অন্যান্যউপ-সম্পাদকীয়

দুশ্চিন্তার দিন শেষ, স্মার্ট ভূমিসেবায় বাংলাদেশ -মোহাম্মদ ওমর ফারুক দেওয়ান

মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহন করেছিলেন ময়মনসিংহ জেলার নান্দাইল উপজেলার বাসিন্দা মোঃ সজিব মিয়া (ছদ্মনাম)। উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিতও হয়েছেন তিনি। নিয়েছেন সরকারি চাকরিও। কিন্তু তাকে নিয়ে তার বাবার দুঃশ্চিন্তার শেষ ছিলো না। বাবার অবর্তমানে ছেলে তার রেখে যাওয়া জমি-জমা রক্ষা করতে পারবে কিনা এটিই ছিল সজিবের বাবার দুঃশ্চিন্তার মূল কারন। বহুবার ছেলেকে এ বিষয়ে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন সজিবের বাবা, কাজ হয়নি। সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে নিজের জীবদ্দশাতেই তাঁর সমস্ত সম্পত্তি হেবা দলিল করে দেন ছেলের নামে। ছেলে সজিবের কাছে জমিজমা মানেই এক জটিল, দুর্বোধ্য বিষয়। তার ওপর ছোট বেলা থেকেই শুনে আসছেন ভূমি অফিস মানেই দুর্ভোগ আর হয়রানির কারখানা। টাউট দালালদের দৌরাত্ম আর ভূমি অফিসের কর্মচারীদের অসহযোগিতার চিত্রই যেন তাঁর মাথায় ভেসে উঠত সবসময়। কিন্তু তাঁর এই ধারনা বদলে যায় আঞ্চলিক তথ্য অফিস, ময়মনসিংহ আয়োজিত এক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে। উক্ত প্রশিক্ষণে সজিব জানতে পারেন ভূমিসেবা এখন হাতের মুঠোয়। ভূমি অফিসে না গিয়েও প্রায় সব ধরনের ভূমিসেবা পাওয়া যায় ঘরে বসেই। বিষয়টা তাঁকে কৌতূহলী করে তোলে। বাবার সাথে আলোচনা করে তিনি অনলাইনে নামজারির আবেদন করেন। একদিনও ভূমি অফিসে না গিয়ে, ঘরে বসে সকল প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে এক মাসের মধ্যে তিনি খতিয়ান হাতে পান। এটা তাঁর কাছে স্বপ্নের মতো লাগে। তিনি যেন নিজেই নিজেকে বিশ্বাস করতে পারছেন না।

ই-নামজারি কি?

ক্রয়সূত্রে বা উত্তরাধিকারসূত্রে কিংবা যে কোন সূত্রে জমির নতুন মালিক হলে নতুন মালিকের নাম সরকারি খতিয়ানভূক্ত করার প্রক্রিয়াকে নামজারি বলা হয়। অনলাইনে আবেদনের মাধ্যমে নামজারি সম্পন্ন করা হলে তাকে ই-নামজারি বা ই-মিউটেশন বলে। ভূমিসেবা ডিজিটালাইজেশনের অংশ হিসেবে ২০১৭ সালের ১ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের ৭টি উপজেলায় পাইলট আকারে ই-নামজারি কার্যক্রম শুরু হয়। জনগনের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলে প্রকল্পটি। ভূমিসেবা জনগনের দোরগোড়ায় নিতে ২০১৯ সালের ১ জুলাই সারাদেশে একযোগে শতভাগ ই-নামজারি কার্যক্রম চালু হয়। তিনটি পার্বত্য জেলা বাদে দেশ জুড়ে 4594 টি অফিস (উপজেলা ভূমি অফিস, সার্কেল অফিস ও ইউনিয়ন ভূমি অফিস) ই-নামজারি চালু রয়েছে। আইসিটি বিভাগ ও এটুআই প্রকল্পের সার্বিক সহযোগিতায় ভূমি সংস্কার বোর্ড ই-নামজারি বাস্তবায়ন করছে।

বিগত ৯০ দিনের তথ্যচিত্র

ভূমি মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে প্রতিবছর গড়ে প্রায় ২২ লাখ নামজারির আবেদন করা হচ্ছে। বিগত ৯০দিনে (১৭ ডিসেম্বর, ২০২৩ খ্রি. তারিখ পর্যন্ত) সমগ্র বাংলাদেশে ৪৫৯4টি ভূমি অফিসে মোট আবেদন পড়েছে ১১ লাখ ৯৬ হাজার ১৩২টি, নিষ্পত্তিকৃত আবেদন সংখ্যা ১৩ লাখ ৮৪ হাজার ৩৭১টি, যার ৭৮ শতাংশ আবেদন মঞ্জুর হয়েছে। আবেদন নিষ্পত্তিতে গড় সময় লেগেছে মাত্র ২৭দিন। ভূমি ব্যবস্থাপনায় অসামান্য এই অগ্রগতির স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশের ভূমি মন্ত্রণালয় ‘জাতিসংঘ পাবলিক সার্ভিস অ্যাওয়ার্ড-২০২০’ অর্জন করেছে। ‘স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক সরকারি প্রতিষ্ঠাণের বিকাশ’ ক্যাটাগরিতে জাতিসংঘের এই মর্যাদপূর্ণ পুরস্কার ১৩ ডিসেম্বর ২০২১ দুবাইয়ে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর হাতে তুলে দেওয়া হয়।

ই-নামজারির আবেদন পদ্ধতি

বাংলাদেশের যে কোন নাগরিক ঘরে বসেই দিনরাত চব্বিশ ঘন্টার যে কোন সময় অনলাইনে ই-নামজারির জন্য খুব সহজেই আবেদন করতে পারেন। এজন্য তাকে যে কোন একটি কম্পিউটার বা মোবাইল থেকে https://mutation.land.gov.bd ওয়েবসাইটে প্রবেশ করতে হবে। সেখানে ই-নামজারি মেনুর ‘অনলাইনে আবেদন করুন’ সাবমেনুতে ক্লিক করলেই একটি আবেদন ফরম আসবে। আবেদন ফরমে জমির মালিকানা সূত্র (ক্রয়,ওয়ারিশ, হেবা ইত্যাদি), আবেদিত জমির তথ্য (মৌজা, খতিয়ান, দাগ, পরিমান, দলিল নং ইত্যাদি), রেকর্ডীয় মালিকের নাম ও ঠিকানা,

-02-

আবেদনকারীর নাম ঠিকানা এনআইডি মোবাইল, যাদের নাম হতে কর্তন হবে তাঁদের নাম ও ঠিকানা ইত্যাদি তথ্য দিয়ে পূরণ করতে হবে। অতঃপর আবেদনকারীর পাসপোর্ট সাইজের এককপি ছবি, স্ক্যান করা স্বাক্ষর, স্ক্যান করা অন্যান্য প্রযোজ্য কাগজপত্র (সংশ্লিষ্ট খতিয়ানের কপি, মূল ওয়ারিশ সনদপত্র, মূল দলিলের সার্টিফাইডকপি, সর্বশেষ দাখিলা, আবেদনকারীর জাতীয় পরিচয়পত্র) ইত্যাদি পিডিএফ/জেপিজি/পিএনজি ফরমেটে আপলোড করতে হবে। অতঃপর দাখিল বাটনে ক্লিক করলে আবেদনের একটি প্রিভিউ দেখা যাবে। প্রয়োজনে সেটা সংশোধন করা যাবে নতুবা চূড়ান্তভাবে দাখিল করা যাবে। দাখিল করার সাথে সাথে একটি আবেদন আইডি নম্বরসহ আবেদনপত্রটি পিডিএফ আকারে সিস্টেমে সংরক্ষিত হবে। প্রয়োজনে এটি ডাউনলোড করে প্রিন্ট করা যাবে।

আবেদন ফি প্রদান পদ্ধতি

আবেদন দাখিলের সাথেসাথে সেটি নিয়ে কাজ শুরু হয়ে যায় না। সরকার নির্ধারিত কোর্ট ফি ও নোটিশ জারি ফি বাবদ ৭০ টাকা পরিশোধের পরই এটি নিয়ে কাজ শুরু করে ভূমি অফিস। তবে এর জন্যও আপনাকে কোথাও যেতে হবে না। ঘরে বসেই অনলাইনে (মোবাইল ব্যাংকিং-নগদ,বিকাশ ইত্যাদি এবং ভিসাকার্ড, মাস্টার্ডকার্ডসহ অন্যান্য ইন্সট্রুমেন্টস ব্যবহার করে) পেমেন্ট করতে পারবেন। আবেদন দাখিলের পর পেমেন্ট অপসনে গেলে আপনার প্রদত্ত মোবাইল নম্বরে একটি ‘পেমেন্ট ট্রাকিং নম্বর’ এসএমএস আকারে যাবে। সেটি ব্যবহার করেই পেমেন্ট করা যাবে। পেমেন্ট সম্পন্ন হলে সেটির একটি রশিদ সিস্টেমে সংরক্ষিত থাকবে।

আবেদন ট্রাকিং পদ্ধতি

আবেদনকারী উল্লিখিত ওয়েবসাইটের ‘আবেদন ট্রাকিং’ মেনুটি ব্যবহার করে যে কোন সময় আবেদনের অবস্থা ট্রাক/যাচাই করতে পারবেন। আবেদন ফি জমার পর আবেদনপত্রটি সংশ্লিষ্ট সহকারী কমিশনার (ভূমি) এর কার্যালয়ে স্বয়ংক্রিয়ভাবে জমা হয়। সহকারী কমিশনার (এসিল্যান্ড) আবেদনের বিপরীতে একটি কেস নাম্বার দেন এবং সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তার (ইউএলএও) কাছে প্রতিবেদনের জন্য প্রেরণ করেন। ইউএলএও অনলাইনেই প্রতিবেদন দিয়ে এসিল্যান্ড অফিসে ফেরত পাঠান। অতঃপর কানুনগো প্রতিবেদনটি যাচাইকরে অনুমোদনের জন্য পুনরায় সহকারী কমিশনারের কাছে প্রেরন করেন। সবকিছু ঠিক থাকলে এসিল্যান্ড অনুমোদন করেন অথবা শুনানীর প্রয়োজন হলে শুনানীর দিন ধার্য করেন। এই শুনানীর জন্য আগে ভূমি অফিসে যেতে হলেও এখন অনলাইনেই জুম বা অন্য প্লাটফর্মে গ্রহণ করা হয়। এসিল্যান্ড কর্তৃক খসড়া খতিয়ান অনুমোদনের পর আবেদনকারীর সংশ্লিষ্ট মোবাইলে ডিসিআর ফি প্রদানের জন্য একটি ম্যসেজ যায়। পেমেন্ট ট্রাকিং নম্বর ব্যবহার করে পূর্বের ন্যায় একই পদ্ধতিতে অনলাইনে ডিসিআর ফি বাবদ ১১০০টাকা পরিশোধ করা যায়। ডিসিআর ফি প্রদানের দু-একদিনের মধ্যে ডিসিআর ফি রশিদ ও পূর্নাঙ্গ খতিয়ান প্রস্তুত হয়ে অনলাইন সিস্টেমে সংরক্ষিত থাকে। এই পুরো প্রক্রিয়াটি আবেদনকারী ঘরে বসেই ট্রাকিং করতে পারেন, জানতে পারেন কখন কোন অগ্রগতি হচ্ছে। তাছাড়া, ভূমি মন্ত্রণালয়ের হটলাইন নম্বর 16122 নম্বরে ফোন করেও ভূমি সেবা সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য জানার ব্যবস্থাও রয়েছে।

পরিশেষে বলা যায়, ভূমির সাথে আমাদের সম্পর্ক আজন্ম, কিন্তু ভূমি নিয়ে ভোগান্তির বিস্তর অভিযোগ ছিল। ই-নামজারি চালুর মাধ্যমে দালালচক্রের হাত থেকে যেমন মুক্তি মিলেছে তেমনি কমেছে সংশ্লিষ্ট সরকারী কর্মচারীর ক্ষমতার অপব্যবহারের সুযোগ। ফলে দূর হয়েছে জনগনের ভোগান্তি ও হয়রানি। স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণ তারই এক বাস্তব উদাহরণ এই ই-নামজারি। এখন প্রয়োজন শুধু জনগনের সচেতনতা।

লেখকঃ উপপ্রধান তথ্য অফিসার, আঞ্চলিক তথ্য অফিস, পিআইডি, ময়মনসিংহ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *