দখল হয়ে যাচ্ছে বধ্যভূমি! বধ্যভূমি সংরক্ষণে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের আরো জোরালো ভূমিকা প্রয়োজন!
বাবলী আকন্দ ঃ একটি যুদ্ধ, সকল নিপীড়ন ও শোষণ বঞ্চনা থেকে মুক্তি পাবার জন্য একটি মুক্তিযুদ্ধ। স্বাধীনতার স্বাদ আস্বাদন করার তীব্র আকাঙ্খা ধাবিত করে আমাদের দেশের তেজোদৃপ্ত দামাল ছেলেদের। সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। যে যুদ্ধে নৃশংসভাবে, অত্যন্ত ঘৃণিতভাবে হত্যা করা হয় মুক্তিকামী মানুষদের। সেইসব মানুষের লাশগুলোকে বিভিন্ন জায়গায় গর্ত খুঁড়ে, কুপের মধ্যে থরে থরে, স্তুপাকৃতভাবে জমা করা হয়। দেয়া হয় মাটি চাপা। রক্তেমাখা সেসব স্থান, লাখো মানুষের রক্তের বিনিময়ে পাওয়া বাংলাদেশের স্বাধীনতা, ইতিহাস হয়ে আছে।
স্বাধীনতার ৫০ বছরে এসে উদ্যোগ নিলেও উল্লেখযোগ্যভাবে সেসব ইতিহাস, ইতিহাসের জায়গা সংরক্ষিত হয় নি। উদ্ধার হয় নি দখল করা সেসব বধ্যভূমি, চিহ্ণিত হয় নি ইতিহাস। সারাদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বধ্যভূমিগুলো বর্তমান সরকারের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে সংরক্ষণের কথা থাকলেও দৃশ্যমানভাবে সংরক্ষিত হয়েছে যা যৎসামান্য। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সূত্র থেকে জানা যায়, সারা দেশে প্রায় ৯২০টি বধ্যভূমি এবং ৮৮টি নদী ও ৬৫টি ব্রিজ-কালভার্ট শনাক্ত করা হয়েছে, যেখানে সেসব মুক্তিকামী সাধারণ মানুষদের বর্বরভাবে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়। ‘২৮০টি বধ্যভূমি সংরক্ষণ ও স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ’ প্রকল্পে গত সাড়ে তিন বছরে মাত্র ৩৬টি বধ্যভূমির জন্য জমি পাওয়ায় সেগুলোর কাজ শুরু করা হয়, যার মধ্যে ৮টির নির্মাণ শেষ হয়েছে।
ময়মনসিংহ শহরেও ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বধ্যভূমি যা সংরক্ষণের তেমন উদ্যোগ চোখে পড়ার মতো নয়। ময়মনসিংহ নগরীর মুক্তিযোদ্ধা সরণি সড়কটি স্বাধীনতার একটি ইতিহাস বহন করছে। প্রতি বছর ময়মনসিংহের মুক্ত দিবস উপলক্ষে ১০ ডিসেম্বর থেকে সপ্তাহব্যাপী এই মুক্তমঞ্চে বিভিন্ন অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। যেখানে ময়মনসিংহের বীর মুক্তিযোদ্ধাগণ সহ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ বক্তব্য রাখেন। নতুন প্রজন্মকে প্রকৃত ইতিহাস জানান। কিন্তু ঠিক এই মুক্তমঞ্চের পাশেই রয়েছে আলোচিত একটি বধ্যভূমি। যেখানে একটি কূপ বা ইদারা ছিল। সেখানে শহরের নিরীহ মানুষকে ধরে ধরে এনে পাকিস্তানি হায়েনা, রাজাকাররা নির্মমভাবে অত্যাচারের মধ্য দিয়ে হত্যা করে। যা রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দসহ বীর মুক্তিযোদ্ধাগণও অকপটে স্বীকার করেন। অথচ কোন এক অদৃশ্য শক্তিবলে সেটি ভরাট করে এখানে বর্তমানে ইসলামী ব্যাংক নামে একটি প্রতিষ্ঠান তাদের অফিস স্থাপনা করে পরিচালিত হচ্ছে। বধ্যভূমি হিসেবে এটিকে আজো চিহ্নিত করা হয়নি।
মহানগরীর ডাকবাংলোর পেছনে (থানাঘাট) যেখানে স্মৃতিস্তম্ভ স্থাপন করা হলেও শুধুমাত্র বিশেষ দিবসে চলে ঘষামাজা। এছাড়া সারাবছরই অবহেলায় পড়ে থাকে। এ।ছাড়া বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের রেস্টহাউসের পেছনে, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন পার্কেও ছিল বধ্যভূমি। তৎকালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ক্যাম্প ছিল বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে। বড়বাজার কালিবাড়ী, কেওয়াটখালি রেলওয়ে কলোনি, নিউমার্কেট ও সাহেবপাড়া বধ্যভূমি। এছাড়া ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে আরো বধ্যভূমি সেখানে মুক্তিযোদ্ধাসহ মুক্তিকামী অনেক মানুষকে ধরে নিয়ে হত্যা করে লাশ ফেলে রাখা হয়। বেশ কয়েক বছর ধরে অনসাম্বলসহ বেশ কয়েকটি সাংস্কৃতিক সংগঠন ময়মনসিংহ শহরের সার্কিট হাউজ মাঠসংলগ্ন বধ্যভূমিতে বিশেষ দিবসে মোমবাতি প্রজ্জ্বলনের ব্যবস্থা করে। কিন্তু সেটি নিয়ে কারো উৎসাহ আগের মতো চোখে পড়েনি।
সম্প্রতি উক্ত বধ্যভূমি সংরক্ষণের দাবী নিয়ে সরব হয় সমাজ রুপান্তর সাংস্কৃতিক সংঘ নামে একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন। বিভিন্ন সময় তারা স্মারকলিপি ও মানব বন্ধনের মধ্য দিয়ে প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করে এবং তা সংরক্ষণের দাবী জানায়। সে দাবীর প্রেক্ষিতে জেলা প্রশাসন উপজেলা প্রশাসনের মাধ্যমে তথ্যের যাচাই-বাছাই করে। প্রশাসনের তথ্য মতে জানা যায়, টাউন মৌজার বি আর এস ১ নং খাস খতিয়ানভুক্ত ৪১৪ নং পতিত শ্রেণী হিসেবে ১.৪২ একর ভূমি রেকর্ডে আছে। বর্তমানে যেটি জয়নুল আবেদীন পার্ক হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। বর্তমানে জেলা প্রশাসনের দৃষ্টিতে তা নিয়ে আসলে সেখানে দৃশ্যমান স্মৃতিস্তম্ভ করার জন্য উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে।
এ ব্যাপারে বধ্যভূমি সংরক্ষণের দাবীতে সরব সমাজ রূপান্তর সাংস্কৃতিক সংঘ, ময়মনসিংহ এর সভাপতি ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, মহান মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানী বর্বর হানাদার বাহিনী এবং তাদের দোসর আলবদর, আলশামস্, রাজাকারদের নির্মমতার সাক্ষী বধ্যভূমি গণকবরগুলো। যে বধ্যভূমি গণকবরগুলোতে মুক্তিকামী বাঙালীকে নির্মমভাবে হত্যা করে ফেলে রাখা হতো। মুক্তিযুদ্ধে এদের নির্মমতার সাক্ষী এবং মুক্তিকামী বাঙালী জাতির আত্মত্যাগের মহান ইতিহাস প্রজন্মের সামনে দৃশ্যমান রাখার জন্য বধ্যভূমি গনকবরগুলো সংরক্ষণ করা অতীব জরুরী। অথচ, সংরক্ষণের অভাবে দিন দিন মুছে যাচ্ছে মহান মুক্তিযুদ্ধের সাক্ষীগুলো।
সারাদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এসব বধ্যভূমি সংরক্ষণ করা হলে নতুন প্রজন্ম দেশের ইতিহাস জানবে এবং এক সাগর রক্তের বিনিময়ে এদেশের স্বাধীনতা কত মূল্যবান তা উপলব্ধি করবে। বধ্যভূমি এবং মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক বিভিন্ন তথ্যাদি সংরক্ষণের ক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় আরো জোরালো ভূমিকা পালন করবে বলেই সকলে প্রত্যাশা।