ডা. এম এ করিম এঁর শততম জন্মদিবসে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত
নিজস্ব প্রতিবেদক: ডা. এম এ করিম এঁর শততম জন্মদিবস উপলক্ষ্যে এক আলোচনা সভা গতকাল বিকাল ৫ ঘটিকায় তোপখানা রোডস্থ বাংলাদেশ শিশু কল্যাণ পরিষদ মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হয়। জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট-এনডিএফ এর উদ্যোগে ২৩ জুলাই তাঁর জন্মদিবস উপলক্ষ্যে বিভিন্ন কর্মসূচির অংশ হিসেবে এ আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়।
সভায় সভাপতিত্ব করেন সংগঠনের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি চৌধুরী আশিকুল আলম । আলোচনা সভায় বক্তব্য রাখেন জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্টের (এনডিএফ)সহ-সভাপতি ও ধ্রুবতারা সাংস্কৃতিক সংসদের সভাপতি শ্যামল কুমার ভৌমিক, এনডিএফ ও বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন সংঘের সহ-সভাপতি খলীলুর রহমান, বাংলাদেশ কৃষক সংগ্রাম সমিতির সহ—সভাপতি এডভোকেট মনসুর হাবীব, বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন সংঘের যুগ্ম-সম্পাদক মোহাম্মদ ইয়াসিন, প্রগতিশীল লেখক ও সাংবাদিক বদরুল মোহাম্মদ খালেকুজ্জামান, এনডিএফ’র প্রচার সম্পাদক রফিকুল ইসলাম, জাতীয় ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি ড.ওবায়দুল্লাহ সাগর ও বাংলাদেশ হোটেল রেস্টুরেন্ট সুইটমিট শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার হোসেন প্রমুখ। জন্মদিবসে বক্তারা তাঁদের বক্তব্যে বলেন, ডা. এমএ করিম ছিলেন এক জীবন্ত ইতিহাসের অগ্রসেনা ও ইতিহাসের কালপঞ্জী। প্রায় ৮ দশক জুড়ে রয়েছে তাঁর বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের সুদূরপ্রসারী কর্মতৎপরতা ও সাধারণ মানুষের চিকিৎসা সেবায় এক অনন্য দৃষ্টান্ত। তিনি মওলানা ভাসানীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ছিলেন। এদেশের কমিউনিস্ট বিপ্লবীনেতা কমরেড আবদুল হক এর সাথে ঘনিষ্ট রাজনৈতিক সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল তাঁর। তিনি দেশের শ্রমিক-কৃষক-জনগণের এক অকৃত্রিম দরদী বন্ধু ও নেতা ছিলেন। জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট এর সারের দাবিতে ৯৩ সালে সংসদ ভবন ঘেরাও আন্দোলন, খুলনায় বিল ডাকাতিয়া ও ডহুরি বাঁধ আন্দোলন, হাওড় অঞ্চলের ইজারাবিরোধী ভাসান পানির আন্দোলন, টিপাইমুখ বাঁধ বিরোধী আন্দোলন, সুনামগঞ্জ জেলার সুনেত্র গ্যাসক্ষেত্র ইজারা বিরোধী আন্দোলনসহ নৌযান, হোটেল, চা, গার্মেন্টসসহ অসংখ্য শ্রমিক আন্দোলন ও কৃষক আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন। বক্তারা বলেন, ১৯২৩ সালের ১৫ জুলাই চাঁদপুর জেলার হাজিগঞ্জের সাদরা গ্রামে তিনি জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর পিতা হাকিম উদ্দিন একজন শিক্ষক ছিলেন এবং মাতা মেহের নিগার ছিলেন একজন গৃহিনী। ১৯৪২ সালে মেট্রিকুলেশন পাস করেন। ১৯৪২ সালে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে ভর্তি হতে গেলেও সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে তার পিতা তাকে ঢাকায় মেডিকেল স্কুল কিংবা প্রকৌশল স্কুলে ভর্তি করতে নিয়ে আসেন। ভর্তির তারিখ চলে যাওয়ায় সে বছর আর ভর্তি হতে পারেন না। ১৯৪৩ সালে ঢাকার মিটফোর্ড মেডিকেল স্কুলে ভর্তি হন। এখান থেকেই শুরু হয় ডাঃ করিমের জীবনের এক নতুন অধ্যায়। মেডিকেল স্কুলে ভর্তি হওয়ার প্রাক্কালেই শুরু হয়ে যায় ’৪৩ এর দুর্ভিক্ষ। দুর্ভিক্ষে তিনি প্রত্যক্ষ করলেন ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের। যা তাঁকে নাড়া দিয়েছিল ভীষণভাবে। দুর্ভিক্ষ কবলিত মানুষদের রক্ষায় অন্যান্যদের সঙ্গে তিনিও যুক্ত হয়ে যান। যুক্ত হয়ে যান রাজনীতিতে। সাম্রাজ্যবাদের নির্মমতা কতটা নিষ্ঠুর এবং ভয়ংকর হতে পারে, দুর্ভিক্ষ প্রত্যক্ষতায় তাকে বুঝতে সহায়তা করেছিল। তিনি দেখলেন বাজারে মহাজন ধনী ব্যবসায়ীদের হাতে পর্যাপ্ত মজুদ খাদ্য সামগ্রী বাজার থেকে তা উধাও করে কৃত্রিম সঙ্কট দেখিয়ে সৃষ্টি করা হয় এই দুর্ভিক্ষ।
তিনি প্রত্যক্ষ করলেন দেশপ্রেমিক একদল তরুণ দুর্ভিক্ষ কবলিত মানুষদের পাশে দাঁড়িয়ে তাদেরকে বাঁচানোর জন্য নিঃস্বার্থ, আত্মত্যাগের এক অভূতপূর্ব তৎপরতা। বসে থাকলেন না তিনি, নেমে পড়লেন এদের সাথে। পরিচিত হয়ে উপলব্ধি করলেন এঁরা সাধারণ মানুষ নন। এদের মধ্যে কাজ করছে প্রচন্ড আদর্শবোধ ও দেশপ্রেমের অনন্য উন্মাদনা। খাবার জোগাতে চিকিৎসা দিতে যেমন নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন পাশাপাশি গণবিরোধী রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থা উচ্ছেদ করতে নিজেদেরকে নিবেদিত করে দিয়েছেন। এদের আদর্শবোধের উৎস হলো কমিউনিস্ট মতধারা। তারা সমাজ থেকে শোষণ-লুণ্ঠন উচ্ছেদ করে ধনবৈষম্য শ্রেণিবৈষম্য বিলোপ ঘটিয়ে সকল শোষিত শ্রেণিকে মুক্ত করতে চান। ডাঃ করিমের ভেতরেও শৈশবে সুপ্ত ছিল এই বোধের। এদের সংস্পর্শে এসে ডাঃ করিম যুক্ত হয়ে গেলেন তাঁদের সাথে। পরিচিত হলেন প্রথমে ডাঃ বারীর সঙ্গে, পরবর্তীতে পরিচয় ঘটলো মোহাম্মদ তোয়াহার সঙ্গে। এরা প্রত্যেকেই ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত।
এদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার কারণে ডাঃ করিম হয়ে উঠলেন রাজনীতিবিদ এবং সে রাজনীতি হল গণমানুষের মুক্তির জন্য, আত্মপ্রতিষ্ঠার জন্য নয়। যা ডাঃ করিম আজীবন লালন করেছেন। তার প্রকাশ ঘটেছিল মেডিকেলে পড়া অবস্থায়। ফাইনাল পরীক্ষায় প্রশ্ন এসেছিল কিভাবে টিবি রোগ এই দেশ থেকে নির্মুল করা যাবে। তিনি প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিলেন, সাম্রাজ্যবাদকে উচ্ছেদ করতে পারলে টিবি রোগ চিরতরে নিমর্‚ল করা যাবে। এই উত্তর দিতে তিনি পাস-ফেলের দিকে তাকানি। দিন গিয়েছে ডাঃ করিমের রাজনৈতিক বোধ ও কর্মক্ষেত্র প্রসারিত হয়েছে। ’৪৬-এ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রতিরোধে অংশগ্রহণ করেছেন। তিনি মেডিকেল টিম নিয়ে দাঙ্গাপীড়িত বিহারে গিয়েছিলেন। ’৪৬-এ সময় পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা না হলেও গঠিত হয়েছিল পাকিস্তান রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি। ডাঃ করিম এই সোসাইটির প্রথম সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন।
ডাঃ করিম কমিউনিস্ট পার্টি এবং গড়ে ওঠা বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রাখতেন। নাচোলের কৃষক আন্দোলন জঙ্গিরূপ নিলে তা রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে রূপ নেয়। নাচোল আন্দোলনের নেত্রী ইলা মিত্র গ্রেফতার হন এবং চরম নিগ্রহের শিকার হন শাসকগোষ্ঠীর হাতে। ইলা মিত্রের জবানবন্দী লিফলেট আকারে বাংলা এবং ইংরেজিতে প্রকাশিত হয়। সেই লিফলেট সংরক্ষিত রাখা হয় ডাঃ করিমের দায়িত্বে। এ সময় রাজবন্দীদের মুক্তির দাবিতে মেয়েরা করোনেশন পার্কে মিছিল সংগঠিত করলে পুলিশ হামলা চালায় এবং অনেককে গ্রেফতার করে। আটককৃত মেয়েদের এবং বাইরে যারা গ্রেফতার এড়িয়ে আত্মগোপন করে ডাঃ করিম বিভিন্নভাবে তাদেরকে সহায়তা করেছেন। ডাঃ করিম অত্যন্ত সচেতন ছিলেন আজকের যুগে কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের নেতৃত্ব ছাড়া সাম্রাজ্যবাদ-সামন্তবাদ বিরোধী জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব সফল হবে না। এজন্যে তিনি সবসময় কমিউনিস্ট পার্টির সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখতেন। সাম্রাজ্যবাদ ও তার দালাল সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে তিনি সক্রিয় ভ‚মিকা রেখেছেন নিরবচ্ছিন্নভাবে। এ কারণেই ছাত্র আন্দোলন ’৫৪ নির্বাচনসহ সর্বত্রই ডাঃ করিমের বিচরণ ছিল। আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন, ন্যাপ গঠন, যুবলীগ গঠন সর্বত্রই তিনি ছিলেন সরব।
১৯৫৭ সালে কাগমারিতে আওয়ামী লীগের বিশেষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সময় পাকিস্তানের রাজনীতিতে সিয়েটো-সেন্টো চুক্তি এবং মার্কিন অনুগত পররাষ্ট্র নীতির বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। সমসাময়িক সময়ে কমরেড আবদুল হকের সঙ্গে তার প্রথম সাক্ষাত ও পরিচয় হয়। প্রথম পরিচয়েই তাঁদের মধ্যে গড়ে ওঠে রাজনৈতিক গভীর ঘনিষ্ঠতা। সেই ঘনিষ্ঠতার ধারাবাহিকতা তিনি কমরেড হক জীবিত থাকাকালে ও পরবর্তীতে শ্রমিক রাজনীতির সঙ্গেও সম্পৃক্ততা বজায় রেখেছেন ঐতিহাসিক কারণে।
গণমানুষের চিকিৎসা সেবায় ডাঃ এম.এ করিম অদ্বিতীয় দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী ব্যক্তিত্ব। তিনি আজীবন অত্যন্ত স্বল্পম‚ল্যে চিকিৎসা সেবা দিয়ে গিয়েছেন। শ্রমিক দিনমজুর নিম্নবিত্তদের চিকিৎসক হিসেবে তিনি ছিলেন সমধিক পরিচিত। তাছাড়া প্রগতিশীল রাজনৈতিক কর্মীসহ অন্যান্য রাজনীতিকদেরও তিনি বিনাম‚ল্যে চিকিৎসা প্রদান করেছেন। অনেক দরিদ্র রোগীদেরকে তিনি বিনা ফিতে শুধু চিকিৎসা সেবা দেননি অনেককে নিজের পকেট থেকে অর্থ দিয়ে ঔষধ এমনকি পথ্য কিনার জন্যও অর্থ দিতেন। তাঁর চিকিৎসার ব্যবস্থাপত্রও ছিল অদ্বিতীয়। কোনো বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকও তাঁর সমকক্ষ ছিল না। সস্তা এবং অল্প ঔষধ এবং সাধারণ রোগে অত্যন্ত স্বল্পম‚ল্যে প্যাথলজিও করতেন রোগীদের খরচ বাঁচাতে। যখন এদেশের ডাক্তারদের ফি একহাজার টাকার ওপর তখন ডা. এম. এ. করিমের ফি ছিল মাত্র ৫০ টাকা। তাও মূলত ছিল মধ্যবিত্তদের জন্য। নিস্নবিত্তরা ইচ্ছা করে যে ফি দিতেন সেটিই তিনি হাসিমুখে গ্রহণ করতেন। এদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থাকে তিনি সাম্রাজ্যবাদের মুনাফা লোটার বাজার হিসেবে দেখতেন। তাই তিনি গণমুখী স্বাস্থ্যনীতি হিসেবে বুঝতেন সাম্রাজ্যবাদ-সামন্তবাদ-আমলা-মুৎসুদ্দি পুঁজি তথা সকল প্রকার শোষণ-শাসনমুক্ত স্বাস্থ্য ও সমাজ ব্যবস্থাকে। আর তাই চিকিৎসা সেবার পাশাপাশি জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব প্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে এগিয়ে নেয়ার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। ’৭০-এর পর থেকে ডাঃ করিম রাজনৈতিক কারণেই চিকিৎসা পেশা সামনে রেখে তার রাজনৈতিক ভূমিকা অব্যাহত রাখেন। তাঁর সকল ভূমিকাই ছিল এদেশের সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী গণতান্ত্রিক বিপ্লবী আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রশ্নের সাথে সম্পর্কযুক্ত।
বামহঠকারী সুবিধাবাদী প্রবণতা ও তিনবিশ্ব তত্ত ইত্যাদি কেন্দ্র করে বাংলাদেশের সাম্রাজ্যবাদ সামন্তবাদ বিরোধী জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লবের প্রশ্নে যে লেজুড়বাদী রাজনীতি সামনে আসে তিনি এর মুখোশ উন্মোচনের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন। এ লক্ষ্যেই ১৯৮১ সালের ৪ এপ্রিল ডা. এম এ করিমের সম্পাদনায় গণতন্ত্রের নির্ভীক মুখপাত্র হিসেবে সাপ্তাহিক সেবা পত্রিকার আত্মপ্রকাশ ঘটে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৮৮ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকার প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেরনের মাধ্যমে ঘোষণা করা হয় জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট। জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্টের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি নির্বাচিত হন ডাঃ এম. এ. করিম। আর সাধারণ সম্পাদক হন প্রখ্যাত শ্রমিক নেতা প্রতাপ উদ্দীন আহম্মেদ। যা ছিল বাংলাদেশ সৃষ্টির পর সাম্রাজ্যবাদ সামন্তবাদ বিরোধী জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এক যুগান্তকারী ঘটনা। যার অন্যতম নায়ক হলেন ডাক্তার এম. এ. করিম। সুতরাং ডাঃ এম. এ. করিম এদেশের জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লবের ইতিহাসে বিপ্লবী গণতান্ত্রিক নেতা হিসেবে অক্ষয় হয়ে থাকবেন। এদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের যেমন পুরোধা কমরেড আবদুল হক তেমনি এদেশের বিপ্লবী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পুরোধা ডাঃ এম. এ. করিম।
গত বছর ২০২১ সালে ৪ নভেম্বর দুপুরে ঢাকায় আজগর আলী হাসপাতালে ডা.এম এ করিম শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।