নেয়ার নজির রয়েছে। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক ট্রেড ইউনিয়ন নেতৃত্বগণ যখন এই চুক্তিতে আবদ্ধ হোন, তখন শ্রমিকদের দাবি-দাওয়ার স্কেল নিচে নেমে যায়। সাধারণত প্রচলিত শ্রম আইন মালিকদের স্বার্থ রক্ষা করে। সে কারণে শ্রমিকদের দাবি করতে হয় তাদের ন্যায়সঙ্গত প্রয়োজন থেকে, যা সঙ্গত কারণেই আইনের অতিরিক্ত দাবি করতে হয়। কিন্তু যখন আশপাশে আইনের কম সুবিধা নিয়ে কোন চুক্তির রেফারেন্স দেখা যায়, তখন মালিকদের কাছে চাহিদা দেয়ার ক্ষেত্রেই নিচে নেমে চাইতে হয়। এতে দীর্ঘদিনের লড়াই-সংগ্রামের মাধ্যমে শ্রমিকদের যা অর্জন ছিলো, তা আপনা-আপনি কর্তন হয়ে যায়। চতুর এইসব শ্রমিক নেতারা যে শ্রমিকদের এই স্বার্থ হানির বিষয়টির ব্যাপারে ওয়াকিবহাল নন, তা নয়। বরঞ্চ বিশেষ উদ্দেশ্য, ব্যক্তিগত বিভিন্ন সুবিধা আদায় এবং প্রকৃত শ্রমিক আন্দোলনের সাথে বিশ্বাসঘাতকতার কারণেই এসব তৎপরতা তারা চালিয়ে থাকে।
দেশের ট্রেড ইউনিয়ন চর্চায় আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবণতা হচ্ছে সামাজিক সংলাপ বা অংশীজন সংলাপে অংশগ্রহণ। সংলাপের বিষয়টি ট্রেড ইউনিয়ন চর্চার ক্ষেত্রে দরকষাকষির একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুসঙ্গও বটে। কারণ সবসময় আন্দোলন বা ধর্মঘটের মাধ্যমে দাবি-দাওয়া আদায় সম্ভব হয়ে উঠে না। সেক্ষেত্রে মালিক বা সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের সাথে ট্রেড ইউনিয়ন নেতৃবৃন্দের সংলাপ ও আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে আইনি অনেক সুযোগ-সুবিধা আদায় সম্ভবপর হয়ে উঠে। কিন্তু এসডিজি প্রণয়ণের পর এই সংলাপের বিষয়টি ভিন্নরুপে প্রভাব ফেলছে। চলতি দশক বিশ্বব্যাপী মন্দা, বেকারত্ব বৃদ্ধি, শিল্পক্ষেত্রে প্রযুক্তির পুনর্বিন্যাস, আন্ত:সাম্রাজ্যবাদী দ্বন্দ্বের প্রকট রুপ ও বাজার পুনর্বন্টন ইত্যাদি বিষয় পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বব্যবস্থাকে প্রকম্পিত করে তুলছে। প্রায় ভঙ্গুর অবস্থা প্রচলিত বিশ্বব্যবস্থার। সেটিকে রক্ষা করার জন্য বিশ্ব একচেটিয়া পুঁজিপতি সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠী এমডিজি’র পর এসডিজি কর্মসূচি সামনে এনেছে। ট্রেড ইউনিয়ন সংক্রান্ত এসডিজি’র যে সমস্ত লিটারেচার রয়েছে বা যেসব রিসোর্স পারসন শ্রম পরিবেশের ক্ষেত্রে এসডিজি কার্যকর করতে প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকেন তারা প্রথমত: শ্রম ও পুঁজির দ্বন্দ্বকে স্বীকৃতি দিয়ে থাকেন। শ্রম ও পুঁজির স্বার্থ যে বিপরীতমুখী এই সত্যটিকে তারা অস্বীকার করতে পারেন না। কিন্তু কৌশলে যেটা অস্বীকার করে যায়, সেটা হচ্ছে পুঁজির অতি উৎপাদন সংকটকে। অতি উৎপাদন সংকট যে পুঁজির ব্যক্তিগত বন্টনকে প্রশ্নবিদ্ধ করে সেটিকে আড়াল করতেই তারা শ্রম ও পুঁজির বিরোধটাকে সংলাপের নামে একটা সহাবস্থানে রেখে শ্রমিকের ক্ষোভটাকে সহনীয় পর্যায়ে রাখতে চায়। বিপ্লবী আন্দোলন গড়ে তোলার প্রচেষ্টাকে প্রশমিত করার চেষ্ঠা করে। সেটির জন্যই এসডিজি কর্মকৌশলের একটি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ হচ্ছে সকল সেক্টরে সকল অংশীজনদের নিয়ে সংলাপ আয়োজন। এই সংলাপ আয়োজনে অংশগ্রহণকারী ট্রেড ইউনিয়ন নেতৃত্বগণ এসডিজি প্রদত্ত লিটারেচারের মধ্যকার তর্ক-বিতর্কে আটকে থেকে যত চৌকষ আর কৌশলীই হোন না কেন, তিনি একচেটিয়া পুঁজির গুটি হয়েই থাকবেন। বরং কম পারঙ্গমতা থাকা সত্ত্বেও সরকারের বিভিন্ন চাতুর্যতা নিয়ে যদি প্রশ্ন তোলা যায় এবং এসডিজি’র নামে ষড়যন্ত্র-চক্রান্তকে উন্মোচন করা যায় তাহলে সেটা শ্রমিক আন্দোলন বিকাশে প্রভাব ফেলতে পারে। অন্যথায় বিরাটকায় ট্রেড ইউনিয়ন নেতৃত্বগণ কথিত “ডিসেন্ট ইমেজ’ নিয়ে সরকারের প্রিয়ভাজন ব্যক্তিতে পরিণত হয়ে ধীরে ধীরে রাজনৈতিক আপোসকামী নেতৃত্বে পরিণত হওয়ার শংকা তৈরি হয়। প্রচলিত ট্রেড ইউনিয়ন সংগ্রামে আন্দোলন বিক্রি করে দেয়া, অর্থনৈতিক বা ব্যক্তিগত সুবিধা গ্রহণ ইত্যাদি চিহ্নিত বিষয়সমূহ বহুল প্রচলিত। কিন্তু সাম্প্রতিক কালে এসব বাদেও আপোসকামীতার বিভিন্ন দিক ফুটে উঠে। এমনকি সংগঠন-সংগ্রামের কর্মসূচি গ্রহণ করার ক্ষেত্রেও আপোসকামীতার বিভিন্ন দিকগুলি ভেসে উঠে। ট্রেড ইউনিয়নের কর্মসূচিকে কেবল অর্থনৈতিক দাবি-দাওয়ার মধ্যে আটকিয়ে রাখলে “আন্দোলন আন্দোলন ভাব” দেখানোর ইমেজ দেখানো গেলেও সেসব আন্দোলন কখনো রাষ্ট্রব্যবস্থাকে আঘাত করে না। ফলে রাষ্ট্রযন্ত্রের রোষানল থেকে এসব আন্দোলনের নেতৃত্বগণ একটা নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে নিজেদের নিরাপদ রাখতে পারেন। বরং সরকার ও মালিকের কাছে নিজেদের দরদাম কিছুটা বাড়াতে পারেন। কিন্তু তা ট্রেড ইউনিয়ন সংগ্রামকে রাজনৈতিক সংগ্রামে পরিণত করার অন্তরায় হয়ে উঠে। নেতৃত্বের লাইফ স্টাইলেও অনেক সময় আাপোসকামীতার বিভিন্ন চিত্র দেখা যায়। ব্যক্তিগত গাড়ি হাঁকিয়ে সরকারী খরচে বা বিদেশী ডোনেশনে সারাদিন এ অফিসে ও অফিসে বা দেশের বিভিন্ন জায়গায় মিটিং, সভা-সেমিনার করে যাচ্ছেন কতিপয় নেতৃত্বগণ। মালিকদের এসোসিয়েশনসহ সরকারের বিভিন্ন এমপি, মন্ত্রীদের সাথে তাদের খুব দহরম মহরম সম্পর্ক। শ্রমিকদের সামনে যেয়ে নিজেদের বিরাট মাপের শ্রমিক নেতা হিসেবে নিজেদের উপস্থাপন করেন। মূলত: শ্রমিকদের সাথে প্রতারণা করে মালিকদের সাথে দরাদরি করে নিজেদের আখের গোছানোই হচ্ছে এসব পতিত নেতাদের অভিসন্ধি। সামাজিক সংলাপের নামে শ্রমিক অঙ্গণে এসব ট্রেড ইউনিয়ন নেতাদের উপহার দিচ্ছে কথিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য-এসডিজি।
অন্যদিকে শ্রমিক সংগঠন ও আন্দোলনকে ক্ষতিগ্রস্ত করার জন্য তৈরি করা হয়েছে বিভিন্ন এনজিও গোষ্ঠী। বিশেষত রপ্তানীমুখী শিল্প হিসেবে গার্মেন্টস সেক্টরে ইউরোপ-আমেরিকার প্রত্যক্ষ স্বার্থ জড়িত থাকায় এই শিল্পের বিনিয়োগকারী ইউরোপ-আমেরিকার একচেটিয়া পুঁজিপতি গোষ্ঠী এদেশে বিভিন্ন এনজিও সৃষ্টি ও পৃষ্ঠপোষকতা করে যাচ্ছে। গার্মেন্টস কারখানাসমূহের শ্রমিকদের মধ্যে বিভিন্ন সমস্যায় কেউ সামনের সারিতে আসলেই বা সেফটি কমিটি ও অংশগ্রহণকারী কমিটি ইত্যাদি প্রতিনিধিত্বকারী কমিটির মধ্যে যেসব শ্রমিকরা নির্বাচিত হয় সেসব অগ্রসর শ্রমিকদের টার্গেট করে এসব এনজিও-রা তৎপরতা চালায়। তাদেরকে নিয়ে শীতাতপ কক্ষে সভা-সেমিনার করে ট্রেনিং দেয়ার নামে প্রকৃত শ্রমিক আন্দোলনের শিক্ষা থেকে বিভ্রান্ত করা, উন্নতমানের খাবার এবং নগদ টাকা প্রদান করা ও ক্ষেত্র বিশেষে বিদেশ সফরে নিয়ে যাওয়া- এসব তৎপরতার মাধ্যমে বর্তমানে দেশের শ্রমিক সংগঠন ও আন্দোলনে এক ভয়ানক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। কখনো সরাসরি এনজিও নামে, কখনো বা কোন কোন ফেডারশনকে আর্থিক ও লজিস্টিক সাপোর্ট দিয়ে বিদেশী ব্র্যান্ড কোম্পানীর মালিকরা এদেশে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্ঠা করছে। এনজিও ঘরানার এসব সংগঠন ও নেতৃত্ব কখনো শ্রম শোষণ উচ্ছেদের লক্ষ্যে শ্রমিক আন্দোলনকে প্রবাহিত করবে না। বরঞ্চ অংশীদারী সংলাপ ও সস্তা জনপ্রিয় কিছু শ্লোগান ও দাবি সামনে এনে প্রকৃত ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনকে পরিকল্পিতভাবে বিভ্রান্ত ও ক্ষতিগ্রস্ত করাই হচ্ছে এদের লক্ষ্য।
শিল্প প্রতিষ্ঠার যুগে পুঁজির মালিকরা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সম্পদ লুটপাট করে আদিপুঁজির সৃষ্টি করলেও, যেদিন থেকে এই পুঁজিতে শ্রমিকের শ্রম যুক্ত করতে পেরেছে তখন থেকে এই শ্রম নিংড়েই মালিকরা পুঁজির পাহাড় গড়ে তুলেছে। কিন্তু শ্রমিকদের উপর অমানুষিক নির্যাতন শ্রমিকরা বেশিদিন সহ্য করে নি। শ্রম শোষণের বিরুদ্ধে শ্রমিকরা রুখে দাঁড়িয়েছে। রক্ত ও জীবন দিয়ে একের পর এক অধিকার তারা ছিনিয়ে এনেছে। অপ্রতিরোধ্য এই শ্রমিকদের রুখতে যেয়েই বুর্জোয়ারা শ্রম আইনের উৎপত্তি ঘটায় । শ্রমিকরা অকাতরে জীবন বিলিয়ে দিয়ে বুর্জোয়াদের দ্বারা গঠিত আইনেই তারা নতুন নতুন অধিকার সংযোজন করেছে। সেসব অকুতোভয়, মহান পূর্বসূরীদের আত্মত্যাগের ফসল ভোগ করছে আজকের শ্রমিক শ্রেণী ও জনগণ। অথচ আজকের শ্রমিকনেতা নামধারীরা কথিত শ্রমিক প্রতিনিধি সেজে একের পর এক শ্রমিকদের অধিকার কর্তন করে যাচ্ছে। বিশ্বাসঘাতকতা করছে আমাদের পূর্বসূরী মহান শহীদদের রক্তের সাথে। ফলে আজকেও শ্রমিকদের তাদের অর্জিত অধিকার রক্ষাসহ নতুন অধিকার সংযোজন করতে হলে শ্রমিক আন্দোলন থেকে এসব দালাল, বিশ্বাসঘাতক কথিত শ্রমিক নেতা ও তাদের সংগঠনগুলোকে চিহ্নিত করতে হবে। মালিকরা কৌশল হিসেবে অর্জিত অধিকারগুলি থেকে বঞ্চিত করে শ্রমিকদের সবসময় ব্যস্ত রাখছে। ফলে আজকের বাস্তবতায় নতুন নতুন অধিকার নিয়ে শ্রমিকদের আন্দোলন গড়ে তোলার আর সুযোগ দিচ্ছে না। কথিত “অংশীজন সংলাপের” নামে টেবিলে বসেই শ্রমিকদের নেতাদের ম্যানেজ করে ফেলা হচ্ছে। আর কথিত এসব নেতারা মুখিয়েও থাকেন কখন টেবিলে বসার ডাক আসবে? এভাবে মাঠের আন্দোলন না থাকায় সংগঠন-সংগ্রাম গড়ে উঠছে না। বরঞ্চ দেশের শিল্পাঞ্চলগুলোতে শ্রমিক সংগঠন ও নেতা নামে কিছু লুম্পেন, টাউট-বাটপার সৃষ্টি হচ্ছে প্রতিনিয়ত। শ্রমিকরা যখন দেখে তাদের প্রাপ্য ১০ টাকা পাওনার মধ্যে কথিত শ্রমিক নেতারা আলোচনায় বসে ৫ টাকায় রাজি হয়ে যায় এবং শ্রমিককে প্রদত্ত সেই ৫ টাকার মধ্যেও ২/৩ টাকা কথিত শ্রমিক নেতা দাবি করে বসে, তখন সংশি¬ষ্ট শ্রমিকটির মধ্যেও এই প্রবণতার আকাংখা তৈরি হয়। দুদিন পরে এই শ্রমিকও আরেকটি সংগঠনের ব্যানার খোলে সেই একই কাজ করতে থাকে। শ্রমিক সংগঠন ও শ্রমিক আন্দোলন দমনের ক্ষেত্রে দেশী-বিদেশী যে ষড়যন্ত্র দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে আজকের বাস্তবতা হচ্ছে তার প্রতিফলন। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে আদর্শিক শ্রমিক আন্দোলন গড়ে তোলার বিকল্প নেই। শ্রমিক শ্রেণীর রাজনৈতিক শিক্ষায় উদ্বুদ্ধ হয়ে আত্মত্যাগের উজ্জল দৃষ্টান্ত স্থাপন করা ছাড়া এ অবস্থার অবসান ঘটবে না। তাই শ্রমিক শ্রেণীর মুক্তির লক্ষ্যে শ্রমিক শ্রেণীর আদর্শে সুসজ্জিত হয়ে প্রকৃত সৎ, সংগ্রামী ও আপোসহীন নেতৃত্বে লড়াকু সংগঠন গড়ে তুলতে হবে।