উপ-সম্পাদকীয়

অনলাইন আসক্তি থেকে আপনার সন্তান নিরাপদ তো?

খুব বেশিদিন আগের কথা নয় যখন ছেলেমেয়েরা বিকেল হলেই মাঠে খেলতে যেত। শেরপুরের প্রত্যন্ত এলাকার বাসিন্দা বিপুল (৩২বছর) ছাত্রাবস্থায় প্রতিদিন স্কুল থেকে ফিরে ব্যাট-বল/ফুটবল নিয়ে বেরিয়ে পড়তো। তখনকার দিনে ঋতুভেদে এলাকায় ফুটবল, হাডুডু, দাড়িয়াবান্ধা, কানামাছি ভোঁ ভোঁ, নদীতে সাঁতার কাটা, ভলিবল, ক্রিকেট খেলা হতো। স্কুলশেষে বাসায় ফিরে খাওয়া-দাওয়া হোক না হোক, খেলার মাঠে যাওয়া ছিল বাধ্যতামূলক। বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত মাঠে খেলাধুলা শেষে ঠিক সন্ধ্যায় মাগরিব নামাজের আজান শুরু হলেই বাড়িতে ফিরে ফ্রেশ হয়ে পড়তে বসতো। কি সুন্দর সোনালী দিন ছিল! এখনো যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজ থেকেও যে জিনিসটা তাকে সহজেই আকর্ষণ করে, তা হচ্ছে বাচ্চাদের ক্রিকেট/ফুটবল খেলা। কিন্তু আফসোসের বিষয় বিপুল বা তার কাছাকাছি বয়সের ছেলেমেয়েরা যেসকল মাঠে খেলাধুলা করে বড় হয়েছেন, যুগের বিবর্তনে আজ সেগুলোতে ধানসহ বিভিন্ন সবজি যেমন শসা, পটল, লাউ, কুমড়া, চিচিঙ্গাসহ বিভিন্ন ফসল উৎপাদন করা হয়। বিশ্বায়ন ও উন্নয়নের জোয়ারে এখন আর একখণ্ড পতিত জমি খুঁজে পাওয়া যায় না। কালের বিবর্তনে প্রযুক্তির ছোয়ায় মানুষের হাতে স্মার্টফোন এলো, খেলার মাঠের অভাবে সে জায়গা দখল নিল স্মার্টফোন এবং ইন্টারনেট। এছাড়াও বিকেলে খেলাধুলার সময়ে বিভিন্ন টিউশন-কোচিং ক্লাস ও প্রতিযোগিতা। খেলাধুলা এখনো চলে, তবে সেটা শারীরিক কসরতযুক্ত ফুটবল বা ক্রিকেট নয়, অনলাইনে ইন্টারনেটের কল্যাণে পাবজি, ফ্রি-ফায়ার, লুডু ইত্যাদি। ফুটবল/ক্রিকেট এর জায়গা দখল করে নিয়েছে ইন্টারনেট আসক্তি। এসব দেখে বিপুলের আফসোস হয়। বিশ্বায়নকে গ্রহণ করে আমরা আবার শেকড়কে ভুলে যাচ্ছি না তো?

বিপুলের ছেলের বয়স চার বছর। এই ছোট্ট শিশুটি অনলাইন ছাড়া কিছুই বুঝে না। অন্যান্য শিশুদের সাথে খুব একটা মিশছে না, সারাক্ষণ স্মার্টফোনে কার্টুন, অ্যানিমেশন এবং ভিডিও দেখছে। বাচ্চার মা নিজেকে ঝামেলামুক্ত রাখতে মোবাইলে কার্টুন চালু করে বাচ্চাকে খাওয়াচ্ছে বা অন্য কাজ করছে। এভাবে শিশুদেরকে আমরা অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দিচ্ছি না তো?

স্কুল-কলেজের কোমলমতি বাচ্চারা যাদের খেলার মাঠে খেলতে যাওয়ার কথা, আধুনিক বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে তাদের হাতে স্মার্টফোন ও ইন্টারনেট তুলে দিয়েছি। খেলার মাঠের অভাবে এবং শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে তারা ইন্টারনেটে ডুবে রয়েছে। প্রযুক্তি অবশ্যই শতভাগ খারাপ বা ভালো নয়। কিন্তু উঠতি বয়সের এসব তরুণরা প্রযুক্তির ভালো ব্যবহারের চেয়ে অপব্যবহারেই বেশি ঝুঁকছে। তারা বুঝে বা না বুঝে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম যেমন ফেইসবুক, ইনস্টাগ্রাম, লাইকি, টিকটকে মজে রয়েছে; সেখানে তারা রিলস ভিডিও দেখা, সস্তা জনপ্রিয়তার আশায় টিকটক ভিডিও তৈরি ও আপলোড করছে। তেমনি অনলাইনের বিভিন্ন গেইমস যেমন ফ্রি ফায়ার, পাবজি, অনলাইন বেটিং এবং পর্নোগ্রাফিতেও যুক্ত হয়ে যাচ্ছে। অনলাইন গেইমসে তারা এতোটাই আসক্ত যে সিনিয়রদের সাথে অসম্মানজনক ও অসৌজন্যমূলক আচরণ, মেজাজ খিটখিটে হওয়া, পড়াশোনায় মনোযোগহীনতা এমনকি মা-বাবার সাথেও খারাপ আচরণ করছে। বাস্তব দুনিয়ায় কোনো ভ্রূক্ষেপ নাই, সারাদিন অনলাইনে ডুবে থাকে। এমনও দেখা যায়, জেএসসি এসএসসিতে গোল্ডেন এ+ পাওয়া ছেলেটাও অনলাইনের চক্করে পড়ে এইচএসসিতে ফেল করে বসেছে, পরে আর পড়ালেখা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয় নি। ছাত্র-ছাত্রীদের প্রধান কাজ পড়ালেখা করা, এর ব্যত্যয় ঘটলে সেটি ক্রাইম এর পর্যায়ে পড়ে। এর দায় কার?

অনলাইন সেবা ব্যবহারের প্রতি যে মোহ ব্যবহারকারীকে মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন করে তোলে এবং অনিয়ন্ত্রিতভাবে অনলাইন প্ল্যাটফর্মে নেশাগ্রস্ত করে রাখে তাই অনলাইন আসক্তি। এই আসক্তি সকল শ্রেণি-পেশা-বয়সের মানুষের মধ্যেই দেখা দিতে পারে। তবে কিশোর-কিশোরী ও তরুণ-তরুণীদের মধ্যে সমস্যাটি বেশি দেখা যায়। এর ফলে উঠতি বয়সী ছেলেমেয়েদের বিভিন্ন শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তন, অনিদ্রা, অস্থিরতা, মেজাজ খিটখিটে হওয়া, পড়াশোনায় মনোযোগহীনতা, উগ্রতা দেখা দেয়।

মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এডুকেশনাল অ্যান্ড কাউন্সিলিং সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. মেহজাবীন হক ইত্তেফাককে এ প্রসঙ্গে বলেন, অনলাইন গেম খুবই আকর্ষণীয়। এখানে তারা আনন্দ পাচ্ছে। আমাদের ব্রেইনের যে অংশটা আমরা আনন্দ উপভোগ করি, এই অনুভূতি যেটা দেয়- এই ধরনের কাজগুলো আসলে আমাদের ব্রেইনের ওই পার্টিকুলার আনন্দ অনুভূত হওয়ার যে অংশটা আছে সেটাকে স্টিমুলেট করে এবংশক্ত করে তোলে। এ কারণে ভালোলাগার হরমোনগুলো সৃষ্টি হতে থাকে। এমনিতে মনে হচ্ছে এটা একটা আনন্দের ব্যাপার। কিন্তু এটার পেছনে অনেক ক্ষতিকর দিক আছে, ড্রাগের যেমন আসক্তি এটারও তেমন আসক্তি এবং ওই ধরনের স্টিমুলেশন ছাড়া অন্য কিছুতে আনন্দ পাবে না। এতে সে শারীরিকভাবে, মানসিকভাবে ও সামাজিকভাবে সবদিক থেকেই সে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কারণ সে আসক্ত হয়ে গেছে। অন্যান্য আসক্তির ক্ষেত্রে যে যে বিষয়গুলো প্রযোজ্য এখানেও ঠিক তাই হচ্ছে।

ইন্টারনেটের অপব্যবহার রোধ করতে হলে সতর্ক হতে হবে পরিবার ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে। পরিবারে সন্তানকে পর্যাপ্ত সময় দেওয়া, তাদের নিয়ে ঘুরতে যাওয়া, ভালো-মন্দের পার্থক্য অনুধাবন করানো জরুরি। নিরাপদ ইন্টারনেটের ব্যবহারবিধি পাঠ্যপুস্তকে সংযোজন করা প্রয়োজন। স্কুলের সিলেবাস যাতে অনলাইন আসক্তিতে প্ররোচিত না করে, সেদিকতায় খেয়াল রাখতে হবে। যে কোনো মূল্যে শিশু-কিশোরদের নিরাপদ শৈশব ও কৈশোর নিশ্চিত করতে হবে। আপনার শিশু কোথায় কি করছে, কার সাথে মিশছে এসব নজরদারি করতে হবে কৌশলে। তবেই নিশ্চিত করা যাবে তাদের সুন্দর ভবিষ্যৎ।

মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের মতে, অনলাইন আসক্তি কমাতে অভিভাবকের ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সন্তানকে বকুনি দিয়ে কিংবা স্মার্টফোন, ল্যাপটপ কেড়ে নিয়ে এ অভ্যাস ঠেকানো যাবে না। বরং এতে বিপরীত হতে পারে। স্মার্টফোন, ল্যাপটপ আসক্তদের এসব ডিভাইস ব্যবহারের সময়টি ধাপে ধাপে কমানোর পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, সবার আগে অভিভাবককে দেখতে হবে কেন তার সন্তান অনলাইনে বা অনলাইন গেমে সময় কাটানোতে আসক্ত হয়ে যাচ্ছে? শুধু অনলাইন গেম খেলতে কিংবা অনলাইনে থাকতে নিষেধ করলেই হবে না, বিকল্প কোনো খেলাধুলার ব্যবস্থা করার বিষয়েও গুরুত্ব দিতে হবে। সন্তানরা পিতামাতার সান্নিধ্যে সবচেয়ে বেশি শেখে, হোক সেটা ভালো বা মন্দ। তাই সন্তানের সামনে অভিভাবকদের স্মার্টফোনে মগ্ন থাকা, খাবার টেবিলে স্মার্টফোন দেখার অভ্যাসেও পরিবর্তন আনতে হবে।

বিভিন্ন ডিজিটাল ডিভাইসের ব্যবহার বর্তমানে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ এবং এর মাধ্যমে বিভিন্ন প্রয়োজনে আমরা অনলাইনে কাজ করে থাকি। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে, অনলাইনে আমাদের এতো বেশি সময় দেওয়া উচিৎ নয়। বরং অনলাইনের জগত থেকে বের হয়ে এসে আমাদের বাস্তব জীবনে আরো বেশি মনোযোগী হওয়া আবশ্যক।

মোঃ মাসুদ মিয়া
তথ্য অফিসার, আঞ্চলিক তথ্য অফিস, ময়মনসিংহ