শিক্ষকগণ সমাজের প্রাণ সঞ্চারক
শিক্ষা যদি জাতির মেরুদন্ড হয় তবে শিক্ষকগণ সেই মেরুদন্ডের ভিত স্থাপনকারী, শক্তপোক্তকারী এবং বিবেক সমুন্নয়কারী। পিতামাতা কেবল সন্তানকে জন্ম দিতে পারে কিন্তু সেই সন্তানকে প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা, সমাজ ও রাষ্ট্র সম্পর্কে দায়িত্ববোধ ও সচেতন করে সামাজিক জীব হিসেবে প্রতিষ্ঠা করাতে শিক্ষকদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। পৃথিবীতে যতগুলো সম্মানজনক পেশা আছে তার মধ্যে শিক্ষকতা সর্বোচ্চস্তরের সম্মানিত পেশা। কোন পেশাই মহান পেশা হতে পারে কিনা সেটা নিয়ে সমূহ বিতর্ক থাকলেও শিক্ষকতাকে সামাজিক দৃষ্টিকোনে ভিন্ন চোখে বিচার করা হয়। সল্প পারিশ্রমিকের বিনিময়ে আবার কোথাও কোথাও বিনা পারিশ্রমিকে একজন শিক্ষক সমাজবদ্ধ কিংবা সমাজ বিচ্ছিন্ন মানুষের মধ্যে জ্ঞানের মশাল প্রজ্জ্বলিত করে দেন। এককথায় শিক্ষকগণ এই সমাজ-রাষ্ট্রের লাইট হাউস। শিক্ষক হতে হলে তাকে কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত হতে হবে এমন কোন বাঁধাধরা নিয়মেের বালাই নেই। যার কাছ থেকে মানুষ সামান্য কোন বিষয়েও জ্ঞান অর্জন করে তাকেই শিক্ষক হিসেবে বিবেচনা করা যায়। শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্কের অন্তরালে বয়সও কোন বাঁধা সৃষ্টি করতে পারে না।
স্বাভাবিকভাবে শিক্ষকের চেয়ে শিক্ষার্থীর বয়স কম হবে এমনটা ধারনা করা হয় তবে শিক্ষার্থীর চেয়ে শিক্ষকের বয়স কম হলেও অবাক হওয়ার কিছু নাই। প্রাচীন গ্রিক সভ্যতা থেকে শিক্ষকদেরকে অনেক সম্মানের চোখে দেখা শুরু হয়। পরবর্তীতে সোফিস্টদেন আচারণে সেই ধারণায় কিঞ্চিৎ পরিবর্তন ঘটে। গুরু-শিষ্যের মধ্যে সৃষ্ট সম্পর্কের সাথে অন্য কোন সম্পর্কের তুলনা করা প্রায় অসম্ভব। এ সম্পর্কে যেমন আন্তরিকতা থাকে তার অধিক থাকে আধ্যাতিকতার বন্ধন। তবে বর্তমান সময়ে বাংলাদেশসহ বিশ্বের কিছু দেশে শিক্ষকদেরকে প্রাপ্য সম্মান দেয়া হয় না। বরং ক্ষেত্রবিশেষ অপমান-অপদস্থ করার ঝাঁপি খুলে বসা হয়েছে। এক্ষেত্রে আমাদের চিন্তাশক্তির অবক্ষয় যেমন দায়ী তেমনি শিক্ষকরাও কিছু কিছু ক্ষেত্রে অংশত দায়ী। গতিশীল বিশ্বের সাথে পাল্লা দিতে গিয়ে অতীত সংস্কার থেকে মানুষ বের হয়ে আসতে শুরু করেছে। এই প্রবনতা আমাদের জীবনের বহুক্ষেত্রে ইতিবাচক পরিবর্তন সৃষ্টি করলেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্কে। তবুও বিনা বিতর্কে বলা যায়, গোটা মানবসমাজের মধ্যে নৈতিক বিচার-বিশ্লেষণে শিক্ষকদের চেয়ে সম্মানিত এবং শিক্ষকতার চেয়ে মর্যাদাপূর্ণ পেশা আর একটাও নাই। শিক্ষকরাই এই সমাজের প্রাণভোমরা।
প্রতিবছর ৫ই অক্টোবর বাংলাদেশসহ বিশ্বের কয়েকটি দেশে পালিত হয় বিশ্ব শিক্ষক দিবস। মূলত শিক্ষকদের কর্মকান্ডের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে এবং তাদের অবদানকে বিশ্বব্যাপী স্মরণ ও স্বীকৃতি প্রদানের জন্য পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে শিক্ষক দিবস পালন করা হয়ে থাকে। শিক্ষক দিবস পালনের আনুষ্ঠানিক ইতিহাস খুব বেশিদিনের পুরাতন নয়। এই দিবসটি উদযাপনের শুরু হয় ১৯৯৫ সালের ৫ই অক্টোবর থেকে। এরপর থেকে প্রতিবছর নির্ধারিত দিনে শিক্ষকদের প্রতি বিশেষভাবে সম্মান এবং তাদের অবদানকে তুলে ধরার জন্য এ দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। ইউনেস্কোর মতে, বিশ্ব শিক্ষক দিবস শিক্ষা ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে শিক্ষকদের অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ পালন করা হয়। বিশ্বের ১০০টি দেশে এই দিবসটি পালিত হয়ে থাকে। এই দিবসটি পালনে এডুকেশনাল ইন্টারন্যাশনাল (Educational International-EI) ও তার সহযোগী ৪০১টি সদস্য সংগঠন মূল ভূমিকা রাখে। দিবসটি উপলক্ষে ইআই প্রতিবছর একটি প্রতিপাদ্য বিষয় নির্ধারণ করে থাকে যা জনসচেতনতা বৃদ্ধির সাথে সাথে শিক্ষকতা পেশার অবদানকেও স্মারন করিয়ে দেয়। বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলির মত বাংলাদেশেও যথাযোগ্য মর্যাদায় বিশ্ব শিক্ষক দিবস পালিত করা হয়ে থাকে। এই বছর যখন বাংলাদেশে বিশ্ব শিক্ষক দিবস পালনের আয়োজন চলছে তখন দেশের শিক্ষক শ্রেণী ভিন্নরকম বাস্তবতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। যা বহুলাংশেই অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির উদ্রেক করেছে।
সারা বিশ্বের মত বাংলাদেশেও শিক্ষকতা একটি মহান পেশা হিসেবে স্বীকৃত। এ পেশাটি মহান পেশা হলেও বিভিন্ন গণমাধ্যমে শিক্ষকদের দুরবস্থার কথা প্রকাশিত হয়। এ দেশের একজন শিক্ষক যখন তার জন্য নির্ধারিত সম্মানীর মাধ্যমে পরিবারের ভরণ-পোষণের ব্যবস্থা করতে না পেরে হতাশায় হাবুডুবু খায় কিংবা এই মহান পেশা ছেড়ে দিয়ে অন্য কোন অসম্মানের পেশায় জড়িয়ে যায় তখন জাতি হিসেবে আমাদের লজ্জিত হওয়ার কথা। শিক্ষকতা পেশা ছাড়া বাংলাদেশের প্রায় সবগুলো পেশায় দুর্নীতির ভয়ানক ছোঁয়া লেগেছে। শিক্ষা সেক্টরও যে দুর্নীতিমুক্ত তা দাবি করা যায় না তবে তুলনামূলকভাবে চিত্র কিছুটা সন্তোষজনক। অধিকাংশরা শিক্ষকরা ইচ্ছা করলেও অসৎ পথে দু’টো টাকা রোজগার করতে পারে না! শিক্ষকরা অসৎ উপায়ে জীবিকা নির্বাহ করবেই বা কেন? তারা তো সে শিক্ষা পায়নি কিংবা জাতিকে সে শিক্ষা দেয় না। অথচ সেই শিক্ষকদের জন্য রাষ্ট্র কর্তৃক যা নির্ধারিত বেতন ও যে বরাদ্ধ রাখা হয়েছে তা কোন বিচারেই যুক্তিযুক্ত নয়। অন্যান্য পেশায় উচ্চ স্কেলের বেতনের সাথে উপরি কামাইয়ের যথেষ্ট সুযোগ রাষ্ট্র সৃষ্টি করে রেখেছে। শিক্ষকরা সৎভাবে জীবন যাপন করার শপথ নিয়ে এ পেশায় প্রবেশ করলেও শিক্ষকদেরকে উপযুক্ত বেতন প্রদানের মাধ্যমে ভালো থাকতে দেয়া হচ্ছে না। এ যেন রাষ্ট্র কর্তৃক অসহায়কে আরও অসহায় করে দেয়ার পায়তাঁরা। সুতরাং প্রাইমারী স্কুল থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সকল শিক্ষকগণের বেতন কাঠামো অন্যান্য পেশাজীবিদের বেতন কাঠামো থেকে আলাদা করে তাদের বেতন বৃদ্ধি করা উচিত। শিক্ষকরা যদি তাদের সকল দুশ্চিন্তা দূরে ঠেলে না দিতে পারেন তবে তাদের থেকে শিক্ষার্থীরা প্রকৃত জ্ঞান আশা করতে পারে না। সকল হতাশার সূতিকাগার হিসেবে আর্থিক অনটন স্বীকার্য!
জাতি গঠনে শিক্ষকের ভূমিকাকে যারা অস্বীকার করবে তাদেরকে বৌদ্ধিক ও যৌক্তিক মানুষ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করার কোন যুক্তি নাই। পৃথিবীতে যে যত মহৎ হোক না কেন, সে কোন না কোন শিক্ষকের অধীনে জ্ঞান অর্জন করেছে। রাষ্ট্রপ্রধান থেকে শুরু করে রাষ্ট্রে প্রতিটি স্তরের সম্মানিত ব্যক্তিবর্গসহ অক্ষরজ্ঞান সম্পন্ন সকল মানুষ কোন এক বা একাধিক শিক্ষকের তত্ত্বাবাধানে তাদের ছাত্রজীবনে জ্ঞান অর্জন করে আজ সম্মানের পদে আসীন হয়েছেন। মানুষের মধ্যে যারা কৃতজ্ঞশ্রেণীর তারা সার্বিকভাবে না হলেও ব্যক্তিগতভাবে কোন না কোন শিক্ষকের কাছে ঋণী এবং বিভিন্ন সভা সেমিনারে তাদের সে অভিব্যক্তিও তুলে ধরেন। তবে তাদের সে বাসনা যদি ব্যক্তিগতভাবে কার্যকরী না হয়ে সার্বিকভাবে কার্যকরী হয় তবে সকল শিক্ষক যেমন উপকৃত হবে তেমনি শিক্ষার্থীদের জন্যও এটা জ্ঞান অর্জনের পথে সহায়ক হবে। একটি রাষ্ট্রের বিচার বিভাগকে স্বাধীন রাখার জন্য যেমনভাবে বিচারকদের স্বাধীনতা এবং সার্বিক নিরাপত্তা দিতে হয় তেমনি একটি জাতিকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলার জন্য শিক্ষকদেরকেও পারিপার্শ্বিকতার সকল ক্ষেত্র থেকে চাপমুক্ত রাখতে হবে। কোন প্রকার রাষ্ট্রীয় চাপ এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে হয়রানি থেকে মুক্ত রেখে শিক্ষকদেরকে গবেষণাধর্মী জ্ঞান চর্চা এবং জ্ঞান বিতরণের সুযোগ নিশ্চিত করে দিতে হবে।
‘শিক্ষক মোরা শিক্ষক/ধরনীর মোরা পরমাত্মীয়/মানুষের মোরা দীক্ষক’। সমাজের অন্যান্য পেশাজীবিদের মত শিক্ষকদের একাংশ বিভিন্ন অনৈতিক কার্যকলাপের সাথে জড়িত হয়েছে। রাজনৈতিক মতাদর্শে নিয়োগ পেয়ে শিক্ষকদের কেউ কেউ শিক্ষক অসুলভ আচরণ করছে। একজন শিক্ষকের সাথে একজন শিক্ষার্থীর সম্পর্ক পিতামাতা সাথে সন্তানের সম্পর্কের মত। কাজেই শিক্ষকরা কোন রাজনৈতিক দলের ঝান্ডাবাহী কিংবা অন্যকোন অবৈধ-অনৈতিক সম্পর্কে জড়িয়ে নিজেকে এবং নিজ সম্প্রদায়কে কলুষিত করতে পারেন না। শিক্ষকরা সমাজ এবং রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে আলোকবর্তিকার মত কাজ করবে। বিশ্বব্যাপী শিক্ষকের জ্ঞানের রশ্মি বিস্তৃত হয়। সেই তারাই যদি অন্ধকার জগতে বিলীন হয়ে যায় তবে জাতিকে সঠিকপথ প্রদর্শন করবে কারা? এজন্য সকল শিক্ষককে আরও সচেতন থাকতে হবে। মহান সম্মানিত একজন শিক্ষক যদি নিজের সম্মান নিজেই বিলীন করে দেন কিংবা আদর্শ বিক্রি করেন তবে সে জন্য সমাজ-রাষ্ট্রকে দায়ী করা যাবে না। সুতরাং শিক্ষক দিবসে কবি কাজী কাদের নেওয়াজের সাথে আমরাও যেন বলতে পারি, ‘আজ হতে চির উন্নত হল শিক্ষাগুরুর শির।’- সেই পরিস্থিতি শিক্ষক, সমাজ ও রাষ্ট্র সমন্বয় করো নিশ্চিত করুক।
রাজু আহমেদ, প্রাবন্ধিক।
Fb.com/rajucolumnist/