অন্যান্য

বিদ্যমান বাজার ব্যবস্থায় শোভন সমাজ ও জীবন অর্জন প্রশ্নসাপেক্ষ

 

বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মহামন্দা ও কোভিড-১৯ মহামারির অভিঘাত মোকাবিলা করে শোভন ও সমৃদ্ধ একটি বাংলাদেশ গড়ে তুলতে অর্থনীতি ব্যবস্থায় নজর দেওয়ার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন অর্থনীতিবিদেরা। মূলধারার অর্থনীতিশাস্ত্রের কিছু  সীমাবদ্ধতার কথা তুলে ধরে তারা বাংলাদেশসহ সব দেশের বৈষম্য হ্রাসকারী দেশজ উন্নয়নদর্শন দিয়ে সমস্যার সমাধান করে ভবিষ্যতের আর্থসামাজিক উন্নয়ন নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়েছেন। বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি আয়োজিত ‘শোভন সমাজ ও মূলধারার অর্থনীতিশাস্ত্র’ শীর্ষক ভার্চ্যুয়াল এক আলোচনায় প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদেরা এ কথা বলেন।

গতকাল সন্ধ্যায় গণমানুষের অর্থনীতিবিদ-সমাজ গবেষক অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত রচিত ‘বড় পর্দায় সমাজ-অর্থনীতি-রাষ্ট্র: ভাইরাসের মহাবিপর্যয় থেকে শোভন বাংলাদেশের সন্ধানে’ গবেষণাগ্রন্থের ওপর ১৩ সিরিজের ওয়েবিনারের (ভার্চ্যুয়াল সেমিনার) ১৩তম ও সর্বশেষ পর্বে প্যানেলিস্ট হিসেবে ছিলেন যুক্তরাজ্যের আলস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অর্থনীতি বিভাগের খ্যাতনামা অধ্যাপক ড. এস আর ওসমানী এবং আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) কর্মসংস্থান খাতবিষয়ক সাবেক বিশেষ উপদেষ্টা ড. রিজওয়ানুল ইসলাম ।

ড. রিজওয়ানুল ইসলাম বলেন, শোভন সমাজ আসলে একটি হীরকখ-ের ন্যায়, যার উপাদান হতে পারে শোভন জীবনযাত্রা, সর্বজনীন সামাজিক সুরক্ষা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, রাজনৈতিক স্বাধীনতা, ক্ষমতায়ন এবং সব ধরনের বৈষম্য নিরোধ। এ ধরনের ব্যবস্থা সব মানুষেরই কাম্য। কিন্তু বাজারভিত্তিক আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে শোভন সমাজব্যবস্থা বিনির্মাণ সম্ভব কি না, তা প্রশ্নসাপেক্ষ। তিনি ফ্রিডম হাউজ প্রণীত বৈশ্বিক স্বাধীনতার সূচকে বাংলাদেশের ১০০ এর মধ্যে ৩৯ পাওয়ার উল্লেখ করে বলেন, এমন পরিস্থিতিতে সব মানুষের কাক্সিক্ষত শোভন সমাজ ও জীবনব্যবস্থা অর্জন করা একটু কঠিনই বটে। এ জন্য শিক্ষা শিক্ষা, স্বাস্থ্য, রাজনৈতিক স্বাধীনতা, ক্ষমতায়ন ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে।

আলস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. এস আর ওসমানী বলেন, শোভন একটি সমাজব্যবস্থা তৈরি করতে হলে সর্বাগ্রে শোভন একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থা অর্জন করতে হবে। আর্থ-রাজনৈতিক কাঠামোর মধ্যে তত্ত্বকাঠামোর সুসংঘবদ্ধকরণের মধ্যে দিয়ে শোভন সমাজমুখী হতে হবে। তিনি কোভিড-১৯ এর অর্থনৈতিক বিপর্যয় থেকে মানুষকে উদ্ধারে সরকারি বাজেট ও খাতওয়ারি বরাদ্দের কথা উল্লেখ করে বলেন, প্রবৃদ্ধিমুখী প্রণোদণা কর্মকাণ্ডে সাধারণ মানুষ খুব কম প্রাধান্য পেয়েছে। প্রণোদনার বেশির ভাগ অর্থই উদ্দিষ্ট লোকজনের হাতে পৌঁছেনি, লাভবান হয়েছে বড় বড় শিল্পখাতের মালিকেরা। সরকারের প্রণোদনায় দরিদ্রদের সামান্যই উপকার পেয়েছে। এককথায় বলতে গেলে সরকার ব্যর্থ হয়েছে। প্রবৃদ্ধি অর্জনের জন্য সরকারের মরিয়া প্রচেষ্টায় সামাজিক সুরক্ষা খাত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

 

গতকাল সন্ধ্যয় ঢাকার ইস্কাটনে সমিতির কার্যালয় থেকে এই ওয়েব সেমিনার পরিচালিত হয়। পুরো অনুষ্ঠানটি অর্থনীতি সমিতির ইউটিউব এবং ফেসবুকে পেজে সরাসরি সম্প্রচারিত হয়। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সহ-সভাপতি এ জেড এম সালেহ্। সেমিনারে উপস্থিত ছিলেন অর্থনীতি সমিতির সাধারণ সম্পাদক ড. জামালউদ্দিন আহমেদ, সহসম্পাদক শেখ আলী আহমেদ টুটুল। দেশ-বিদেশে অবস্থানরত বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ এই অনুষ্ঠানে সংযুক্ত ছিলেন। সেমিনার শেষে শ্রোতা-দর্শক ও আলোচকেরা প্রশ্নোত্তর পর্বে অংশ নেন।

 

উল্লেখ্য, শোভন সমাজ, শোভন সংস্কৃতি, শোভন জীবনবোধ, শোভন জীবনব্যবস্থা, শোভন অর্থনীতি, শোভন রাষ্ট্র বিনির্মাণে─জ্ঞানভিত্তিক প্রভাবকের ভূমিকা পালন করার লক্ষ্য নিয়ে দেশে-বিদেশে বহুল সমাদৃত এই গ্রন্থটির গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন অংশ নিয়ে চলতি বছরের ১৩ মার্চ জুম প্লাটফর্মে ভার্চ্যুয়াল ওয়েবিনার সিরিজের সূচনা করে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি। চার মাস ধরে চলা বিভিন্ন পর্বে শোভন সমাজের তত্ত্বকাঠামো; প্রচলিত মূলধারার অর্থনীতিশাস্ত্রের অপারগতা ও নতুন অর্থনীতিশাস্ত্রের যৌক্তিকতা; মুক্তিযুদ্ধের চেতনার রাজনৈতিক অর্থনীতি; ধনী-দরিদ্র-শ্রেণিবৈষম্য ও অসমতা; ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদ ও জঙ্গিবাদ; বিশ্বায়নের স্বরূপ; দুর্নীতি দুর্বৃত্তায়নের কাঠামোতে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সীমানা প্রসঙ্গ; কভিড-১৯ এ ক্ষতির বিশ্লেষণ; শোভন সমাজ-শোভন অর্থনীতি বিনির্মাণের মডেল; সমাজ সমগ্রকের রাজনৈতিক অর্থনীতি; কেমন হওয়া উচিত শোভন সমাজ বিনির্মাণের জাতীয় বাজেট এবং শোভন সমাজ ও মূলধারার অর্থনীতিশাস্ত্র বিষয় নিয়ে ভার্চ্যুয়াল আলোচনায় অংশ নেন দেশ ও বিদেশের প্রায় অর্ধশতাধিক প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ, সমাজবিজ্ঞানী, অর্থনীতিবিদ, চিকিৎসক, আইনজ্ঞ, রাজনীতিবিদ, এবং মানবাধিকার বিশেষজ্ঞ।

চলতি মাসেই অধ্যাপক ড. আবুল বারকাতের এই গ্রন্থটি নিয়ে একটি বিশেষ একক আলোচনায় অংশ নেবেন আধুনিক ভাষাবিজ্ঞানের জনক, বর্তমান সময়ে সর্বজন শ্রদ্ধেয় দার্শনিক ও সমাজ সমালোচক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস ইউনিভার্সিটির প্রফেসর নোয়াম চমস্কি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের প্রাক্তন চেয়ারম্যান ও জাপানিজ স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ও প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান অর্থনীতিবিদ আবুল বারকাতের চার দশকের গবেষণার ফসল ‘বড় পর্দায় সমাজ-অর্থনীতি-রাষ্ট্র: ভাইরাসের মহাবিপর্যয় থেকে শোভন বাংলাদেশের সন্ধানে’ বইটি যৌথভাবে প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি ও মুক্তবুদ্ধি প্রকাশনা। ৭১৬ পৃষ্ঠার এ বইটি সম্পর্কে অভিনন্দন বাণী দিয়েছেন আধুনিক ভাষাবিজ্ঞানের জনক, দার্শনিক ও সমাজ সমালোচক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস ইউনিভার্সিটির ইমেরিটাস অধ্যাপক নোয়াম চমস্কি। কৃতজ্ঞতাপত্র, মুখবন্ধ ও মোট ১২টি অধ্যায় ছাড়াও বইটিতে রয়েছে ২৭টি সারণি, ৩৯টি লেখচিত্র, তথ্যপঞ্জি ও নির্ঘণ্ট।

প্রেস বিজ্ঞপ্তি

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *