অন্যান্য

সর্বজন শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় বীরের বিদায়

বাবলী আকন্দঃ ময়মনসিংহে এক বীরের বিদায়। শেষ বিদায়ে সর্বজন শ্রদ্ধেয় এবং ভালোবাসায় সিক্ত হলেন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য, প্রবীণ রাজনীতিবিদ ও সাবেক ধর্ম মন্ত্রী অধ্যক্ষ মতিউর রহমান। নানা স্তরের নেতৃবৃন্দ ও সাধারণ মানুষের নীরব পদচারণায় অধ্যক্ষ মতিউর রহমান এর নিজ হাতে গড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আলমগীর মনসুর মিন্টু মেমোরিয়াল কলেজ প্রাঙ্গণে স্মরণীয় হয়ে উঠেন আওয়ামী রাজনীতির কিংবদন্তি এই নেতা। দল মত নির্বিশেষে সকলে শেষ বিদায়ে এক পলকের জন্য হলেও তাঁর এ অম্লান মুখটি স্মৃতির পাতায় রেখে দিতে ভীড় জমিয়েছিলেন তাঁর প্রতিষ্ঠান প্রাঙ্গণে। অধ্যক্ষ মতিউর রহমান (৮১) ২৭ আগস্ট রবিবার দিবাগত রাত আনুমানিক পৌনে এগারোটার দিকে ময়মনসিংহ নগরীর নেক্সাস কার্ডিয়াক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। তাঁর এ মৃত্যুর খবরে শোকের ছায়া নেমে আসে ময়মনসিংহবাসীর হৃদয়ে। তাঁর বর্ণাঢ্য কর্মজীবন ও রাজনৈতিক জীবন আবারও সকলের মুখে মুখে ফিরে। সর্বস্তরের মানুষের ফুলেল শ্রদ্ধায় সিক্ত হন লাশবাহী ফ্রিজিং গাড়িতে থাকা ময়মনসিংহের এ বীর।

বর্ষীয়ান এই রাজনীতিবিদের মৃত্যুতে রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গভীর শোক জানিয়েছেন। শোক জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় আওয়ামীলীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতৃবৃন্দ, জেলা-উপজেলা আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গসংগঠনের নেতৃবৃন্দ, বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও পেশাজীবি সংগঠনের নেতৃবৃন্দ। বর্ষিয়ান এই মৃত্যুর মধ্য দিয়ে এই অঞ্চলের কিংবদন্তি এক রাজনীতিকের চির বিদায় হলো।

বাদ আসর জানাজায় পরিলক্ষিত হয় এক অভূতপূর্ব ভালোবাসার শেষ মেলবন্ধনে। নগরীর আঞ্জুমান ঈদগাহ ময়দানে মরহুমের প্রথম জানাজায় লাখো জনতার ঢল নামে। স্থানীয় বাসিন্দা ও নগরবাসীর মতে, এটি ইতিহাসের সবচেয়ে বড় জানাজা এই মাঠে। জানাজায় ঈদগাহ মাঠ পেরিয়ে আশপাশের রাস্তায়ও তিল ধারনের ঠাঁই নেই। হিন্দু ও খ্রীষ্টান সম্প্রদায়ের অসংখ্য মানুষ জানাজা দেখতে উপস্থিত হন।

রোববার সকাল থেকেই অধ্যক্ষ মতিউর রহমান নাটকঘর লেনস্থ নিজ বাসায় অসুস্থ্য হয়ে পড়েন। পরে চিকিৎসকের পরামর্শে অনেকটা সুস্থ্য হয়ে উঠেন। এরপর সন্ধ্যার পর আবারো অস্বস্থি রোধ করলে রাত সাড়ে ১০টার দিকে নেক্সাস কার্ডিয়াক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে লাইফ সাপোর্ট থেকে রাত পৌঁণে ১১টার দিকে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। তাঁর মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে হাজারো নেতাকর্মী, বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক-সাংস্কৃতিক, পেশাজীবী ও সব শ্রেণিপেশার মানুষ হাসপাতালে ভিড় জমান। এসময় এক শোকাবহ পরিবেশের সৃষ্টি হয়।

বর্ষীয়ান এ নেতার মৃত্যুর খবরে হাসপাতালে ছুটে এসেছেন মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সিটি মেয়র ইকরামুল হক টিটু, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এহতেশামুল আলম, সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট মোয়াজ্জেম হোসেন বাবুল, জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ইউসুফ খান পাঠানসহ আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতারা। পরে লাশবাহী ফ্রিজিং গাড়িতে মরদেহ তাঁর নিজ হাতে গড়া ৩৪ বছরের শিক্ষকতা জীবনের প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠান আলমগীর মনসুর (মিন্টু) মেমোরিয়াল কলেজ প্রাঙ্গণে আনা হয়।
বর্ষিয়ান এই রাজনীতিককে একনজর দেখতে সোমবার সকালে মরদেহ আলমগীর মনসুর (মিন্টু) মেমোরিয়াল কলেজ প্রাঙ্গণে হাজারো নেতাকর্মী, ভক্ত ও শ্রেণী-পেশার মানুষ ভীড় জমান। এসময় শ্রদ্ধাঞ্জলী জ্ঞাপন করেন বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক-সাংস্কৃতিক, পেশাজীবী ও সব শ্রেণিপেশার মানুষ। বিকেলে শীববাড়িস্থ দলীয় কার্যালয়ে মরদেহ আনা হলে সেখানে শ্রদ্ধাঞ্জলী প্রদান করেন জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ। এরপর মরদেহ নেয়া হয় আঞ্জুমান ঈদগাহ ময়দানে। সেখানে গার্ড অব অনার শেষে নামাজের জামাজের হাজারো নেতাকর্মী, বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক-সাংস্কৃতিক, পেশাজীবী ও নানা শ্রেণিপেশার মানুষ শরিক হোন। মরহুমের জানাযায় ঐতিহাসিক আঞ্জুমান ঈদগাহ ময়দান কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে চর্তুদিকে রাস্তায়ও উপচে পড়া ভীড়ে পরিনত হয়। এ যেন স্মরণকালের সবচেয়ে বেশি উপস্থিতি বলে নগরবাসী জানায়।

জানাযাপূর্ব বক্তব্য রাখেন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক, সাংগঠনিক সম্পাদক আহম্মদ হোসেন, শফিউল আলম নাদেল, স্বেচ্ছাসেবকলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক আফজালুর রহমান বাবু, সিটি মেয়র ইকরামুল হক টিটু, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এহতেশামুল আলম, সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট মোয়াজ্জেম হোসেন বাবুল ও অধ্যক্ষ মতিউর রহমানের পুত্র মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোহিত উর রহমান শান্ত। এসময় গৃহায়ণ ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী শরীফ আহমেদ এমপি, সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কেএম খালিদ, সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী আশরাফ আলী খসরু, ধর্ম প্রতিমন্ত্রী ফরিদুল হক, এডভোকেট মোসলেম উদ্দিন এমপি, বীর মুক্তিযোদ্ধা নাজিম উদ্দিন আহমেদ এমপি, ফাহমি গোলন্দাজ বাবেল এমপি, আনোয়ারুল আবেদিন খান তুহীন এমপি, কাজিম উদ্দিন ধনু এমপি, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রী নেতা রেমন্ড আরেং, মারুফা আক্তার পপি, ময়মনসিংহ চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাষ্ট্রির সভাপতি আমিনুল হক শামীম, জেলা যুবলীগের আহবায়ক এডভোকেট আজহারুল ইসলামসহ জানাজায় বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের বিভিন্ন জেলা-উপজেলা থেকে শতশত নেতাকর্মী অংশগ্রহন করেন।

এসময় আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, অধ্যক্ষ মতিউর রহমান ছিলেন নির্যাতিত-নিপীড়িত ও কারাবরণকারি নেতা। ১৯৭৫ থেকে ৭৭ সাল পর্যন্ত অসংখ্যবার জেল খেটেছেন। সিনেমা হলে সিরিজ বোমা হামলার ঘটনায়ও জেল খেটেছেন। তাঁর মতো ত্যাগী নেতা ও প্রাণপুরুষ আর জন্ম নেবে না। তিনি বলেন, আজকের এই জানাজাই প্রমান করে, অধ্যক্ষ মতিউর রহমান কতোটা ভালবাসার মানুষ ছিলেন। দলের জন্য ও মানুষের জন্য তাঁর ত্যাগ ও ভালবাসার কারনে জানজায় লাখো মানুষের অংশগ্রহন। পরে মরদেহ মঙ্গলবার নগরীর আকুয়া মড়লবাড়ি এলাকায় দ্বিতীয় জানাযা শেষে পারিবারিক গোরস্থানে মরদেহ দাফন করা হবে বলে জানান তাঁর পরিবার।
শ্রদ্ধাঞ্জলি জ্ঞাপন করেন- জাতীয় সংসদের হুইপ আতিকুর রহমান আতিক, আনোয়ারুল আবেদিন খান তুহিন এমপি, মনিরা সুলতানা মনি এমপি, সিটি মেয়র ও মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ইকরামুল হক টিটু, বিভাগীয় কমিশনার উম্মে সালমা তানজিয়া, ডিআইজি দেবদাস ভট্রাচার্য, জেলা প্রশাসক মোস্তাফিজার রহমান, পুলিশ সুপার মাছুম আহাম্মদ ভূঞাঁ, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এহতেশামুল আলম, সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট মোয়াজ্জেম হোসেন বাবুল, সাবেক সভাপতি এডভোকেট জহিরুল হক খোকা, মহানগর বিএনপির আহবায়ক অধ্যাপক একেএম শফিকুল ইসলাম, ময়মনসিংহ প্রেসক্লাব সাধারণ সম্পাদক অমিত রায়, সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি আতাউল করিম খোকন ও সাধারণ সম্পাদক মীর গোলাম মোস্তফা, রিপোর্টার্স ইউনিটির সভাপতি সাইফুল ইসলাম, কমিউিনিস্ট পার্টির সভাপতি এডভোকেট এমদাদুল হক মিল্লাত, জেলা জাসদের যুগ্ম-সম্পাদক এডভোকেট নজরুল ইসলাম চুন্নুসহ বিভিন্ন সংগঠন ও হাজারো মানুষ মরহুমের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানান।

২৮ আগষ্ট বাদ আসর নগরীর আঞ্জুমান ঈদগাহ ময়দানে প্রথম জানাজা এবং আগামীকাল ২৯ আগষ্ট আকুয়ায় দ্বিতীয় জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হবে।
মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী, এক ছেলে ও তিন মেয়েসহ অসংখ্য গুনগ্রাহী রেখে গেছেন। একমাত্র পুত্র মোহিত উর রহমান শান্ত ময়মনসিংহ মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *