নির্বাচনী প্রচারণায় নারীদের উপস্থিতি লক্ষণীয় হলেও ভোটকেন্দ্রে যাওয়া নিয়ে অনাগ্রহ
বাবলী আকন্দ ঃ ভোটের মাত্র আছে হাতে ৩ দিন। প্রার্থীদের নির্বাচনী প্রচারণা শেষের দিকে। প্রার্থীদের নির্বাচনী প্রচারণাগুলোতে নারী উপস্থিতি লক্ষণীয় হওয়া স্বত্বেও ভোটকেন্দ্রে যাওয়া নিয়ে নারীসহ তৃণমূল পর্যায়ের মানুষের অনাগ্রহ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। প্রার্থীদের পক্ষ থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে ভোটকেন্দ্রে যাওয়া নিয়ে আগ্রহ সৃষ্টি করা হয়েছে। ময়মনসিংহ ৪ সদর আসনে নির্বাচনী আমেজ শুরু হয়েছিল গত ১৮ ডিসেম্বর থেকে। বিভিন্ন সভা, মিছিলে অংশগ্রহণ করার মধ্য দিয়ে ভোট প্রার্থনায় কেটেছে প্রার্থীদের ব্যস্ত সময়। নগরীতে পোষ্টারে পোষ্টারে শোভা পাচ্ছে প্রার্থীদের প্রতীকসহ নিজস্ব ছবি। মাইকিং, গানের মধ্য দিয়ে গুণগান, বাসায় বাসায় গিয়ে কর্মীদের মাধ্যমে লিফলেট বিতরণ চলেছে জোরেসোরে। পাশাপাশি ঘোষিত হয়েছে নানা উন্নয়নের বাণী। এছাড়াও চলেছে একে অন্যকে কাউন্টার দিয়ে বক্তব্য। বিশেষ করে নৌকা ও ট্রাক প্রতীকের প্রার্থীদের।আর আসনবাসীদের দিচ্ছেন নানা প্রতিশ্রুতি। ময়মনসিংহ ৪ সদর আসনে নৌকা প্রতীক নিয়ে লড়ছেন সাবেক ধর্ম প্রতিমন্ত্রী মরহুম বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যক্ষ মতিউর রহমান এঁর ছেলে ও ময়মনসিংহ মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোহিত উর রহমান শান্ত এবং তার বিপরীতে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ট্রাক প্রতীক নিয়ে লড়ছেন ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামী লীগের সহ সভাপতি ও বিশিষ্ট ব্যবসায়ী আমিনুল হক শামীম।
এদিকে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দের মধ্যে বিভক্ত হয়ে প্রার্থীদের প্রচারণায় অংশ নিচ্ছেন অনেকে। নৌকার পক্ষে প্রচারণায় আছেন ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এহতেশামুল আলমসহ আওয়ামীলীগের একাংশ, অঙ্গ সহযোগী সংগঠনের একাংশ ও ১৪ দলের নেতৃবৃন্দ এবং ট্রাক প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থীর পক্ষে প্রচারণায় আছেন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এড মোয়াজ্জেম হোসেন বাবুলসহ অন্যান্য অঙ্গ সহযোগী সংগঠনের একাংশ।
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় পর্যায়ের নেতৃবৃন্দের একটা বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে ভোটকেন্দ্রে ভোটারের উপস্থিতি। যা প্রায় প্রতিটি আসনের জন্যই চ্যালেঞ্জ। যার প্রভাব পড়তে পারে ময়মনসিংহ ৪ সদর এই আসনেও। তাই প্রার্থীরা তাঁদের বক্তব্যে ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে হাজির হওয়ার অনুরোধ জানাচ্ছেন। নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক করতে এই আসনে জমে উঠেছে নৌকা ও ট্রাকের লড়াই।
ভোট দেয়া নিয়ে কি ভাবছেন তৃণমূল পর্যায়ের মানুষ!
আগামী ৭ জানুয়ারি ভোট দেয়া নিয়ে তেমন আগ্রহ নেই খেটে খাওয়া মানুষদের। শ্রমজীবী ও শ্রমিকেরা এ নিয়ে তেমন মাথা ঘামাচ্ছেন না। তারা নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির মূল্য বৃদ্ধি, বাজারের সাথে সঙ্গতি রেখে মজুরি না বাড়ানো নিয়ে শংকিত। অতিকষ্টে দিন পার করছেন তারা।
দিন আনে দিন খায় একজন ভ্যানশ্রমিক জানান, আমরা খাইট্টা(খেটে) খাই। নির্বাচনে যেই আয়ুক (আসুক),সবাই নিজের নিজের স্বার্থের লেইগা (জন্য) কাজ করবো। আমরার আল্লাহ ছাড়া আর কেউ নাই!
লুৎফর মোল্লা নামে একজন রিকশাচালক জানান, ভোট দেয়ার বিষয়ে তেমন আগ্রহ নাই। কারণ আওয়ামীলীগ আওয়ামীলীগই প্রার্থী। স্বতন্ত্র শামীম সাহেব হে (সে)তো আওয়ামী লীগই করে আর এদিকে মতি (প্রয়াত বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যক্ষ মতিউর রহমান) চাচার ছেড়া(ছেলে) শান্ত ভাই সেও আওয়ামী লীগ। তাইলে কারে রাইখা কারে ভোট দিমু। আর অন্য যারা প্রার্থী আছে হেরাও(তারাও) আওয়ামী লীগের সাপোর্টার। তাই ভোট দেয়ার আগ্রহ নাই।
শহরের হোটেলে কাজ করে রব্বানী ভোটের প্রশ্নে হেসে দেন। তিনি বলেন, আমরার বেতন বাড়ে না। হেরা (তারা) বেতন কি বাড়াইয়া (বাড়িয়ে) দিবো। বেতন বাড়াক,পরে চিন্তা করমু নে।
গাঙ্গিনাপাড় ফুটপাতে বসে কাপড় বিক্রি করেন রহিম(ছদ্মনাম)। তিনি বলেন, গরীব মানুষের চিন্তা হেরা(তারা) কেউই করে না। দুইদিন পর পর এইন্তেকা(এখান থেকে) উঠাইয়া দেয়। পুলিশসহ অইসব নেতাগোর লোকদের মাসোয়ারা দিতে হয়। ভোট দিয়া আর কারে আনমু। যেই আইবো তারেই মাসোয়ারা দিতে হইবো। তাইলে ভোট দেয়া দরকার কি!!
ময়মনসিংহের ৪ সদর আসনে নারী ভোটারের সংখ্যা বেশি। ভোটকেন্দ্রে যাওয়া নিয়ে যা ভাবছেন নারীরা!
নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নিলেও নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন নারী ভোটকেন্দ্রে যাবেন না। কেন জানতে চাইলে হেসে জানান, অভাবের সংসারে প্রচারণায় গেসি দুই টাকা পাওয়ার জন্য। বিকেলে বের হইসি সন্ধ্যা পর্যন্ত প্রচারণা চালাইসি। বাড়ি বাড়ি গেসি। পরে ৩০০/- দিয়েছে। ভোটকেন্দ্রে মারামারি হইতে পারে তাই বাচ্চার বাপ যাইবার না করসে। টেহা(টাকা)থেইকা (থেকে) জীবনের দাম অনেক বেশি, আফা।
গৃহকর্মী শবনম জানান, মাইনসের(মানুষের) বাসায় কাজ কইরা(করে) খাই। ভোট এইতা (এটা) বেডাইনগর (পুরুষের) কাম(কাজ)। ভোট দেওনের(দেয়ার) সময় নাই। কামে(কাজে) ব্যস্ত থাহুইন (থাকতে) লাগবো।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন নারী জানান, হেরা (তারা) যে এতো কথা কয়(বলে) জিনিসপত্রের দাম কমানির (কমানোর) কথা কয় (বলে)না কেন? বাসা ভাড়া কমানির (কমানোর) কথা কয় (বলে)না কেন? ভোট দিয়া কি হবে!!
ভোটকেন্দ্রে সহিংসতার আশংকা করে গৃহিণী রহিমা বেগমকে তার স্বামী ফজলু ভোটকেন্দ্রে না যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। এ বিষয়ে গৃহিণী রহিমা বেগম জানান, শহরে যে পরিস্থিতি। এই পরিস্থিতিতে আমাদের নিরাপত্তার কথা ভেবেই আমার স্বামী ভোটকেন্দ্রে যেতে না করছে।
সানকিপাড়া নিবাসী গৃহিণী হেলেনা জানান, স্বামী অনুমতি না দিলে অথবা আমারে নিয়ে না গেলে ভোট দিতে পারবো না।
আকুয়াবাসী সোনিয়া এবার প্রথম ভোটার। তার আগ্রহের সীমা নেই সে প্রথম ভোট দিতে যাবে। কিন্তু ভাইয়ের আবদারে তাকে ভোট দিতে হবে বলে জানান তিনি। ভাই যাকে ভোট দিতে বলেছে তাকেই ভোট দিবেন তিনি তবে সেগুলো বিবেচ্য বিষয় নয় কেননা তিনি প্রথম ভোট দিচ্ছেন এটাই তার কাছে খুব আনন্দদায়ক ও উত্তেজনাপূর্ন বিষয়।
৭০ বছর বৃদ্ধা মরিয়ম জানান, আমরা বুড়া হইয়া গেসি, আমগর(আমার) ভোটের আর কি দাম আছে! আর অসুস্থ এই শরীর নিয়া যাইতাম না, বাবা!
তৃণমূল পর্যায়ে ভোট কেন্দ্রে যাওয়া নিয়ে যে অনাগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে তা আগামী ৭ জানুয়ারি ভোটকেন্দ্রগুলোতে বিরুপ প্রভাব পড়তে পারে বলে মনে করছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন লেকচারার। তিনি বলেন, একটি রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দের মধ্যে বিভক্ত করে নিজেরাই নির্বাচন করছে। তবে সেটিকে আদৌ গণতান্ত্রিক নির্বাচন বলা যাবে না। আর এ বিষয়টি সাধারণ মানুষ উপলব্ধি করে বিধায় ভোটকেন্দ্রে উপস্থিত না হওয়ার আগ্রহ বাড়ছে।
এদিকে বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটার তালিকার নামের লিষ্ট ও ভোটকেন্দ্রের নাম মানুষের বাসায় বাসায় গিয়ে পৌঁছে দিচ্ছেন প্রার্থীদের এজেন্টরা।
উল্লেখ্য, ময়মনসিংহের এই আসনটিতে মোট ভোটার ৬,৫০,২৮৯( ছয় লক্ষ পঞ্চাশ হাজার দুইশত ঊননব্বই) জন। নারী ভোটারের সংখ্যা ৩,২৭,৪৭৮ (তিন লক্ষ সাতাশ হাজার চারশত আটাত্তর) জন, পুরুষ ভোটার ৩,২২,৮০১ (তিন লক্ষ বাইশ হাজার আটশত এক)জন, হিজড়া ভোটার ১০ জন।