কৃষি পর্যটনের বিকাশ: যথাযথ ব্যবস্থাপনা জরুরি
‘বহুদিন ধরে বহু ক্রোশ দূরে/বহু ব্যয় করি বহু দেশ ঘুরে/দেখিতে গিয়াছি পর্বতমালা/দেখিতে গিয়াছি সিন্ধু/দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া/ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া/একটি ধানের শিষের উপর/একটি শিশির বিন্দু।’ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর উক্ত পঙক্তিগুলো রচনা করেছিলেন আক্ষেপ করে যে আমরা বহু অর্থ ও সময় ব্যয় করে দূরের জিনিস দেখতে গেলেও সহজে পাওয়া যায় বলে ঘরের কাছের সৌন্দর্যটুকু দেখি না। কিন্তু এর বাইরেও অন্য আরেকটি কারণ হচ্ছে দেখার মতো এবং মনকে সতেজ করার মতো অর্নিবচনীয় সৌন্দর্যের প্রাচুর্যতা না থাকা। বাংলাদেশ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি। সবসময় নির্দিষ্ট কিছু স্থানের পাহাড়, সমুদ্র বা প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলোতে যাওয়া সম্ভব হয় না সময় ও অর্থের সীমাবদ্ধতায়। বাড়ির পাশেই যদি কাছাকাছি এমন কোনো দর্শনীয় জায়গা, কৃষি পর্যটন বা এমন কিছু থাকে যা অর্থ ও সময় সাশ্রয়ী এবং সহজলভ্য, তা মানুষকে সহজেই আকৃষ্ট করে। যান্ত্রিক এ কর্মব্যস্ততা থেকে সাময়িক মুক্তির জন্য মানুষ প্রকৃতির কাছাকাছি যেতে চায়, প্রকৃতিকে উপভোগ করতে চায়। কিন্তু মাঝে মাঝে সুযোগ থাকা সত্ত্বেও অসীম সম্ভাবনার পর্যটন সম্ভব হয় না যথাযথ ব্যবস্থাপনার অভাবে।
ফুল সৌন্দর্য, পবিত্রতা ও ভালোবাসার প্রতীক। জগতে এমন কোনো মানুষ নেই যে ফুল পছন্দ করে না। আর ফুলসহ হাতের নাগালেই যদি ফুলের বাগান উপভোগ করা যায়, তাহলে তো সোনায় সোহাগা। সম্প্রতি শেরপুর সদর উপজেলার শেরী ব্রীজ এলাকায় মৃগী নদীর তীরে তেমনই এক সূর্যমুখী বাগানের ফুলের সৌরভে বিমোহিত হয়েছিলেন শেরপুরের স্থানীয় বাসিন্দারা। দৃষ্টিনন্দন এ ফুল থেকে সৌন্দর্য উপভোগের পাশাপাশি তেল ও বীজ সংগ্রহ করা যায়। সাড়ে চার একর জায়গা জুড়ে চাষ করা এ বাগানটি ইতোমধ্যেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল। ফেইসবুক ও ইউটিউব ব্লগার এবং প্রথম সারির মিডিয়া কভারেজের কল্যাণে বাগানটি সৌন্দর্যপিপাসু ফুলপ্রেমীদের কাছে সহজেই পৌঁছে গেছে। সম্প্রতি শেরপুরের জেলা প্রশাসকও বাগানটিতে পরিদর্শন করেন এবং ফুলের সান্নিধ্যে এমন উদ্যোগের ভূয়সী প্রশংসা করেন। ব্যাপক জনপ্রিয়তা এবং চাহিদার প্রেক্ষিতে বাগান মালিক ভলান্টিয়ার নিয়োগ দেন এবং প্রবেশ ফি ৫০টাকা নির্ধারণ করেন। শুধু ছবি তোলা ও সৌন্দর্য উপভোগ করতে এতো মূল্য নির্ধারণ করলেও জনসমাগমের কমতি নেই। শেরপুর-জামালপুর মহাসড়কের সাথে অবস্থিত হওয়ায় প্রতিদিনই হাজার হাজার স্কুল-কলেজেজ তরুণ, মধ্যবয়সী মানুষ থেকে শুরু করে সব ধরনের দর্শনার্থী এ কৃষি পর্যটনকে উপভোগ করতে চলে আসতেন। কিন্তু ভাইরাল বিড়ম্বনায় হয়েছে বিপত্তি। অতিরিক্ত জনসমাগমের কারণে শেরপুর-জামালপুর মহাসড়কে যানজট এবং জনভোগান্তি তীব্র হয়ে উঠে। পর্যটনের নগরী শেরপুরের মধুটিলা ইকোপার্ক থেকে শিক্ষা সফর শেষে ফেরার পথে এক স্কুলবাসের ছাত্রীকে উত্যক্ত করে স্থানীয় যুবক। উত্যক্তকারী যুবককে ফুলবাগানের মালিকের গ্রামের কতিপয় লোকজন শায়েস্তা করায় দুই গ্রামের লোকজনের মধ্যে শুরু হয় ভয়াবহ সংঘর্ষ। দফায় দফায় সংঘর্ষে উভয় গ্রামের অন্তত ৩০ জন আহত এবং স্থানীয় কুসুমহাটি বাজারে কয়েকটি দোকানে লুটপাটের মতো ঘটনা ঘটে। ফলশ্রুতিতে সদ্য প্রস্ফুটিত এ কৃষি পর্যটন গত ০৯ ফেব্রুয়ারী থেকে বন্ধ ঘোষণা করেছে জেলা প্রশাসন। অথচ শৃঙ্খলা ও নিয়মের মধ্যে পরিচালিত হলে ১৪ই ফেব্রুয়ারী, ২১ ফেব্রুয়ারীসহ পুরো মাসজুড়ে সর্বস্তরের মানুষ উপভোগ করতে পারতো এ উদ্যোগ। একটা সম্ভাবনাময় কৃষি উদ্যোক্তার স্বপ্ন অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে গেল।
২০২২ সালের ঘটনা, শেরপুর-জামালপুরের সীমান্তে ব্রহ্মপুত্র নদের চুনিয়ার চর ও ডাকপাড়া গ্রাম সংলগ্ন অংশে নদীতে উঁচু বাঁধ নির্মাণ করে নদীর গতিপথ ঘুরিয়ে দেওয়া হয়। এতে যমুনার বাহাদুরাবাদ অংশ দিয়ে উজান থেকে নেমে আসা ব্রহ্মপুত্র নদের পানি সরাসরি জামালপুর শহরের পাইলিংয়ে আঘাত না করে বাঁধের কারণে বাইপাস হয়ে সরাসরি ব্রীজের কাছাকাছি গিয়ে পতিত হয়। ফলে শহরের বাঁধ ও চরের কৃষি জমিগুলো ভাঙ্গন থেকে রক্ষা পায় এবং কৃষকরা বাদাম, মাসকলাই ডাল, আখ, বেগুন এবং অন্যান্য সবজি চাষ শুরু করে। নদীর সেই দৃষ্টিনন্দন বাঁধটি স্থানীয় দুই জেলার একটা পর্যটন হাবে পরিণত হয়। শহরের কর্মব্যস্ত মানুষ নৌকাযোগে এসে বাঁধ এবং আশেপাশে চরের মুক্ত আবহাওয়ায় প্রতিনিয়ত প্রমোদভ্রমণে চলে আসতো। দর্শনার্থীদের সহায়ক হিসেবে ভ্রাম্যমাণ বিভিন্ন ব্যবসায় উদ্যোগ যেমন ভ্রাম্যমাণ কৃষিপণ্যের দোকান, ফুচকা চটপটির ব্যবস্থা, ভাড়ায় ডিঙি নৌকা ভ্রমণ এবং অন্যান্য আয়োজন দেখা যায়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে সেই পর্যটন স্থানটিও ব্যাপক ভাইরাল হয় সেসময়। কিন্তু বিপত্তি বাঁধে অন্য জায়গায়। ভ্রাম্যমাণ দোকান স্থাপন এবং বাঁধের স্থানে প্রভাব বিস্তারকে কেন্দ্র করে শেরপুর জেলার অন্তর্গত ডাকপাড়া এবং জামালপুর জেলার অন্তর্গত পাথালিয়া গ্রামের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ ও ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া শুরু হয়। ফলশ্রুতিতে উভয় জেলার প্রশাসন সেই বাঁধে জনসাধারণের যাতায়াত নিষিদ্ধ করে দেয়।
উপরের ঘটনায় যে বিষয়টি সবচেয়ে বেশি লক্ষ্যনীয় তা হচ্ছে ভাইরাল বিড়ম্বনা ও যথাযথ ব্যবস্থাপনার অভাব। জুলাই অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম হয়ে উঠেছে জনমত প্রকাশের অন্যতম ক্ষেত্র হিসেবে। যেকোনো ঘটনা ঘটার সাথে সাথে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে সহজেই সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করছে। বাংলাদেশের আনাচে কানাচে এমন অসংখ্য কৃষি পর্যটন রয়েছে যেগুলো পর্যাপ্ত প্রচার ও যথাযথ ব্যবস্থাপনার অভাবে পর্যটন হাবে রুপান্তরিত হতে পারছে না।
কৃষিভিত্তিক পর্যটন হলো অবকাশ যাপনের এমন এক মাধ্যম, যেখানে খামারগুলোতে আতিথেয়তার পাশাপাশি পণ্য প্রদর্শনীরও আয়োজন করা যেতে পারে। অবকাশকালীন কর্মকাণ্ডের মধ্য থেকে কৃষি পদ্ধতি সম্পর্কে বাস্তব জ্ঞান আহরণ, ফল ও সবজি চাষ, ফল ও সবজি ক্রয়, মধু আহরণ এবং স্থানীয় আঞ্চলিক বিভিন্ন পণ্য অথবা হস্তশিল্প সামগ্রীর তৈরি শৈলী দেখা ও কেনার সুযোগ তৈরি হয়। পর্যটনের সঙ্গে কৃষিকে সম্পৃক্ত করলে একদিকে যেমন পর্যটকেরা ভ্রমণ ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারবেন, সেইসঙ্গে কৃষিজ পণ্য ও বাজার সম্প্রসারণে কৃষি পর্যটন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। কারণ আমাদের আছে নাতিশীতোষ্ণ জলবায়ু, আছে উর্বর ভূমি, রয়েছে অন্যান্য দেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করার সামর্থ। এরই মধ্যে আমাদের দেশে কিছু কৃষি পর্যটন গড়ে উঠেছে, যেমন রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের আম বাগান, দিনাজপুরের লিচু বাগান, স্বরূপকাঠির পেয়ারা বাগান, যশোরের ফুলের বাগান, নরসিংদীর লটকন বাগান, কিশোরগঞ্জ ও সুনামগঞ্জের হাওরসহ এমন আরও অসংখ্য কৃষি পর্যটন। ময়মনসিংহ জেলায়ও বিভিন্ন ধরনের কৃষি পর্যটন ও উদ্যোগ রয়েছে। যান্ত্রিক শহরের সৌন্দর্যপ্রিয় জনগণের জন্য এ স্থানগুলো খুবই চিত্তাকর্ষক।
বাংলাদেশের পর্যটন বিকাশে বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশন এবং বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের অন্যতম প্রধান উদ্যোগ হচ্ছে কৃষি পর্যটন সম্প্রসারণ। শহরের মানুষকে কৃষি উদ্যোক্তার সাহচর্যে এনে সরাসরি কৃষি চাষ পর্যবেক্ষণ করাতে পারলে দেশের অর্থনীতিতে তা হবে মাইলফলক। বাংলাদেশে কৃষি পর্যটনের বিকাশ বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয় যার মধ্যে রয়েছে অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা, সচেতনতার অভাব এবং সহায়ক কর্মসূচির জন্য পৃষ্ঠপোষকতা নিশ্চিত করার জন্য সীমিত বিকল্প এবং কৃষি পর্যটন ও শিক্ষার অনুকূল নীতি। সমাধানগুলোর মধ্যে রয়েছে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব, নিয়ন্ত্রক কাঠামো এবং কৃষি পর্যটনের জন্য পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনা প্রক্রিয়ায় স্থানীয় সম্প্রদায়ের অংশগ্রহণ। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কৃষি-কেন্দ্রিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কৃষি শিক্ষানবিশের প্রচার ও সুবিধার্থে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। কৃষি পর্যটনের পূর্ণ সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে, কার্যকর প্রচার এবং বিপণন কৌশল প্রয়োজন। বাংলাদেশে কৃষি পর্যটন টেকসই গ্রামীণ উন্নয়ন, অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন এবং কৃষিকাজ এবং ফসল-পরবর্তী কার্যক্রমে দক্ষতা বৃদ্ধির একটি গেটওয়ে হিসেবে কাজ করবে। দেশের কৃষি বৈচিত্র্য প্রদর্শন করে, সম্প্রদায়ের সম্পৃক্ততা বৃদ্ধি করে এবং টেকসই অনুশীলনের প্রচারের মাধ্যমে, বাংলাদেশ পর্যটন এবং শিক্ষার জন্য একটি পছন্দসই গন্তব্য হিসেবে অবস্থান করতে পারে। যথাযথ ব্যবস্থাপনার ফলে কর্মমুখর মানুষের প্রমোদ – ভ্রমণের গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হয়ে উঠুক কৃষি পর্যটন কেন্দ্রগুলো।
মোঃ মাসুদ মিয়া
বিসিএস (তথ্য) ক্যাডার অফিসার,
আঞ্চলিক তথ্য অফিস (পিআইডি), ময়মনসিংহ।