উপ-সম্পাদকীয়

জন্মবার্ষিকীতে স্মরণ: হাছনরাজার গান এবং অপপ্রকাশ, অপব্যাখ্য -ইমতিয়াজ আহমেদ

বাউল সাধকদের পুন্যভূমি এই বাংলা বদ্বীপ। এখানে যুগে যুগে আগমন ঘটেছে বাউল সাধকদের। তারা তাদের গানে সৃষ্টিকর্তার কথা, সৃষ্টিতত্ত্বের কথা, মানবতার কথা, সহমর্মিতার কথা, অসাম্প্রদায়িক চেতনার কথা বলেছেন। তেমনি একজন বাউল সাধক হাছনরাজা। তবে তিনি সামাজিক ও আর্থিক অবস্থানগত কারণে অন্যান্য বাউল সাধকদের থেকে ছিলেন ভিন্নতর। সচরাচর আমরা দেখে থাকি আর্থিকভাবে অস্বচছল পরিবারে বাউল সাধকদের অবস্থান ছিল। হাছনরাজা এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। ১৮৫৪ সালের ২১ ডিসেম্বর তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন তৎকালীন জমিদার পরিবারে। নিজেও ছিলেন জমিদার। অথচ সম্পদের মোহ ভোগবিলাস তাঁকে আটকাতে পারেনি। জীবনের একপর্যায়ে তিনি সম্পদের মোহ ও ভোগবাদিতা ছেড়ে তিনি পাড়ি দিলেন নির্মল ভাবের জগতে। রচনা করেন অগণিত ভাববাদী সুফিবাদী গান।

ভাবের জগতে প্রবেশের প্রথম পর্যায়ে তিনি অনেককিছুর হিসাব মিলাতে পারতেন না। মনে বয়ে যেত ঝড়। মনে জাগতো হাজারো প্রশ্ন। আর গানের মাধ্যমে ছুঁড়ে দিতেন সেসব প্রশ্ন। খুঁজতেন উত্তর। যেমন, “বাউলা কে বানাইল রে হাছনরাজারে?” বা “আগুন লাগাইয়া দিল কনে হাছনরাজার মনে?”

এ ধরণের প্রশ্ববোধক গানের মাধ্যমে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিতেন। প্রশ্ন ছোঁড়ে দিতে দিতে একসময় পৌঁছে যান তাঁর কাংখিত গন্তব্যে। ভাসতে থাকেন ভাবের তরঙ্গে, ভাবের মায়ায় ভাবের দেশে। রচনা করতে থাকেন ভাবজগতের সমাধানমূলক অসংখ্য গান। যেমন, “নিশা লাগিলরে বাঁকা দুইনয়নে নিশা লাগিলরে” বা “ছাড়িলাম হাছনের নাওরে।” মোটা দাগে হাছনরাজার গানগুলো দু’প্রকারের অর্থাৎ প্রশ্নমূলক ও সমাধানমূলক।

হাছনরাজার ভাববাদী গানগুলোকে আমরা প্রায়শ:ই অপব্যাখ্যারুপে পরিবেশন করতে দেখি। যা গানের ভাবার্থের সাথে সম্পূর্ণ বেমানান। আমরা অনেক গায়ককেই গানগুলো ভুলভাবে পরিবেশন করতে দেখি। নৃত্যেও গানগুলোর অপপ্রকাশ অপপ্রয়োগ করা হয়। ভাববাদী গানের সাথে খেমটা তালে হইহুল্লুড় জাতীয় চটকদার নৃত্য চোখে পড়ে।

অপপ্রকাশ, অপপ্রয়োগ, অপব্যাখ্যার উদাহরণ হিসেবে এখানে হাছনরাজার দুটি গানের আলোকপাত করা হলো। “আগুন লাগাইয়া দিল কনে হাছনরাজার মনে?” শিরোনামের গানটি ব্যাখ্যা করলে আমরা জানতে পারি, হাছনরাজা যখন ভাবের দরজায় কড়া নাড়তে শুরু করলেন তখন তাঁর মনে যে ঝড় বইতে শুরু করে বা যে আগুন জ্বলতে থাকে তার প্রেক্ষিতে তিনি প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন এই গানের মাধ্যমে। কে তাঁর মনে আগুন জ্বালিয়ে দিল? এ আগুন তো নিভেনা, শুধু জ্বলছেই। এ আগুনের মাত্রার ব্যাপকতা বুঝাতে তিনি গানটিতে ব্যক্ত করেছেন:

“ধক ধক করে উঠল আগুনধইল আমার প্রাণে/সুরমা নদীর জল দিলে নিভেনা সে কেনে?”

এদিকে হাছনরাজার অত্যধিক জনপ্রিয় “নিশা লাগিল রে” গানটির অবস্হা অথৈবচ। যে যেভাবে পারছে অপব্যবহার করছে সিনেমায়, নাটকে, নৃত্যে। ঢং করে রস দিয়ে গাইছে মঞ্চে। কখনো কখনো ‘নিশা’ শব্দের পরিবর্তে ‘নেশা’ শব্দ জুড়ে দিয়ে গেয়ে উঠে গায়ক। যেন মানব মানবীর প্রেমের রসময় গান। নৃত্যে দেখা যায় খেমটা তালে যুবক-যুবতীদের বাহারি পরিবেশনা। এই গানের মাজেজা কি তাই? এ গানের অর্থ বুঝতে হলে বুঝতে হবে ‘নিশা’ শব্দটিকে। বাংলা অভিধানে ‘নিশা’ শব্দের অর্থ রাত বা রজনী। রাত বা রজনী শব্দ এই গানের সাথে সম্পূর্ণ বেমানান। বাংলা অভিধানে আছে ‘নিশানা’ শব্দ। ‘নিশানা’ শব্দের অর্থ হলো লক্ষস্থির করা। ইংরেজিতে যাকে বলে aim। হাছনরাজা গানের তাললয়ের সুবিধার্থে নিশানা শব্দ থেকে ‘না’ প্রত্যয় বাদ দিয়ে ‘নিশা’ শব্দটি গানে ব্যবহার করেছেন। যখন ভাবের জগতে লক্ষস্থির করতে পেরেছেন তখনই তিনি গান বাধলেন “নিশা লাগিলরে/বাঁকা দুইনয়নে নিশা লাগিলরে/হাছনরাজা পেয়ারির প্রেমে মজিলরে।” এই গানটিতে পেয়ারি বলতে নারীকে বুঝানো হয়নি। বুঝানো হয়েছে সর্বেস্বরকে। যার প্রেমে তিনি মজেছেন। যা উর্ধ্বমূখী প্রেম। অথচ হালজামানায় এই গানটি পরিবেশন করে বুঝানো হয় মানবমানবীর প্রেম হিসেবে। যা গানের ভাবার্থের সাথে সম্পূর্ণ বেমানান বিপরীত।

বাউল সাধক হাছনরাজার ভাববাদী গানগুলোর ভাবার্থ মর্মার্থ অনুধাবন করে, ন্যুনতম অর্থ বুঝেই উপস্থাপন পরিবেশন করতে হবে। তাহলেই তাঁর গানের ভাবার্থ মর্মার্থ যথাযথভাবে প্রকাশ পাবে। আর গানগুলোও বেঁচে থাকবে তার নিজস্ব স্বকীয়তা নিয়ে। সঙ্গীতজগতের সাথে যারা জড়িত তাদেরকে এক্ষেত্রে অগ্রগামী ভূমিকা পালন করতে হবে। বিশেষ করে বয়োজ্যেষ্ঠদের। কারণ তাদের হাত ধরেই পরবর্তি প্রজন্ম হাছনরাজার গানের ভাবার্থ মর্মার্থ শিখে ভাবের মশাল প্রজ্জ্বলিত রাখবে সুরের মূর্ছনায়।

মরমি সাধক হাছনরাজার ভাববাদী গানগুলো বেঁচে থাকুক তার ভাববাদী স্বকীয়তা নিয়ে। হাছনরাজার ১৭০তম জন্মবার্ষিকীতে এটাই প্রত্যাশা।

ইমতিয়াজ আহমেদ
লেখক: প্রাবন্ধিক, গণসাংস্কৃতিক কর্মি।