বাগান থেকে ছায়াবৃক্ষ ও কাঁচা চা পাতা চুরি: ক্ষতির মুখে চা শিল্প
নূরুল মোহাইমীন মিল্টন ॥ ছায়াবৃক্ষ চা গাছের ছাতা হিসাবে কাজ করে। অতিবৃষ্টি ও রোদ থেকে রক্ষা ছাড়াও পরিবেশের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে ছায়াবৃক্ষ বা সেডট্রি। তবে অব্যাহতহারে ছায়াদানকারী এসব মূল্যবান গাছগাছালি চুরি হওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে চা শিল্প। এর প্রভাব পড়ছে ওই শিল্পের সাথে জড়িত শ্রমিকদের উপর। মৌলভীবাজারের চা বাগান থেকে গাছ ও কাঁচা চা পাতা চুরি হচ্ছে হরদম। চা বাগানের কতিপয় কর্মকর্তা, কর্মচারীর যোগসাজসে এসব অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে বলে বিভিন্ন সুত্রে জানা যায়। ফলে পাতি উত্তোলনে নিরিখ পুরো হচ্ছে না শ্রমিকদের। চায়ের উৎপাদনে পড়ছে প্রভাব। ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে ধাবিত হচ্ছে চা শিল্প।
সরেজমিনে ঘুরে ও চা শ্রমিকদের সাথে কথা বলে জানা যায়, মৌলভীবাজারের সরকারি, বিভিন্ন কোম্পানি ও ব্যক্তিমালিকানাধীন চা বাগান থেকে ছায়াদানকারী গাছ ও সেকশনের কাঁচা চা পাতা চুরির ঘটনা দীর্ঘদিনের। চা বাগানের ম্যানেজমেন্টের কতিপয় কর্মকর্তা ও কর্মচারীর যোগসাজসে বৃক্ষশূন্য হচ্ছে চায়ের টিলাভূমি। ফলে এই শিল্পের সাথে জড়িত হাজারো শ্রমিকের জীবন জীবিকাও হুমকির মুখে পড়েছে। নানা সমস্যা সংকটে জর্জরিত চা শ্রমিকরা। তার উপর নিরিখ পুরো করতে না পারলে দৈনিক মজুরি থেকেও সপ্তাহে হাজিরা কমে আসে। আর ছায়াদানকারী গাছ গাছালি চুরি হওয়ায় প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা করতে পারছে না চা গাছ। এতে উৎপাদনও কম হচ্ছে। অন্যদিকে বাগানের সেকশন থেকে কচি চা পাতা কেটে চুরি হওয়ায় নারী শ্রমিকরা পাতি উত্তোলন করতে পারছে না। মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার ডানকান ব্রাদার্স শমশেরনগর এর ফাঁড়ি কানিহাটি চা বাগান থেকে সম্প্রতি ছায়াবৃক্ষ চুরির অভিযোগ তুলেন শ্রমিকরা। ওই বাগানের ফাঁড়ি বাঘিছড়া ও দেওছড়া চা বাগানের বিভিন্ন সেকশন থেকে কাঁচা চা পাতাও চুরি হচ্ছে। এতে নারী শ্রমিকদের পাতি উত্তোলনে নিরিখ পুরো করা সম্ভব হচ্ছে না বলে তারা দাবি করছেন। ক্ষুদ্ধ শ্রমিকরা বাগান ম্যানেজমেন্টকে ব্যবস্থা গ্রহণেরও দাবি জানিয়েছেন। প্রতিনিয়ত রাতের আঁধারে গাছ ও চা পাতা চুরির ঘটনা নতুন নয়। এর ফলে চায়ের উৎপাদন, শ্রমিকের হাজিরা এবং পরিবেশেরও উপর প্রভাব পড়ছে।
চা শ্রমিকদের অভিযোগে জানা যায়, গাছ ও কাঁচা চা পাতা চোর সিন্ডিকেট চক্র রাতের আঁধারে বাগানের টিলায় প্রবেশ করে প্রতিনিয়ত গাছ ও কাঁচা চা পাতা চুরি করে। চা বাগানের কতিপয় কর্মকর্তা, কর্মচারী ও পাহারাদারদের সাথে যোগসাজস করে নিয়মিত এসব অপরাধ সংগঠিত হচ্ছে। বাগানের মূল্যবান ও পুরাতন ছায়াবৃক্ষ হিসাবে আকাশি ও রেন্ট্রি গাছ ভূমিকা পালন করছে। এই গাছগুলো কেটে টুকরো করে ঠেলাগাড়ি যোগে স’মিলসহ বিভিন্ন স্থানে পাচার করা হয়। অপরদিকে কাঁচা চা পাতা চোর চক্র রাতে সেকশনে প্রবেশ করে কাঁচি দিয়ে চা গাছের কচি পাতা কেটে বস্তা ভর্তি করে নেয়। প্রতি রাতেই দেওছড়া, কানিহাটি, ডবলছড়া, বাঘিছড়া, শমশেরনগর, আলীনগরসহ বিভিন্ন চা বাগানের সেকশন থেকে কাঁচা চা পাতা পাচার করে। বস্তাভর্তি করে বাগানের বাহিরে নির্দিষ্ট স্থানে জড়ো করে মধ্যরাত কিংবা ভোর রাতে ট্রাক ও পিকআপযোগে পাচার করা হয়। চোরাই কাঁচা চা পাতা ভর্তি গাড়ি কুলাউড়া ও রাজনগর সড়ক দিয়ে স্থানান্তর করা হয়।
শ্রমিকরা জানান, স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনকে ম্যানেজ করে প্রতিনিয়ত চা বাগানের গাছ ও কাঁচা চা পাতা চুরি হচ্ছে। এসব ঘটনায় কিছু শ্রমিকরা ক্ষুব্ধ হলেও তা কোনমতেই রোধ হচ্ছে না। সম্প্রতি শমশেরনগর এর ফাঁড়ি কানিহাটি চা বাগানের ২ নম্বর সেকশন থেকে তিনটি মূল্যবান আকাশি গাছ চুরির ঘটনা ঘটে। এর প্রতিবাদ জানিয়ে তারা কিছু সময়ে কর্মবিরতি পালন করে ও বাগান ম্যানেজমেন্টকে দ্রুত ভূমিকা ও ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন। চা বাগানের বিভিন্ন সেকশন বা টিলা থেকে গাছ কেটে পাচার হয়ে যাওয়ায় বৃক্ষ শূন্য টিলা খাঁ খাঁ করছে। এভাবে ধ্বংস করে টিলাগুলোতে এক সময় রাবার গাছ লাগানো হতে পারে বলে শ্রমিকদের শঙ্কা রয়েছে।
বাঘিছড়া চা বাগানের নারী শ্রমিক সুফলা বাউরী, সুজতা রিকিয়াশন, আরতি উরাং ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, সেকশনে গেলাম পাতি উঠাতে। গিয়ে দেখি রাতেই এগুলো চুরি হয়ে গেছে। এখন আমরা কোথা থেকে চা পাতা উত্তোলন করবো। বাগানে পাহারাদার থাকে। দেখাশুনার জন্য। এরপরও সেকশন থেকে কচি চা পাতা চুরি হওয়ায় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য ম্যানেজমেন্টকে বলেছি।
বাঘিছড়া চা বাগান পঞ্চায়েত সভাপতি লছমন রবিদাস, কানিহাটি চা বাগানের সভাপতি প্রতাপ রিকিয়াশন বলেন, বাগান থেকে গাছগাছালি ও কাঁচা চা পাতা চুরি হচ্ছে। অন্যান্য বাগানের মতো সেকশনের চা গাছ থেকে নারী শ্রমিকরা পাতি উত্তোলন করতে পারছে না। তাদের নিরিখ পুরো করা কষ্টকর হয়ে পড়ছে। তারা আরও বলেন, গাছ চুরি হয়ে যাওয়ায় টিলাগুলো বৃক্ষ শূন্য হয়ে পড়ছে। এজন্য চা গাছে ছায়াও থাকবে না। ফলে বাগানের বড় ধরণের ক্ষতি হচ্ছে।
শমশেরনগর কানিহাটি চা বাগানের শ্রমিক ও ইউপি সদস্য সীতারাম বীন বলেন, দেওছড়া, শমশেরনগর, কানিহাটি, বাঘিছড়া এসব বাগান থেকে দীর্ঘদিন ধরে কাঁচা চা পাতা ও মূল্যবান গাছ চুরি হচ্ছে। ফলে এর প্রভাব পড়ছে চা শ্রমিক ও উৎপাদনে। গাছ কমে যাওয়ায় পরিবেশেও হুমকির মুখে পড়ছে। এসব বিষয়ে ম্যানেজমেন্ট যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ না করলে ভবিষ্যতে বড় ধরণের ক্ষতি গুণতে হবে।
এ ব্যাপারে শমশেরনগর চা বাগানের ডেপুটি ম্যানেজার মো. রফিকুল ইসলামের সাথে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করলে তিনি নিজের দায়িত্ব এড়িয়ে বলেন, চা বাগানের গাছ ও কাঁচা চা পাতা চুরির বিষয়ে শ্রমিকরা লিখিত অভিযোগ দিলে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
(সূত্র: সাপ্তাহিক সেবা ॥ ৪০ বর্ষ ॥ সংখ্যা- ০৫ ॥ রবিবার ॥ ২৮ অগ্রহায়ণ ১৪২৭ ॥ ১৩ ডিসেম্বর ২০২০)