রক্তাক্ত খাপড়া ওয়ার্ড: প্রয়াত রাজবন্দী আবদুস শহীদের কারা স্মৃতি
বিশেষ প্রতিবেদক: ২৪ এপ্রিল ঐতিহাসিক খাপড়া ওয়ার্ড দিবস। ১৯৫০ সালের রাজশাহী কারাগারের খাপড়া নামক ওয়ার্ডে ইতিহাসের বর্বরতম এই জেল হত্যাকান্ড সংঘঠিত হয়। ১৯৪৯-৫০ সালে জেলখানাগুলিতে মোট চারবার অনশন ধর্মঘট অনুষ্ঠিত হয়। প্রথমবার ৩৮ দিন, দ্বিতীয় বার ৪১ দিন, তৃতীয়বার ৪৫ দিন এবং চতুর্থবার ৬১ দিন। প্রত্যেক বারই দাবি ছিল মোটামুটি এক। জেলখানায় সে সময়ে সরকার রাজবন্দীদের কোন রাজনৈতিক মর্যাদা না দিয়ে তৃতীয় শ্রেণির সাধারণ কয়েদি করে রেখেছিল। সেই হিসাবে কয়েদীদের জেলের কুর্তা পরতে হতো এবং বইপত্র, খবরের কাগজ ইত্যাদি দেওয়া হতো না। এসবের প্রতিবাদে কয়েদীরা ধর্মঘট শুরু করে। সেদিনকার ধর্মঘটে নেতৃত্ব দেন কমরেড আবদুল হক। এই ধর্মঘট ঢাকা ও রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগার এবং অন্যান্য জেলা কারাগারগুলিতে অনুষ্ঠিত হয়। ২৪ এপ্রিলের ঘটনা সেদিনকার এক রাজবন্দী আবদুশ শহীদের কারাস্মৃতি থেকে উল্লেখ করা হলো –
“১৯৫০ সালের ২৪ এপ্রিল সম্ভবত ছিল সোমবার। খাপরা ওয়ার্ডের রাজবন্দীরা সকালের চা-রুটি দিয়ে নাশতা করছেন আর তাদের আগের রাতের আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন। চায়ের পেয়ালা, কেটলি, রুটির থালা এদিক ওদিকে রাখা হয়েছে। সকলেই ক্লান্ত ও অবসাদগ্রস্ত। সভায় সভাপতিত্ব করছে দীর্ঘদেহী শ্যামলা বর্ণের গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ কুষ্টিয়ার কমরেড হানিফ। তিনি বক্তাদের বক্তব্য সংক্ষেপ করতে বললেন এবং জানালেন সময় বেশি নেই। কমরেড হানিফের কথা সারা হতে না হতেই খাপড়া ওয়ার্ডের বাইরে অনেক বুটের খট খট আওয়াজ শুনতে পেলাম। সভাপতি উঠে দাঁড়াতেই আমরা পিছন ফিরেই দেখি সুপার মি. বিল, ডাক্তার দুইজন ডেপুটি জেলার সুবেদার আকবর খাঁ, কয়েকজন মেট এবং সিপাহীসহ প্রায় পঁচিশ ত্রিশজন ওয়ার্ডের মধ্যে ঢুকে পড়েছে। সুপার সরাসরি পূর্বদিকে হক সাহেবের কাছে গিয়েই বললো ‘‘Be ready Haque, some of you are to be segregated now”Ó । হক সাহেব সঙ্গে সঙ্গে বললেন : “Just sit down please, we have talk with you about this matter” আমি তখন ঠিক বিলের পাশেই দাঁড়ান। হকের কথা শেষ না হতেই সে বলে চিৎকার করে উঠল “Shut up the door” । মনে হলো যেনো, এই আদেশ দেয়ার পরই তার খেয়াল হলো খাপড়ার একটি মাত্র গেট বাইরে থেকে আটকে দিলে তাতে সবাইকে নিয়ে আটকা পড়বে। তাই সে অর্ডার দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে দ্রুত দৌড়ে বেরিয়ে যেতে চাইল। গেটে দাঁড়ানো ছিল পাবনার উল্লাপাড়ার বাবর আলি, কুষ্টিয়ার দেলওয়ার, বরিশালের আবু (রশীদউদ্দীন)। তারা গেটটি প্রায় বন্ধ করে আনছিল, এরই মধ্যে বিল এসে বাবর আলির হাতে হান্টার দিয়ে সজোরে আঘাত করে তার কব্জি ভেঙ্গে দিল এবং বুট দিয়ে প্রচন্ড ধাক্কা মেরে গেটের বাইরে বেরিয়ে গেল। বিলের ঠিক পশ্চাতে ছিল কমরেড সদানন্দ। সে সুবেদারের পাগড়ি ধরে টান দেয়ায় সুবেদার পাগড়ি রেখেই বেরিয়ে গেল। এদিকে বিল বেরিয়েই বাঁশিতে হুইসেল দিল। সঙ্গে সঙ্গে প্রায় চল্লিশ জন সিপাই লম্বা বাঁশের লাঠি নিয়ে খাপড়ার বারান্দায় এসে উপস্থিত হলো। ইতিমধ্যে আমরা ভিতর দিয়ে গেট আটকিয়ে দেয়ায় ওদের কেউ ভিতরে ঢুকতে পারল না। কিন্তু ওরা সমস্ত জানালার গরাদের ফাঁক দিয়ে লাঠি ছুঁড়ে মারতে লাগল। উন্মত্ত আক্রোশে সিপাইরা গরাদের ওপর লাঠি দ্বারা প্রচন্ড আঘাত করতে লাগল। আমরাও আমাদের লোহার খাটগুলো এগিয়ে নিয়ে জানালার কপাটগুলো আটকাতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু ওদের লাঠির সামনে এগোতে পারছিলাম না। এরই এক ফাঁকে আমি জানালার কাছে গিয়ে উর্দুতে সাধারণ সিপাইদের উদ্দেশ্যে বলতে লাগলাম : “সিপাহী ভাইও ইয়ে লড়াই তোমলোগে কা নেহি হায়। মগার ইস সরমায়াদার সরকারকে সাথ জো তোমকো আওর হামকো ভি দুশমন হ্যায়।” বলা শেষ হতে না হতেই এক মেট এসে আমার হাতে এমন বাড়ি মারল যে আমার ডান হাতের তর্জনীটি কেটে সামান্য একটু চামড়ার সঙ্গে ঝুলে রইল। আমি দৌড়ে ভিতরে গেলে কমরেড সত্যেন সরকার আমার আঙ্গুল বেঁধে দিলো। তারপর আবার আমরা খাট নিয়ে জানালার দিকে এগোতে লাগলাম। আমরা এবার আমাদের কাঁসার থালা, ঘটি, বাটি, শিশি, দোয়াত যাবতীয় জিনিস জানালার ফাঁকা দিয়ে ওদের দিকে ছুড়তে লাগলাম। ওরাও এমনভাবে লাঠি দিয়ে জানালায় দেয়া আমাদের লোহার খাটগুলো ধাক্কা দিয়ে ফেলতে লাগল যে আমাদের দিনাজপুরের কমরেড কালী সরকার এবং মিরপুরের নাসির খাটের নিচে পড়ে গেল। মনে আছে খাপড়ার দক্ষিণ দিকে আমি একটি দোয়াত নিয়ে বাইরে সজোরে নিক্ষেপ করেছি এমন সময় ফায়ার শব্দে খাপড়া যেন বিদীর্ণ হলো। চকিতে দৃষ্টিতে দেখলাম, খাপড়ার প্রায় পঞ্চাশটি জানালায় বন্দুকের নল লাগিয়ে সিপাহীরা দাঁড়িয়ে আছে। আমি তৎক্ষণাৎ উপুড় হয়ে বালিশের নিচে মাথা গোঁজার সঙ্গে সঙ্গে রাইফেলের গর্জনে খাপড়ার ভিত যেন ফেটে চৌচির হতে চাইল। গেটের দিকে একটু চোখ পড়তেই দেখলাম ফিনকি দিয়ে রক্ত একেবারে ছাদ পর্যন্ত উঠছে। আমার মাথা একটি সাপোর্টিং ওয়ালের আড়ালে বালিশের নিচে গোঁজা ছিল, পা-কনুই বাইরে ছিল। হঠাৎ লক্ষ্য করলাম হাঁটু দু’ফাঁক করে স্প্লিন্টার ঢুকে গেল। বালিশের নিচ থেকে দেখলাম পাশেই কমরেড হানিফের বাহুর উপরিভাগ ছিঁড়ে গেছে এবং সেখান থেকে অঝোরে রক্ত ঝরছে। একটু পরেই কমরেড হানিফকে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে দেখি। যেন দেখলাম আমার অদূরেই কুষ্টিয়ার কমরেড নন্দ সান্যাল রক্তাক্ত শরীরে মেঝের উপর লুটিয়ে পড়েছে। আমার হুঁশ হারাবার পূর্বে যতটুকু মনে আছে দেখলাম খাপড়া ওয়ার্ডে রক্তের স্রোত বইছে। আমার শরীর বুক পর্যন্ত রক্তে ডুবন্ত।” (কারা স্মৃতি : আবদুশ শহীদ, পৃষ্ঠা ১০৪-১০৬ তৃতীয় সংস্করণ ২০১৪)