জন্ম নিবন্ধনের আওতায় না থাকায় যৌনকর্মীদের শিশুরা শিক্ষা থেকে বঞ্চিত
বাবলী আকন্দ: জন্ম নিবন্ধনের আওতায় না থাকায় যৌনকর্মীদের শিশুরা শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। বিশেষ ব্যবস্থাপনায় তাদের জন্ম নিবন্ধন করার ব্যবস্থা গ্রহনের দাবী উঠেছে। জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন আইন বাধ্যতামূলক করা হলেও নানা জটিলতায় নিবন্ধনের আওতায় আসছে না সমাজে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠির একাংশ যৌনকর্মি ও তাদের সন্তানরা। তথ্যগত ,ব্যক্তিগত ও সামাজিক পর্যায়ে বাধা থাকায় নিবন্ধনের আওতায় আসতে তাদের অনাগ্রহ সৃষ্টি হচ্ছে। ফলে নানাবিধ সুযোগ সুবিধা থেকে সমাজের একটা অংশ এসব যৌনকর্মি ও তাদের সন্তানরা পিছিয়ে পড়ছে। যৌনকর্মীদের সন্তানদের জন্ম নিবন্ধনের ক্ষেত্রে জটিলতা তৈরি হওয়ায় প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে এসব শিশু। পুরাতন বছর শেষে বিভিন্ন বিদ্যালয়ে ভর্তি প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে কিন্তু এসকল শিশু জন্ম নিবন্ধনের জটিলতায় পড়ে বিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ময়মনসিংহের যৌনপল্লিতে ও তৎসংলগ্ন এলাকায় বসবাসরত যৌনকর্মীদের এমন ৪৯ জন শিশুসহ তাদের মায়েদের জন্ম নিবন্ধন না থাকা, সংশ্লিষ্ট এলাকার নাগরিক ও চারিত্রিক সনদ না পাওয়াসহ জাতীয় পরিচয়পত্র না থাকায় জটিলতা তৈরি হয়েছে। বয়স প্রমাণের ক্ষেত্রে শিশুদের টিকা কার্ড না থাকা, পিতৃপরিচয় অজানা,শিশুর ভবিষতের কথা চিন্তা করে জন্মস্থানের নাম ব্যবহার না করতে চাওয়ায় আটকে আছে জন্ম নিবন্ধন প্রক্রিয়া। চিত্রটি শুধু ময়মনসিংহেই নয় দেশের অন্যান্য স্থানেও প্রায় একই ধরনের জটিলতায় পড়তে হচ্ছে যৌনকর্মী ও তাদের সন্তানদের।
যৌনকর্মী শাহিদা(ছদ্মনাম) এ প্রতিবেদককে জানান,আমি যে পেশায় থাকি না কেন,আমি চাই আমার সন্তান যেন ভালো থাকে। সামাজিকভাবে তাকে যেন কেউ হেয় না করে। জন্ম নিবন্ধনে বিভিন্ন তথ্য দিতে হয় যেমন বাবার নাম, ঠিকানা, মোবাইল নাম্বার। এগুলো আমরা কিভাবে দেবো। তাছাড়া আমাদের প্রত্যয়নই বা কে করবে!
যৌনকর্মী রিমা (ছদ্মনাম) জানায়,নিবন্ধন করতে গেলে টাকা লাগে। আমরা নিজেরাই অনেক কষ্ট করে চলি। খদ্দের পেলে পেটে ভাত জুটে নইলে না। সেখানে টাকা দিয়ে নিবন্ধন করবো কিভাবে! তাছাড়া জন্ম নিবন্ধনে আমাদেরকে যৌনকর্মীর ঠিকানা দেখালে আমাদের সন্তানদের উপর এর প্রভাব পড়বে।
ময়মনসিংহ সিটি কর্পোরেশন অঞ্চল ২ এর জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন সহকারী রাকিবুজ্জামান বলেন,২০০১ সালের পরে যারা জন্মগ্রহন করেছে তাদের সন্তানদের জন্ম নিবন্ধন করার ক্ষেত্রে তাদের পিতামাতার জন্ম নিবন্ধন আবশ্যক। এক্ষেত্রে ময়মনসিংহ যৌনপল্লীতে অনেক যৌনকর্মীর জন্ম নিবন্ধন নেই আবার অনেক শিশুদের টিকা কার্ড নেই। ফলে জন্ম নিবন্ধন প্রক্রিয়ায় সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে তবে ঊর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা পেলে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে।
শাপলা মহিলা সংস্থার (এসএমএস) ময়মনসিংহ এর প্রোগাম অফিসার শিবু পদ সরকার জানান, আমরা যৌনকর্মীদের সন্তানদের জন্ম নিবন্ধনের আওতায় আনতে চাই। এক্ষেত্রে ময়মনসিংহ সমাজসেবা অফিস ও ময়মনসিংহ সিটি কর্পোরেশন সহযোগিতা করছে। ইতিমধ্যে প্রায় ৪৯ জন শিশু ও ১৮ জন মায়েদের তালিকা করা হয়েছে যাদের এ সেবাপ্রাপ্তি প্রক্রিয়াধীন আছে। তবে শিশুদের বয়স প্রমাণক না থাকায় প্রক্রিয়াটি শ্লথ হচ্ছে। এ সময় তিনি বেশ কয়েকটি প্রস্তাবনা তুলে ধরে বলেন,জন্ম নিবন্ধন ফি এবং বিলম্ব ফি মওকুফ করা,প্রশিক্ষিত সরকারের জনবল বৃদ্ধি করে সেবা প্রদানের লক্ষে তাঁদের যৌনপল্লীগুলো পরিদর্শন ও কাজ বাস্তবায়ন করা, যৌনপল্লীগুলোতে মোবাইল রেজিষ্ট্রেশন ইউনিট স্থাপন করা,প্রাপ্তবয়ষ্ক না হলে অসত্য জন্মনিবন্ধন সনদ প্রদান বন্ধ করার ক্ষেত্রে বিবাহ রেজিষ্টার,নোটারি পাবলিক ও স্থানীয় সরকার কঠোর ভূমিকা নিতে পারে।
শাপলা মহিলা সংস্থা এর উদ্যোগে ময়মনসিংহ নগরীর গাঙ্গিনারপাড় রমেশ সেন রোডের যৌনপল্লী ও তৎসংলগ্ন এলাকায় বসবাসরত যৌনকর্মী ও তাদের সন্তানদের জন্ম নিবন্ধন তালিকা সরেজমিনে পর্যবেক্ষণ করেন ময়মনসিংহ সিটি কর্পোরেশন এর সহকারি নিবন্ধক রাকিকুজ্জামান, জন্ম নিবন্ধন সহকারী (হেলথ ভিজিটর) অঞ্চল ০২ এবং জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের প্রতিনিধি সাইকোসোস্যাল কাউন্সিলর মোঃ সবুজ ইসলাম এবং শিশু সুরক্ষা সমাজকর্মী মোঃ আরিফুল ইসলাম। সরকারি বিধি মোতাবেক সরকারের স্থানীয় সরকার বিভাগ এর আওতাধীন জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন রেজিস্টারের অফিস থেকে নির্দেশিত পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্ম নিবন্ধন কর্মসূচি তাদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলে।
মঙ্গলবার (২৪ ডিসেম্বর ২০২৪) দুপুরে গাঙ্গিনার পার যৌনপল্লীতে কর্মসূচিটি পালিত হয়। যৌনপল্লীতে বসবাসরত যৌনকর্মী মায়েরা তাদের সন্তানদেরসহ পর্যবেক্ষক প্রতিনিধিদের সামনে হাজির হয়ে তাদের মতামত ও দাবী তুলে ধরেন । এ সময় সকল বিষয়ে পর্যবেক্ষকবৃন্দ সর্বোচ্চ সহযোগিতার আশ্বাস দেন। সমাজসেবা কর্তৃপক্ষ যথাযথ বিধি মোতাবেক বয়সের প্রামাণক ব্যবস্থা করবেন বলে জানান এবং জন্ম ও মৃত্যু সহকারী নিবন্ধক স্বল্পসময়ের মধ্যে জন্ম নিবন্ধন সম্পাদনের আশ্বাস দেন ।
উল্লেখ্য দি ফ্রিডম ফান্ড এবং ইউএসআইড এর সহযোগিতায় শাপলা মহিলা সংস্থা এ প্রকল্পটি নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে।