আন্তর্জাতিকরাজনীতি

ম্যাঁখো-এরদোয়ানের স্বরূপ উন্মোচন করে পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলন অগ্রসর করুন

সুদীপ্ত শাহিন:  সামাজিক বৈষম্য ও ধনী-গরিবের পার্থক্যকে অমানবিক ও অযৌক্তিক আখ্যা দিয়ে রুশো তুলে ধরেছিলেন সাম্যের দাবি, “প্রকৃতির বিধান কিন্তু একেবারে নিরপেক্ষÑ প্রকৃতি কাউকে রাজা, ধনবান বা অভিজাত করে সৃষ্টি করে নি।” “গরিবদের উদরের চাইতে ধনীর উদর তো আর বড় নয়, ভৃত্যের চাইতে প্রভুর বাহু দীর্ঘতর বা অধিকতর সবল নয়; বড় লোকও সাধারণ মানুষের চাইতে অধিকতর লম্বা নন। বস্তুত সব মানুষের প্রাকৃতিক প্রয়োজন সমরূপ এবং এ প্রয়োজন মেটাবার উপকরণও সমভাবে সবার নাগালে থাকতে হবে।” ব্যক্তিগত সম্পত্তিকে সমাজ-প্রগতির প্রতিবন্ধক হিসাবে চিহ্নিত করে তিনি লিখেছিলেন, “মানুষ এবং নাগরিক মাত্রের সমাজে সম্পত্তি বলে কিছু নেই, আছে শুধু নিজের সত্তা, এছাড়া সব বিষয়-সম্পদের মালিক হয়েছে সমাজ।”
আধুনিক যুগের গোড়াপত্তনের মধ্য দিয়ে রেনেসাঁ (Renaissance) এবং এনলাইটেনমেন্ট (Enlightenment) শব্দ দুটি বেশ পরিচিত হয়ে উঠে। মধ্যযুগের ইউরোপে ছিল খ্রিষ্টান ধর্মের প্রবল প্রতাপ। মানব চিন্তার কেন্দ্রে ছিল ঈশ্বর এবং ধর্মবিশ্বাস। রেনেসাঁ কথাটার মানে নবজন্ম। যার শুরু প্রথমে ইতালি এবং পরবর্তীতে গোটা ইউরোপে। রেনেসাঁ ঈশ্বরকে সরিয়ে দিয়ে মানুষকে নিয়ে এল চিন্তা ও শিল্পকর্মের কেন্দ্রবিন্দুতে। অন্ধ বিশ্বাসের পরিবর্তে নিয়ে এল যুক্তি। এ ক্ষেত্রে লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি, বতিচেল্লি, মিকেলেঞ্জেলো, রাফায়েল প্রমুখ চিত্রশিল্পী ও ভাস্করদের ভূমিকা অনেকেরই জানা। চিন্তার জগতে নতুনধারা নিয়ে এলেন পিকো দেলা মিরানদোলা (১৪৬৩-১৪৯৪), ম্যাকিয়েভেলি (১৪৬৯-১৫২৭), টমাস মুর (১৪৭৮-১৫৩৫)। আর এনলাইটেনমেন্ট শব্দটার অর্থ আলোকায়ন, যার সাহায্যে চিন্তার নবজাগরণ বোঝায়। এর পটভূমি ছিল ফ্রান্স। ফরাসি বিপ্লবের আগে প্রায় এক শতাব্দী ধরে ফ্রান্স আলোড়িত হয়েছে পুরনো আর নতুন চিন্তার দ্বন্দ্বে। গোড়ার দিকে ছিলেন সংস্কারপন্থী অভিজাত চিন্তাবিদ বস্যুয়ে (১৬১২-১৭০৪), মঁতেস্কু (১৬৮৯-১৭৫৫); পরে বিপ্লবী ভাবধারা নিয়ে এলেন ভলতেয়ার (১৬৯৪-১৭৭৮), রুশো (১৭১২-১৭৭৮), কন্ডসেট (১৭৪৩-১৭৯৪)-এর মতো বহু দার্শনিক-চিন্তাবিদ। এসেছেন প্যাসকেল (১৬২৩-১৬৬২), বু্যঁফ (১৭০৭-১৭৮৮), ল্যাভয়সিয় (১৭৪৩-১৭৯৪)-এর মতো বিজ্ঞানসাধক। এর পরই আমরা পাই এনসাইক্লোপিডিস্ট  বা মহাকোষ-সংকলক নামে একদল চিন্তাবিদ যার মধ্যে আছেন দেনিশ দিদেরো (১৭১৩-১৭৮৪), দালেমব্যার, দোলবাশ, এলভেতিয়াস প্রমুখ। উল্লেখিত মনীষীদের প্রভাবে তখন ইউরোপব্যাপী অর্থনীতি, রাজনীতি ও দর্শনের বিকাশ ঘটতে শুরু করে। ইংল্যান্ডে বুর্জোয়া অর্থনীতির বিকাশ, জার্মানীতে দর্শনের বিকাশ এবং ফ্রান্সে আধুনিক দার্শনিকদের চিন্তার প্রভাবে রাজনীতির তীর্থভূমি তৈরি হয়। এ সমস্ত কারণে গোটা ইউরোপে সামন্তীয় ব্যবস্থা উচ্ছেদ করে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের পটভূমি তৈরি হয়। সর্বপ্রথম হল্যান্ড এবং প্রভাব বিস্তারকারী হিসেবে ১৬৪৯ সালে ইংল্যান্ডে বুর্জোয়া বিপ্লবের ধারাবাহিকতায় শিল্প বিপ্লব ঘটে অষ্টাদশ শতাব্দীতে। এর প্রভাবে ফরাসি জনগণের মধ্যেও স্বাধীনতার স্পৃহা তৈরি হয়। ১৭৭৬ সালে আমেরিকা ব্রিটেনের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার ঘোষণা করে। বহু ফরাসি এ সময় আমেরিকানদের পক্ষে লড়তে সে দেশে গিয়েছিল। তারাও দেশে ফিরে এসে স্বাধীনতার চেতনায় নির্যাতিত জনগণকে উজ্জীবিত করতে থাকে। উনবিংশ শতাব্দিতে পশ্চিম ইউরোপব্যাপী সামন্তবাদ উচ্ছেদ করে বুর্জোয়া বিপ্লব সম্পন্ন হয়।
অষ্টাদশ শতকের অন্তিমপর্বে সমাজ পরিবর্তনের উদ্বেলিত তরঙ্গ ফ্রান্সের বুকে আছড়ে পড়ে। ফ্রান্সের মানুষ রাজতন্ত্র, যাজকতন্ত্র এবং অভিজাততন্ত্র উচ্ছেদ করে আধুনিক স্যেকুলার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র এবং সমাজ গঠনের লক্ষ্যে যে সংগ্রামের সূচনা করেছিল, তাকে আধুনিক মানব সভ্যতার ঊষা বললেও অত্যুক্তি হবে না। কারণ ফরাসি বিপ্লবের অভিঘাত, তার সাম্য-মৈত্রী-স্বাধীনতার (Liberty-Equality-Fraternity) বাণী শুধু ফ্রান্সের অভ্যন্তরেই সীমাবদ্ধ ছিল না, দেশের সীমানা ছাড়িয়ে পুরো ইউরোপ এবং আমেরিকাতেও স্ফুলিঙ্গ হিসেবে ছড়িয়েছিল। রাজা চতুর্দশ লুইয়ের সময় থেকেই জনজীবনে অবক্ষয় আর অবনতি প্রকট হয়ে উঠতে থাকে। রাজা এবং তার পাইক-পেয়াদাদের অপচয় ও জনগণের প্রতি দায়হীন আচরণ বাড়তে থাকে। যাজক-অভিজাতদের শোষণ-অত্যাচারও ক্রমাগত বাড়ছিল। রাজা-রানীর বিলাসিতায় রাজকোষ শূন্য। জনগণের কাছ থেকে আরো বেশি করে খাজনা আদায়ের উদ্দেশ্যে রাজা এতা জেনেরোর অধিবেশন ডাকলেন। তখন ফ্রান্সের জনগণকে তিনভাগে ভাগ করা হত। ধর্মীয় যাজকগোষ্ঠী এবং সমাজের উপরতলার অভিজাত সম্প্রদায় হল প্রথম দুই এস্টেট। বণিক, ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক, আইনজীবী, চিকিৎসক, কারিগর এবং বিভিন্ন পেশাজীবী অর্থাৎ সাধারণ মানুষ হলেন তৃতীয় এস্টেট। এই তিন এস্টেটের প্রতিনিধি নিয়ে হল এতা জেনেরো বা এস্টেটস জেনারেল (Estates General)। ১৭৮৯ সালের ৫ মে ভার্সাই-এর এস্টেট জেনারেলের অধিবেশন বসল। প্রথা ছিল- রাজা বক্তৃতা করার সময় তৃতীয় এস্টেটের প্রতিনিধিরা হাঁটু গেড়ে বসবেন। কিন্তু এবার তা হল না। তৃতীয় এস্টেটের প্রতিনিধিরা প্রকাশ্যে অবাধ্যতা দেখালেন, তারা দাঁড়িয়ে রইলেন। রাজা আসলেন, তার সংক্ষিপ্ত বক্তৃতায় আরো টাকা দাবি করে চলে গেলেন। এদিকে বাইরে প্যারিস থেকে বিক্ষুব্ধ জনগণ এসে ভীড় করছে ভার্সাইতে। রাজার বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণের জন্য তারা চাপ দিতে থাকে তৃতীয় এস্টেটের প্রতিনিধিদের ওপর। এস্টেট জেনারেলের অধিবেশনে প্রথম দুই এস্টেটের সঙ্গে তৃতীয় এস্টেটের বিরোধ শুরু হল ভোট দেয়ার পদ্ধতি নিয়ে। নিয়ম ছিল পরিষদে প্রত্যেক এস্টেটের একটি করে ভোট থাকবে, তা সে এস্টেটের সদস্য সংখ্যা যাই হোক না কেন। তৃতীয় এস্টেটের প্রতিনিধিরা এই পুরনো নিয়ম পরিবর্তনের দাবি জানালেন। কারণ এ নিয়মের কারণে সংখ্যায় বেশি হয়েও তাদের ভোটের কোনো মূল্য থাকবে না। এ নিয়ে বেশ কয়েকদিন ধরে বিরোধ চলে। অভিজাত এবং যাজক সম্প্রদায় যখন কিছুতেই এ দাবি মানতে রাজি হল না তখন তৃতীয় এস্টেটের প্রতিনিধিরা ১৭ জুন ১৭৮৯ সালে নিজেদেরকেই জাতীয় পরিষদ বলে ঘোষণা করল। তৃতীয় এস্টেট আরো জানায়, তৃতীয় এস্টেট অর্থাৎ জাতীয় পরিষদের সিদ্ধান্তই হবে চূড়ান্ত, রাজার কোনো অধিকার নেই তা বাতিল করার বা অমান্য করার। এসময় গির্জার একজন যাজক লিখেন “তৃতীয় এস্টেট কি? কিছু না”। এর তিনদিন পর ২০ জুন বিপ্লবী জাতীয় পরিষদের সদস্যরা যে হল ঘরে মিলিত হতো, যেয়ে দেখে হল ঘরের দরজা বন্ধ। বলা হয়, ঘরের মেরামত কাজ চলছে। কিন্তু প্রকৃত সত্য তৃতীয় এস্টেটের প্রতিনিধিদের সামনে গোপন রইল না। রাজা চান না যে তৃতীয় এস্টেট বা বিপ্লবী জাতীয় পরিষদের সভা বসুক। বিপ্লবী জাতীয় পরিষদের সদস্যরা এতে না দমে গিয়ে পাশের এক টেনিস কোর্টে সভায় মিলিত হোন। তারা নিজেদের সংবিধান প্রণয়নকারী সংসদ বলে ঘোষণা করলেন এবং সংবিধান রচনা শুরু করেন। পরিস্থিতি বুঝতে পেরে রাজা চাতুর্যের সঙ্গে জানালেন যে তিনি সংবিধান রচনার কাজে বাধা দেবেন না। কিন্তু ভেতরে ভেতরে তৃতীয় এস্টেটের ওপর সশস্ত্র আক্রমণের প্রস্তুতি নিতে লাগলেন। প্রচুর সেনা মোতায়েন করা হল, প্যারিস শহরও হাজার হাজার সেনা দিয়ে ঘিরে ফেলা হল। এ খবর ছড়িয়ে পড়লে জনগণ আরো বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠল। প্রতিদিনই শহরের কেন্দ্রস্থলে শহরবাসীরা জমায়েত হচ্ছে, সেখানে চলছে রাজতন্ত্র-অভিজাততন্ত্র-যাজকতন্ত্র-বিরোধী বক্তৃতা। রাজা একদল বিদেশী সৈন্য নিয়ে এসেছিলেন প্যারিসবাসীকে দমন করার জন্য। ১২ জুলাই তারা প্যারিসবাসীর ওপর আক্রমণ চালায়। সঙ্গে সঙ্গে ঘটল বিস্ফোরণ। জনগণ প্রস্তুত নিয়েই ছিল, আক্রমণের সঙ্গে সঙ্গে শহরের ঘণ্টা বেজে উঠল। বিপ্লবী জনগণ রাষ্ট্রীয় অস্ত্রভান্ডার দখল করে নিয়ে পাল্টা আক্রমণের জন্য প্রস্তুত হল। একটি ফরাসি গার্ড রেজিমেন্ট জনগণের পক্ষে অবস্থান নিল। ১৪ জুলাইকে বলা হয় ফরাসি বিপ্লবের সূচনা পর্ব। বাস্তিল দুর্গ থেকে জনগণের ওপর কামান দাগা হবে চারিদিকে এমন সংবাদ প্রচারিত হয়। এই বাস্তিল দুর্গটি ছিল একদিকে অস্ত্রের ভান্ডার, অন্যদিকে রাজার কারাগার। রাজবিদ্রোহের অপরাধে সেখানে আটকে রাখা হত সাধারণ মানুষকে। বলা হত যে একবার বাস্তিলের ভেতরে আটক হয়েছে সে আর জীবিত বের হতে পারে না। জনতা ছুটল বাস্তিল দুর্গের দিকে। কারাগার ভেঙে জনতা মুক্ত করে দিল বন্দিদের। দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ল বিপ্লবী জনতার বিজয়বার্তা। কথিত আছে যে বাস্তিল পতনের খবর শুনে রাজা আঁতকে উঠে বলেছিলেন, ‘কি বলছ, এ-যে বিদ্রোহ!’ উত্তরদাতা বলেছিলেন, ‘এটা বিদ্রোহ নয়, বিপ্লব।’ ফরাসি বিপ্লবের সূচনা ১৪ জুলাই ১৭৮৯ ধরা হলেও তা ধাপে ধাপে নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে এগিয়েছে। বাস্তিলের পতন, সাংবিধানিক রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, মানবাধিকারের ঘোষণা ইত্যাদি ধাপ পেরিয়ে বিপ্লব এগিয়ে গেল প্রজাতন্ত্র ঘোষণার স্তরে। ১৭৯১ সালের ১০ আগস্ট প্যারিসের সংগ্রামী জনতা রাজপ্রাসাদ আক্রমণ করে রাজপ্রাসাদ দখল করে নেয়। বিপদ টের পেয়ে রাজা-রাণী আগেই পালিয়ে গিয়েছিল। ফ্রান্স থেকে পালিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে তারা সীমান্তের দিকে যাওয়ার পথে ধরা পড়ে। বন্দি রাজা বাধ্য হলো সংবিধানকে স্বীকৃতি দিতে। এর মধ্য দিয়ে রাজতন্ত্রের সম্পূর্ণ উচ্ছেদ ঘটে, স্থাপিত হয় ফ্রান্স প্রজাতন্ত্র।
ফরাসি বিপ্লবে যে শোষণমুক্তির চেতনা মার খেয়েছিল তাকে বিজ্ঞানসম্মত ও ইতিহাসসম্মতভাবে প্রণালীবদ্ধ করে মহান কার্ল মার্কস এবং তাঁর অকৃত্রিম বন্ধু ফ্রেডরিখ এঙ্গেলসের সহযোগিতায় দাঁড় করালেন এ যুগের বিপ্লবী তত্ত্ব, যাকে বলা হয় মার্কসবাদ বা দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ। কার্ল মার্কস দেখালেন, যে পর্যন্ত সম্পত্তির ওপর ব্যক্তিমালিকানা উচ্ছেদ হয়ে সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠিত না হবে সে পর্যন্ত সামাজিক সাম্য বা ব্যক্তির স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। তাঁদের ওই চিন্তা ফ্রান্সের বুকে নতুন ঢেউ তুলেছিল। ফরাসি সমাজের ক্রমবর্ধমান শোষণমুক্তির চেতনা সদ্য গড়ে ওঠা মার্কসবাদী চিন্তাকে অবলম্বন করে পরিণতি পেয়েছিল ১৮৭১ সালে প্যারিসের মাটিতে প্যারি কমিউনে। মাত্র ৭২ দিনের সংক্ষিপ্ত অথচ বিশ্বের প্রথম শ্রমিকশ্রেণির রাষ্ট্রব্যবস্থায়। এর প্রায় অর্ধশতাব্দী পরে মার্কসবাদকে ভিত্তি করে শ্রেণিহীন শোষণমুক্ত সমাজের আকাক্সক্ষা নিয়ে রাশিয়ার মাটিতে বিপ্লব করেছেন কমরেড লেনিন এবং রাশিয়ার শ্রমিকশ্রেণি। প্যারি কমিউন টিকে নি, কিন্তু বুর্জোয়াদের উচ্ছেদ করে শ্রমিক শ্রেণি কিভাবে রাষ্ট্র পরিচালনা করতে পারে তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে বিশ^ শ্রমিক শ্রেণির কাছে অণুপ্রেরণা তৈরি করার ক্ষেত্রে গভীর প্রভাব ফেলে। (১) কোন প্রকার স্থায়ী সেনাবাহিনী থাকবে না বরং সাধারণ জনগণের দ্বারাই তৈরী হবে সশস্ত্র বাহিনী। (২) একজন দক্ষ শ্রমিকের চেয়ে কোনো অবস্থাতেই কোনো সরকারি কর্মকর্তা বেশি বেতন পাবেন না। ‘রাষ্ট্রের বড় চাকুরেদের সংগে সংগে তাদের সমস্ত বিশেষ সুবিধা ও প্রতিনিধিত্ব ভাতাও দূর’ করা। ‘রাষ্ট্রের সমস্ত পদাধিকারীর বেতন হবে মজুরের বেতনের সমান’। (৩) সরকারে সকল স্তরের কর্মকর্তাগণ অবশ্যই জনগণের দ্বারা নির্বাচিত হবেন এবং প্রয়োজনে তাদেরকে অপসারণের অধিকারও থাকবে। ‘কমিউন গঠিত হবে প্যারিসের বিভিন্ন পল্লীতে সর্বজনীন ভোটে নির্বাচিত পৌর পরিষদ সভ্যদের নিয়ে। তারা থাকবে জবাবদিহিতে বাধ্য এবং যে কোনো সময়ে অপসারণীয়। স্বভাবতই তাদের অধিকাংশই ছিল শ্রমিক, অথবা শ্রমিক শ্রেণির স্বীকৃত প্রতিনিধি। (৪) নির্ধারিত সময়ান্তে প্রত্যেক ব্যক্তিই অর্থনীতি ও রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে পরিচালনার কাজে অংশগ্রহণ করবেন। ইতিহাসের সর্বপ্রথম প্রতিষ্ঠিত শ্রমিক রাষ্ট্র প্যারিসে কমিউন প্রতিষ্ঠায় এরকম প্রধান চারটি র্শত ছিল। লেনিনের কথায়, ‘যদি প্রত্যেকেই আমলা হয়ে যান, তবে আর কেহই আমলা থাকবেন না’। অথচ ফ্রান্সের বুর্জোয়ারা পৈশাচিকভাবে হামলা করে পৃথিবীর প্রথম শ্রমিক রাষ্ট্রটি দমন করে। ১৮৭১ সালের ২১মে তিয়োরের প্রতিবিপ্লবী সৈন্য প্যারিসে প্রবেশ করে ও প্যারিসে শ্রমিকদের ওপর নিষ্ঠুর দমননীতি চালায়। প্রায় ৩০,০০০ জন নিহত, ৫০,০০০ জন ধৃত ও হাজার হাজার লোক কারাদন্ডিত হয়। বুর্জোয়া সেনাপতিবৃন্দের ঘোষিত নীতি ছিল ‘কোনো দয়ামায়া দেখানো চলবে না’। কমিউনার্ড বা কমিউনের সেনানীদের দমন করতে তারা যে ভয়াবহ অত্যাচার ও বর্বরতার পরিচয় দিয়েছিল তা বর্ণনাতীত। যত্রতত্র গুলি করে, বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে, আগুন দিয়ে ইত্যকার উপায়ে ভার্সাই সেনারা হত্যা করে সাধারণ মানুষদের। এমনকি এই গণহত্যা থেকে নারী, শিশু, বৃদ্ধরাও ছাড় পায়নি।
বিংশ শতাব্দীতে বিশ^ পুঁজিবাদ সাম্রাজ্যবাদী যুগে প্রবেশ করে। সাম্রাজ্যবাদীদের চরিত্রের বৈশিষ্ট্য হল যুদ্ধ ও পররাজ্য গ্রাস। যেহেতু ব্রিটিশরা ছিল সেই সময়ে সর্বাধিক সংখ্যক উপনিবেশের মালিক তাই সাম্রাজ্যবাদী ফ্রান্সও হয়ে উঠে বিশ্বজুড়ে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের প্রতিদ্বন্দ্বী এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্য দিয়ে বেশ কিছু উপনিবেশ গড়ে তুলতে সক্ষম হয়। কিন্তু বিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকেই পুঁজিবাদী অর্থনীতির সাধারণ সংকট দেখা দেয়ায় প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সূচনা হয় এবং বিশ্বযুদ্ধের প্রায় পুরোটাই ফ্রান্সের মাটিতে সংঘটিত হয়। এর ফলে দেশটির ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। আবার এই শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে পুঁজিবাদী অর্থনীতির ২য় সাধারণ সংকট দেখা দিলে ২য় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা হয়। এ সময় জার্মানি উত্তর ফ্রান্স দখল করলে মধ্য ফ্রান্সের ভিশিতে (Vichy) একটি অস্থায়ী সরকার গঠন করা হয়। ২য় বিশ্বযুদ্ধের পর ফ্রান্স তার ধূলিস্যাৎ অর্থনীতিকে আবার গড়ে তোলার চেষ্টা করে। বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে ফ্রান্সের উপনিবেশগুলিতে সাম্রাজ্যবিরোধী আন্দোলন জেগে ওঠে এবং এর ফলে ফ্রান্স তার বেশির ভাগ উপনিবেশ হারায়। ১৯৫৮ সালে আলজেরিয়ায় ফরাসি বিরোধী আন্দোলন ফ্রান্সকে গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দিচ্ছিল। এ সময় ফরাসি বুর্জোয়ারা ২য় বিশ্বযুদ্ধকার ফরাসি নেতা চার্লস দ্য-গল’কে (Charles de Gaulle) একনায়কের ক্ষমতা দান করে। যার মধ্য দিয়ে ফ্রান্স ইউরোপের অন্যতম শক্তিতে পরিণত হয়। পরবর্তীতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন গড়ে উঠলে ফ্রান্স জার্মানির সাথে একত্রে মিলে ইউরোপীয় ইউনিয়নের অর্থনীতি ও রাজনীতিতে সমন্বিত ভূমিকা রেখে চলে। কিন্তু যুক্তরাজ্য ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বের হয়ে যাওয়া এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিভিন্ন ইস্যুতে আন্তঃসাম্রাজ্যবাদী দ্বন্দ্ব তৈরি হওয়ায় ইউরোপীয় ইউনিয়ন সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কিছু অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করছে। ইউরোপ এখন তিনটি বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। এর প্রথমটি হচ্ছে ব্রেক্সিট, যেটা গত কয়েক প্রজন্মের মধ্যে ব্রিটিশ রাজনীতির সবচেয়ে বড় ঘটনা। ইউরোপের দ্বিতীয় বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে দুর্বল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও প্রতিযোগিতা। ইউরোপীয় অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি যুক্তরাষ্ট্র ও অধিকাংশ এশীয় দেশের তুলনায় কম। একই সঙ্গে তার জ্বালানি ও শ্রমের খরচ এশিয়ার তুলনায় দ্বিগুণ। ফলে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর বাজারের নিয়ন্ত্রণ শিথিল করা এবং শিল্পকে আরও প্রতিযোগিতামূলক করার চ্যালেঞ্জ রয়েছে। ইউরোপের তৃতীয় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে সামাজিক অসমতা। স্পেন, পর্তুগাল ও গ্রিসের এক-চতুর্থাংশ তরুণ বেকার।
আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ওয়াশিংটনের সঙ্গে নিরাপদ দূরত্ব তৈরিতে ইউরোপের দেশগুলো একদিকে যেমন চীনের সঙ্গে কৌশলগত এবং অর্থনৈতিক অংশিদারিত্বের বিস্তৃৃত পরিসরে যুক্ত হচ্ছে, অপরদিকে অন্যান্য দেশের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের মাধ্যমে তারা বিশ্বের সুপার পাওয়ার হিসেবে পরিচিত যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নিজেদের নির্ভরশীলতা কমিয়ে আনছে। বিগত বছরগুলোতে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ইস্যুতে ট্রাম্পের কৌশলগত অবস্থানের কারণে অনেক ক্ষেত্রেই যুক্তরাষ্ট্রের সাথে দ্বন্দ্ব তৈরি হয় ইউরোপের। প্যারিস জলবায়ু চুক্তি, ইরানের সঙ্গে পারমাণবিক চুক্তি এবং ফাইভ-জি বিষয়ে ট্রাম্পের অবস্থানের কারণে ইউরোপ তাদের পুরাতন মিত্র চীনের পক্ষে নিজেদের দাঁড় করাতে হয়েছে। অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপকে সাথে নিয়ে ইসলামী সন্ত্রাস মোকাবেলার নামে মধ্যপ্রাচ্যে ও ভূমধ্য উপসাগরীয় অঞ্চলে যে যুদ্ধ কৌশল গ্রহণ করেছিল, সম্প্রতি তা পরিবর্তন করে তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী চীনের বিরুদ্ধে ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল (আইপিএস) বাস্তবায়নে জাপান-অস্ট্রেলিয়া-ভারত-যুক্তরাষ্ট্র মিলে কোয়াড গঠন করে অগ্রসর হচ্ছে। ফলে ইউরোপের সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর জোট হিসেবে ইউরোপীয় ইউনিয়নকে নিজস্ব শক্তির উপর দাঁড়িয়ে নিজেদের সুসংহত করে আন্তঃসাম্রাজ্যবাদী দ্বন্দ্বের প্রক্রিয়ায় অগ্রসর হতে হচ্ছে।
এমন পরিস্থিতিতে প্যারিসে এক ফরাসি স্কুলশিক্ষক এবং এক চেচেন পরিচয়ধারী যুবকের লাশ পাওয়া যায়। ফরাসি পুলিশ বলছে, স্কুলশিক্ষককে গলা কেটে হত্যা করেছে ওই চেচেন যুবক। চেচেন যুবককে সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ গুলি করে হত্যা করায় তার ভাষ্য আর পাওয়ার উপায় নেই। খেয়াল করার বিষয় যে আমেরিকার টুইন টাওয়ার, ফ্রান্সে ২০১৫ সালে ট্রাক চাপিয়ে হত্যা, শার্লি এবদো অ্যাটাক এবং এবারের শিক্ষক হত্যা সবগুলোতেই হামলাকারীরা ঘটনাস্থলেই পুলিশের গুলিতে নিহত হন। ফলে তাদের জবানবন্দি পাওয়ার সুযোগ নেই। চেচেন যুবকটি মুসলিম। আর স্যমুয়েল প্যাটি নামের ওই স্কুলশিক্ষক অবাধ বাক্-স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। চেচেন যুবক ফরাসি ওই স্কুলশিক্ষকের হত্যাকারী হিসেবে ফরাসি গণমাধ্যমে আসলেও এটাকে ব্যক্তির হত্যাকান্ডের ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে না প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ এটাকে মুসলমানদের অপরাধ হিসেবে ঘোষণা করেছে। এ ঘটনায় ফরাসি সমাজে তুমুল আলোড়ন জেগেছে।
প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাঁখো নিহত শিক্ষককে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সম্মানে ভূষিত করেছেন এবং ‘ইসলামি বিচ্ছিন্নতাবাদ’ (Islamic separatism)এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। এমনকি সংসদে ‘ইসলামি বিচ্ছিন্নতাবাদ’ বিরোধী নতুন আইনের বিল এনেছেন এবং ফরাসি ‘ইসলামের’ সংস্কারের প্রতিজ্ঞা জানিয়েছেন।
ফ্রান্সের রাজনীতিতে এমানুয়েল ম্যাঁখো’র রাজনৈতিক অবস্থানের ক্ষেত্রে দেখা যায় গত সেপ্টেম্বর মাসে ফ্রান্সের একটি নির্ভরশীল প্রতিষ্ঠান আইপিএসওএস’র জাতীয়ভাবে চালানো একটি জরিপে ৭৮ ভাগ ফরাসি মনে করে প্রেসিডেন্ট ম্যাঁখোর আমলে ফ্রান্স পতনের দিকে ধাবিত হচ্ছে। এর মধ্যে ২৭ ভাগ এতই হতাশ যে তারা মনে করে, এই অধঃপতন আর ঠেকানো যাবে না। আগামী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আর বেশি দিন নেই। এই সময়ের মধ্যে প্রেসিডেন্ট ম্যাঁখো’র এই অবস্থান নিশ্চয়ই নির্বাচনের ক্ষেত্রে ইমেজ সংকট তৈরি করবে। ম্যাঁখো সরকার তিনটি গুরুতর জায়গায় শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ। করোনা মহামারী মোকাবিলা, (প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের মতোই তাঁর সরকার মাস্ক পরা জরুরি নয় বলে অপরাধমূলক অবহেলার দায়ে অভিযুক্ত), ম্যাঁখোর ভুল অর্থনৈতিক নীতির জন্য ফরাসি অর্থনীতির ঐতিহাসিক মন্দা এবং ট্রাম্পের মতোই ফরাসি সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে দুর্বল করে ধনিক শ্রেণির স্বার্থরক্ষা। এসবের পরিণতি হলো প্রেসিডেন্টের জনপ্রিয়তার ধস এবং জনগণের বিক্ষোভ। মুসলমানরা ফ্রান্সের মূল সংখ্যালঘু ধর্মীয় জনগোষ্ঠী। জনসংখ্যায় তারা প্রায় ৭০ লাখ এবং শতকরা হিসাবে জনগণের সাড়ে ৭ শতাংশ। এরা মূলত ফ্রান্সের সাবেক উপনিবেশ আলজেরিয়া, মরক্কো ইত্যাদি উত্তর আফ্রিকীয় দেশ থেকে আসা। ঔপনিবেশিক আমলে একসময় ফরাসি ভূখন্ডে এসে পৌঁছানো আলজেরীয়দের ফ্রান্সের নাগরিক হিসবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল। এই মুসলিম জনগোষ্ঠীর বড় অংশ তারাই। ফ্রান্স যদি তাদের দেশ লুণ্ঠন না করত, তাহলে তাদের ফ্রান্সে আসার প্রয়োজন হতো না। তা ছাড়া শ্রমশক্তির ঘাটতি মেটাতে ফ্রান্সেরও তাদের দরকার ছিল। ফরাসি মুসলমানদের বড় অংশই আজ দরিদ্র বস্তিবাসী, তাদের ৩০ শতাংশই বেকার। ফ্রান্সের জনগণের বিক্ষোভে মুসলমানদের এই দরিদ্র ও বেকার জনগণও অংশীদার। এমন অবস্থায় ফ্রান্সের একচেটিয়া পুঁজির স্বার্থে জনগণের ক্রমবর্ধমান বিক্ষোভকে মোকাবেলা করার জন্য এবং অর্থনৈতিক সংকট থেকে উত্তরণের জন্য জনগণের ক্ষোভকে ভিন্ন দিকে প্রবাহিত করতে জনগণের মধ্যে বিভ্রান্তি, বিভক্তি তৈরি করে উগ্রজাতীয়তাবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়াচ্ছে। বলা বাহুল্য, ফ্রান্সে এখনো অনেকগুলো নাগরিক অধিকার সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের অজুহাতে স্থগিত রাখা হয়েছে। এ থেকে বোঝা যায় জঙ্গি হামলাকারীরা যে উদ্দেশ্যেই কাজ করুক, শেষ পর্যন্ত তাদের ঘোষিত শত্রুদের পক্ষেই তারা অঘোষিতভাবে কাজ করে। কারণ তাতে লাভবান হয় পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী শক্তি।
অন্যদিকে তুর্কিদের প্রাচীন ইতিহাস পুরোপুরিভাবে ইতিহাসের আলোয় উজ্জ্বল নয়। তবে চৈনিক সূত্র থেকে জানা যায়, চীন সাম্রাজ্যের প্রান্তদেশে এক বৃহৎ যাযাবর গোষ্ঠী বসবাস করত। এদের মধ্যে মঙ্গোল ও তুর্কি জাতির লোক ছিল বলে অনুমান করা হয়। এসব দলের মাঝে নিরন্তর অন্তর্দ্বন্দ্ব লেগে ছিল এবং ষষ্ঠ শতকে এ ধরনের যুদ্ধবিগ্রহের মধ্যে তুর্কি নামক দলের সন্ধান পাওয়া যায়। চৈনিক ঐতিহাসিকরা এদের ‘তু-কিউ’ নামে অভিহিত করেছেন।
সপ্তম শতকে আরবদের ইরান বিজয়ের পর কিছু কিছু তুর্কি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে এবং ইসলামি রাজ্যে বসবাস শুরু করে। নবম ও দশম শতকে এই যুদ্ধপ্রিয় তুর্কিদের অনেকে সৈন্য বিভাগে ও শাসনযন্ত্রের অন্যান্য বিভাগে প্রবেশ করতে শুরু করে। দশম শতকে তুর্কিদের বেশির ভাগই ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। এদের মধ্যে সেলজুক তুর্কিরা উল্লেখযোগ্য। ১২৪৩ সালে সেলজুকরা মঙ্গোলদের কাছে পরাজিত হয়। এতে তুর্কি সুলতানদের ক্ষমতা সীমিত হয়ে পড়ে। পরে প্রথম ওসমান ওসমানীয় সাম্রাজ্যের সূচনা করেন। তার বংশধররা পরবর্তী ৬০০ বছর শাসন করে। এ সময় তারা তুরস্কে পূর্ব ও পশ্চিমা সংস্কৃতির সমন্বয় ঘটালে ১৬ ও ১৭ শতকে তুরস্ক বিশ্বের বৃহৎ দেশগুলোর একটিতে পরিণত হয়। ১৯১৪ সালে তুরস্ক অক্ষশক্তির পক্ষে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেয় এবং পরাজিত হয়। মূলত নিজের ভৌগোলিক অখ-তা রক্ষার জন্যই তুরস্ক এ যুদ্ধে অংশ নেয়। এ সময় চারটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্রন্টে তুর্কি বাহিনী নিয়োজিত ছিল। ফ্রন্ট চারটি হলো- দার্দানেলিস, সিনাই-প্যালেস্টাইন, মেসোপটেমিয়া ও পূর্ব আনাতোলিয়া। যুদ্ধের শেষের দিকে প্রতিটি ফ্রন্টেই তুর্কি বাহিনী পরাজিত হয়। তুর্কি বাহিনীর মধ্যে এ সময় হতাশা দেখা দেয়। প্রতিটি ফ্রন্টে পর্যুদস্ত তুরস্কের পক্ষে যুদ্ধবিরতি গ্রহণ করা ছাড়া অন্য কোনো উপায় ছিল না। ১৯১৮ সালের অক্টোবর মাসের ৩১ তারিখে তুর্কি ও ব্রিটিশ প্রতিনিধিরা লেমনস দ্বীপের সমুদ্র বন্দরে অবস্থিত ব্রিটিশ নৌবাহিনীর ‘আগামে মনন’ জাহাজে যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে স্বাক্ষর করে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পরাজয়ের পর অটোমান সাম্রাজ্যের পতন ঘটে। খন্ড-বিখন্ড হয়ে পড়ে তুরস্ক। খন্ডিত তুরস্কের মূল ভূ-খন্ডেই পরে গড়ে ওঠে আধুনিক তুরস্ক। এর পত্তন করেন মোস্তফা কামাল আতাতুর্ক। একই সাথে মুসলিম বিশ্ব থেকে বিলুপ্তি ঘটে খিলাফত ব্যবস্থার। কামাল আতাতুর্ক ক্ষমতা গ্রহণের পর তুরস্ককে একটি আধুনিক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে ব্যাপক সংস্কার কর্মসূচি হাতে নেন। যার অনেক পদক্ষেপই ছিল তুরস্কের ইসলামী চেতনার বিরোধী। তার পরও সংস্কার ছিল অপরিহার্য। এভাবে ১৯২৩ সালে তুরস্ককে একটি প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করা হয়। ১৯৪৫ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি দেশটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যোগ দেয়। যুদ্ধের পর দেশটি জাতিসঙ্ঘ ও ন্যাটোতেও যোগ দেয়। এ সময় থেকে তুরস্কে বহুদলীয় রাজনীতির প্রবর্তন হয়। ১৯৬০ থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত দেশটিতে রাজনৈতিক অস্থিরতা বিরাজ করে। ভূমধ্য উপসাগরীয় দেশ হওয়ায় ইউরোপ-যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার আন্তঃসাম্রাজ্যবাদী দ্বন্দ্বের প্রভাব পড়ে তুরস্কে। ফলে ১৯৬০, ১৯৭১ ও ১৯৮০ সালে তুরস্কে সামরিক অভ্যুত্থান হতে দেখা যায়। সর্বশেষ সামরিক অভ্যুত্থান ঘটে ১৯৯৭ সালে। যা পরে আবার সংসদীয় ব্যবস্থায় ফিরে আসে। কিন্তু ২০১৩ তে গাজি পার্কের বিক্ষোভ ও ২০১৫তে সুরুক বোমা হামলা পুনরায় অস্থিরতার জন্ম দেয়। সর্বশেষ ২০১৬ সালে রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের বিরুদ্ধে এক সামরিক অভ্যুত্থান ঘটানোর চেষ্টা করা হয়। তবে রাশিয়ার ভূমিকার কারণে শেষ পর্যন্ত তা ব্যাপক প্রতিরোধের মুখে ব্যর্থ হয়। ২০১৯ সালে এরদোয়ানের নেতৃত্বে ইসলামপন্থী দল জাস্টিস এন্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি বা একেপি সারা দেশের স্থানীয় নির্বাচনগুলোতে স্বৈরতান্ত্রিক উপায়ে জয়লাভ করে। যদিও বড় তিনটি শহর- ইস্তাম্বুল, রাজধানী আঙ্কারা এবং ইজমিরে তার দল পরাজিত হয়। সরকারি কর্মকর্তা, মন্ত্রী ও ভাইস প্রেসিডেন্ট সরাসরি নিয়োগের ক্ষমতা, দেশটির বিচার ব্যবস্থায় হস্তক্ষেপের ক্ষমতা, জরুরি অবস্থা জারি করার ক্ষমতা গ্রহণের মাধ্যমে তুরস্কে এরদোয়ান একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী হয়ে উঠে। একই সাথে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে তার বিরোধীদের ওপর দমন-পীড়নও আরো জোরালো ভাবে শুরু হয়।
এ অবস্থায় তুরস্ক এবং রাশিয়া এখন তাদের কৌশলগত সম্পর্ককে আরো জোরদার করছে। তুরস্ক-যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের অবনতি ঘটার পরিপ্রেক্ষিতে মস্কো-আঙ্কারা সম্পর্কের উন্নতি হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্কের অবনতি রাশিয়ার সাথে সম্পর্কোন্নয়নে ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। যুক্তরাষ্ট্র-তুরস্কের দাবি অনুযায়ী ফতুল্লাহ গুলেনকে তুরস্কে প্রেরণে অস্বীকৃতি জানানোর কারণে এবং মার্কিন ধর্মযাজক অ্যান্ড্রো ব্রনসেনকে কারারুদ্ধ করার পরিপ্রেক্ষিতে দু’দেশের সম্পর্কের অবনতি ঘটে এবং যুক্তরাষ্ট্র-তুরস্কের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করলে তুর্কি অর্থনীতিতে তার বিরূপ প্রভাব পড়ে। তুরস্কের জ্বালানি ও প্রতিরক্ষা খাতে রাশিয়ার কৌশলগত সমর্থন এবং সিরিয়ার ইদলিবে একটি অসামরিক অঞ্চল গড়ে তুলতে দু’দেশের যৌথ সিদ্ধান্ত এসব কিছু মস্কোকে আঙ্কারার একটি লাভজনক অংশীদারে পরিণত করেছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এরদোয়ান ও পুতিনের মধ্যে প্রায়ই বৈঠক হয়েছে। এতে এটা স্পষ্ট হয়েছে, রাশিয়া যুক্তরাষ্ট্র-ইইউ থেকে দূরে সরে গিয়ে তুরস্কের সাথে সম্পর্ক আরো সুদৃঢ় করেছে। এর মধ্যে পূর্ব ভূমধ্যসাগরে সম্প্রতি গ্যাসের বিশাল ভান্ডারের খোঁজ পাওয়া প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের ভূ-রাজনৈতিক এজেন্ডার গুরুত্ব বৃদ্ধি করেছে। রাশিয়া-তুরস্কের পূর্ব ভূমধ্যসাগরে সাইপ্রাস দ্বীপ থেকে লিবিয়া পর্যন্ত বিশাল অঞ্চল জুড়ে তৎপরতার বিরুদ্ধে তাই ইউরোপীয় সরকারগুলো বিভিন্ন তৎপরতা গ্রহণ করছে। তুরস্ক সরকার একদিকে পূর্ব ভূমধ্যসাগর এলাকায় তেল ও গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলন কর্মসূচি জোরদারের মাধ্যমে এই এলাকার নিজের প্রভাব ধরে রাখার চেষ্টা করছে এবং অন্যদিকে লিবিয়ায় ফাইজ আল সেরাজের নেতৃত্বে ন্যাশনাল ওয়াফাক সরকারের সঙ্গে দুটি চুক্তি সই করে আঙ্কারা নজিরবিহীনভাবে লিবিয়ায় তাদের উপস্থিতি বজায় রাখার চেষ্টা করছে। এ প্রেক্ষিতে ইইউ’র নেতা হিসেবে ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাঁখোর বক্তব্য হচ্ছে- ইউরোপীয় ইউনিয়ন যদি তুরস্কের এসব পদক্ষেপের ব্যাপারে উপযুক্ত জবাব না দেয় তাহলে ইইউ’র অনেক বড় ভুল হবে। কিন্তু প্যারিস আঙ্কারাকে এ সুযোগ কখনোই দেবে না।
পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর উল্লেখিত আন্তঃসাম্রাজ্যবাদী দ্বন্দ্বের বলি হচ্ছে শ্রমিক-জনগণের বিক্ষোভ ও আন্দোলন-সংগ্রাম। সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ফ্রান্স ও তার প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাঁখো যেমন ইসলামী সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে উগ্রজাতীয়তাবাদ স্লোগান তুলে তার নেতৃত্ব ধরে রাখা ও শ্রমিক-জনগণের আন্দোলনকে ভিন্ন দিকে প্রবাহিত করতে চাচ্ছে, তেমনি মুসলিম মূল্যবোধের পক্ষে সরাসরি বক্তব্য দিয়ে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান মুসলিম বিশ্বের কাছে জনপ্রিয়তা তৈরি করে স্বীয় অবস্থান সুসংহত করতে চাইছে। ফ্রান্স ও তুরস্ক উভয়েই ধর্মীয় ও জাতিগত উস্কানি দিয়ে বিশ্বের জনগণকে বিভ্রান্ত, বিভক্ত করে পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে চলমান আন্দোলনের গতিপথ পরিবর্তন করতে চাইছে। তাই বিশ্বব্যাপী আন্তঃসাম্রাজ্যবাদী দ্বন্দ্বে জনগণের উপর মুদ্রাযুদ্ধ, বাণিজ্য যুদ্ধ, স্থানিক যুদ্ধ ও আঞ্চলিক যুদ্ধ চাপিয়ে দেওয়ায় সাম্রাজ্যবাদীদের সাথে নিপীড়িত জাতি ও জনগণের দ্বন্দ্ব যে প্রকট রূপ ধারণ করছে বিশ্বের নিপীড়িত জাতি ও জনগণকে এ ব্যাপারে সজাগ, সচেতন থেকে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলন অগ্রসর করতে হবে।
(সূত্র: সাপ্তাহিক সেবা ॥ ৪০ বর্ষ ॥ সংখ্যা- ০৬ ॥ বুধবার ॥ ০৭ পৌষ ১৪২৭ ॥ ২৩ ডিসেম্বর ২০২০)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *